[প্রথমপাতা]
|
মানবাধিকারের অর্থ নৈরাজ্য সৃষ্টির লাইসেন্স নয়
প্রফেসর আবদুল মান্নান
‘অধিকার’ নামক একটি জামায়াত-বিএনপি পন্থী তথাকথিত মানবাধিকার সংগঠনের
সম্পাদক আদিলুর রহমান খানকে সম্প্রতি সরকারের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী
৫৪ ধারায় গ্রেফতার করেছে । এই ধারা অনুযায়ী সাধারণত একজন ব্যক্তিকে
গ্রেফতার করা হয় যখন তার গতিবিধি সন্দেহজনক মনে করা হয় । পরবর্তীকালে তার
বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় তিনি তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার ১ ও ২ উপধারা
লঙ্ঘন করে অসত্য তথ্য প্রচার করেছেন এবং এর দ্বারা দেশের ও দেশের বাইরের
মানুষজন ও বিভিন্ন গণমাধ্যমকে বিভ্রান্ত করেছেন, দেশের সুনাম হানি করেছেন
এবং অনেক মানুষের জীবন বিপন্ন করেছেন । এই ধারায় বলা হয়েছে ‘কোন ব্যক্তি
যদি ইচ্ছাকৃত ভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোন ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু
প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা
বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসত্য হইতে উদ্বুদ্ধ
হইতে পারেন, অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা
ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয় বা রাষ্ট্র বা ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষূণœ হয় বা
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরণের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো
ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানি প্রদান করা হয়, তাহা হইলে তাহার এই
কার্য হইবে অপরাধ । কোন ব্যক্তি এর অধীনে অপরাধ করিলে তিনি অনধিক ১০ বছর
কারাদ-ে অথবা অনধিক এককোটি টাকা অর্থদ-ে দ-িত হইবেন ।’ আইনটি বিগত
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৬ সালে প্রণয়ন করা হয়েছিল ।
আদিলুর রহমান খান জোট সরকারের আমলে ডেপুটি এটর্নি জেনারেল ছিলেন এবং বলা
বাহুল্য তিনি সে সময় সরকারের অত্যন্ত একজন আস্থাভাজন ব্যক্তি ছিলেন নতুবা
রাষ্ট্রের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে তাঁকে পদায়ন করা হতো না । অধিকারের
সভাপতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক এবং ইতোপূর্বে তিনি বাংলাদেশে
বসবাসরত পাকিস্তানি নাগরিকদের উচ্চ আদালতের মাধ্যমে বাংলাদেশের নাগরীকত্ব
পেতে সহায়ত করেছিলেন । ‘অধিকার’ নামক সংগঠনটির সাথে দেশের সুধিজন পরিচিত
হলেও আদিলুর রহমান খান তার সংগঠনের মতো তেমন একটা পরিচিত ছিলেন না । তাঁকে
আটক করার পর তিনি এখন তাঁর সংগঠনের চেয়েও অনেক বেশী পরিচিতি লাভ করেছেন ।
সেই পরিচিতি দেশেতো বটেই দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পরেছে । জাতিসংঘের মানবাধিকার
কমিশন, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, সুলতানা কামালের মানবাধিকার
সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র ও টিআইবি, বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম জিয়া,
সুপ্রিম কোর্টের বেশ কিছু আইনজীবী সহ অনেক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি আদিলুর
রহমান খানের আটকের নিন্দা জানিয়ে তাঁকে মুক্তি দিতে সরকারের প্রতি জোর দাবি
জানিয়েছেন । একাধিক পত্রিকায় এই বিষয়ে বিশেষ সম্পাদকীয় লেখা হয়েছে আর
মধ্যরাতে টেলিভিশন টকশোগুলিতে ক’দিন ধরে সকলে তাঁর নাম জপতে জপতে মুখে ফেনা
তুলে ফেলছেন । এদের মধ্যে যেমন আছেন বিজ্ঞ আইনজীবী তেমন আছেন আইনের অধ্যাপক
। আছেন স্বনাম খ্যাত সাংবাদিক আর রাজনৈতিক বিশ্লেষক । আদিলুর রহমান খান
বর্তমান সরকারকে কৃতজ্ঞতা জানাতে পারে এই কারণেইযে তাঁকে আটক না করলে তিনি
যে এক খ্যাতিমান একজন ব্যক্তি তা হয়তো তিনি নিজেই জানতেন না । দূঃখ হয়
বন্ধুবর ডঃ মুনতাসীর মামুন, সাবেক সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী, সাংবাদিক
শাহরিয়ার কবির, সেলিম সামাদ অথবা এনামুল হকের জন্য কারণ যখন চারদলীয় জোট
সরকারের আমলে এঁদের ময়মনসিং সিনেমা হলে বোমা ফাটানোর বা অন্যান্য অভিযোগে
গ্রেফতার করে নির্যাতন করা হয় তখন তাদের পক্ষ হয়ে কেউ তেমন একটা টু শব্দটা
করেন নি । অনুজ প্রতীম এনামতো মুক্তি পাওয়ার পর অনেকদিন সোজা হয়ে হাঁটতে
পারেন নি । কেউ কেউ বলবেন তখন সংবাদ পত্রের বা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আজকের
মতো ছিল না, ছিল নিয়ন্ত্রিত । আসলে সব দোষ শেখ হাসিনা আর তার সরকারের । কেন
যে তিনি সকলকে এত স্বাধীনতা দেন তা অনেকের কাছে বোধগম্য নয় । এমন অবারিত
স্বাধীনতা ওই সমাজেই মানায় যেখানে মানুষ তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ
সচেতন ও দায়িত্বশীল থাকে । বর্তমান সরকারের আমলে এই স্বাধীনতা এমন পর্যায়ে
গিয়েছেযে সেদিন একটি টিভি টকশোতে একজন বিজ্ঞ আলোচক বললেন মানবাধিকার একটি
অলংঘনীয় অধিকার । হেফাজত বা জামায়াতেরও মানবাধিকার আছে । খাঁটি কথা । আলোচক
আইনের মানুষ । তার কছে একটা ছোট প্রশ্ন, একজন গাড়ীর মালিক রাস্তা দিয়ে তার
পরিবার সহ তার গাড়ী ড্রাইভ করে যাচ্ছেন । সাথে তার লাইসেন্স করা নিজের
আগ্নেয়াস্ত্র আছে । পথে জামায়াত বা হেফাজতের কিছু দূর্বৃত্ত তাদের গাড়ী
থামিয়ে তাতে আগুন দিতে উদ্যত হলো । ওই ব্যক্তি যদি তার অস্ত্র দিয়ে
দু’চারজনকে হত্যা করে তা হলে তা কী মানবাধিকার লঙ্ঘন হবে? যুক্তরাষ্ট্রে
১৯৭৮ সালে এমন ঘটনা ঘটেছিল । তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের
এএফএল-সিআইও সারা দেশে ট্রাক ধর্মঘট আহ্বান করলো । এই সংগঠনটি সে দেশে খুবই
শক্তিশালী । বাংলাদেশে জিএসপি সুবিধা বাতিলের পিছনে তাদের বিরাট ভূমিকা আছে
। ট্রাক চালক আর মালিকদের ধর্মঘটের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির এক
