|
উপজেলা নির্বাচন-সুস্থ রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ
-প্রফেসর আবদুল মান্নান আর ক‘দিন পর ১৯ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে তৃতীয়বারের মতো উপজেলা নির্বাচন-২০১৪ এর প্রথম কিস্তির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে । তিন কিস্তির প্রথম কিস্তিতে ১০২টি উপজেলায় এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে । শেষ কিস্তিটা হবে মে মাসে । মাঝখানে একটি হবে আগামী মার্চে । সর্বমোট ৪৮৭টি উপজেলায় এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে । দেশে মোট উপজেলার সংখ্যা ৫০০টি । বাকিগুলির নির্বাচন নানা আইনী জটিলতায় অনুষ্ঠিত হতে পারছে না । ময়মনসিংহের ‘তারাকান্দা’ উপজেলার নির্বাচনটি হবে ২০১৮ সালে কারণ তখন এই উপজেলা পরিষদের পাঁচ বছর মেয়াদ শেষ হবে । একটি নির্বাচিত উপজেলা পরিষদের মেয়াদ পাঁচ বছর । প্রশাসনিক কাঠামোতে উপজেলা পরিষদ হচ্ছে সর্বশেষ ধাপ, ইউনিয়ন পরিষদের ঠিক উপরের ধাপ । তার উপরে আছে জেলা আর বিভাগ । এই দু’টির প্রশাসনিক কাঠামো সরকারের নিয়ন্ত্রণে কারণ জেলা প্রশাসক আর বিভাগীয় কমিশনার প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা আর তাদের নিয়োগ দেয় সরকার । তার নীচের স্তরের, উপজেলা আর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যরা সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন । প্রত্যেক উপজেলার ভোটাররা একজন উপজেলা চেয়্যারমেন, একজন ভাইস চেয়ারম্যান ও একজন মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত করেন । উপজেলায় নির্বাচিত ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানরা উপজেলার পরিষদ সদস্য হিসেবে পরিগণিত হন । সামরিক শাসক এরশাদ যে’কটি ভাল কাজ করেছিলেন তার মধ্যে নিঃসন্দেহে উপজেলা পদ্ধতি একটি । ১৯৮২ সনে উপজেলা অধ্যাদেশ বলে এই পদ্ধতির জন্ম । পরবর্তীকালে সেই অধ্যাদেশকে আইনে পরিণত করা হয় । এরশাদের আমলে দুইবার উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় । প্রথমবার ১৯৮৫ সালে আর দ্বিতীয়বার ১৯৯০ সালে । ১৯৯১ সালে বেগম জিয়া ক্ষমতায় এসে এই নির্বাচন বন্ধ করে দেন । রাজনৈতিক দিক হতে তাঁর এই সিদ্ধান্ত ছিল অত্যন্ত অদূরদর্শী এবং অনেকটা আত্মঘাতি । উপজেলা পদ্ধতি একটি তৃণমূল পর্যায়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনী ব্যবস্থা । এতে তৃণমূল পর্যায়ে দলকে সংগঠিত করার একটি সুযোগ সৃষ্টি হয় । একই সাথে সৃষ্টি হয় তৃণমূল পর্যায় হতে নেতৃত্ব সৃষ্টির সুযোগ । দূর্ভাগ্যবশতঃ বাংলাদেশের রাজনীতিতে বর্তমানে তৃণমূল পর্যায় হতে নেতৃত্ব সৃষ্টির চেয়ে উপর হতে চাপিয়ে দেয়া নেতৃত্বের কদর বেশী । আর বিএনপি নেত্রী সর্বক্ষণ যাদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে থাকেন তাদের অধিকাংশই সাবেক সামরিক বেসামরিক আমলা যাদের সাথে জনগণের কোন সম্পর্ক নেই । দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগও ইদানিং এই দোষে দুষ্ট হয়ে উঠছে । সাম্প্রতিক কালের বেগম জিয়ার রাজনৈতিক বিপর্যয়ের জন্য একক ভাবে দায়ী কিন্তু এইসব অতিথি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ । তাদের পরামর্শ কম শুনলে তিনি হয়তো এখনো বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে থাকতেন । কিন্তু বাস্তবে তিনি এবং তাঁর দলকে আপাততঃ কিছু দিনের জন্য রাজনৈতিক মঞ্চের বাইরে অবস্থান করতে হবে । পুরো দল খোল নলচে পাল্টাতে হবে । অবশ্য কী করবেন তা একান্তভাবে তাঁদের দলীয় সিদ্ধান্ত । ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনের তিন সপ্তাহ পর দেশে শেষবার উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল । কিন্তু স্থানীয় সংসদ সদস্য আর নির্বাচিত উপজেলা পরিষদের মধ্যে সৃষ্ট দ্বন্ধে সেই উপজেলা পরিষদ সঠিকভাবে কাজ করতে পারেনি । এই না পারাটা ছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের একটি বড় ব্যর্থতা । কোন বোধগম্য কারণ ছাড়া সংসদ সদস্যরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের নিজেদের প্রতিপক্ষ ভেবেছেন যদিও প্রত্যেকের দায়িত্ব সাংবিধানিক ভাবেই পৃথক । সংসদ সদস্যদের প্রধান দায়িত্বই হচ্ছে আইন প্রণয়ন এবং দেশের সার্বিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখা । তারা নিজেদের নির্বাচনী এলাকার বিষয় সংসদে তুলে ধরবেন, সরকার হতে বরাদ্দের ব্যবস্থা করবেন কিন্তু উপজেলা পর্যায়ে সেই বরাদ্দের সুষ্ঠু ব্যবহারের দায়িত্বটা ছেড়ে দিতে হবে উপজেলা পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের । এই কাজটি কোন সংসদ সদস্যই করতে চান নি কারণ তারা মনে করেছেন তাই যদি হয় তা হলে এক সময় উপজেলা পর্যায়ের নেতারা তাদের চেয়ে জনগণের কাছে বেশী গ্রহণযোগ্য হয়ে পরতে পারেন । এটি একটি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা । জনগণ যদি দেখে উপজেলা পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ আর সংসদ সদস্যরা নিজ নিজ এলাকার জন্য একটি টিম হিসেবে কাজ করছেন তাহলে তারা তাদের সেই ভাবেই মূল্যায়ন করবেন । আর এক সময় স্বাভাবিক নিয়মেই একজন উপজেলা নেতা তার কর্মের মাধ্যমে জাতীয় পর্যায়ের নেতা হয়ে উঠতে পারেন তাতে তো কোন অসুবিধা নেই । এটাইতো গণতন্ত্রের রীতি । কেউই নিজেকে কোন পদের জন্য অপরিহার্য ভাবা উচিৎ নয় । এই যে সামনে উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে তা সম্পূর্ণ হলে আশা করি বিগত দিনে মহাজোট সরকার উপজেলাকে ক্ষমতায়নের ব্যাপারে যে ভুল করেছে তার পুনরাবৃত্তি হবে না । মনে রাখা ভাল কার্যকর উপজেলা ব্যবস্থা স্থানিয় সরকার প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভ’মিকা রাখতে পারে । বিএনপি আর তার মিত্ররা গত ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করে উপজেলা নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করছে । তাদের এই পরষ্পর বিরোধী সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি দিয়ে তারা বলছে এটি কোন সরকার পরিবর্তনের জাতীয় নির্বাচন নয় । এটি একটা খোড়া যুক্তি । যেই যুক্তিতে বিএনপি আর তার মিত্ররা দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সেই যুক্তিগুলি কী এখনো বলবত আছে? তা হলে ? তবে এই নির্বাচনে তাদের অংশ গ্রহণ একটি সঠিক সিদ্ধান্ত কারণ এই নির্বাচনের ফলে তাদের ছত্রভঙ্গ কর্মী বাহিনীর আবার পুনর্গঠিত হওয়ার একটি সুযোগ সৃষ্টি হলো । অন্যদিকে যেভাবে এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলীয় কোন্দল মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে তাতে আওয়ামী লীগের জন্য একটি অশনি সংকেতও তৈরী হয়েছে । দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতা কর্মীদের একাধিকবার নির্দেশ দিয়েছেন প্রত্যেক উপজেলায় ঐক্যবদ্ধ ভাবে একজন করে প্রার্থী দিতে । তাঁর সেই নির্দেশ অধিকাংশ উপজেলায় কেউ গুরুত্ব দিয়েছেন বলে মনে হয় না । হয়তো তারা একটি বিপর্যয়ের জন্য অপেক্ষা করছেন । সেই বিপর্যয়ের পরবর্তী ফলাফল ভাল নাও হতে পারে । চোর পালালে বুদ্ধি বাড়লে কারো কোন লাভ নেই । এই ব্যপাওে দলকেই শক্ত ভুমিকা নিতে হবে । আসন্ন উপজেলা নির্বাচন নিয়ে বেশ কিছু নির্বাচনী এলাকায় বিভিন্ন জনের সাথে কথা বলে জেনেছি তারা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সম্ভাব্য সহিংসতা নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন । সামনের নির্বাচনগুলিতে সেনাবাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত হয়েছে । কিন্তু তাদের মতে বিগত সংসদ নির্বাচনেও সেনা বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল কিন্তু তাতে তো কোন কোন এলাকায়, বিশেষ করে ধর্মীয় সংখ্যা লঘু অধ্যুষিত এলাকায় ভয়াবহ সহিংসতা এড়ানো সম্ভব হয় নি । মনে রাখা ভাল সেই সময় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সেনা বাহিনীর শীতকালিন মহড়া চলছিল । সেই মহড়া অনেক ক্ষেত্রে হাইওয়ে বা সড়কের পাশে সীমাবদ্ধ ছিল । সেই সময় যদি সেনা বাহিনী সাতক্ষীরার মতো সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় নিয়োজিত থাকতো তাহলে জামায়াত-বিএনপি’র দুর্বৃত্তরা এত ভয়াবহ সন্ত্রাস চালাতে পারতো না । এটি ছিল নির্বাচন কমিশনের বড় ধরণের ভুল এবং ব্যর্থতা । ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর সেখানে বন্দুক কামান নিয়ে সশস্ত্র পাহারা দেয়াটা অর্থহীন । আশা করি নির্বাচন কমিশন এবার তেমন ভুল করবে না । প্রয়োজনে সেনা বাহিনীকে ম্যাজেষ্ট্রিসি ক্ষমতা দেয়ার কথাও চিন্তা করা যেতে পারে । সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের যে সব ভুল ছিল দেশের মানুষ আশা করে তারা সেই সব ভুল হতে শিক্ষা নিয়ে দেশে একটি ভাল, শান্তিপূর্ণ উপজেলা নির্বাচন উপহার দেবে । আসন্ন উপজেলা নির্বাচন হতে পারে বাংলাদেশের সুস্থ রাজনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ । লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় । ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১৪
WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action.
|
লেখকের আগের লেখাঃ |