@
@
@
@
@ |
@
আমার বন্ধু জগলুল
আহমেদ চৌধুরী
প্রফেসর আবদুল মান্নান
আমন্ত্রিত হয়ে ২৯ তারিখ রাতে এক সামাজিক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম । উদ্দেশ্য
বাংলাদেশে সফররত কিছু বিদেশী অথিতির সাথে পরিচিত হওয়া । সব শেষে রাতের
খাওয়ার বিশাল আয়োজন । সাধারণতঃ এই ধরণের অনুষ্ঠানে আমার দীর্ঘকালের বন্ধু
সাংবাদিক জগলুল আহমেদ চৌধুরী উপস্থিত থাকে। সে দিন তাকে না দেখে আয়োজকদের
একজনের কাছে জানতে চাইলাম জগলুল আসবে কী না ? উনি জানালেন কোন এক টিভিতে
তার একটি রেকর্ডিং আছে । সময় করে আসতে পারলে আসবেন । শেষতক সেই রাতে জগলুল
আর আসে নি । আসা সম্ভব ছিল না কারণ ততক্ষণে সে এক মর্মান্তিক সড়ক দূর্ঘটনায়
না ফেরার দেশে চলে গেছে । জগলুলের সাথে আমার পরিচয় ১৯৬৭ সন হতে । তখন আমরা
দুজনেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হাজী মুহাম্মদ মহসীন হলের প্রথম ব্যাচের ছাত্র ।
জগলুল রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের আর আমি বাণিজ্যের। তখন হল বা বিশ্ববিদ্যালয়ে
এত ভিড়-ভাট্টা ছিল না । হলের সকলেই সকলকে কম বেশী চিনতো । জগলুলের সাথে
পরিচয়টা একটু গাঢ় । আমার অনেক বন্ধু বান্ধব রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র
। তাদের সাথেই জগলুলের সাথে পরিচয় । জানা মতে পরবর্তী জীবনে সকলে
প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অনেকেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল । বেশ কয়েকজন
শহীদও হয়েছে । বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষে জগলুল সাংবাদিকতা পেশা বেছে নিল ।
শিক্ষকতায় গেলাম আমি । দেখা হতো মাঝে মাঝে । তবে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক
বিষয় নিয়ে তাঁর বিশ্লেষণ ধর্মী লেখা পারতপক্ষে মিস করতাম না । কোন কোন
লেখার বক্তব্যের সাথে এক মত না হলে সে কথা তার সাথে দেখা হলেই বলতাম । যখন
থেকে বেসরকারি টিভি চ্যানেলের টক-শোতে অংশগ্রহণ করা শুরু করেছি তখন তার সাথে
ঘন ঘন দেখা হওয়া শুরু হলো । সামাজিক অনুষ্ঠানতো ছিলই । জগলুলের কথা বলার
একটি পৃথক ষ্টাইল ছিল । সিলেটের মানুষ গলার ভিতর থেকে কথা বলে । জগলুলও তার
ব্যতিক্রম ছিল না । ঠাট্টা করে তাকে তা বললে সে শুধু হাসতো । ২৯ তারিখ
জগলুল যাচ্ছিল কারওয়ান বাজারের এটিএন বাংলা ষ্টুডিওতে শ্যামল দত্ত পরিচালিত
eঅন্য দৃষ্টিf অনুষ্ঠানে । আলোচনার বিষয় ছিল নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে
সদ্য সমাপ্ত সার্ক সম্মেলনে প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি নিয়ে । জগলুল সেই আলোচনায়
আর অংশ নিতে পারেনি । নিজের গাড়ী থাকা সত্ত্বেও ড্রাইভার না আসাতে সে দিন
বাসেই সে রওনা হয়েছিল । আমরা যারা ঢাকা শহরে থাকি তাদের মাঝে মধ্যে এই
ধরণের ব্যবস্থায় চলাফেরা করতে হয় । সম্ভবত ঢাকা হচ্ছে বিশ্বের একমাত্র
রাজধানী যেখানে কার্যকর কোন গণপরিবহন নেই । যেগুলি আছে তাদের কাছে যাত্রীরা
একশত ভাগ জিম্মি । আর এই সব পরিবহণের মালিক আর চালকরা অত্যন্ত ক্ষমতাশীল
কারণ তাদের পিছনে আছে রাজনৈতিক প্রশ্রয় আর ছায়া । তাদের আচার আচরণ দেখে কারো
কারো মনে হতে পারে তারা সরকারের চেয়েও অনেক বেশী ক্ষমতাধর । অনেক চেষ্টা
করেও সিএনজি ত্রিহুইলার বলি আর টেক্সি ক্যাব, কোনটাকে মিটারে চলতে বাধ্য করা