বিপর্যয়কর অবস্থা । তবে যারা এই সংগঠনের অন্তর্ভূক্ত নয় সেই সব মালিক ও
চালকরা সিদ্ধান্ত নিল তারা ট্রাক চালু রাখবে । ধর্মঘটকারীরা বললো তারা পথে
বাধা দেবে । কার্টার প্রশাসন সিদ্ধান্ত দিল কোন ট্রাক ড্রাইভার চাইলে নিজের
ও তার ট্রাকের নিরাপত্তার স্বার্থে সাথে আগ্নেয়াস্ত্র রাখতে পারবে। এই
ব্যাপারে প্রশাসনও সাহায্য করবে । দেখা গেল কয়েক দিনের মধ্যেই শত শত ট্রাক
ড্রাইভার পাশে এম-১৬ স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে রাস্তায় তাদের ট্রাক চালু
রেখেছে । অচিরেই এএফএল-সিআইও’র ধমর্ঘট ভেঙ্গে গিয়েছিল । তখন ওই দেশে কেউ
কিন্তু মানবাধিকার গেল গেল বলে চিৎকার করে নি । তবে এটাও ঠিক মানবাধিকারের
সংজ্ঞাটি আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিলে পরিবর্তন হয়ে পরে আর এশিয়া পর্যন্ত
আসতে আসতে তার পুরো চেহারাই পরিবর্তন হয়ে যায় । যাক সে কথা, তা অন্য সময়
বলা যাবে । এখন ‘অধিকার’ আর তার সম্পাদক আদিলুর রহমান খান প্রসঙ্গে ফিরে
আসি ।
খান সাহেবের সাথে আমার কখনো দেখা হয়নি । হওয়ার সম্ভাবনাও তেমন দেখিনা । না
হলে তাঁর কোন ক্ষতি নেই । শুনেছি তিনি বেশ স্মার্ট আইনজীবী। হওয়ারই কথা ।
নাহলে তিনি জাসদ ছেড়ে বিএনপি রাজনীতির সাথে জড়িত হবেন কেন ? প্রচলিত
বিশ্বাস চাষাভূষার দল হলো আওয়ামী লীগ । তাদের বেশীর ভাগের গায়েই ঘাম আর
মাটির গন্ধ । আর বিএনপি মানে স্যুটেড বুটেড । আওয়ামীরা হাত দিয়ে প্লেট হতে
খাওয়ার চেটে পুটে খায় । সারা মুখে লেগে থাকে । খানিকটা কাপড়েও পড়ে । আর
বিএনপি ঘরানার বুদ্ধিজীবী বলি আর দলীয় নেতা কর্মী, তারা মোটামুটি খাওয়ার
সময় কাঁটা চামচ ব্যবহার করেন । খাওয়া শেষ হলে বুঝা যায়না কী খেলেন যে কারণে
তারা কোটি কোটি টাকার দূর্নীতি করলেও তা বুঝা মুস্কিল । তারা বেশ স্মার্ট ।
অন্যদিকে আওয়ামীরা একশত টাকার দূর্নীতি করলেও পথে পথে তার স্বাক্ষী রেখে
যান যেমন ভাবে খাওয়ার সময় কী দিয়ে খেলেন তা তার মুখ আর কাপড় দেখলেই বুঝা
যায় । স্মার্ট মানুষরা বিএনপি করেন, তা মোটামুটি এখন সকলে মানে, এমন কী
প্রধানমন্ত্রীও ।
বাংলাদেশে নিজেকে সবকিছুর উর্দ্ধে রাখতে সব চেয়ে সুবিধা হচ্ছে বিদেশের
অর্থে একটি মানবাধিকার নামক সংগঠন খোলা । তা যদি করতে না পারেন তবে কোন
প্রকারে যদি আপনি সাবেক হওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একজন উপদেষ্টা হয়ে যেতে
পারেন তা হলেতো কথাই নেই । চারিদিকে আপনাকে নিয়ে ধন্য ধন্য পড়ে যাবে ।
অবশ্য এই মন্তব্য সকলের বেলায় নয়, দুই একজনের বেলায় সত্য । এই ব্যক্তিরা যে
কোন যোগ্যতায় জাতিকে উপদেশ খয়রাত করার দায়িত্ব পেয়েছিলেন তা অনেকের কাছে এক
রহস্যময় বিস্ময় । তা যদি না পারেন তা হলে কোন ভাবে হয়ে যেতে পারেন হতাশা
গ্রস্থদের জাতীয় সংগঠন সিপিডি অথবা টিআইবি’র সদস্য । এর কোনটাই যদি আপনার
পক্ষে সম্ভব না হয় তা হলে খুলে ফেলুন একটি নতুন রাজনৈতিক দলের দোকান । ঘটা
