[প্রথমপাতা]
|
বাংলাদেশে সেই সব পাকিস্তানীরা
প্রফেসর আবদুল মান্নান
ইমরান খান, বিশ্বনন্দিত পাকিস্তানের ক্রিকেটার । যে ক্রিকেটকে ভালবাসে সে
ইমরান খানকে ভাল না বেসে পারবে না । বর্তমানে সেই ইমরান খান পাকিস্তানের
একজন উদীয়মান রাজনীতিবিদ । তেহরিখ-ই-ইনসাফ নামে একটি দল করেছিলেন বেশ আগে।
পাকিস্তানে এটি এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য যে তার এই দল গড়ার পিছনে পাকিস্তানের
গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইএর প্রত্যক্ষ মদদ ছিল । তালেবানদের সাথে তার সখ্যতা
এখন ওপেন সিক্রেট । তাদের সাথে সমঝোতা করে তার দল খাইবার-পাকতুন খাওয়ায়
সরকার গঠন করেছে । তার দলের ভাইস প্রেসিডেন্ট ইসখাক খান খাকওয়ানি, যিনি আগে
একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ছিলেন, তার একটি লেখা গত ২৫ অক্টোবর পাকিস্তান হতে
প্রকাশিত ডেইলি টাইমস পত্রিকায় ‘Millions of Pakistan Supporters in
Bangladesh-especially in the BNP’ (বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ পাকিস্তানি
সমর্থক-বিশেষ করে বিএনপিতে) শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে । খাকওয়ানি পাকিস্তান
রাজনীতিতে বেশ একটি পরিচিত নাম এবং নিয়মিত বিভিন্ন টিভি টকশোতে অংশ গ্রহণ
করেন এবং তালেবানদের পক্ষ নিয়ে কথা বলেন ।
সম্প্রতি প্রকাশিত খাকওয়ানির লেখার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশের
যুদ্ধাপরাধের বিচার । তার মতে যারা এই বিচারের সমর্থন করেন তারা এই বিষয়ে
তাদের একপেশে বক্তব্য উত্থাপন করেন এবং ইদানিং দেখা যাচ্ছে তা হতে
গণমাধ্যমও বাদ যাচ্ছে না । তিনি এই ব্যাপারে সম্প্রতি ডেইলি ষ্টার পত্রিকায়
একটি মন্তব্য প্রতিবেদন পাঠিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন যা এখন পর্যন্ত প্রকাশিত
হয়নি । ডেইলি ষ্টার তা প্রকাশ করবে কী না তা তাদের নিজস্ব ব্যাপার কারণ
তাদের নিজস্ব একটি সম্পাদকীয় নীতিমালা আছে (মন্তব্য এই লেখকের) । পত্রিকাটি
সম্প্রতি আগামী নির্বাচন নিয়ে এশিয়া ফাউন্ডেশনের সহায়তায় একটি জরিপের ফলাফল
ছেপেছে যাতে ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে ধরাশায়ী করে ফেলেছে । তা নিয়ে
বিভিন্ন টকশোতে কিছু লোকজন রাতের ঘুমও হারাম করে ফেলছে । কিন্তু ডেইলি
ষ্টার এই কথাটি চেপে গেছে যে এশিয়া ফাউন্ডেশন সারা বিশ্বে নিন্দিত
যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র অর্থায়নে পরিচালিত একটি অঙ্গ সংগঠন
। সিআইএ দেশে দেশে তাদের নাযায়েজ কর্মকান্ড পরিচালনা করার জন্য সরাসরি
হস্তক্ষেপ করতে অসুবিধা মনে করলে এশিয়া ফাউন্ডেশনের মতো সংস্থাকে কাজে
লাগায় । ধারণা করা হচ্ছে বাংলাদেশে সামনের নির্বাচনে যাতে আওয়ামী লীগ
পুনরায় ক্ষমতায় ফিরতে না পারে তার জন্য সিআইএ ইতোমধ্যে তাদের চাকা সচল করে
ফেলেছে । এই সম্পর্কে আওয়ামী লীগ কতটুকু সতর্ক বা ওয়াকিবহাল তা আমার সন্দেহ
আছে । এই জরিপ সম্পর্কে আগামীতে বিস্তারিত লেখার ইচ্ছা রইলো । ফিরে আসি
খাকওয়ানির লেখায় ।
খাকওয়ানির মতে যুদ্ধাপরাধী বিচারের বিষয়টি বাংলাদেশের সামনের নির্বাচনে
একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে । তার মতে এই ব্যাপারে ইসলামাবাদের
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত পাকিস্তানের দূতাবাস আত্মরক্ষা
মূলক ভূমিকা পালন করছে । গত ৪২ বছরে বাংলাদেশ সুযোগ পেলেই পাকিস্তানকে
ধোলাই (bashing) করে । এর জন্য তারা কিছু দিনকে বেছে নেয় । এর মধ্যে আছে
একুশে ফেব্রুয়ারী, শেখ মুজিবের জন্ম দিন (মার্চ ১৭), ২৫ মার্চ (বাংলাদেশে
পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর সর্বাত্মক আক্রমন), ২৬ মার্চ (বাংলাদেশের
