[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধে আপনি কোথায় থাকবেন?

 

 

প্রফেসর আবদুল মান্নান


গত ২০ নভেম্বর নবম জাতীয় সংসদের ১৯তম অধিবেশন শেষ হলো । ধারণা করা হচ্ছে আগামী সংসদ নির্বাচনের পর দশম সংসদ গঠিত হলে পরবর্তী সংসদ অধিবেশন হিসেবে ওই নতুন সংসদের প্রথম অধিবেশন বসার আগে বর্তমান সংসদ আর বসছে না । তবে সংবিধান অনুযায়ী দেশে কোন জরুরী বা যুদ্ধাবস্থা দেখা দিলে বর্তমান সংসদের অধিবেশন ডাকতে কোন বাধা নেই । এমন ঘোষণা প্রধানমন্ত্রী সংসদেও দিয়েছেন । সামনের নির্বাচনে যে সকল ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বা সুশীল সমাজের বা সুজন সখী পার্টির সদস্যরা অথবা এক শ্রেণীর মিডিয়া যে কোন উপায়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারকে দেখতে উদগ্রীব তারা গত কয়েক সপ্তাহ হতে বিশেষ করে যে দিন পরবর্তী নির্বাচনের নব্বই দিন কাউন্ট ডাউন শুরু হলো তখন থেকে বলছেন কেন সংসদ অধিবেশন শেষ হয় না অথবা কেন সংসদ ভেঙ্গে দেয়া হয় না । তাদের মতে এই নব্বই দিনের ভিতরে সংসদ অধিবেশন বসা বেআইনী যদিও এমন কোন কথা সংবিধানের কোথাও লেখা নেই । সংবিধানের ১২৩ এর ৩(খ) ধারায় সংসদ নির্বাচনের সময় সম্পর্কে উল্লেখ করা আছে ’মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙ্গিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে‘ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে । নির্বাচন বিধি অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠানের কম পক্ষে ৪৫ দিন আগে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করার রেওয়াজ আছে । তা না হয়ে সময় মতো নির্বাচনী কার্যক্রম শেষ করা কঠিন হয়ে পরে। সব কিছু ঠিক থাকলে এই সপ্তাহের কোন একদিন নির্বাচন কমিশন নির্বাচন অনুষ্ঠানের তারিখ ঘোষণা করবেন বলে আশা করা যাচ্ছে। অবশ্য এরই মধ্যে জামায়াত-বিএনপি জোট ঘোষণা করেছে যেদিন তফসিল ঘোষণা করা হবে সেদিনই তারা তাদের ভাড়াটে সন্ত্রাসীদের জান মাল ক্ষতি ও পেট্রোল আর গানপাউডার দিয়ে মানুষ হত্যা করার জন্য মাঠে নামিয়ে দেবে । তারা দেশকে অচল করে দেবে । এই ব্যাপারে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা সাহেব গত শুক্রবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রকাশ্যে হুমকি দিয়েছেন এবং ছাত্রদলের সদস্যদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দিতে গিয়ে বলেছেন এবার হতে তাদের হরতালের দিন শুধু মাত্র দুই একটা গাড়ী জ্বালালেই হবে না হাজারে হাজারে মাঠে নেমে আসতে হবে এবং প্রয়োজনে নগর লোকালয় পুড়ে ছাড়খার করে দিতে হবে । কী সর্বনাশা কথা । প্রতি রাতে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে তথাকথিত সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা দেশের মানুষকে নানা বিষয়ে জ্ঞান দান করেন এবং ভিন্ন মতাবলম্বী রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তিকে নসিহত করেন । জামায়াত বিএনপি’র কোন মধ্য মাপের নেতাকেও সুনির্দিষ্ট অভিযোগে পুলিশ আটক করলে বলেন সরকার এটি উদ্দেশ্যমূলকভাবে করেছে এবং এই সকল আটকের কারণে যদি শহরে দু’চার দশটি গাড়ীতে অগ্নিসংযোগ অথবা ভাঙচুর করা হয় তা হলে তাকে যায়েজ করার আপ্রাণ চেষ্টা করেন । নিজের গাড়ীতে আগুন দিলে কী বলতেন তা জানার খুব ইচ্ছা হচ্ছে । কিন্তু এই ব্যক্তিরা মির্জা ফখরুলের এহেন চরম উস্কানিমূলক বক্তব্য নিয়ে টুঁশব্দটি করতে দেখা গেল না । দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে একটি সংসদ যে সময়কালের জন্য নির্বাচিত হয় (বাংলাদেশে বা ভারতে পাঁচ বছর) সেই সংসদ তার পূর্ণ মেয়াদ শেষ করবে যদি না অন্য কোন কারণে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙ্গে দেয় সংবিধানের [১২৩ (৩)(খ) ধারা ] । তা যদি হয় তা হলে সংসদের মেয়াদ তখনই শেষ হয়ে যাবে ।