করে কোন একটা তারকা খচিত হোটেলে সাংবাদিকদের ডেকে এনে দেশ সেবার অঙ্গিকার
করুন । সাথে আবার দুই একজন অন্য দল হতে বিতর্কিত ও বিতারিত হাই প্রোফাইল
নেতা নেত্রী থাকতে হবে । চাইলে সে সভায় আসন্ন নির্বাচনে কাদের কাদের আপনি
নমিনেশন দিচ্ছেন তাও ঘোষণা করতে পারেন । তা নিয়ে যদি মধ্যরাতের কোন এক
টকশোতে আপনি দু’এক কথা বলতে পারেন তা হলে কিল্লা ফতে । ‘অধিকার’ অবশ্য তেমন
কোন সংগঠন নয় । তারা যাত্রা শুরু করেছিল ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে । সেই
নির্বাচনে যে আওয়ামী লীগ পরাজিত হচ্ছে তা অনেকের ধারণা থাকলেও ছিলনা আওয়ামী
লীগের । এই বিষয়ে আমি একটি মন্তব্য প্রতিবেদন লিখেছিলাম নির্বাচন অনুষ্ঠিত
হওয়ার সপ্তাহ দশদিন আগে । সেটি ছাপা হয়নি । পরে সম্পাদক আমাকে জানিয়েছিলেন
তারা আওয়ামী লীগ শিবিরে আতঙ্ক ছড়িয়ে কর্মীদের মনোবল ভেঙ্গে দিতে চায় নি ।
আমাকে সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে আগাম ধারণা
দিয়েছিে নির্বাচন পর্যেবেক্ষণের জন্য আসা একটি অত্যন্ত শক্তিশালী দেশের
পর্যবেক্ষকদের আমার পূর্ব পরিচিত প্রধান সমন্বয়ক । সেই নির্বাচন খুবই
সুষ্ঠু হয়েছিল বলে সকলে সার্টিফিকেট দিয়েছিল যার মধ্যে এই ‘অধিকার’ও ছিল ।
তখন কিন্তু ‘অধিকার’এর যিনি কর্তা ব্যক্তি ছিলেন তিনি সরাসরি
জামায়াত-বিএনপি’র রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন না যেমনটি আদিলুর রহমান সাহেব
আছেন বলে জানা যায় । এই বিষয়ে গত বৃহষ্পতিবার জনকণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক
স্বদেশ রায় তার নিয়মিত কলামে বিস্তারিত লিখেছেন তাই এই বিষয়ে লিখে লেখার
কলেবর বৃদ্ধি করতে চাই না ।
যে কারণে আদিলুর রহমান খানকে গ্রেফতার করা হয়েছে তা হচ্ছে গত ৫ মে হেফাজত
নামক একটি মধ্যযুগীয় সংগঠন কর্তৃক রাজধানীর মতিঝিল এলাকা দখল এবং
তৎপরবর্তীকালে তাদের সেখান হতে উৎখাত করতে সরকারের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী
বাহিনীর গৃহীত পদক্ষেপ এবং সেই পদক্ষেপের ফলে ওই রাতে মতিঝিলে কত হাজার
‘ওলামা মাশায়েখ’ নিহত হয়েছেন তার সংখ্যা বিষয়ক বিতর্ককে কেন্দ্র করে । ওই
দিন ও রাতে ঢাকায় হেফাজত আর তাদের ছদ্মবেশে জামায়াত শিবির দেশের অন্যতম
প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি’র মদদে যে নৈরাজ্য চালিয়েছে তা নজির বিহীন ।
পরিকল্পনা ছিল পরদিন তাদের সাথে বিএনপি‘র নেতা কর্মীরা যোগ দেবেন এবং
সরকারকে উৎখাত করে সেখানে ‘আল্লামা’ শফি, বেগম জিয়া আর জুনায়েদ বাবুৃ
নগরী‘র সরকার কায়েম হবে । শুরুতে এমন পরিকল্পনা হয়তো হেফাজতের ছিল না
পরবর্তীকালে তাদের মাথায় সেই পরিকল্পনা ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল । এর আগে
একাধিকবার বলেছি ও লিখেছি হেফাজত হয়তো একটি অরাজনৈতিক সংগঠন কিন্তু তাদের
বোকামীর কারণে তারা কখনযে জামায়াতের পেটে ঢুকে যাবে তা তারা টেরও পাবে না ।
