[প্রথমপাতা]
|
বাংলাদেশ একাত্তর-ইন্দিরা, নিক্সন ও কিসিঞ্জার
প্রফেসর আবদুল মান্নান
১৯৭১ সালের ২৩ নভেম্বর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন
প্রশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান রাওয়ালপিন্ডির নিকটবর্তী ঐতিহাসিক তক্কশীলা
শহরে এক কারখানা উদ্বোধন করতে গিয়ে বলেন ‘আগামী দশদিনের মধ্যে হয়তো আমাকে
যুদ্ধে যেতে হবে।’ বলাবাহুল্য তিনি ভারতের সাথে সম্ভাব্য যুদ্ধের কথা
বলেছিলেন । একই দিন বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন
আহমেদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে দেয়া এক ভাষণে বলেন ‘আমাদের মুক্তি
বাহিনী এখন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যেকোন সময় যে কোন স্থানে শত্রুর ঘাঁটিতে
আঘাত হানতে সক্ষম ।’ একই দিন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ হতে ভারতের
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে লিখিত এক পত্রের মাধ্যমে প্রবাসী সরকারকে
আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিতে অনুরোধ জানানো হয় । ইয়াহিয়া খান বুঝতে পেরেছিলেন
তার সাধের পাকিস্তানের শেষ সময় হয়তো সমাগত । তা বুঝতে পেরে তিনি ২ ডিসেম্বর
নিক্সনের কাছে এক পত্র মারফত পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপাক্ষিক
প্রতিরক্ষা চুক্তির এক নম্বর ধারার কথা মনে করিয়ে দেন যেখানে বলা হয়েছে
প্রয়োজনে উভয় রাষ্ট্র একে অপরকে প্রতিরক্ষা বিষয়ে সহায়তা করবে ।
একাত্তরে মার্কিন সরকার বাংলাদেশের জনগণের কোন বন্ধু ছিল না এবং সে সময়
মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও তার প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হেনরী
কিসিঞ্জার তা কখনো গোপন করেননি । অন্যের গোপন কথায় আড়িপাতা নিক্সনের
অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল এবং এর ফলশ্রুতিতে জন্ম হয়েছিল ওয়াটারগেটের মতো
কেলেঙ্কারি যেখানে তার প্রতিপক্ষ ডেমোক্রেটদের দপ্তরে নিক্সনের নির্দেশে
আড়িপাতা যন্ত্র বসানো হয়েছিল । পরবর্তীকালে এই তথ্য ফাঁস হয়ে গেলে নিক্সনকে
তার পদ হতে ইস্তফা দিতে হয় এবং বেশ অপদস্ত হয়ে তাঁকে হোয়াইট হাউজ ছাড়তে হয়
। মার্কিন রাজনীতিতে এটি ছিল একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় । নিক্সন হোয়াইট হাউজে
তার নিজস্ব দপ্তর ওভাল অফিসেও আড়ি পাতা যন্ত্র বসিয়েছিলেন এবং সেই দপ্তরে
তিনি কারো সাথে কোন বিষয় নিয়ে আলাপ করলে তা টেপে ধারণ করা হতো । বর্তমানে
যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী সে সব টেপের অনেকগুলি জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে
দেয়া হয়েছে । নিক্সনের সেই টেপকে সূত্রধরে এরই মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে একাধিক
প্রবন্ধ ও গ্রন্থ রচিত হয়েছে যার মধ্যে সম্প্রতি প্রকাশিত প্রিন্সটন
বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞানের অধ্যাপক গ্যারী ব্যাস এর গ্রন্থ ‘দি
ব্লাড টেলিগ্রাম’ (The Blood Telegram: Nixon,
Kissinger and a Forgotten Genocide) অন্যতম । এই গ্রন্থে ১৯৭১ সালে
বাংলাদেশে যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার আলবদররা
নির্বিচারে গণহত্যা চালাচ্ছিল তখন নিক্সন ও কিসিঞ্জার তা নিয়ে কী চিন্তা
