[প্রথমপাতা]
|
জেল হত্যাকান্ড-আওয়ামী লীগ ধ্বংসের চলমান প্রক্রিয়া
প্রফেসর আবদুল মান্নান
বিংশ শতকে যে’কটি রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে তার মধ্যে
আছে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, উত্তর উপনিবেশ পর্বে মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ
পূর্ব এশিয়ায় বেশ কিছু নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম, ভিয়েতনাম যুদ্ধ এবং
সেই যুদ্ধে আমেরিকার শোচনীয় পরাজয় এবং দুই ভিয়েতনামের একত্রিকরণ, বার্লিন
দূর্গের পতন শেষে দ্বিখন্ডিত জার্মানির একত্রিকরণ আর বিশ্বের অন্যতম
পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গন । তবে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে এই
শতকে আর একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ।
বিশ্লেষকদের কাছে এই কারণেই বাংলাদেশের অভ্যুদয় তাৎপর্যপূর্ণ কারণ ১৯৪৬
সনের নির্বাচনে, যেটিকে বলা হয় পাকিস্তানের পক্ষে একধরণের গণভোট, অর্থাৎ যে
প্রদেশে মুসলীম লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী হবে ধরে নেয়া হবে সেই প্রদেশ
পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত হতে আগ্রহী । নির্বাচন পরবর্তীকালে দেখা গেল
একমাত্র অবিভক্ত বাংলা ছাড়া অন্য আর কোন প্রদেশে মুসলীম লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ
আসনে জয়ী হতে পারে নি, এমন কী বর্তমানে যে চারটি প্রদেশ নিয়ে পাকিস্তান
গঠিত সেই চারটি প্রদেশও পাকিস্তানের পক্ষে ভোট পড়ে নি । যে প্রদেশটি
পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দিয়েছিল সেই বাংলাকে ভারত বিভাগের সময় জিন্নাহ্
ষড়যন্ত্রের ফলে দ্বিখন্ডিত হতে হয়েছিল । জিন্নাহ আর তাঁর রাজনৈতিক সহযোগীরা
ঠিকই বুঝেছিলেন অবিভক্ত বাংলা দ্রুততম সময়ে পাকিস্তানের অন্যান্য
প্রদেশগুলির চেয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে কারণ সেই সময় অবিভক্ত বাংলা
ভারতবর্ষের অপরাপর যে কোন প্রদেশের চেয়ে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে অনেক বেশী
অগ্রসরমান ছিল । বাংলা ভাগ হলো, সৃষ্টি হলো পূর্ব পাকিস্তান মাঝখানে বারশত
মাইল পার হলে দেখা মিলবে পশ্চিম পাকিস্তানের । পূর্ব আর পশ্চিম পাকিস্তান
উভয়ই মিলে এক পাকিস্তান । অদ্ভুত সেই এক দেশ, বিশ্বে যার দ্বিতীয় কোন নজির
নেই । গোড়া হতেই পাকিস্তানের বিশ্বস্ত বন্ধু যুক্তরাষ্ট্র । দ্বিজাতি
তত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্টি হয়েছে বলে পাকিস্তান দাবি করলো সে মুসলীম বিশ্বের
নেতা । তা অনেকাংশে মেনেও নিল মধ্যপ্রাচ্যের অনেক আরব দেশ । জোট নিরপেক্ষ
আন্দোলনের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলে
কৌশলগত কারণে পাকিস্তান হয়ে পরে লাল চীনের বন্ধু । ১৯৬০ সনে চীন ভারত
যুদ্ধের পর চীন পাকিস্তানের আরো কাছে চলে আসে । আর মতাদর্শগত পার্থক্যের
কারণে ততদিনে সমাজতান্ত্রিক চীন আর সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন পরস্পর
পরস্পরের শত্রু হয়ে পড়েছে । এই প্রেক্ষাপটেই ১৯৭১ সনে শুরু হয় বাংলাদেশের
মুক্তিযুদ্ধ যার অন্যতম কারণ ততদিনে বাঙালিরা বুঝতে পেরেছেন যদিও তাদের
শক্তিশালী সমর্থনেই পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির সৃষ্টি হয়েছিল কিন্তু
বাস্তবে বাঙালিদের পশ্চিম পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার কখনো একটি স্বাধীন