যায় নি । সেনা বাহিনীর পরিচালনায় একটি ট্যাক্সি ক্যাব সার্ভিস চালু হয়েছিল
। সেই সার্ভিস ব্যর্থ হতে বাধ্য কারণ ট্যাক্সি ক্যাব পরিচালনা করা সেনা
বাহিনীর কাজ নয় এবং এই ট্যাক্সি ক্যাবে চড়তে হলে যে ভাবে পকেট খালি করতে হয়
তা অকল্পনীয় । ইদানিং আবার সেনা বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনেও মনোযোগী
হয়েছে । এই বিষয়ে পরে আলোচনা করার ইচ্ছা রইলো ।
জগলুলকে রাত সাড়ে আটটার দিকে কারওয়ান বাজারের সার্ক ফোয়ারার মোড়ে বাস থেকে
নামিয়ে দেয় এবং সম্ভবত সে সম্পূর্ণ নামার আগেই বাসটি আবার চলতে শুরু করে
যার ফলে জগলুল পড়ে গিয়ে গুরুতর আহত হয়ে রাস্তায় পরে থাকে । ইমরুল কায়েস
একজন শিক্ষিত বেকার যুবক । কাজ খুঁজছে এই প্রাণহীন ঢাকা শহরে । একজন গুরুতর
আহত মানুষ রাস্তায় পরে থাকতে দেখে চেষ্টা করেন চলমান কোন একটা গাড়ী থামিয়ে
কাছের কোন এক হাসপতালে নিয়ে যেতে । কারো কোন সময় নেই । কেউ কেউ আবার ভয়েও
থামে না । একবার আমার এক পরিচিত জন এই রকম একজন আহত রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে
গিয়েছিল তার গাড়ীতে । রোগী সেখানে মারা যায় । পরে পুলিশ উদ্ধারকারীকেই নিয়ে
টানাটানি শুরু করেন । শেষ মেষ ইমরুল গুরুতর আহত জগলুলকে রিক্সায় করে
পার্শ্বের মোহনা নামক একটি হাসপাতালে নিয়ে গেলে দেখে সেখানে কোন চিকিৎসা
ব্যবস্থা নেই । পরে তাকে অন্য আর একটি হাসপাতালে স্থানান্তর করলে কর্তব্যরত
ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন । সময় মতো চিকিৎসা পেলে হয়তো জগলুলকে বাঁচানো
যেত ।
বন্ধু জগলুলের মৃত্যু অনেক চলমান প্রশ্নকে আবার সামনে নিয়ে এসেছে । ঢাকা
শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ে দেশেতো বটেই বিদেশেও প্রচুর লেখালেখি হয়েছে ।
ঢাকায় যত সংখ্যক বিভিন্ন প্রকারের যানবাহন আছে সেই তুলনায় আমাদের সড়কের
সংখ্যা নিতান্তই অপ্রতুল । নিত্য দিনের এই ট্রাফিক জামের ঘটনা সামাল দিতে
এই শহরের ট্রাফিক পুলিশ যে পরিশ্রম করেন তা বিদেশের অন্য কোন শহরে দেখা যায়
না, এমন কী পার্শ্বের শহর কোলকাতায়ও না । এই শহরে যে বেপরোয়া ভাবে ট্রাক,
বাস অথবা লেগুনা নামক ছোট হিউম্যান হলার চলে তা এক কথায় নজির বিহীন । সাথে
আছে ধীর গতি সম্পন্ন আনাড়ি হাতে চালিত রিক্সা আর বেয়ারা ত্রিহুইলার সিএনজি
। প্রাইভেট কারওয়ালারা অনেকটা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকে কারণ গাড়ী নিজস্ব এবং
তারা কিছুটা হলেও দায়িত্বশীল । গাড়ী চালানো অবস্থায় মোবাইল ফোনে কথা বলা
আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ কিন্তু তা কfজন গাড়ীর চালক মানেন? বাস আর হিউম্যান
হলারের ওভার টেকিং দেখলে যাত্রীদের দোয়া দরুদ পড়া ছাড়া উপায় থাকে না । ঢাকা
শহরে যে সব ড্রাইভার হিউম্যান হলার চালায় তাদের কfজনের লাইসেন্স পাওয়ার বয়স
হয়েছে ? জগলুলকে যে বাস চলন্ত অবস্থায় নামিয়ে দিল সেটিকে সনাক্ত করা যায় নি
। সে যখন গাড়ী নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল তখন অন্য যাত্রীরা তাকে কেন বাঁধা দিলেন
না ? কfদিন পুলিশ পথচারীদের ফুটওভার ব্রীজ অথবা আন্ডার পাস ব্যবহার করতে
বাধ্য করলো । কিন্তু ঢাকা শহরে কfটি ফুট ওভার ব্রীজ অথবা আন্ডার পাস আছে?
