|
সাকিব আল হাসান যেন স্বর্গেই ফিরে আসেন
প্রফেসর আবদুল মান্নান
বাংলাদেশ ক্রিকেটের উজ্জ্বল নক্ষত্র সাকিব আল হাসান । ক্রিকেট দুনিয়ার
মোটামুটি একটি অতি পরিচিত নাম । বিশ্বের সেরা অল-রাউন্ডার । অনেক কঠিন সময়ে
বাংলাদেশের ত্রাতার ভ’মিকায় অবতীর্ন হয়েছেন । মাঠে নামলে গ্যালারি ভর্তি
দর্শক উদ্বেলিত হন । ভারতের আইপিএল‘এ এই মুহুর্তে বাংলাদেশের একমাত্র
নন্দিত ক্রিকেটার । কোলকাতা নাইট রাইডার্সকে খাদের কিনারা হতে উদ্ধার
করেছেন বেশ কয়েকবার । বিভিন্ন ভোক্তা পন্য প্রস্তুতকারি প্রতিষ্ঠানগুলির
কাছে বেশ সমাদ্রিত একজন মডেল । শৃংখলা ভঙ্গের অভিযোগে গত সোমবার বাংলাদেশ
ক্রিকেট কন্ট্রোল বোড, বিসিবি, তাঁকে বেশ কঠোর শাস্তি দিয়েছে। সাকিব আগামী
ছয় মাস কোন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে পারবেন না আর বিদেশে গিয়ে কোন
ক্রিকেট খেলায় অংশ গ্রহনও করতে পারবেন না দেড় বছর । সাকিবের এই সাজা নিয়ে
দেশের ক্রিকেট প্রেমীরা দুই ভাগে বিভক্ত । কারো মতে এটি সাকিবের মতো একজন
খেলোয়াড়কে ধ্বংস করার গভীর ষড়যন্ত্র । কেউ কেউ আবার এটাকে বাংলাদেশে
ক্রিকেট ধ্বংস করারও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন । অবশ্য
সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশে ক্রিকেটের যে ছত্রভঙ্গ অবস্থা তাতে ধ্বংস করার
মতো তেমন কিছু একটা নেই । আবার সারা দেশে মানব বন্ধন করার ডাক দিয়েছেন তার
ভক্তরা । একদল আবার প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপও কামনা করেছেন । কয়েকজন
বলেছেন সাকিবের উচিৎ এখন উনিশ দলের সরকার বিরোধী আন্দোলনের সাথে একাত্মতা
প্রকাশ করা । বিসিবি প্রধান নাজমুল হক পাপন ও সিলেক্টর আকরাম খান কেন সাজা
হতে বেঁচে গেলেন তাও জানতে চেয়েছেন অনেকে । একাধিক জন বলেছেন বিসিবি ভেঙ্গে
দিলে ক্রিকেটের কোন ক্ষতি বৃদ্ধি নেই । একজন জন নন্দিত অভিনেত্রী প্রশ্ন
করেছেন সাকিব তার স্ত্রী শিশিরের উত্যক্তাকারিদের শায়েস্তা করেছেন তার
জন্যই কী তার বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা ? অন্য দিকে আর একটি গোষ্টি বলেছেন
সাকিব নিজের ব্যক্তি স্বার্থে জাতীয় স্বার্থকে উপেক্ষা করে দেশকে অপমান
করেছেন । এই সাজা তার প্রাপ্য ছিল । সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এই সব মত আর
মতামতে সয়লাব । চলবে আরো কিছু দিন । যারা এই বিষয় নিয়ে রাতের ঘুম হারাম
করছেন তাদের একটু পিছনের দিকে নিয়ে গিয়ে ক্রিকেটে কেরী প্যাকারের জমানার
যৎসামান্য কাহিনী শুনাতে চাই কারণ বর্তমান প্রজন্মের ক্রিকেট ভক্তদের কছে
কেরী প্যাকার তেমন একটা পরিচিত নাম নাও হতে পারে ।
