সুতোর টানে-৩
সুলতান সালাহ্উদ্দীন আহমেদ
সৃষ্টি সুখের উল্লাসে
সৃষ্টির রহস্য জানার বিপুল আগ্রহ আমার শুরু থেকেই। কোন জিনিসটা
কীভাবে হলো তা উল্টে পাল্টে না দেখলে মন ভরতো না। জহুরুল হক নামে
একজন বায়োলজির টিচার ছিলেন। তার ক্লাসে একটি বিষয় আমার চিন্তা
ভাবনাকে বদলে দেয়। বিষয়টা ছিল চোখ আর ক্যামেরা। চোখ কীভাবে দেখতে
পায় আর ক্যামেরায় কীভাবে ছবি উঠে। তখন চোখ নিয়ে পড়ার সময় আমি খুব
অবাক হতাম যে মানুষের শরীরে এতো জিনিস আছে! সে সময় অমি ফিজিক্সে
খুব ভালো ছিলাম। একটা ইচ্ছে ছিল ফিজিক্স পড়ার। আইনস্টাইন, নিউটন
এদের তখন খুব ভালো লাগতো। ল্যাবরেটরি স্কুলে তখন সায়েন্স ফেয়ার হতো।
সায়েন্স ফেয়ারে প্রত্যেকবার আমি পুরষ্কার পেতাম। মনে পড়ে একবার
বিখ্যাত বিজ্ঞানী ড. কুদরত-ই-খুদার কাছ থেকেও পুরষ্কার নিয়েছিলাম।
সে সময় প্রত্যেক স্কুল থেকে বিজয়ীদের নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
কার্জন হলে বড় করে সায়েন্স ফেয়ার হতো।
তখন যেসব প্রজেক্ট করেছিলাম তার মধ্যে একটি হলো চুম্বক দিয়ে ডিসি
রেন্ট যে কাঁটা ঘুরে অর্থাৎ দিক নির্দেশের উত্তর-দক্ষিণ, তার ওপর
দিয়ে তার জড়িয়ে ব্যাটারি দিয়ে দিলে যে ইলেকট্রকাল সার্কিট হয় তাকে
ম্যাগনেটটা চেঞ্জ হয় ওটা ছিল একটা প্রজেক্ট।
আরো ছিল, ফুলকে সিদ্ধ করার পর কনডেন্সড করে তার সুগন্ধীটাকে ধরে
রাখা। এক ধরনের পারফিউম-এর মতো। কিন্তু এগুলো আমার মনে অতটা দাগ
কাটেনি। কুদরত-ই-খুদা যেটাতে আমাকে প্রথম পুরষ্কার দেন তাতে তিনি
বিচারক ছিলেন। এটা আন্তঃস্কুল কম্পিটিশনে ফার্স্ট হয়। আমার
প্রজেক্টটা ছিল তিনটা বড় ড্রইং। যেহেতু আমি প্রতিবারই কিছু না কিছু
করি, ওই বছরই আমার সামনে করার মতো কিছু ছিল না। অর্থাৎ দেখানোর মতো
কোনো জিনিস ছিল না। সবাই যখন বড় বড় জিনিস বানাচ্ছে বা দেখাচ্ছে তখন
আমি চুপ করে বসে থাকলাম। সবাই মনে করলো যে সালাউদ্দিন এবার শুধু বসে
আছে। কিন্তু ড.কুদরত-ই-খুদা যখন কাছে আসলেন তখন আমি বলা শুরু করলাম।
যে তিনটা কাগজ ছিল তাতে এঁকেছিলাম গাছ কীভাবে খাদ্য তৈরি করে অর্থাৎ
ফটোসিনথেসিস প্রক্রিয়াটি। এটার সঙ্গে আমাদের খাদ্যের একটা
তুলনামূলক চিত্র। অর্থাৎ গাছের জীবন এবং মানুষের জীবন। গাছ যে
খাবার তৈরি করছে এবং কিভাবে তৈরি করছে। মানুষ খাবার খেতেও পারছে
না, তৈরিও করতে পারছে না-এভাবেই আমি বক্তব্য রাখলাম। ওটার ওপর আমি
ফার্স্ট প্রাইজ পাই।
আমার মনে আছে সবাই খুব অবাক হয়েছিল যে কীভাবে কোনো মডেল না করে
তিনটা কাগজ দিয়ে ফার্স্ট প্রাইজ পেলাম!
সে ঘটনার একটা বড় প্রভাব আমার ওপর পড়ে এবং সায়েন্সের প্রতি আমার
আকর্ষণটা আরো বেড়ে যায়। বায়োলজির ওপর পুরষ্কার পাওয়ার পর এবং
পাশাপাশি জহুরুল স্যারের প্রভাবেও আমি বায়োলজির দিকে যাই। যদিও
ফিজিক্সটা নিয়ে আমার রোমান্টিক চিন্তা ছিল।
[লেখক পরিচিতি
আমেরিকার নোভা সাউথইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অফ মায়ামিসহ বেশ
কিছু ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ডা. সুলতান সালাহ্উদ্দীন আহমেদ মানব সেবার ব্রত
নিয়ে চিকিৎসা পেশাকে বেছে নেন। দেশে এবং প্রবাসে তিনি তার পেশায় আন্তরিকতা
এবং সততার জন্য প্রশংসিত হয়েছেন।
তিনি কলেজ ছাত্র অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। মুক্তিযুদ্ধের সময় বন্দী
শিবিরে অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হন। মুক্তিযুদ্ধে তার উদ্ভাবিত হাতে তৈরি
সাইক্লোস্টাইল মেশিনে মুক্তিযুদ্ধের অনেক জরুরি এবং গোপন তথ্য নিয়মিত
প্রকাশিত হয়। এই মেশিন পরবর্তী সময়ে তাকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয়।
গবেষক ও আবিষ্কারক হিসেবেও দেশে-বিদেশে স্বীকৃতি পেয়েছেন তিনি। একজন
মানুষের জীবন কতোটা বৈচিত্র্যময় হতে পারে তার একটি চমৎকার উদাহরণ হতে পারে
এই বইটি। জীবনের দুঃসময়ে ভেঙে না পড়ে তা কাটিয়ে ওঠার প্রেরণা হিসাবে বইটি
কাজ করবে। জীবনকে নিয়ে নতুন করে ভাবার অনেক উপকরণ ছড়িয়ে আছে সীমিত কলেবরের
এই বইটির পাতায় পাতায়। ব্যক্তিজীবনে সুলতান সালাহ্উদ্দীন আহমেদ একমাত্র মেয়ে
ও স্ত্রীকে নিয়ে মায়ামিতে বসবাস করেন।]
|