করছিলেন সে সম্পর্কে একটি বিস্তারিত বিবরণ আছে । গ্রন্থটির শিরোনামে যে
‘ব্লাডের’ কথা উল্লেখ করা হয়েছে তিনি হচ্ছেন একাত্তরে ঢাকায় নিযুক্ত
মার্কিন কন্স্যাল জেনারেল আর্চার ব্লাড । ব্লাড ২৬ মার্চ ও তার পরবর্তীকালে
ঢাকা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত
নির্বিচারে গণহত্যার একজন সাক্ষী । পরবর্তী কয়েকদিনে তিনি দেশের অন্যান্য
অঞ্চল হতেও নিজস্ব সূত্রের মাধ্যমে গণহত্যার তথ্য সংগ্রহ করে সে সম্পর্কে
বিভিন্ন সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের ষ্টেট ডিপার্টমেন্টে তারবার্তা পাঠিয়ে তার
অনুভূতি প্রকাশ করেন এবং এই বিষয়ে মার্কিন সরকারের করণিয় সম্পর্কে পরামর্শ
দেন । এতে নিক্সন এবং কিসিঞ্জার দু’জনই ব্লাডের উপর ক্ষুব্দ হন এবং এক
পর্যায়ে ব্লাডকে একজন বিদ্রোহী হিসেবে আখ্যায়িত করে তাঁকে ওয়াশিংটন ডিসিতে
ফিরিয়ে নিয়ে ষ্টেট ডিপার্টমেন্টের কেরাণির কাজে নিয়োগ দেন । কিন্তু যেহেতু
ব্লাডের তারবার্তা গুলি শুধু উচ্চ পর্যায়ের গোপনীয় হিসেবে পাঠানো হয়নি
সেহেতু ওই তারবার্তাগুলি ষ্টেট ডিপার্টমেন্টের অন্যান্য ষ্টাফরা পড়তে
পারতেন । ব্লাডের তারবার্তা পড়ার পর বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের প্রতি তাদের
অনেকের মাঝে প্রচ- সহানুভূতির সৃষ্টি করে । এ’সময় নিক্সনের কাছে চীনের সাথে
যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক উন্নয়নটা অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ ছিল । চীন ছিল
পাকিস্তানের অকৃত্রিম বন্ধু সে কারণে নিক্সনের ধারণা ছিল বাংলাদেশের মুক্তি
সংগ্রামের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র যদি সহানুভূতি দেখায় তা হলে চীনের সাথে যে
নতুন সম্পর্ক সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে ।
কিসিঞ্জারের সাথে কথোপকথনের এক পর্যায়ে জার্মানিতে হিটলারের ইহুদি নিধনকে
নিক্সন সমর্থন করে বলেন ইয়াহিয়া খানও পূর্ব পাকিস্তানে যা করছে তা ঠিকই
করছে । নিক্সন এমন একজন মানুষের সামনে এই কথা গুলি বলছিলেন যার কমপক্ষে
তেরজন নিকট আত্মীয় নাৎসি বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছিলেন । কিসিঞ্জার একজন
জার্মান বংশোদ্ভুত ইহুদী ছিলেন । তারপরও কিসিঞ্জার নিক্সনের কথার বক্তব্যের
কোন প্রতিবাদ করেন নি । নিক্সন ও কিসিঞ্জার দু’জনই মনে করতেন স্বাধীন
বাংলাদেশ একটি বামপন্থি রাষ্ট্র হবে সুতরাং তাকে দমন করার জন্য ইয়াহিয়া খান
যা করছে তাকে সমর্থন করতে হবে ।
সম্প্রতি পাকিস্তানের জিও টিভি নির্মিত ৬.৪১ মিনিটের একটি ছোট ডকুমেন্ট্রি
হাতে এসেছে যেটি ‘The
Fall of Dhaka-Mistakes from the Past, (Saqoot-e-Dhaka), টাইটেলে
টিভিতে প্রদর্শিত হয়েছে । এই ডকুমেন্ট্রিতে যাদের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে
তাদের মধ্যে আছেন পাকিস্তান বিমান বাহিনীর সাবেক প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল
আসগর খান, অবসর প্রাপ্ত লেঃ জেনারেল আলী কুলি খান, মুসলীম লীগ (নেওয়াজ) এর
শীর্ষ স্থানীয় নেতা জাভেদ হাসমি, পাকিস্তানের সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ডঃ
মুব্বাসির হাসান, বিশিষ্ট গবেষক ও সাংবাদিক হুমায়ূন গওহর, আওয়ামী ন্যাশনাল
পার্টির নেতা হাজি আদেল । এদের মধ্যে আসগর খান বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত বন্ধু
