@
@
@
@
@ |
@
দলের কিছু মানুষই শেখ
হাসিনার অস্বস্তির কারণ
প্রফেসর আবদুল মান্নান
একটি প্রথম শ্রেণীর জাতীয় দৈনিকের এক অনুজপ্রতিম সাংবাদিক বন্ধুর সাথে
ধানমন্ডির রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটছিলাম । হাঁটতে হাঁটতে সে বললো তার আশঙ্কা
হচ্ছে দেশে অশুভ কিছু একটা হতে যাচ্ছে । জানতে চাই তার এমন ধারণার হেতু কী
? সে কয়েকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে । প্রথমটি সাউথ সাউথ পুরস্কার আনতে আর
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিদেশ না
যাওয়ার সিদ্ধান্ত । তাকে বলি সাউথ সাউথ পুরস্কার এর আগেও শেখ হাসিনা
পেয়েছেন । এবার তাঁর ছেলে এবং প্রধানমন্ত্রীর অবৈতনিক তথ্য উপদেষ্টা সজীব
ওয়াজেদ জয় তাঁর পক্ষ হয়ে এই পুরষ্কার গ্রহণ করেছেন । অক্সফোর্ড
বিশ্ববিদ্যালয়ের বক্তৃতা যে কোন সুবিধা মতো সময়ে পুননির্ধারণ করা যাবে ।
সরকারি ভাবে জানানো হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শারীরিক ভাবে অসুস্থ । যারা
প্রধানমন্ত্রীর কাজের ধরণ সম্পর্কে কিছুটা জানেন তারা স্বীকার করবেন তাঁর
সাথে কাজ করে তাল রাখা খুবই দুরুহ । কিছুদিন আগে জাপান সফরে তাঁর সফর সঙ্গী
হয়ে তা টের পেয়েছি । আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বর্তমান মন্ত্রী সভায় যোগ দেয়ার
পূর্বে একবার বলেছিলেন শেখ হাসিনার সাথে কাজ করতে গেলে সব সময় দৌড়ের উপর
থাকতে হয় । মঞ্জু শেখ হাসিনার ১৯৯৬-২০০১ সরকারের মন্ত্রী সভায় সরকারের
যোগাযোগ মন্ত্রী ছিলেন । পারিবারিক ভাবেও দুই পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক
বঙ্গবন্ধু আর মানিক মিয়ার সময় হতে । যারা শেখ হাসিনার খুবই কাছের মানুষ
তাদের অনেককেই বলতে শুনেছি তিনি দুfথেকে তিন ঘন্টার বেশী ঘুমান না । শুক্র
শনিবারে দলীয় কর্মকান্ডে অংশগ্রহন ছাড়াও তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ফাইল সই
করেন, সিদ্ধান্ত দেন । তিনি নেপালে গিয়েছিলেন সার্ক সম্মেলনে অংশ নিতে ।
শেষ দিন সার্কের অন্যান্য সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানদের সাথে তার অবকাশ
কর্মসূচিতে যোগ দেয়ার কথা ছিল । যেতে পারেন নি কারণ তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে
পরেছেন । কেউ কেউ বলেন শেখ হাসিনা নিজের উপর অতি মাত্রায় জবরদস্তি করেন ।
অনেকের মতো শেখ হাসিনা একজন নিংসঙ্গ শেরপা । রাষ্ট্রের সব গুরুত্ব পূর্ণ
দায়িত্ব ও কাজ নিজেকেই সামাল দিতে হয় । কথাটি হয়তো ভুল নয় । সাংবাদিক
বন্ধুকে বলি তার বিচলিত হওয়ার কিছু নেই ? মনে হলো না সে শঙ্কা মুক্ত । বলে
আরো বেশ কিছু সাম্প্রতিক ঘটনা তাকে ভাবিয়ে তুলেছে । প্রথমে তারই দলের একজন
মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রী যিনি আবার আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় গুরুত্বপূর্ণ
দায়িত্ব পালন করেছেন সেই এয়ার ভাইস মার্শাল (অব) এ কে খন্দকার, বীর উত্তমের
একটি চরম বিভ্রান্তি মূলক আত্মজীবনী মূলক বই eভেতরে বাইরেf অনেক মীমাংসিত
সত্যকে পুনরায় উস্কে দিয়েছে । খন্দকার সাহেবের বইয়ের আগে বাংলাদেশের প্রথম
প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিনের আহমদের কন্যা শারমিন আহমদ সিমির একটি বই
বাজারে আসে এবং তাতে তিনি লেখেন ২৫ মার্চ রাতে তার বাবা তাজউদ্দিন আহমেদ