এখন ঠিক তাই হয়েছে । সেই রাতের অপারেশনের পর হেফাজত, বিএনপি, জামায়াত,
একশ্রেণীর মিডিয়া, কিছু জামায়াত পন্থী বুদ্ধিজীবী মাতম শুরু করলেন এই বলে
কেন এই অপারেশন দিনে চালানো হলো না, কেন রাতের অন্ধকারে সব বাতি নিভিয়ে
দিয়ে এই ‘হত্যাযজ্ঞ’ চালান হলো ? বাস্তবে এটি ছিল একেবারেই নিরাপত্তা ও
সন্ত্রাস বিষয়ক একটি কপি বুক অপারেশন যা যে কোন নিরাপত্তা বিশ্লেষক স্বীকার
করবেন । আড়াই হাজার বছর আগে চীন দেশের জগৎ বিখ্যাত কৌশলবিদ সুন জু (ঝঁহ
ঞুঁ) তার বই ‘দি আর্ট অব ওয়ারে’ তা বিস্তারিত লিখে গিয়েছেন । এই বইটি
বিশ্বের সকল নিরাপত্তা ও সমর বিশারদদের জন্য আবশ্যকীয় পাঠ্য । সে রাতে যে
কৌশলটি বাংলাদেশের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবহার করেছেন তাকে সুন জু আখ্যায়িত
করেছেন ‘শক এন্ড অ’ (ঝযড়পশ ধহফ ধবি) হিসেবে । সে রাতের অপারেশন সম্পর্কে
সরকার বলেছে ওই রাতে মতিঝিলে কোন প্রাণ হানি হয়নি । দিনের বেলায় হেফাজত
নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা করলে তাদের সাথে সংঘর্ষে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী
বাহিনীর সদস্য সহ এগারজনের প্রাণহানি হয়েছে । হেফাজত গংরা প্রথমে বলল দশ
হাজার তারপর হাজারে হাজার । ‘অধিকার’ প্রথম দিন বললো পাঁচ হাজার । তাদের
বরাত দিয়ে আল জাজিরা, বিবিসি সহ বিদেশের বিভিন্ন প্রচার মাধ্যম সেই সংবাদ
সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিল । দু’দিন পর ‘অধিকার’ জানাল এই সংখ্যা আড়াই হাজার ।
তারপর সাড়ে চারশত । সর্বশেষ তারা অনুসন্ধান করে তাদের ওয়েব সাইটে পোষ্ট
করলো একষট্টি । কিন্তৃু কারা কখন মারা গেল তাদের পরিচয় সরকারকে জানাতে
অস্বীকার করলো ‘অধিকার’ । এর অর্থ তারা সরকারের একটি যৌক্তিক নির্দেশকে
অমান্য করে দেশের প্রচলিত আইন অমান্য করেছে । গত শুক্রবার অধিকার বলেছে
তারা ‘নিহতের তালিকা’ দেশি বিদেশি পাঁচ প্রতিষ্ঠানকে দিয়েছে । ওই
প্রতিষ্ঠান গুলি শুক্রবার রাত পর্যন্ত তার প্রাপ্তি স্বীকার করে নি । আর
হেফাজত বলেছে ‘নিহতের তালিকা’ অধিকারকে দিয়েছে হেফাজতে ইসলাম । নিজদেশের
সরকারকে না দিয়ে ভিন দেশের প্রতিষ্ঠানকে তালিকা দেয়ার মধ্যে কী কৃতিত্ব
থাকতে পারে তা মোটেও বোধগম্য নয় ।
ভুল বা অসত্য তথ্যের ভিত্তিতে বিদেশে যেমন দেশের ভাব মূর্তির ক্ষতি হয়
তেমনি ভাবে দেশের সাধারণ মানুষেরও জীবন বিপন্ন হতে পারে । যুক্তরাষ্ট্রতো
ইরাকই আক্রমন করে বসলো ভুল তথ্যের ভিত্তিতে ।এই উপমহাদেশে একাধিকবার ভয়াবহ
রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা লাগানো হয়েছে উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে মিথ্যা তথ্য পরিবেশন
করে । অধিকারের মতো একটি মানবাধিকার নামধারী সংস্থা যদি এই ধরণের একটি
গর্হিত কাজ করে তখন তা হয় অমার্জনীয় অপরাধ এবং এই ধরণের অসত্য তথ্য সাধারণ
জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য প্রতিপক্ষ অনায়াশে ব্যবহার করে যা এই ক্ষেত্রে