ছিলেন । তিনি ১৯৭১ সালে পূর্ব বঙ্গে চলমান ঘটনা প্রবাহের বিরুদ্ধে সব সময়
সোচ্চার ছিলেন । ২৬ মার্চ রাতে যখন পাকিস্তান সেনা বাহিনী বাংলাদেশে
‘অপারেশন সার্চলাইটের’ অধীনে গণহত্যা শুরু করে তখন জাভেদ হাসমি বাংলাদেশেই
ছিলেন । তিনি স্বচক্ষে সে বিভীষিকাময় সময়ের স্বাক্ষী । তিনি তার
সাক্ষাৎকারে বলেছেন কার্ফু শীতিল হলে তিনি ধ্বংসযজ্ঞ দেখতে বের হতেন এবং
স্তম্বিত হয়ে যেতেন যখন দেখতেন বাঙালিদের পঁচা গলা লাশ কুকুরে খাচ্ছে । এই
কথা বলতে গিয়ে জাভেদ হাসমি বাকরুদ্ধ হয়ে পরেন । অন্যান্যরা আক্ষেপ করে বলেন
পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ কখনো অতীতের ভুল হতে শিক্ষা নেয় না ।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের সেই ভয়াবহ দুঃসময়ে বাংলাদেশের পার্শ্বে যে কয়েকটি
দেশের সরকার আর জনগণ দাঁড়িয়েছিল তার মধ্যে ভারতের ভূমিকা ছিল সর্বাধিক
উল্লেখযোগ্য । যুক্তরাষ্ট্র সরকার ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলি
বাংলাদেশে পাকিস্তানের গণহত্যাকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানায় যদিও ইসলামের নামেই
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশে গণহত্যা চালাচ্ছিল । একমাত্র ব্যতিক্রম
ছিল ইরাক যারা বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে সমর্থন জানিয়েছিল । পাকিস্তান
সেনাবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের হাত হতে বাঁচার জন্য অক্টোবর মাস নাগাদ
প্রায় এক কোটি শরণার্থী ভারতে বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তি রাজ্যগুলিতে আশ্রয়
নিয়েছে । সেই শরণার্থী শিবিরের অবস্থা ছিল ভয়াবহ । এটি ছিল এক চরম মানবিক
ট্র্যাজেডি । তারপরও সেই দেশের মানুষ ও সরকার সাধ্যমতো এই বিশাল
ভাগ্যবিতাড়িত জনগোষ্ঠিকে সহায়তা করার চেষ্টা করেছে । বাংলাদেশ সংকট নিরসনে
ভারতের তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সেই সময়কার রাষ্ট্রনায়কোচিত
ভূমিকা ইতিহাস স্মরণ করবে ।
অক্টোবর মাসের শেষের দিকে ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের পরিস্থিতি আর সেই সংকট
কালে ভারতের ভূমিকা পরিষ্কার করার জন্য ইউরোপ আর যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন ।
সেই সফর কালে তিনি অধিকাংশ ইউরোপীয় সরকারের কাছ হতে তেমন কোন সহানুভূতি লাভ
করেন নি । নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে উপিস্থিত হন এবং ৪
ও ৫ তারিখ নিক্সন আর কিসিঞ্জারের সাথে তাঁর দুটি বৈঠক হয় । নিক্সন ইন্দিরা
গান্ধীকে বেশ ঘৃণাই করতেন এবং তাতে কোন রাখঢাক ছিল না । তিনি ইন্দিরা
গান্ধীকে একজন ডাইনী বলে আখ্যায়িত করতে পছন্দ করতেন। কিসিঞ্জার তাঁর
আত্মজীবনী মূলক গ্রন্থ ‘হোয়াইট হাউজ ইয়ার্সে’ লিখেছেন ইন্দিরা গান্ধীর সাথে
দেখা করার আগে নিক্সন ওভাল অফিসে অনেকটা অগ্নিমূর্তি ধারণ করে পায়চারি
করছিলেন । এদিকে ইন্দিরা গান্ধী ওয়েটিং রুমে প্রায় কুড়ি মিনিট অপেক্ষা করতে
থাকেন যা ছিল এক কথায় শিষ্টাচার বহির্ভূত । কিসিঞ্জার লিখছেন ‘মিসেস গান্ধী
ছিলেন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন একজন মহিলা এবং সব সময় নিজের দেশের
স্বার্থকে সব কিছুর উপর স্থান দিতেন । আমি সব সময় তাঁর সাহসের সম্মান করেছি
যদিও তাঁর অনেক নীতি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে ছিল ।’
