[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

কোলকাতা নেই কোলকাতাতে

 

 

প্রফেসর আবদুল মান্নান

ভারত উপমহাদেশতো বটেই বিশ্বে এসন মানুষ কম আছে যারা পশ্চিম বঙ্গের রাজধানী কোলকাতার নাম শোনেন নি । ১৯১১ সন পর্যন্ত এটাই ছিল বৃটিশ ভারতের রাজধানী । কোলকাতা তখন লন্ডনের চেয়ে অনেক উন্নত শহর । এই শহরের সাথে তুলনা হয় তেমন শহর সম্ভবত বিশ্বে আর দুটি ছিলনা । কালক্রমে সেই শহর অনেকটা ক্ষয় রোগীর মতো ধুঁকে ধুঁকে মরছিল । ১৯৭২ সালে প্রথমবার কোলকাতা গিয়ে মনে হয়েছিল আফ্রিকার কোন এক অনুন্নত দেশের শহর । লোড শেডিং শব্দটি প্রথমবার পরিচয় এই কোলকাতায় । তখন বাংলাদেশের মানুষকে ওপারের বাঙালিরা বলতো ‘জয় বাংলার’ লোক । সোজা কথা নয় মাছে ভাতে বাঙালি নিজেদের জন্য একটা গোটা দেশকেই যুদ্ধ করে স্বাধীন করে ফেলেছে । এই পারের বাঙালদের তখন কদরই আলাদা । প্রথম বছর দুইতো কোন পাসপোর্ট ভিসাই ছিলনা । একশত টাকা দিলে সরকারের পাসপোর্ট অফিস একটা পারমিট মিলতো আজমিড় দিল্লী যাওয়ার জন্য । সেটা দেখালেই বনগাঁ পার হয়ে সীমান্তের ওপার । তার পর মুরগীর মতো গাদাগাদি করে ট্রেনে শিয়ালদা ষ্টেশন । সেখান হতে অন্য কোথাও যাওয়া একমাত্র ভরসা টানা রিকশা অথবা এম্বেসেডর ট্যাক্সি । কুড়ি টাকা দিয়ে শিয়ালদা হতে বন্ধুর বাড়ী শ্যামবাজার গিয়েছিলাম । পথ যেন আর শেষ হয় না । বদলে যেতে দেখেছি সেই কোলকাতাকে গত চল্লিশ বছরে । বদলের প্রথম পদক্ষেপ কোলকাতার মেট্রো রেল । কেন্দ্রে তখন রেল মন্ত্রী মালদাহের গনি খান চৌধুরী । কেন্দ্র হতে টাকা বরাদ্দ দিলেন রাজ্যের এই মেট্রোর জন্য । অন্যরাজ্যগুলির সেই কি প্রতিবাদ । পরিবেশবাদী আর বামরা বললেন কংগ্রেস সরকার দিলতো কোলকাতার সব ঐতিহ্যকে শেষ করে । লাল ঝা-াধারীরা বললেন এই এক মেট্রো কোলকাতার পরিবেশের বারটা বাজাবে । জমির মালিকরা বলল জান দেবতো মেট্রোর জন্য জমি দেব না । শেষ পর্যন্ত কেন্দ্র সরকার জনগণকে বোঝালেন কেন এই মেট্রো প্রয়োজন । বামদের বোঝানো হলো বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মেট্রো কিন্তু মস্কোয় । মস্কোর কথা বললে তখন বামরা চুপ মেরে যেত । কংগ্রেস ঠাট্টা করে বলতো মস্কোয় বৃষ্টি হলে কোলকাতার বামরা ছাতা মেলে ধরে । সেই মেট্রো শেষ করতে বারবছর কোলকাতার মানুষ কষ্ট স্বীকার করেছে । এখন কোলকাতার মানুষ গর্ব করে বলে ভাগ্যিস আমাদের গনি খানের মতো একজন মন্ত্রী ছিলেন । এখন সস্তায় দু’ঘন্টার পথ কুড়ি মিনিটে যাওয়া যায় ।