হয়েছে । গত রমজানের প্রায় প্রত্যেক দিন ইফতারের সময় হেফাজত আমিরের দক্ষিণ
হস্ত বলে পরিচিত, যিনি ৫ মে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন
দেখেছিলেন সেই জুনাইদ বাবুনগরী চট্টগ্রামের হেফাজতের এলাকা বলে পরিচিত
হাটহাজারির বিভিন্ন মাদ্রাসায় গিয়ে ওয়াজ করেছেন এবং তার সারমর্ম ছিল আগামী
নির্বাচনে যেন আল্লাহ ‘জালেম নাস্তিক আওয়ামী লীগ সরকারের হাত হতে ইসলামকে
রক্ষা করেন ।’ একই সাথে তিনি ৫ মে’র রাতে ‘জালেম সরকারের হাতে হাজার হাজার
নিহত হওয়া তৌহিদী জনতার’ রুহের মাগফেরাত কামনা করেন । অনেক মাদ্রাসায় ইফতার
বিতরণ করার জন্য তের ডেগ (বড় ডেকচি) বিরানি রান্না করা হয় এবং বলা হয় এই
তের ডেগ হচ্ছে হেফাজতের তের দফা । যে সরকার তাদের তের দফা মেনে, দেশের সব
মেয়েদের স্কুল কলেজে পড়া আর তৈরী পোষাক শিল্পকারখানায় কাজ করা বন্ধ করে
দেবে, সেনাবাহিনী, পুলিশ সহ অন্যান্য সরকারি চাকুরীতে কর্মরত সকল মহিলাকে
ঝেঁটিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দেবে তাদের নির্বাচিত করার জন্য বাবুনগরী সকলকে
অঙ্গিকার করায় । একজন হেফাজতির কাছে জানতে চেয়েছিলাম ভাই মহিলা চিকিৎসকদের
কী করা হবে, তাদেরতো দরকার । তার সহজ সরল উত্তর কেন আগে যেমন হুজুরদের পানি
পড়া নিতেন এখনো তা নিবেন । আল্লাহর উপর ভরসা রেখে পানি পড়া সেবনে সব
মুস্কিল আসান । তার সাথে তর্ক করি কোন সাহসে ? এখন দেখার বিষয় একবিংশ শতকে
ডিজিটাল বাংলাদেশে এমন উন্মাদ তৈরী করতে বংলাদেশে ‘অধিকারের’ মতো সংগঠন এবং
তাদের সুহৃদরা কত ভাবে অবদান রাখছে ।
সব শেষে অধিকার এবং তার সুহৃদদের কাছে একটি ছোট প্রশ্ন । প্রায়শঃ আমি
বিভিন্ন ব্যক্তি হতে সামাজিক ওয়েবসাইটে প্রাণনাশের হুমকি পাই । তা তেমন
একটা গা করি না কারণ ইতোপূর্বে আমার পূর্বেও কর্মক্ষেত্রে দুবার আমার
প্রাণনাশের চেষ্টা করা হয়েছে । সম্প্রতি মোরশেদুল হক (আসল নাম না হওয়ার
সম্ভাবনা বেশী) একজন ফেইস বুকে আমার উদ্দেশ্যে লিখেছে ‘ওহে মিথ্যাবাদী, ওহে
খবিশ, আল্লাহকে স্মরণ কর । সময় ফুরিয়ে আসছে ।’ এখন এই ‘খবিশ’টার যদি কিছু
হয় তা হলে ‘অধিকার’ কী কার অধিকার রক্ষা করবে ? আদিলুর রহমান খান গ্রেফতার
হওয়ার কারণে তার খ্যাতি দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বময় ছড়িয়ে গেছে । সরকারের
উচিৎ তাকে আর বিনা বিচারে আটকে না রেখে দ্রূত তাঁর ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ
করা । গত চার বছরে বাংলাদেশে অনেকে জিরো থেকে হিরো হয়েছেন । এখন আর বোধ হয়
এমন হিরোর প্রয়োজন নেই।
লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় । আগষ্ট ১৭, ২০১৩
WARNING:
Any unauthorized use
or reproduction of
'Community' content is
strictly prohibited
and constitutes
copyright infringement
liable to legal
action.
[প্রথমপাতা] |
লেখকের আগের লেখাঃ
|