নবম জাতীয় সংসদ নানা কারণে স্মরণীয় হয়ে থাকবে । এর কার্যদিবস ছিল রেকর্ড পরিমাণ, মোট ৪১৮ দিন । এরশাদ পতনের পর বেগম জিয়ার অধীনে প্রথম সংসদের (১৯৯১-৯৫) কার্য দিবস ছিল ৪০০ দিন । শেখ হাসিনার অধীনে প্রথম সংসদের (১৯৯৬-২০০১) কার্য দিবস ৩৮২ দিন । পরের সংসদ ৩৭৩ দিন । এই তিনটি সংসদের মেয়াদ শেষে একমাত্র শেখ হাসিনাই শান্তিপূর্ণভাবে পরবর্তী সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিলেন । তবে এই নবম সংসদে সংসদ বর্জনের রেকর্ড করেছে বিএনপি তথা বিরোধী দল । ৪১৮ দিনের মধ্যে সর্বমোট তারা সংসদ অধিবেশনে ৭৬ কার্য দিবস উপস্থিত ছিলেন যার মধ্যে বিরোধী দলীয় নেত্রী উপস্থিত ছিলেন মাত্র দশ কার্য দিবসে । সংসদ অধিবেশনে অনুপস্থিত থাকলেও তারা কিন্তু সংসদ সদস্য হিসেবে প্রাপ্য সকল প্রকারের সুযোগ সুবিধা নিতে কার্পণ্য করেন নি । এমনকি বিভিন্ন সময় এই পদ ব্যবহার করে সরকারি খরচে বিদেশ ভ্রমনের সুযোগ পেলে তা গ্রহণ করতে দ্বিধা করেন নি । তবে তাদের সংসদে যোগ দেয়ার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সংসদ সদস্য পদ রক্ষা করা । একবার শোনা গিয়েছিল তাদের আন্দোলনের অংশ হিসেবে তারা সংসদ হতে পদত্যাগ করবেন যা তারা করা হতে বিরত ছিলেন পাছে এই সব সুযোগ সুবিধা চলে যায় । ১৯৯৫ সনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিরোধী দল আন্দোলনের কৌশল হিসেবে সংসদ হতে পদত্যাগ করতে দ্বিধা করেন নি । সংসদে অনুপস্থিতির বিষয়টা আলোচনায় এলে সুশীলদের অনেকেই বেশ উচ্চ কণ্ঠে বলেন এর আগে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বিরোধী দলও সংসদ অধিবেশন বর্জন করেছিল । সেটিও সমর্থনযোগ্য ছিল না যদিও সেই বর্জনের একটি সুনির্দিষ্ট কারণ ছিল, মূলত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি, যা এখন দেশের সর্বোচ্চ আদালত অসাংবিধানিক ও অবৈধ ঘোষণা করেছেন । কিন্তু এই মেয়াদে বিরোধী দল যে সব কারণে সংসদ বর্জন করেছে তার মধ্যে আছে বেগম জিয়াকে সেনানিবাসের বাড়ী হতে উচ্চ আদালতের আদেশে উচ্ছেদ, তারেক জিয়ার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের মামলা প্রত্যাহার, সংসদে কথা বলতে না দেয়ার অজুহাত ইত্যাদি । সংসদের প্রতি যে দলটির বিন্দু মাত্র আগ্রহ নেই সে দলই আগামী সংসদ অধিবেশন নিয়ে গত দুই বছর দেশে এক ভয়ঙ্কর আর নজিরবিহীন অশান্তি, সংঘাত আর সন্ত্রাস সৃষ্টি করে জন জীবনে চরম দূর্ভোগ সৃষ্টি করেছে । তারা নাকি এ’সব করছে একটি অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনার জন্য । তাদের দাবি যে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা উচ্চ আদালত বাতিল করে দিয়েছে তা ফিরিয়ে আনতে হবে কিন্তু তা কী ভাবে সম্ভব তা তারা সংসদে গিয়ে বলেন না । বাতিল হওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় সদ্য সাবেক প্রধান বিচারপতি প্রধান উপদেষ্টা পদে অধীষ্ট হবেন । বেগম জিয়া বলেন তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা চাই তবে বিচারপতি খায়রুল হককে মানি না ।