স্বাধীনতা দিবস), ১৫ আগষ্ট (শেখ মুজিবের হত্যা ও জাতীয় শোক দিবস), ১৬
ডিসেম্বর (ঢাকার পতন ও পাকিস্তান সেনা বাহিনীর আত্মসমর্পন) । বাংলাদেশে
পাকিস্তানের অনেক সমর্থক আছে, বিশেষ করে বিএনপিতে । অন্যান্য স্বাধীনচেতা
মানুষও পাকিস্তানকে সমর্থন করে এবং কাউকে না কাউকে এই সব বিষয় নিয়ে কথা
বলতে হবে যাতে মানুষ মুদ্রার অন্যপিঠও দেখতে পায় । খাকওয়ানি লিখেছেন এই সব
বিষয় নিয়ে তার পক্ষে কথা বলা তেমন একটা সহজ নয় কারণ তিনি একজন পাকিস্তানি
এবং সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পারিবারিক বন্ধু । তিনি লিখেছেন ‘আমি সে
দেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সমর্থকদের দৃষ্টিভঙ্গির
সম্মান করি কারণ তারা সেই দেশের সম্মানিত নাগরিক কিন্তু আমি প্রার্থনা করবো
আমার দৃষ্টিভঙ্গিগুলি তারা গুরুত্ব সহকারে নেবেন ।’ তিনি স্বীকার করেছেন
অতীতে পাকিস্তানি শাসকরা তাদের নিজস্ব জনগণের উপর অনেক অবিচার করেছে । তিনি
প্রশ্ন রেখেছেন এই সব অবিচার কী কোন ব্যক্তি বিশেষ কর্তৃক সৃষ্ট নাকি
শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় যন্ত্র দেশের জনগণের উপর চাপিয়ে দিয়েছে ? তিনি তার
দ্বিতীয় প্রশ্নে জানতে চেয়েছেন পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর সে দেশের
শাসকবর্গ (সামরিক ও বেসামরিক) দেশটিকে কী ভাবে শাসন করেছে? রাষ্ট্রের
সম্পদের সুষম বন্টন কী বাংলাদেশে সম্ভব হয়েছে ? মানুষের দারিদ্র কী কমেছে ?
বাংলাদেশের জনগণের প্রতি খাকওয়ানি শেষ প্রশ্ন রেখে জানতে চেয়েছেন
যুদ্ধাপরাধের দায়ে দ-িত দশজন ব্যক্তিকে ফাঁসিতে ঝুলালে বাংলাদেশের হিসেব
অনুযায়ী যে লক্ষ লক্ষ শোকার্ত মানুষ ও একাত্তরে শহিদ (শব্দটি আমার) মানুষ
আছে বলে বলা হচ্ছে তারা কী তৃপ্ত হবেন বা শান্তি পাবেন? তিনি এই ঘাতকদের
বিচার নিয়ে প্রশ্ন তুলে লিখেছেন আওয়ামী লীগের কী উচিৎ হবে না তাদের জন্য
একটি নিরপেক্ষ বিচারের ব্যবস্থা করা ?
খাকওয়ানি তার পারিবারিক বন্ধু সাকাচৌর দন্ডে ভীষণ ব্যথিত হয়েছেন এবং তার
বিচারের স্বচ্ছতা ও প্রক্রিয়া নিয়ে ক্ষুব্দ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন এবং
মন্তব্য করেছেন তার বিরুদ্ধে যে সকল সাক্ষ্য দেয়া হয়েছে তার সবটাই ছিল
বানোয়াট । তার মতে পাকিস্তান হতে যদি সাক্ষীদের সাক্ষ্য দিতে সে দেশে
যাওয়ার সুযোগ থাকতো তা হলে সাকাচৌ সুবিচার পেত । তিনি বাংলাদেশের উচ্চ
আদালতের বিচারপতি শামিম হাসনাইনের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে লিখেছেন তাকে
অন্যায় ভাবে এই মামলায় সাক্ষ্য দিতে দেয়া হয়নি । বাস্তবে কথাটা সত্য নয়
কারণ রেওয়াজ, আইন অনুযায়ী তার সরাসরি সাক্ষ্য দেয়ার সুযোগ থাকার কথা নয় ।
সাকাচৌ সম্পর্কে খাকওয়ানি ভূয়সি প্রশংসা করেছেন এবং বলেছেন শেখ হাসিনা তাকে
তার একজন শক্ত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মনে করেন বলে তাকে একাত্তরে গণহত্যা
পরিচালনা করার অপরাধে অন্যায়ভাবে এই বিচারের মুখোমুখি করেছেন । তার পিতা
শেখ মুজিব, যিনি বাংলাদেশের ‘মুক্তিযুদ্ধে’ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কখনো এই
ধরণের বিচারের কথা চিন্তা করেন নি । সেই দেশের প্রতিষ্ঠাতারা অনেক বেশী
দূরদর্শী ছিলেন এবং তারা যে ধরণের দেশ গড়বেন বলে স্বপ্ন দেখেছিলেন তা গড়ার
দিকে দৃষ্টি দিয়েছিলেন । খাকওয়ানির শেষ কথা হচ্ছে আওয়ামী লীগ এই সব করে
দেশটিকে ঐক্যবদ্ধ করার পরিবর্তে বিভক্ত করেছে এবং সেই বিভক্তিটা ৪২ বছর পর
আরো প্রকট হয়েছে ।
খাকওয়ানির প্রতিবেদন সম্পর্কে কয়েকটি কথা । বিএনপিতে যে পাকিস্তানি সমর্থক
আছে তা এখন কোন গোপন বিষয় নয় । তাঁর এই মন্তব্যটি একশত ভাগ সত্য । আমার এক
অগ্রজ বলেন বাংলাদেশের জনসংখ্যা দশকোটি । জানতে চাই বাকি ছয়কোটির কী হলো?