বঙ্গবন্ধুর কাছে স্বাধীনতার একটি ঘোষণা পত্র নিয়ে গিয়েছিলেন যা বঙ্গবন্ধু
স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করেন । মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন শারমিনের বয়স
এগার । তিনি বইটি পরিবারের লোকজনের কাছ হতে শুনে লিখেছেন । প্রকাশ করেছেন
তরা মা বেগম জোহরা তাজউদ্দিনের মৃত্যুর পর । খন্দকার সাহেব বইটি নিজে লেখেন
নি, অন্য আরেক জনকে ডিক্টেট করেছেন, তিনিই লিখেছেন । খন্দকার আর শারমিন শেখ
হাসিনার অত্যন্ত কাছের মানুষ ছিলেন । শারমিন যদিও বিদেশে থাকেন তার
পরিবারের সাথে শেখ পরিবারের সম্পর্ক সেই পঞ্চাশের দশক হতে । শারমিন সম্ভবত
একজন মিশরীয়কে বিয়ে করেছেন, থাকের যুক্তরাষ্ট্রে এবং কট্টর মৌলবাদী সংগঠন
মুসলীম ব্রাদারহুডের সমর্থনে কায়রোর তাহরির স্কয়ারে হুসনি মুবারক উৎখাত
আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন । এই দুই জনের লেখনি শেখ হাসিনার প্রতিপক্ষ
শিবিরের হাতকে কিছুটা হলেও শক্তিশালী করেছে । এই সবের রেশ না ফুরাতেই নিউ
ইয়র্কে ইসলামের অন্যতম ফরজ কাজ পবিত্র হজ আর তবলিগ জামায়াত নিয়ে অযাচিত ভাবে
সমালোচনা করলেন শেখ হাসিনারই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দীকি ।
সিদ্দীকি পরিবার টাঙ্গাইলের একটি অতি পরিচিত রাজনৈতিক পরিবার । এই পরিবারের
দুই ভাই আবদুল লতিফ সিদ্দীকি আর আবদুল কাদের সিদ্দীকি, বীর উত্তম, বাংলাদেশে
বেশ পরিচিত নাম । দুজনই একাধিকবার জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন ।
কাদের সিদ্দীকি বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয়ে ছিলেন । ১৯৯১
সনে এরশাদ পতনের পর দেশে ফিরে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়নে জাতীয় সংসদে সদস্য
নির্বাচিত হয়েছিলেন । বর্তমানে তিনি শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের একজন বড়
মাপের সমালোচক । লতিফ সিদ্দীকি শুধু একজন ডাকসাইটে মন্ত্রীই ছিলেন না তিনি
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্যও ছিলেন । মন্ত্রী থাকা কালিন জন্ম দিয়েছেন
অনেক সমালোচনার । নিন্দিত হয়েছেন ক্ষমতার অপব্যবহার আর দূর্নীতির কারণে ।
নিউ ইয়র্কে তার দেয়া বালখিল্য সূলভ মন্তব্য শুধু সরকারকেই বিব্রত করে নি,
ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছে । অথচ তিনি নিজে হজ
করেছেন এবং এই বছর দুfএকজনকে হজে পাঠিয়েছেন । তাঁর নিউ ইয়র্ক সফর
প্রধানমন্ত্রীর সফর সঙ্গী হিসেবে প্রচার করা হলেও তা ছিল ভিন্ন এক সফর ।
তিনি মেক্সিকোতে যাচ্ছিলেন বাংলাদেশের পক্ষে একটি পুরষ্কার গ্রহণ করতে । পথে
নিউ ইয়র্কে যাত্রা বিরতি । সেখানে তিনি এক সংবর্ধনা সভায় হজ আর তবলীগ
জামায়াত সম্পর্কে আপত্তিকর উক্তি করে নিন্দিত হলেন । তার বক্তব্যকে কেন্দ্র
করে বিরোধী দল রাজনৈতিক মাঠ উত্তপ্ত করতে উদ্যোগী হলে প্রধানমন্ত্রী তার
বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে সেই উদ্যোগে পানি ঢেলে দিয়েছেন । দলের
প্রেসিডিয়াম পদ ও মন্ত্রীত্ব দুfটাই তিনি হারিয়েছেন । বাকি রইরো সংসদ সদস্য
পদ । সেটিও হয়তো তাকে হারাতে হতে পারে । তিনি আচমকা দেশে ফিরে সকলকে হকচকিয়ে
দিয়েছেন এবং অনেকের মতে সরকারকে বিব্রত করেছেন । তবে তিনি আইনের প্রতি
শ্রদ্ধাশীল থেকে আইনের কাছে পরদিন আত্মসমর্পন করেছেন । সম্ভবত এই ক্ষেত্রে