বেগম জিয়া আর তাঁর আশ্রিত দল জামায়াত শিবিরের ও ভাড়াটে সন্ত্রাসীদের কারণে গত দুই বছরের কথা বাদই দিলাম শুধু এই বছর ২৬ অক্টোবর হতে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত দশ দিনের হরতালে দেশ ব্যাপী আহত হয়েছেন প্রায় দুই হাজার এবং নিহত হয়েছেন ২৯ জন আর পৃথকভাবে আগুনে পুড়ে মৃত্যু বরণ করেছেন পাঁচজন আর মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন ৭৬ জন যার মধ্যে ১৩জন শিশু এবং ৩ জন প্রতিবন্ধী । মৃত ও আহতের মধ্যে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যও আছেন । ৪৯০টি গাড়ীতে অগ্নি সংযোগ করা হয়েছে যার অনেকগুলিই মাল বা যাত্রী বোঝাই ছিল । এর আগে বিভিন্ন অজুহাতে রেল ষ্টেশন, রেলের দামি কোচ, রেল সেতু, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, আদালত ভবন, প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় স্থাপনায় অগ্নি সংযোগ করা হয়েছে । হামলা করা হয়েছে সংখ্যা লঘুদের গ্রাম বসত ভিটা আর মন্দিরে । কক্সবাজারের রামু, বাঁশখালী, ফটিকছড়ি, সাঁথিয়া, বরিশালের সংখ্যা লঘু অধ্যুষিত এলাকায় এক ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করা হয়েছে । মূল কথা হচ্ছে যদিও বিএনপি তথা তাদের মিত্র দলগুলি বলছে আন্দোলনের নামে তাদের এই সব সন্ত্রাসের মূল কারণ অসাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন আদায় করা কিন্তু বাস্তবে বর্তমানে বিএনপি চালিত হচ্ছে জামায়াতের অর্থে এবং নির্দেশে এবং তাদের স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে । জামায়াতের কাছে কার অধীনে নির্বাচন হবে তা কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয় । তাদের কাছে এই মুহুর্তে একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যুদ্ধাপরাধের দায়ে তাদের যে সকল কেন্দ্রীয় নেতা মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত হয়েছেন দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে তাদের মুক্ত করা । ইতোমধ্যে তারা বেগম জিয়াকে দিয়ে প্রকাশ্যে বলিয়েছেন তিনি ক্ষমতায় গেলে সকল রাজবন্দীদের (পড়ুন যুদ্ধাপরাধীদের) মুক্ত করে দেবেন এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল ভেঙ্গে দেবেন । তিনি আরো ঘোষণা করেছেন তিনি সেখানে থামবেন না । যারা এই বিচারের দাবি তুলেছেন তিনি তাদেরও বিচার করবেন । মনে রাখা প্রয়োজন শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ১৯৯১ সালে যখন গণআদালত সৃষ্টি করে এবং একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের গণআদালতে প্রতীকী বিচার করা হয় তখন বেগম জিয়া এই আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত ২৪ জনের নামে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দায়ের করেন । এই মামলা মাথায় নিয়ে শহীদ জননীকে মৃত্যু বরণ করতে হয় । শুক্রবারের সমাবেশ হতে জামায়াতের ঢাকা মহনগর আমির শফিকুল ইসলাম মাসুদ ঘোষণা করেছেন কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর হলে ৫৫ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশ জ্বালিয়ে দেয়া হবে । ধৃষ্টতারও একটি সীমা থাকা উচিৎ । ৫৫ হাজার বর্গ মাইলের বাংলাদেশকে পাহাড়া দেয়ার জন্য কী দেশে মানুষের অভাব পরেছে ? সেই সভায় আবার সভাপতিত্ব করেছেন একজন মুক্তিযোদ্ধা, সাদেক হোসেন খোকা । এখন দেশের জনগণকে ঠিক করতে হবে যাদের কারণে দেশে এত অশান্তি, মৃত্যু, যারা সংসদকে চরমভাবে অবজ্ঞা করেন, বিদেশে দেশের ভাবমূর্তির ক্ষতি করেন, নিজ দেশের নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করার সর্বাত্মক চেষ্টা করেন, জঙ্গিবাদ লালন করার অঙ্গিকার করে আগামীতে তাদের কর্মকা-কে সমর্থন করবেন নাকি দেশে যে পথে শান্তি ও সমৃদ্ধি আসবে সে পথে যাবেন । সামনে যে যুদ্ধটা আসছে এটি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের একটি দ্বিতীয় অধ্যায় । দেশের মানুষকে ঠিক করতে হবে তারা এই যুদ্ধে কোথায় থাকবেন । এই যুদ্ধে পরাজিত হলে তখন আবার আমাদের একটি বড় যুদ্ধে ফিরে যেতে হবে ।

লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। নভেম্বর ২৩, ২০১৩

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ

[......লেখক আর্কাইভ]