অস্ট্রেলিয়ার ধনকুবের কেরী প্যাকার । বলা হতো গনযোগাযোগ মাধ্যমের বাদশা ।
মিডিয়া মোগল । অস্ট্রেলিয় ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের কাছে আবদার করলেন তিনি
অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত সকল ক্রিকেট খেলা প্রচারের জন্য একক অধিকার চান তাঁর
মালিকানাধিন চ্যানেল-নাইনের জন্য । সেটি ১৯৭৬ সালের কথা । রাজি হলো না
অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড । প্যাকরা জাত ব্যবাসায়ী । ঠিক করলেন
পরের বছর তিনি নিজেই বিভিন্ন দেশের খেলোয়াড়দের নিয়ে ওয়ার্লড ক্রিকেট সিরিজ
শুরু করবেন । টিম বানাবেন বিশ্ব সেনা ক্রিকেটারদের দিয়ে । রাতে দিনেও খেলা
হবে । সে এক অদ্ভুত কান্ড । সেই খেলা তিনি তার টিভি চ্যানেলে প্রচার করবেন
। প্রমাদ গুনলো আইসিসি সহ সব দেশের ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড । ব্যতিক্রম শুধু
ক্যারবিয়য়া । দেশটির আর্থিক অবস্থা ভাল নয় । টাকা কড়ির টানাটানি ।
খেলোয়াড়দের ঠিক মতো বেতন দিতে পারে না । তাদের অর্থ প্রয়োজন । অন্যান্য
দেশের বোর্ড গুলি ফরমান জারি করলো তাদের খেলোয়াড়দের প্যাকারের এই ‘ক্রিকেট
সার্কাসে’ অংশগ্রহণের বিরুদ্ধে । কে শুনে কার কথা । টাকা বলে কথা । ছুঠলেন
সকলে অস্ট্রেলিয়ার দিকে । একমাত্র ব্যতিক্রম ভারতীয় ক্রিকেটররা । পরে জানা
গিয়েছে সুনিল গাভাস্কার ও বিষেণ সিং বেদীও নাকি খেলার জন্য সই করেছিলেন
কিন্তু বিসিসিআই’র নিষেধাজ্ঞার কারণে ওই পথে আর পা বাড়ান নি । আত্ম সম্মান
বলে কথা । টনি গ্রেগ, ভিব রিচার্ডস, গ্রেগ চ্যাপেল, ববি সিম্পসন, ইমরান খান,
মাইকেল হোলডিং, এন্ডি রবার্টাস, ডেনিস লিলি, রোহান কানাই, ইয়েন চ্যাপেল সহ
অনেকে বললেন তারা খেলবেন এই সাড়া জাগানো ‘প্যাকার সার্কাসে’। । শ্লোগান লেখা
হলো ‘ভাল ছেলেরা রাতে খেলে’ (এড়ড়ফ মুঁং ঢ়ষধু ধঃ হরমযঃ) । আইসিসি জানিয়ে দিল
তারা এই খেলার কোন স্বীকৃতি দেবে না । আর ক্যারবিয় বোর্ড ছাড়া অন্য সকল
বোর্ড শাস্তি হিসেবে এই খেলোয়াড়দের জাতীয় দল হতে বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিল ।
পাকিস্তান দল হতে বাদ গেল দুনিয়া কাঁপানো ফাস্ট বোলার ইমরান খান । পদচ্যুত
হন অস্ট্রেলিয়ার ক্যাপ্টেন গ্রেগ চ্যাপেল । ১৯৭৯ এর ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত
বিশ্বকাপে আর এর পর ছয় টেষ্টের ভারত সিরিজে গ্রেগ চ্যাপেল সহ ‘প্যাকার
সার্কাসের‘ কোন খেলোয়াড়ই অংশ নিতো পারে নি । ইংল্যান্ড সফরে সুপার ষ্টার
ইমরান খানও বাদ পরলেন । ১৯৭৯ সালের পর বিভিন্ন দেশের ক্রিকেট কন্ট্রোল
বোর্ডের শক্ত অবস্থানের কারণে ‘প্যাকার সার্কাসের’ সমাপ্তি ঘটে । ক্রিকেটে
অর্থের খেলা আপাততঃ পরিসমাপ্তি । তবে এখনো প্যকারকে চট জলদি ক্রিকেটের, মানি