সাত মসজিদ রোডের শংকরে একটি ফুট ওভার ব্রীজের অর্ধেক কাঠামো হয়ে পড়ে আছে গত
তিন বছর । এই স্থান দিয়ে প্রতিদিন রায়ের বাজার হতে লক্ষাধিক মানুষ জীবন বাজি
রেখে এপার ওপার করেন । বিশ্বের সকল দেশেই রাস্তা পারাপারের জন্য জেব্রা
ক্রসিং আছে । সেই ক্রসিং দিয়ে পথচারী পারাপারের সময় গাড়ীর চাকা একটি দাগে
লাগলেই মোটা অংকের দন্ড গুণতে হয় । ঢাকার কোন ফুটপাত হকার মুক্ত নয় ।
অনেকের সাথে কথা বলে দেখেছি তারা এই সব ফুটপাত দখল করার জন্য পুলিশ আর
পাড়ার মাস্তানদের নিয়মিত বখরা দিয়ে থাকেন । কোলকাতায় আর কুয়ালালামপুরে
দেখেছি দিনের একটি সময়, বিশেষ করে অফিস আর স্কুলের সময় কোন কোন ব্যস্ত
রাস্তাকে এক মুখী করে দিতে । বাঁয়ে মোড় বন্ধ । সেই পরীক্ষা ঢাকায় করা সম্ভব
কী না জানি না । এই যে বাস বা হিউম্যান হলারগুলি একে অন্যের সাথে পাল্লা
দিয়ে চলে তার প্রধান কারণ হচ্ছে যে যত বেশী ট্রিপ মারতে পারে তার তত লাভ ।
ট্রিপের সংখ্যা একটি নির্দিষ্ট সংখ্যায় নামিয়ে আনা যাবে না কেন ? যত্রতত্র
যাত্রী নামানো উঠানো কোন সভ্য দেশে নেই । এই প্রাণঘাতী ব্যবস্থা বন্ধ করতে
ট্রাফিক পুলিশের তেমন কোন বেগ পাওয়ার কথা নয় । তবে অনেক সময় ট্রাফিক পুলিশ
চাইলেই সব কিছু পারা যায় না কারণ মালিক চালকদের পিছনে থাকে কোন মন্ত্রী বা
রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের আশ্রয় । চট্টগ্রামে বেটারি চালিত রিক্সা বন্ধ করতে
গিয়ে পুলিশ সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে । ওই শহরে এই রিক্সাওয়ালাদেও হাতে পুলিশ
জিম্মী ।
এবার আসি হাসপাতালে চিকিৎসার কথায় । জগলুলকে যে eমোহনাf হাসপাতালে প্রথম
নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তা ছিল একটি ভুয়া হাসপাতাল । ঢাকা শহরে এমন ভুয়া
হাসপাতাল অসংখ্য আছে । এই সব হাসপাতাল কেমন করে পরিচালিত হয় ? সব দেশেই
হাসপাতাল মানেই সেখানে জরুরী চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকতে হয় । থাকতে হয়
সার্বক্ষণিক চিকিৎসক । বাংলাদেশে এমন ব্যবস্থা দীর্ঘ ৪৩ বছরেও গড়ে উঠলো না
। এটিতো আমাদের বড় ব্যর্থতা । আর বেশীর ভাগ হাসপাতাল ও চিকিৎসকরা এখন আর
জনগণকে সেবা দেন না, তাদের পকেট কাটেন । ব্যতিক্রম যে অল্প সংখ্যক আছেন
তাদেরকে সতীর্থরা বাঁকা চোখে দেখেন । এক জগলুলের মৃত্যুর পর আরো গোটা দশেক
মানুষ বেয়াড়া ড্রাইভারদের বেপরোয়া গাড়ী চালানোর স্বীকার হয়ে প্রাণ
হারিয়েছেন । কিন্তু কোন ড্রাইভারের কখনো কোন বিচার হবে না । কারণ আইন অতদূর
পৌঁছায় না । মালিক ড্রাইভারদের হাত আইনের চেয়েও অনেক লম্বা ।
লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় । ডিসেম্বর ৫, ২০১৪
@
@
WARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
@
[প্রথমপাতা] |
@
@
@
লেখকের আগের লেখাঃ
[......লেখক আর্কাইভ]
|