তিনি প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ়তা আঁচ করতে পেরেছিলেন । তার দেশে আসাকে কেন্দ্র করে
বিএনপি হেফাজতে ইসলাম ও অন্যান্য ইসলামী দলকে সামনে রেখে পানি ঘোলা করার
পরিকল্পনা সাজিয়ে এনেছিল । লতিফ সিদ্দীকি গ্রেপ্তার হওয়াতে তাও মাঠে মারা
গেল । কিন্তু দূর্ভাগ্যের বিষয় তাকে যখন আদালতে হাজির করা হয় তখন রাজাকার আ
ন ম ইউসুফের পূত্র বিএনপি নেতা আ্যডভোকেট আবেদ রেজার নেতৃত্বে তার প্রতি
নজিরবিহীন ভাবে জুতা প্রদর্শন করা হয় । এটি অনেকটা গোলাম আযমের কফিনে
বাঁধনের জুতা নিক্ষেপের প্রতিশোধ নেয়ার মতো এবং এই সুযোগ করে দিয়েছেন লতিফ
সিদ্দীকি । লতিফ সিদ্দীকির বিরুদ্ধে যে কটি মামলা হয়েছে তার একটি করেছেন এই
আবেদ রেজা । এই মামলা প্রমাণিত হলে লতিফ সিদ্দীকির সর্বোচ্চ সাজা হবে
দুfবছর । তবে লতিফ সিদ্দীকি নিশ্চিত ভাবে শেখ হাসিনা সরকারের ভাবমূর্তির
ক্ষতি করেছেন ।
কিছু দিন আগে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম ছাত্রলীগের এক সমাবেশে
গিয়ে অপ্রাসঙ্গিক কিছু কথা বলে সরকারকে বিব্রত করেছেন । এইচ টি ইমাম একজন
জাঁদরেল আমলা । তাঁর বুঝা উচিৎ কোথায় কী কথা বলতে হবে । তাঁর বক্তব্যে
সরকারতো বিব্রত হয়েছেনই নিজ দলের ভিতরই তিনি তুমুল ভাবে সমালোচিত হয়েছেন ।
এমন কী তাঁর বক্তব্য ও ছাত্রলীগের ইদানিং কালের কর্মকান্ড নিয়ে
যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত দৈনিক নিউ ইয়র্ক টাইমস সম্প্রতি একটি
উপ-সম্পাদকীয়ও প্রকাশ করেছে । ছাত্রলীগ নামধারিদের দূর্বৃত্তপনা নিয়ে যত কম
আলোচনা করা যায় তত ভাল । তারা আলোচনায় আসলেই কেউ কেউ বলে থাকেন কেন ছাত্র
শিবিরের সন্ত্রাস দেখেন না ? তাদেরতো বুঝতে হবে ছাত্র শিবিরের জন্মই হয়েছে
সন্ত্রাস সৃষ্টির উদ্দেশ্যে । এই সংগঠনটিকে বিশ্বের তৃতীয় ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী
সংগঠন হিসেবে বৃটেনের জেনস ডিফেন্স উইকলি স্বীকৃতি দিয়েছে । বঙ্গবন্ধুর হাতে
গড়া ছাত্রলীগকে কেন ছাত্র শিবিরের সমপর্যায়ে নামিয়ে আনতে হবে ? তারা কেন
বিএনপিfর ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবকে মির্জা ফখরুলকে বলতে সুযোগ দিবে e২০ দলিয়
জোট নয় ছাত্রলীগই আওয়ামী লীগের বিষফোঁড়াf?
অনেকে প্রশ্ন করেন আওয়ামী লীগের ভিতর কী আরো লতিফ সিদ্দীকি বা এ কে খন্দকার
আছেন ? বা এইচ টি ইমাম? নাই এ কথা সম্ভবত আর বলা যাবে না । যখন এই দুfজন
বড়মাপের নেতা দল আর সরকারকে তাদের লেখনি বা বক্তব্যের কারণে বিব্রত করতে
পারেন কfদিন পর আর একজন বা দুfজন যে তা করবেন না সেই নিশ্চয়তা কী ভাবে দেয়া
যাবে? তা হলে শেখ হাসিনাকে কী একাই তাঁর ও সরকারের বিরুদ্ধে দেশী বিদেশী
চক্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে? আপাতত তো তাই মনে হচ্ছে । তার
বিকল্প হচ্ছে শেখ হাসিনাকে তাঁর কাছের আস্থা ভাজন মানুষ সম্পর্কে আরো সজাগ
থাকতে হবে। প্রয়োজনে এদের কাউকে কাউকে ছাঁটাই করতে হতে পারে । কী করবেন এই
সিদ্ধান্ত একান্ত ভাবে তাঁর । সব কিছু ঠিক ঠাক থাকলে তাঁকে বর্তমান সরকারকে
আরো পাঁচ বছর কার্যকর ভাবে টিকিয়ে রাখতে হবে । এর জন্য জনগনের আস্থাকে ধরে
রাখার কোন বিকল্প নেই ।
লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় । ২৮ নভেম্বর, ২০১৪
@
@
WARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
@
[প্রথমপাতা] |
@
@
@
লেখকের আগের লেখাঃ
[......লেখক আর্কাইভ]
|