তার সোজা উত্তর তারা সকলে পাকিস্তানি । তার মন্তব্যটা একটু রূঢ় হলেও বাস্তব
সত্য । পাঠক নিজেকে প্রশ্ন করতে পারেন হরতাল নামক নৈরাজ্যের দিন দেশের
বিভিন্ন অঞ্চলে যে চরম সন্ত্রাস সৃষ্টি করে তারা কারা? দ্বিতীয়ত বাংলাদেশের
মানুষ একাত্তরের ঘাতকদের বিচারের জন্য দীর্ঘ চল্লিশ বছর অপেক্ষা করেছে । এই
যাত্রায় শেখ হাসিনা আর তার দল আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসতে হয়েছে এই বহু
প্রতীক্ষিত বিচার কাজটি শুরু করতে । সামনের নির্বাচনে জয় পরাজয় জনগণ
নির্ধারণ করবেন কিন্তু শেখ হাসিনা আর তার দলকে ইতিহাস মনে রাখবে
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যটি শুরু করার জন্য । সাকাচৌ খাকওয়ানির পারিবারিক
বন্ধু হতে পারেন কিন্তু সাকার একাত্তরের অপরাধের জন্য তার একবার নয় একশত
বার ফাঁসি হওয়া উচিৎ ছিল । শেখ মুজিব এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চান নি কথাটি
মোটেও সত্য নয় । তিনি ১৯৭২ সনে দালাল আইন করেছিলেন এবং এই আইনের অধীনে কয়েক
হাজার অপরাধীকে গ্রেফতার করা হয়েছিল যার মধ্যে সাকার বাবা ফকাও ছিলেন । এই
আইনে কয়েক হাজার অপরাধীদের বিচার চলছিল । অনেকের সাজাও হয়েছিল ।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ১৯৭৫ সনের ৩১ ডিসেম্বর জেনারেল জিয়া সেই আইন বাতিল
করে সকল ঘাতক দালালদের মুক্তি দিয়েছিলেন । ১৯৭৩ সনে বঙ্গবন্ধু সরকার
আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন প্রণয়ন করেছিলেন একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী আর
মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার করার জন্য । কিন্তু বিচার কাজ শুরু করার
পূর্বেই পাকিস্তানি এজেন্টরা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছিল । জিয়া সেই
ঘাতকদের পুরষ্কৃত করেছিলেন । বাংলাদেশে বর্তমানে যে বিভাজন তা ১৯৭৫ সালের
পরই সৃষ্টি হয়েছিল তাতে শেখ হাসিনার কোন অবদান নেই । বাংলাদেশ সর্বক্ষেত্রে
পাকিস্তানের চেয়ে হাজার গুন ভাল আছে এটি সারা বিশ্বে স্বীকৃত । তা খাকওয়ানি
আর তার দলের মতে যারা এদেশে পাকিস্তানের সমর্থক তাদের চোখে না পরারই কথা ।
এই দেশের মানুষ আরো ভাল থাকতো যদি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে
পাকিস্তান হস্তক্ষেপ করা বন্ধ করতো । তবে খাকওয়ানিকে ধন্যবাদ এদেশে
পাকিস্তানি সমর্থকদের পুনরায় সনাক্ত করার জন্য।
লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। নভেম্বর ৪, ২০১৩
WARNING:
Any unauthorized use
or reproduction of
'Community' content is
strictly prohibited
and constitutes
copyright infringement
liable to legal
action.
[প্রথমপাতা] |
লেখকের আগের লেখাঃ
[......লেখক আর্কাইভ]
|