কিসিঞ্জারের মতে নভেম্বরের ৪ ও ৫ তারিখে অনুষ্ঠিত এই দুই সরকার প্রধানের
মধ্যে বৈঠক ছিল “আমার দেখা কোন বিদেশী অতিথির সাথে সব চেয়ে দূর্ভাগ্যজনক
এবং অনেকটা অসৌজন্যমূলক আলোচনা। শুরুতে মিসেস গান্ধী ভিয়েতনাম ও চীনে
যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশ নীতির ভূয়সী প্রসংশা করেন । তার বক্তব্য উপস্থাপনের
ধরণ দেখে মনে হচ্ছিল তিনি স্কুলের শ্রেণী কক্ষের পিছনে বসে থাকা কোন এক
নি¤œ মেধার ছাত্রকে পড়া বুঝাচ্ছিলেন । আমি নিক্সনের অনেকটা বিরক্তিকর
চেহারা লক্ষ্য করছিলাম । মিসেস গান্ধী চলে যাওয়ার পর প্রেসিডেন্ট আমার কাছে
তাঁর বিরক্তির কথা গোপন করেন নি । তিনি বলেন ইন্দিরা গান্ধী হচ্ছেন একজন
ঠান্ডা মাথার রাজনীতিবিদ যিনি ক্ষমতার রাজনীতিতে সিদ্ধহস্ত ।”
সম্প্রতি ল-নের কিংস কলেজের গবেষক শ্রীনাথ রাঘভনের প্রকাশিত গ্রন্থ ‘১৯৭১’
নিক্সন-ইন্দিরার পরবর্তি দিন অর্থাৎ ৫ তারিখের বৈঠকের বর্ণনা দিতে গিয়ে
লিখেছেন ‘পর দিন নিক্সন ও কিসিঞ্জার ওভাল অফিসে বসে আগের দিনের বৈঠকের
পর্যালোচনা করেন এবং নিক্সন বলেন ইন্দিরা গান্ধী একজন ডাইনি আর কিসিঞ্জারের
মন্তব্য ছিল ভারতীয়রা ‘এমনিতেই বেজন্মা’ । মিসেস গান্ধীর সাথে অপরাহ্নের
বৈঠকটি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন মেজাজের । সেই বৈঠকে ভারত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন
সম্পূর্ণ শীতল এবং তিনি বৈঠকের কোন পর্যায়ে ভারত উপমহাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে
একটি কথাও বলেন নি । বরং তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশ নীতি ও বিশ্বরাজনীতি
নিয়ে কথা বলে সময় কাটান । কিসিঞ্জার তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন ‘মিসেস গান্ধী
পরদিনের বৈঠকে নিক্সনের সব দূর্বলতা গুলিকে বেশ দক্ষতার সাথে উন্মুক্ত করে
দেন ।’ নিক্সন আর কিসিঞ্জার উভয়ই ইন্দিরা গান্ধীর রাজনৈতিক পরিপক্কতা আর
দূরদর্শিতাকে সঠিক ভাবে মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন । কিসিঞ্জার তার
গ্রন্থে লিখেছেন ‘পরবর্তিকালে নিক্সন অকপটে স্বীকার করেন ইন্দিরা গান্ধী ওই
বৈঠকে তাঁরা দুজনকেই সহজে বোকা বানিয়েছিলেন ।’
ইন্দিরা গান্ধী যখন বিদেশ সফরে ব্যস্ত বাংলাদেশে মুক্তি বাহিনী তখন দেশের
অভ্যন্তরে বিস্তীর্ণ অঞ্চল মুক্ত করে ফেলেছে । তাদের সহায়তা করেছে ভারতীয়
সশস্ত্র বাহিনী । নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে বাংলাদেশে পাকিস্তানের
পূর্বাঞ্চলীয় সেনাপতি জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী উত্তর বঙ্গের বেশ
কয়েকটি সেনা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন এবং সেখানকার সেনা সদস্যদের সাহস যোগান
। কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্তি বাহিনীর উপর্যুপরি আক্রমনের ফলে
পাকিস্তানি সেনা বাহিনী ততদিনে অনেকটা পর্যুদস্ত । ডিসেম্বরের ৩ তারিখ যখন
ইন্দিরা গান্ধী কোলকাতার বিগ্রেড প্যারেড গ্রাউন্ডে এক বিশাল জনসভায়
বক্তব্য রাখছিলেন ঠিক সেই মুহুর্তে বেলা ৫ টায় পাকিস্তান বিমান বাহিনী
পশ্চিম সীমান্তে ভারতের কয়েকটি অগ্রবর্তী বিমানঘাঁটিতে আক্রমণ করে বসে ।
ইন্দিরা গান্ধী তাঁর বক্তৃতা অর্ধ সমাপ্ত রেখে দিল্লী ফেরত গিয়ে লোকসভার
জরুরী অধিবেশন ডেকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন । ভারতীয় বিমান