সীমিত ওভার ক্রিকেটের জনক বলা হয় । প্রশ্ন, যে সব ক্রিকেটার ‘প্যাকার
সার্কাসে’ খেলার জন্য নিজ নিজ দেশে সাজা পেয়েছিলেন সাকিব আল হাসান তাদের
চেয়ে কী বড় ক্রিকেটার ? দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য তাদের সকলকে এমন কঠোর সাজা
পেতে হয়েছিল যদিও কেউ কেউ পুনরায় আবার জাতীয় দলে ফিরে এসেছিলেন ।
ফিরে আসি সাকিব আল হাসানের মামলায় । বিসিবি‘র কাছ হতে ছুঠি না নিয়ে তিনি
খেলতে যাচ্ছিলেন ক্যারবিয় ক্রিকেট লীগে । বিসিবি‘র তিনি একজন বেতনভূখ
খেলোয়াড় । একজন মন্ত্রী দেশের বাইরে গেল প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর হতে ছুঠি নিতে
হয় । একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য একদিনের জন্যও দেশের বাইরে গেলে তিনি
রাষ্ট্রপতির কাছ হতে ছুঠি নেন । আবেদন যায় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর হয়ে । শেখ
হাসিনার ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদ কালে একজন মন্ত্রী ছুঠি না নিয়ে এক দিনের জন্য
ব্যবসায়িক কাজে সিঙ্গাপুর গেলে তাঁকে মন্ত্রী সভা হতে পদত্যাগ করতে হয় ।
সাকিব আল হাসানকে যখন মনে করিয়ে দেয়া হয় তিনি নিয়ম অনুযায়ী ছুঠি না নিয়ে
বিদেশে খেলতে যাচ্ছেন তিনি তার উত্তরে বলেন বাংলাদেশের হয়ে তিনি আর কখনো
ক্রিকেট খেলবেন না । বাংলাদেশ টিম যখন খেলতে মাঠে নামে নিশ্চয় সাকিব
গ্যালারিত এদেশের দর্শকদের উত্তেজনা দেখেছেন । দেখেছেন জিতলে বাঁধ ভাঙ্গা
জোয়ারের মতো উল্লাস, যা বঙ্গপোসাগরের ঢেউয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে আকাশ কাঁপায়।
পরাজিত হলে ভক্তদের শিশুর মতো কান্না শুনেছেন । আমাদেও চট্টগ্রামের খেলা
পাগল ইউসুফ গনি বাংলাদেশ যেখানেই খেলতে গিয়েছে সেখানে তিনি নিজের গাঁটের
পয়সা খরচ করে তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত টিমের আগে পৌঁছে গিয়েছেন । ১৯৭২ সালে
কোলকাতার মোহনবাগান টিম এসেছিল সদ্য গঠিত বাংলাদেশ ফুটবল টিমের সাথে একটি
ম্যাচ খেলতে । বেলা দু’টার আগেই বঙ্গবন্ধু জাতীয় ষ্টেডিয়াম (তখন ঢাকা
ষ্টেডিয়াম) কানায় কানায় পূর্ণ । বাংলাদেশের কাছে হেরে গেল ২-০ গোলে
মোহনবাগান । কোলকাতার আনন্দ বাজার পত্রিকায় বিখ্যাত ক্রীড়া সাংবাদিক মতি
নন্দি লিখলেন ‘ঢাকায় মোহনবাগান পরাজিত হলো ১১+ ৪০,০০০ বাঙালির কাছে ।’ আজ
অবদি মতি নন্দির মতো এত উঁচু দরের ক্রীড়া সাংবাদিক উভয় বাংলায় আর জন্মায়নি
।
লেখাটা শেষ করি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হতে সংগৃহিত সাকিব বিষয়ে একটি
ষ্টাটাস দিয়ে । ষ্টাটাস প্রদানকারি লিখছেন ‘ব্যক্তি বড় না দেশ আর টিম?