বছর খানেক পর এবার কোলকাতায় পদার্পণ করে দেখি সেই পুরানো নেতাজি সুভাস বোস বিমান বন্দর কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গেছে। তার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে এক বিশাল অত্যাধুনিক বিমান বন্দর যার পুরোটাই নির্মিত হয়েছে স্টিল, কাঁচ আর এ্যালুমিনিয়াম দিয়ে । ভুল জায়গায় এসে পরিনিতো ? না বিমান বন্দরের লোকজন বাংলায় কথা বলছে । দিক নির্দেশনাগুলিও হিন্দির পাশাপাশি বাংলায় । ইমিগ্রেশন মহিলা একজন দার্জিলিং কন্যা । হাসি দিয়ে বিচিত্র একসেন্টে যথারীতি নাম ঠিকানা জানতে চাইলেন । বলি সুন্দর বিমান বন্দর । কথা না বাড়িয়ে পাসপোর্টে সীল মেরে বললেন ভাল থাকবেন । বাহ, পরিবর্তনটাতো বেশ হয়েছে বলতে হয় ।
আগে থেকে কথা ছিল সাংবাদিক বন্ধু সুনিলের সাথে পরদিন দুপুরে খাব । ফোন করি তাকে । সুনিল বলে সে দুঃখিত কাল, মানে ৫ অক্টৈাবর দুপুরে আসতে পারবে না কারণ কাল পশ্চিম বঙ্গের রাজধানী স্থান্তরিত হচ্ছে । বলে কী সুনিল ? কোলকাতার অনেক কিছুই গত কয়েক দশকে পরিবর্তন হয়েছে ঠিক কিন্তু খোদ রাজধানীটাই স্থান্তরিত হয়ে যাবে ? বলি ঠাট্টা রেখে আসল কথা খুলে বলতে । বলে কাল পশ্চিম বঙ্গের প্রশাসনের প্রাণ কেন্দ্র এবং মুখ্য মন্ত্রীর দপ্তর ঐতিহাসিক ‘মহাকরন’ ছেড়ে দূরে হাওড়া জেলায় অত্যাধুনিক ‘এইচআরবিসি’ ভবনে যাচ্ছে । দিদি মানে পশ্চিম বঙ্গের মুখ্য মন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি সেই ভবনের আদুরে নাম দিয়েছেন ‘নবান্ন’ । ‘নবান্ন’ কাগজে পত্রে হাওড়ায় হলেও চৌদ্দতলা এই সম্পূর্ণ কাঁচে ভরা ভবন হতে দেখা যাবে এক কালের ভারতবর্ষের রাজধানী কোলকাতা। মহাকরণ হতে এগারটি মন্ত্রণালয় এই ভবনে স্থানান্তরিত হয়েছে । দিদি প্রতিদিন তার নিজ দপ্তরে প্রবেশের আগে দেখতে পারবেন কেমন চলছে তার শহর কোলকাতা । সুনিল বলে তাকে সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত কভার করতে যেতে হবে । কোলকাতার প্রায় আড়াইশ বছর পুরানো ‘মহাকরণ’ ছেড়ে ‘নবান্নে’ । কে হাত ছাড়া করতে চায় এই ঐতিহাসিক মুহূর্ত? বলে রাতে এসে কথা বলবে । আমি দক্ষিণ ভারত হতে ফিরলে অপেক্ষমান দুপুরের খাওয়ারটা না হয় খাওয়া যাবে ।
ডঃ মুস্তাফা নুরুল ইসলাম আর এম আর মুকুলের পিতা সাদাত আলী আখন্দ ‘তের নম্বরে পাঁচ বছর’ নামে এক চমৎকার বই লিখেছিলেন সেই পঞ্চাসের দশকে। স্কুল জীবনে পড়া যে কটি বইয়ের কথা এখনো মনে আছে এটি তার একটি । লেখক এই মহাকরণে চাকুরি করেছিলেন পাঁচ বছর । সেটি সম্ভবত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অফিস ছিল । তের নম্বরটি তার বিভাগের নম্বর হবে। সেই বই পড়ে প্রথম মহাকরণের সাথে পরিচয় । মহাকরণের আর এক নাম রাইটার্স বিল্ডিং । করণিক মানে কেরানী হতে মহাকরণ । মানে বড় বড় কেরানিরা এখানে বসেন । পলাসির যুদ্ধের পর বাংলা দখল করে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৭৭ সালে তাদের ছোট