বাহিনী হামলায় কয়েক ঘন্টার মধ্যেই পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর শক্তি নিস্তেজ
হয়ে পরে । একই রাতে বাংলাদেশে প্রথমে আক্রমণের সূচনা করে সদ্যগঠিত বাংলাদেশ
বিমান বাহিনী । তাদের লক্ষ্য বস্তু ছিল চট্টগ্রাম ও নারায়নগঞ্জের তেল ডিপো
। এরপরই শুরু হয় বাংলাদেশ ও ভারতীয় বাহিনীর ঢাকা দখলের সর্বাত্মক যুদ্ধ ।
ডিসেম্বরের ৯ তারিখ নিয়াজি রাওয়ালপিন্ডিতে এক তার বার্তা পাঠিয়ে
পাকিস্তানের সেনা প্রধান ও ইয়াহিয়া খানকে জানান ‘পূর্ব পাকিস্তানে
পাকিস্তানী সেনাবাহিনী সম্পূর্ণ পর্যুদস্থ । শত্রু পক্ষ আকাশ ও স্থলপথ
সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ফেলেছে । স্থানীয় জনগণ আমাদের প্রতি চরমভাবে
বৈরীভাবাপন্ন । রাতের বেলায় আমাদের চলাচল সম্পূর্ণ অসম্ভব কারণ বিদ্রোহীরা
(মুক্তিবাহিনী) আমাদের চতুর্দিক হতে আক্রমণ করে বেকায়দায় ফেলে । তারা
ভারতীয় সেনা বাহিনীকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসে । সকল জেটি, নৌযান ইতোমধ্যে ধ্বংস
করে দেয়া হয়েছে এবং বিমান আক্রমণের কারণে আমাদের ভারি অস্ত্রশস্ত্র আর গোলা
বারুদের ব্যাপক ক্ষয় ক্ষতি হয়েছে । আমাদের সৈন্যবাহিনী গত বিশ ঘন্টা
নির্ঘুম সময় কাটিয়েছে ।’ নিয়াজির এই তার বার্তায় বুঝা যায় ঢাকা দখলের আগেই
বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কী এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছিল ।
বাংলাদেশে পাকিস্তানের পতন এসময়ে শুধু সময়ের ব্যাপার ছিল ।
ইয়াহিয়া খান বুঝতে পেরেছিলেন তার সময় শেষ হয়ে আসছে । তিনি অনেকটা তড়িঘড়ি
করে শেষ চেষ্টা হিসেবে তার পররাষ্ট্র মন্ত্রী জুলফিকার আলী ভূট্টোকে জাতি
সংঘে পাঠালেন যাতে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে
পাকিস্তানের উভয় অংশে একটি যুদ্ধবিরতির ব্যবস্থা করা যায় । কিন্তু সোভিয়েত
ইউনিয়নের তিন বার ভেটো প্রয়োগের কারণে তা সম্ভব হয়নি । তারা বাংলাদেশ হতে
সকল পাকিস্তানি সৈন্যের অপসারণ ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির উপর জোর দিচ্ছিলেন ।
কিসিঞ্জারের মতে ভারত ইচ্ছা করলে পশ্চিম পাকিস্তানকে খন্ড বিখন্ড করে দিতে পারে
। এটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের দুশ্চিন্তার অন্যতম কারণ । ১৬ই ডিসেম্বরের পড়ন্ত
বিকেলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকার রমনা রেস কোর্সে যৌথ বাহিনীর সেনা
প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে প্রকাশ্যে হাজারো জনতার সামনে
আত্মসমর্পন করে । তখন সারা বাংলাদেশে একটিই শ্লোগান ‘জয় বাংলা’ । অনেক
রক্তক্ষরণ আর ত্যাগের বিনিময়ে জন্ম হলো এক নতুন দেশ-বাংলাদেশ । গ্যারী
ব্যাস তার গ্রন্থে লিখেছেন ‘সিআইএ আগেই খবর দিয়েছিল যে পাকিস্তানের সহায়তায়
চীন এগিয়ে আসবে না কারণ ইতোমধ্যে ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে একটি
প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল । কিসিঞ্জার নিক্সনকে অবহিত করেন
পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ভারতের সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে দু’দিনের বেশী টিকতে
পারবে না । নিক্সন দ্রুত মস্কোয় তার প্রতিপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে অনুরোধ
করেন যাতে ভারত পাকিস্তানকে খন্ড বিখন্ড করার উদ্যোগ গ্রহণ না করেন । সকলের