ব্যক্তি বড় হলে আজকেই বিসিবি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ওখানে সাকিবের মূর্তি স্থাপন
করুন । দেশ আর টিম বড় হলে দায়িত্বপ্রাপ্তদের দায়িত্ব পালন করতে দিন । এবানই
সব চেয়ে বেশী সাবেক ক্রিকেটার বোর্ডের সদস্য । তাঁরা নিশ্চয় আপনার আমার চেয়ে
এদেশের ক্রিকেটকে কম ভালবাসেন না । ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফির একটা ম্যাচ
বৃষ্টি বিঘিœত হবার পর জমে থাকা পানি সরাতে নিজে তোয়ালে নিয়ে মাঠে
নেমেছিলেন সাবেক অধিনায়ক ও তখনকার ম্যানেজার গাজী আশরাফ হোসেন লিপু । তিনি
তখন আমাদের মতো ‘ড্যাম, ইটস ওয়াটরালগড’ পোস্ট দিয়ে দায় সারেন নি । সেই
ম্যাচ জিতেছিল বাংলাদেশ, সেই জয়েরই হাত ধরেই এসেছিল বিশ্বকাপের টিকেট ও
আজকের গ্লামারাস টাইগার ক্রিকেট । লিপুর কমিটমেন্ট নিশ্চয় আমার আপনার থেকে
কম না । ১৯৯৬এ লীগের জন্য মাঠ না পাওয়ায় বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করার
দুশ্চিন্তার মধ্যে প্রতিবাদ স্বরূপ এই আকরাম, দুর্জয়, আতাহারেরা
প্রেসক্লাবের সামেনে ব্যাটবল হাতে প্রতিবাদে নেমেছিলেন । তাঁদের কমিটমেন্ট,
তাঁদের আবেগের জোরেই এক সময় তিল তিল করে ও পরে বিস্ময়কর গতিতে হাজির আজকের
গ্লামারাস টাইগার ক্রিকেট । শৃংখলা ছাড়া টীম গেম হয় না । সাকিব স্বীকার
করেছেন তাঁর ভুলের কথা । এই সবের মধ্যে আবার বিনা কারনে নুতন কোচকেও টেনে
আনা হয়েছে । সাকিব সম্ভবত বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম বিগার দ্যান লাইফ সাইজ
ক্যারেক্টর । দেশের অগুনতি মানুষ নিঃশর্ত ভাবে সাকিবের ভক্ত । নাজমুল হাসান
পাপন ক্রিকেট বা সাকিবকে কতটুকু ভালবাসেন বা তাঁর জন্য করেছেন তা হয়তো
অনেকেই খবর রাখেন না । আশরাফুলকে গড়ে তোলার পিছনে পর্দার অন্তরালে নাজমুল
হাসান পাপনের অবদান অতুলনীয় । সময় মতো আশরাফুলকে সংশোধন না করাতে এখন তিনি
নায়ক হতে ক্রিকেটের একজন খলনায়ক । বিসিবি পরিচালিত হয় নির্বাচিত সদস্যদের
দ্বার । অনেক সংস্কার আর স্বচ্ছতা দরকার । পেশাদারিত্বের পথে, শৃংখলার পথে
তাঁদের নিজেদের যেতে হকে অনেক দুর । তাদের কাজে বাধা দিলে কোন সংস্কার হবে
না । একদিন আমাদের দশা হবে হতচ্ছাড়া পাকিস্তান ক্রিকেটের মতো । নিশ্চয় আমরা
সকলে টাইগার ক্রিকেটারদের ভাল চাই ।’ পোস্টটা যিনি লিখেছেন তাঁর কাছে
কৃতজ্ঞ । সাকিব তাকে দেয়া সাজার বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবেন । তখন নিশ্চয়
বোর্ড তা বিবেচনা করবে । পবিত্র ধর্ম গ্রন্থে আছে দম্ভ, লোভ আর অহংকার
মানুষের পতন অনিবার্য করে তুলে । তবে একটা কথা মনে রাখা ভাল দেশ প্রেম
নিরানব্বই ভাগ হয় না । একশত ভাগ হতে হয় । একাত্তর পরবর্তি প্রজন্মের
সন্তানদের কাছে দেশের মানুষের আশা প্রত্যাশা আকাশচুম্বি । সাকিব আল হাসান
ক্রীড়া জগতের স্বর্গে ছিলেন । কামনা করি তিনি তাঁর সেই স্বর্গেই আবার ফিরে
আসবেন । এই যাত্রা যেন তাঁর স্বর্গ হতে বিদায় না হয় ।
লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় । জুলাই ৯, ২০১৪
WARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
[প্রথমপাতা] |
লেখকের আগের লেখাঃ
[......লেখক আর্কাইভ]
|