দেশের নাগরিক হিসেবে গণ্য করতো না বরং দীর্ঘ তেইশ বছরের শাসনে পূর্ব
পাকিস্তান তথা বাংলাদেশ হয়ে উঠেছিল পুরোদস্তুর পশ্চিম পাকিস্তানের একটি
ঔপনিবেশ ।
১৯৭১ সনে স্বাধীনতার জন্য বাঙালির যুদ্ধ ছিল পাকিস্তানের বন্ধুরাষ্ট্রগুলির
কাছে এক চরম গর্হিত কাজ, অনেকটা অমার্জনীয় অপরাধ । সেই কাজটি মুক্তিপাগল
বাঙালিরা করতে পেরেছিল কারণ তাদের রক্তে ছিল খাঁটি দেশপ্রেম আর নেতৃত্বে
ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মতো একজন কালজয়ী নেতা । আর সেই কালজয়ী নেতার
সাথে ছিলেন একঝাঁক সহকর্মী যাদের ছিল অদম্য সাহস আর দৃষ্টিতে ছিল
বাংলাদেশের স্বাধীনতা । ১৯৭১ এর ২৫ মার্চের কাল রাত্রিতে যখন পাকিস্তান
সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় তখন তিনি তাঁর নিদের্শিত
অসমাপ্ত কাজকে সমাপ্ত করার দায়িত্ব দিয়ে যান তাঁর সেই সহকর্মীদের যাঁদের
মধ্যে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী,
কামরুজ্জামান আর খোন্দকার মোশতাক আহমদ সহ অনেকে । পরবর্তীকালে এই খোন্দকার
মোশতাক আহমদ কিন্তু তার অবস্থানে অবিচল থাকতে পারেন নি । তিনি শুধু নিজ
দেশের সাথেই বিশ্বাসঘাতকতা করেন নি একই সাথে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যায় জড়িত হয়ে নিজের হাতকে জাতির জনকের রক্তে
রঞ্জিত করেছেন । বাংলার ইতিহাসে মীর জাফরের পর তিনি দ্বিতীয় বিশ্বাসঘাতক
হিসেবে নিজের নাম স্থায়ী করে নিয়েছেন ।
বঙ্গবন্ধু যাদের হাতে নিহত হয়েছিলেন তাদের সকলেই তাঁর আস্থাভাজন ছিলেন ।
সদ্য প্রয়াত বিশ্ববরেণ্য সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট বঙ্গবন্ধুর কাছে এক
সাক্ষাৎকারে জানতে চেয়েছিলেন ‘মিঃ প্রেসিডেন্ট, আপনার সব চেয়ে বড় শক্তি
কী?’ জবাবে বঙ্গবন্ধু ফ্রস্টকে বলেছিলেন ‘আমি আমার জনগণকে ভালবাসি ।’
পাল্টা প্রশ্ন ‘আপনার দুর্বলতা কী ?’ আমি তাদের খুব বেশী ভালবাসি ।’ জনগণের
প্রতি এই অন্ধ ভালবাসাই বঙ্গবন্ধুর জন্য পরবর্তীকালে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল
যার প্রমাণ তিনি নিজের জীবন দিয়ে প্রমান করেছেন । বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে দেশে
এবং দেশের বাইরে যে একটি বড় ধরণের ষড়যন্ত্র হচ্ছিল তা অনেকেই টের পেয়েছিলেন
। সোভিয়েত ইউনিয়নের গোয়েন্দা সংস্থা ‘কেজিবি’ আর ভারতের ‘র’ এই ব্যাপারে
তাঁকে সতর্কও করেছিল । কিন্তু বঙ্গবন্ধু কখনো বিশ্বাস করতে পারেন নি তাঁকে
কোন বাঙালি হত্যা করতে পারে । তারপরও তিনি তাঁর একাধিক ঘনিষ্টজনকে বলেছেন
‘হয়তো এটাই তোমার সাথে আমার শেষ দেখা ।’ কেন তিনি এই ধরনের কথা বলতেন তা
এখনো রহস্যাবৃত । যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত সাংবাদিক ক্রিস্টোফার হিচেন্স
তার বহুল আলোচিত গ্রন্থ The Trial of Henry Kissinger এর Bangladesh: One
Genocide, one coup and one assassination Aby অনুচ্ছেদে লিখেছেন
বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে খোন্দকার মোশতাক-ফারুক-রশিদ গং যে একটি ষড়যন্ত্র
করছিলেন তা তিনি ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালিন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ইউজিন বোস্টারের
মাধ্যমে জানতে পেরেছিলেন । এই মোশতাকই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে কুমিল্লা
হতে নির্বাচিত সংসদ সদস্য জহুরুল কাইউমের মাধ্যমে কোলকাতায় নিযুক্ত
যুক্তরাষ্ট্রের কন্সাল জেনারেলের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন ।