মনে কিছুটা ভীতি আর পাকিস্তানকে কিছুটা অভয় দেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র তার
সপ্তম নৌ বহরের বিমানবাহী জাহাজ ‘এন্টারপ্রাইজ’ ভারত মহাসাগরে প্রেরণ করে ।
অন্য দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভূমধ্য সাগরে অবস্থিত তার একটি আস্ত নৌবহর আরব
সাগরের দিকে প্রেরণ করে । হঠাৎ মনে হলো যে যুদ্ধটা একান্ত ভাবে উপমহাদেশে
সীমিত ছিল তা দুটি পরা শক্তির মধ্যে ছড়িয়ে পরছে । এরই মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন
যুক্তরাষ্ট্রকে নিশ্চিত করে যে পশ্চিম পাকিস্তান দখল করার কোন অভিপ্রায়
ভারতের নেই । ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পনের পরদিন
ইন্দিরা গান্ধী পশ্চিম সীমান্তে এক তরফা যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করেন । এই
যাত্রায় পাকিস্তানের অবশিষ্ট অংশ বেঁচে যায় ।
ইতিহাসবিদ আর বিশ্লেষকরা সব সময় স্বীকার করে এসেছেন পাকিস্তানের জন্মেই তার
মৃত্যু নিহিত ছিল কারণ মাঝখানে হাজার মাইলের অন্য আর একটি দেশের ব্যবধান
রেখে শুধু মাত্র ধর্মকে ভিত্তি করে কোন রাষ্ট্র সৃষ্টি হতে পারে না ।
তেমনটা যদি হতো সব আরব রাষ্ট্র মিলে একটি রাষ্ট্র হতে পারতো । এক ধর্ম ছাড়া
পাকিস্তানের উভয় অংশের মাঝে ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাষা, সমাজ, সভ্যতা, কৃষ্টি,
আচার-অনুষ্ঠান কোন কিছুরই মিল ছিল না । পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টারা কখনো
এই সব বাস্তব বিষয়গুলি চিন্তায় আনেননি এবং শেষ পর্যন্ত তাদের চড়া মূল্য
দিতে হয়েছে ।
এই বছর একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ তার বিজয়ের ৪৩তম বার্ষিকী
পালন করছে । বাঙালি হয়েও যারা একাত্তরে এদেশের জন্মকে অস্বীকার করেছে,
পাকিস্তানি সেনাদের সাথে কাঁধ মিলিয়ে এদেশের জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে
তারা সারা দেশে এই বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে পুনরায় লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে
অর্জিত এদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে । সেই যুদ্ধে নিরীহ মানুষ মরছে,
জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে । নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী, আইন শৃঙ্খলা
বাহিনীর কর্মকর্তা কেউ বাদ যাচ্ছেন না । তারা প্রত্যাশা করছে এই যুদ্ধের
মাধ্যমে তারা বাংলাদেশকে পুনরায় আবার একটি মিনি পাকিস্তানে রূপান্তর করবে
এবং একাত্তরে তাদের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেবে । বর্তমানে তাদের দোসর অনেক এবং
তারা আগের যে কোন সময়ের তুলনায় অনেক বেশী শক্তিশালী । তবে এই বছরের বিজয়
দিবসের সব চেয়ে বড় প্রাপ্তি একাত্তরের ঘাতক কসাই কাদের মোল্লার ফাঁসি ।
স্বাধীনতার ৪২ বছর পর এমন একটি অর্জন নিশ্চয় একাত্তরের শহীদদের কিছুটা হলেও
শান্তি দেবে । একাত্তরের শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা । একাত্তরের
চেতনা চিরজীবী হোক ।
লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় । ডিসেম্বর ১৩, ২০১৩
WARNING:
Any unauthorized use
or reproduction of
'Community' content is
strictly prohibited
and constitutes
copyright infringement
liable to legal
action.
[প্রথমপাতা] |
লেখকের আগের লেখাঃ
[......লেখক আর্কাইভ]
|