উদ্দেশ্য ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের সম্মতি পেলে তিনি বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ বন্ধ
করার চেষ্টা করবেন । বলে রাখা ভাল সে সময় মোশতাক মুজিব নগর সরকারের
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছিলেন । হেনরি কিসিঞ্জার তার
আত্মজীবনীমূলক My White House Years গ্রন্থে তা স্বীকার করেছেন । সে সময়
মোশতাকের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে কোলকাতায় নিযুক্ত মার্কিন কন্সাল
অফিসের রাজনৈতিক কর্মকর্তা জর্জ গ্রিফিন যোগাযোগ রক্ষা করতেন । তাদের এই সব
কর্মকান্ড ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার কাছে ফাঁস হয়ে গেলে গ্রিফিনকে ভারত
সরকার সে দেশে অবাঞ্চিত ঘোষণা করে । অক্টোবর মাসে মোশতাককে মুজিব নগর সরকার
নজরবন্দি করে রাখে । পরিতাপের বিষয় হচ্ছে এই সব তথ্য যুদ্ধকালীন সরকারের
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ কখনো বঙ্গবন্ধুকে জানানোর সুযোগ পাননি কারণ
দেশে ফেরার পর বঙ্গবন্ধুকে কিছু চাটুকার চারিদিক হতে ঘিরে ফেলে । এর খেসারত
তাঁকে নিজের জীবন দিয়ে দিতে হয়েছে । চাটুকার আর মোসাহেবদের চেয়ে বড় শত্রু
আর কেউ হতে পারে না । এখানে আরো উল্লেখ্য বঙ্গবন্ধু হত্যার সাথে যে ক’জন
বাঙালি সেনা অফিসার জড়িত ছিল তারা সকলে মুক্তিযুদ্ধের শেষ সময়ে পাকিস্তান
হতে এসে মুজিবনগর সরকারের সাথে যোগ দিয়েছিলেন । এখন এটি অনেকাংশে পরিস্কার
যে তারা আসলে সহজে পাকিস্তান হতে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আসতে পেরেছিলেন কারণ
তাদেরকে পাঠানো হয়েছিল পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই’র ব্রীফ দিয়ে
মুক্তিযুদ্ধকে সাবোটাজ করার জন্য । তবে তাদের কাউকেই সরকার ফ্রন্টে গিয়ে
যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সুযোগ দেয় নি । পনেরই আগষ্টের পূর্বে এই ঘাতকরা একজন
সিনিয়র অফিসারের সাথে তাদের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করেছিলেন । তিনি ছিলেন
সেনা বাহিনীর তৎকালিন উপপ্রধান জেনারেল জিয়া যাঁকে বঙ্গবন্ধু নিজের পুত্রবত
স্নেহ করতেন । ঘাতক দলের অন্যতম সদস্য কর্ণেল (অবঃ) রশিদ নিজে এক
সাক্ষাৎকারে তা সাংবাদিক এন্থনি ম্যাসকেরানহাসের কাছে স্বীকার করেছেন ।
একজন দায়িত্বশীল অফিসার হিসেবে জিয়ার উচিত ছিল তা সেনা প্রধান বা সামরিক
গোয়েন্দা সংস্থাকে অবহিত করা । তাতো তিনি করেনই নাই বরং ঘাতকদের তিনি
অনেকটা উৎসাহিত করেছিলেন ।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারি
রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব শূন্য করে বাংলাদেশকে পুনরায়
পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া । বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরে পনেরই
আগষ্ট সকালে রেডিও মারফত দেশের মানুষ প্রথমে জানতে পারে যে বাংলাদেশের নাম
পরিবর্তন করে ইসলামিক প্রজাতন্ত্র করা হয়েছে এবং খোন্দকার মোশতাক এই
প্রজাতন্ত্রের নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন । যে দেশটি এই
তথাকথিত ইসলামিক প্রজাতন্ত্রকে স্বীকৃতি দেয় সেটি হচ্ছে পাকিস্তান । তারা
বুঝতে পারে তাদের এবং তাদের মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের সম্মিলিত পরিকল্পনা
বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে । তাদের মতে মুজিব ইতিহাস ও তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে
অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানকে দ্বিখন্ডিত করে যে ‘পাপ’ করেছিলেন তিনি তার মূল্য
দিয়েছেন এবং আগামীতে আরো মূল্য দিতে হবে । এরপরই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশকে
যুক্তরাষ্ট্রের আর এক তাবেদার রাষ্ট্র সৌদি আরব ১৬ আগষ্ট স্বীকৃতি দেয় ।
বর্তমানে গোপন মার্কিন দলিলপত্র উন্মুক্ত করার ফলশ্রুতিতে অনেক অজানা
কাহিনী জনগণের সামনে উন্মোচিত হয়েছে । হেনরি কিসিঞ্জার তার সহকর্মী
হ্যারল্ড স্যান্ডার্সকে টেলিফোনে আলাপচ্ছলে বলেছিলেন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক
মোশতাক সরকারকে স্বীকৃতি দিতে পেরে নিজেকে তিনি ধন্য মনে করেছিলেন । ৩রা
নভেম্বরের জেল হত্যার পর ফারুক রহমান গংরা ব্যাংককে পালিয়ে গেলে সেখানকার
মার্কিন দূতাবাস তাদের সর্বাত্মক সহায়তা করে ।
মোশতাক ঠিকই জানতেন একজন মুজিবকে হত্যা মানে বাংলাদেশকে হত্যা নয় কারণ
আওয়ামী লীগের জন্মলগ্ন হতে শুরু করে দুই যুগে মুজিবের পাশাপাশি আরো একাধিক
নেতৃত্ব সৃষ্টি হয়েছে যাঁরা মুজিবের অবর্তমানে তাঁর আরাধ্য কর্মসূচীকে
সামনের দিকে নিয়ে যেতে পারবেন । বঙ্গবন্ধুর এই আস্থাভাজন সৈনিকরাই তাঁর
অবর্তমানে একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে দেশকে স্বাধীন
করেছিলেন । এদের মধ্যে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, তাজউদ্দিন
আহমেদ, কামরুজ্জামান, আবদুস সামাদ আজাদ, জিল্লুর রহমান, তোফায়েল আহমদ,
আবদুর রাজ্জাক প্রমূখরা অন্যতম । ২৩ আগষ্ট বঙ্গবন্ধুর আদর্শে দীক্ষিত
সৈনিকদের মোশতাকের নির্দেশে গ্রেফতার করা হয় । পরদিন মোশতাকের আর এক
আস্থাভাজন জেনারেল জিয়াকে সেনা প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় । মোশতাক তার
পূর্ব পরিকল্পিত ছক অনুযায়ী খুব দ্রুত তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মনোযোগী
হয়েছিলেন ।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট হতে ৩রা নভেম্বর পর্যন্ত ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের এক
ক্রান্তিকাল যে সময়ে সৃষ্টি হয়েছিল এদেশের ইতিহাসের এক ভয়াবহ কালো অধ্যায় ।
যদিও জেনারেল জিয়াকে মোশতাক সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন বাস্তবে তখন
সেনা বাহিনীর সম্পূর্ণ চেন অব কমান্ড ভেঙ্গে পড়েছিল । ঘাতক ফারুক রশিদ গং
এই পুরো সময়টা জুড়ে বঙ্গভবনে অবস্থান করছিল এবং মোশতাককে তাদের কথা মতো
চলতে বাধ্য করছিল । সেনাবাহিনীতে চেন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনতে জেনারেল খালেদ
মোশাররফ সহ আরো কয়েকজন সিনিয়র সেনা কর্মকর্তা চেষ্টা করেন । ফারুক রশিদ গং
উপলব্দি করেন পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যেতে পারে এবং সময়
থাকতে তারা যদি দেশ ত্যাগ না করে তা হলে বিপদ অনিবার্য । তারা সিদ্ধান্ত
নেন তাদের যাই ঘটুক তাদের অতি দ্রুত আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে চিরতরে
শেষ করে দিতে হবে । তা হলে একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ আর কখনো
মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না । তাদের আক্রোশটা যত না ব্যক্তি বিশেষের উপর
তার চেয়ে বেশী ছিল দল হিসেবে আওয়ামী লীগের উপর কারণ এই দলটির কারণে তাদের
সাধের পাকিস্তান ভেঙ্গে গেছে । তাদের এই সকল কর্মকান্ডের আগে ও পরে যে’কটি
দেশ প্রকাশ্যে সমর্থন যুগিয়েছিল তাদের মধ্যে পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি
আরব, লিবিয়া অন্যতম । ফারুক রশিদ গং এবং তাদের নির্বাচিত ঘাতকরা সিদ্ধান্ত
নেয় দেশ ত্যাগের পূর্বে তারা কারাবন্দী আওয়ামী লীগের কয়েকজন কেন্দ্রীয়
নেতাকে হত্যা করে যাবে । জেলে কোন বন্দীকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায় ও
নির্দেশে হত্যার ঘটনা বিশ্বের ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা । ৩রা নভেম্বর
ঘাতকরা সশস্ত্র অবস্থায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে উপস্থিত হয়ে কারাপ্রধানকে
তাদের জেলের ভিতরে প্রবেশের সুযোগ দিতে হুকুম দিলে কারাপ্রধান তাদের জানিয়ে
দেন এই ভাবে সশস্ত্র অবস্থায় কোন ব্যক্তিকে কারাগারে প্রবেশ করতে দেয়ার
রেওয়াজ নেই । ঘাতকদের একজন কারাপ্রধানের টেলিফোন হতে কোন একজনকে (ধারণা করা
হয় খোন্দকার মোশতাককে) ফোন করে এবং রিসিভার কারাপ্রধানকে দেন । অন্য
প্রান্ত হতে তাকে নির্দেশ দেয়া হয় তিনি যেন আগত সেনা সদস্যরা যা করতে চায়
তা করতে দেন । অগত্যা তিনি কারা ফটক খুলে দেন এবং এরপর ঘাতকরা কারাগারে
ঢুকে চার জাতীয় নেতাকে নির্মম ভাবে হত্যা করে এবং সেই রাতেই বাংলাদেশ ত্যাগ
করে ব্যাংকক পাড়ি দেয় ।
১৯৭৫ সনে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার একটি
উদ্যোগ শুরু হয়েছিল । এর আগে পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইউব খান আর ইয়াহিয়া
খানও তা চেষ্টা করেছিলেন । সফল হন নি কারণ যে দলটির শিকড় বাংলার প্রত্যন্ত
অঞ্চলে প্রোথিত সেই দলকে নিশ্চিহ্ন করা সহজ নয় । সর্বশেষ চেষ্টাটি করা
হয়েছিল ২০০৪ সালের ২১ আগষ্ট বঙ্গবন্ধু এভেন্যুতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে
গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে । উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যা
করা । সেই হামলায় আওয়ামী লীগের ২৩জন নেতা কর্মী নিহত হয়েছিলেন । ভাগ্যচক্রে
গুরুতর আহত হয়ে বেঁচে যান শেখ হাসিনা । চিরতর পঙ্গু হয়ে যান কয়েকশত নেতা
কর্মী । ৩রা নভেম্বর জেলের অভ্যন্তরে চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করার পর
বিচারপতি আহসান উদ্দীনকে দিয়ে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত
কমিশন গঠন করা হয়েছিল কিন্তু সেই তদন্ত কমিশন কখনো কার্যকর হয়নি ।
পরবর্তীকালে জিয়া রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে সেই কমিশন বাতিল করে দেন । জিয়ার
ঘনিষ্ঠ সহচর শমসের মোবিন চৌধুরী ব্যাংককে গিয়ে ঘাতকদের কাছে পাসপোর্ট আর
অর্থ পৌঁছে দেন এবং জিয়া পরবর্তীকালে এদের সকলকে বিভিন্ন কূটনৈতিক মিশনে
উচ্চপর্যায়ের কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা করে দেন । ইতিহাস খুবই নির্মম এবং সে
কাউকে ক্ষমা করে না । পুরো সত্য একদিন নিশ্চয়ই জনসম্মূখে উদঘাটিত হবে । তবে
দুঃখের বিষয় হচ্ছে ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বরের সেই ভয়াবহ জেল হত্যার বিচারের
বাণী এখনো নিভৃতে নয় প্রকাশ্যে কাঁদছে । ৩রা নভেম্বরে নিহত চার জাতীয় নেতার
প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ।
লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় । নভেম্বর ১, ২০১৩
WARNING:
Any unauthorized use
or reproduction of
'Community' content is
strictly prohibited
and constitutes
copyright infringement
liable to legal
action.
[প্রথমপাতা] |
লেখকের আগের লেখাঃ
[......লেখক আর্কাইভ]
|