কেরানীদের অফিস হিসেবে থমাস লিয়নের নকশা অনুযায়ী এই রাইটার্স ভবন বানিয়েছিলেন । পর্যায়ক্রমে এটি প্রয়োজন অনুযায়ী অনেকটা পরিকল্পনাহীন ভাবে আকারে বড় হয়েছে । সামনে লাল দিঘী । ইংরেজরা এলাকাটাকে নাম দিয়েছিল বড় লাট লর্ড ডালহাউজির নামে । গত শতকের ত্রিশের দশকে বাংলার যুব বিদ্রোহের সময় তিন বাঙালি যুবক বিনয় বসু, বাদল গুপ্ত আর দিনেশ গুপ্ত পিস্তল নিয়ে রাইটার্সে ঢুকে পুলিশের মহা পরিদর্শক বজ্জাত কর্ণেল এন এস সিম্পসনকে তার অফিসে হত্যা করেছিল । সিম্পসন কোন বাঙালি যুবক রাজনৈতিক কারণে গ্রেফতার হলে তার উপর চরম অত্যাচার করতেন । বিনয় দেহরক্ষীদের গুলিতে মারা যায় । বাদল ধরা পরার পূর্ব মুহূর্তে সাইনাইড খেয়ে আত্মহত্যা করে । আর দিনেশের ফাঁসি হয় । পলাশীর যুদ্ধেও ষড়যন্ত্রকারি ওয়ারেন হেস্টিংস যখন ভারতের বড় লাট তখন ফোর্ট উইলিয়ামস কলেজ রাইটার্সে ইংরেজ কেরানীদের দেশী ভাষার তালিম দেওয়ার জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিল। সত্তরের দশকে ডালহাউজির নতুন নামকরণ হলো বিনয়-বাদল-দিনেশে বাগ । কিন্তু কোলকাতার এক শ্রেণীর মানুষের এখনো ইংরেজ প্রীতি অক্ষুন্ন আছে । তাদের কাছে এই স্থানের নাম এখনো ডালহাউজি । সুনিল রাতে ফোন করে বলে ‘নবান্নে’ দিদির অন্য চেহারা । সাধারণত দিদি সিপিএম ফোবিয়াতে ভুগেন । কেউ তাকে তাঁর অপছন্দের কোন প্রশ্ন করলে সঙ্গে সঙ্গে তিনি বলে ফেলেন নিঃসন্দেহে এটি সিপিএম এর ষড়যন্ত্র । সুনিল বলে দিদির সামনে ‘নবান্নের’ উদ্ভোধনের সময় কয়েকশত সাংবাদিক আর টিভি ক্যামেরা । শুরুতেই দিদি বলে দিয়েছেন আজ কোন প্রশ্ন নয় আজ ‘নবান্নের’ জন্ম দিন সুতরাং সকলকে তিনি মিষ্টিমুখ করাবেন ।
সুনিল জানালো আসলে মহাকরণের সংষ্কার হবে তাই অনেকটা অস্থায়ীভাবে মহাকরণের আংশিক স্থানান্তর করা হয়েছে ‘নবান্নে’ । তবে দিদির একটা মন্তব্য ইতিহাস প্রেমিকদের চিন্তায় ফেলে দিয়েছে । উদ্ভোধনের পর নিজের কক্ষে পা রেখে তাঁর মন্তব্য ‘এই ভবনটিকে আমার ভাল লাগা শুরু হয়েছে । শেষ পর্যন্ত যদি রাইটার্সে ফিরে না যাই ?’ ‘নবান্ন’ দৃষ্টি নন্দন হতে পারে তবে মহাকরণের প্রায় আড়াই শত বছরের ইতিহাসের কী হবে ? সুনিল নিজে সিপিএম এর ভক্ত। জানতে চাই মমতা এত সব কা-কীর্তির পরও সামানের নির্বাচনে কী জিতবেন ? সুনিলের মতো কোলকাতার অনেকেই মনে করেন এই মুহূর্তে পশ্চিম বঙ্গে তৃণমূলকে চ্যালেঞ্জ করার মতো কোন দল নেই । নেই কোন রাজনৈতিক নেতৃত্ব । কংগ্রেস এখানে মৃত প্রায় । বাম ফ্রন্টও ধুঁকছে । বাম ফ্রন্টের যা কিছু জনপ্রিয়তা ছিল তার সব টুকু শেষ করেছে তার অঙ্গসংগঠন গুলি । অন্যরা কাঁধে শান্তিনিকেতনি ব্যাগ ঝুলিয়ে সাংষ্কৃতিক কর্মকা- নিয়ে ব্যস্ত । সুস্থ রাজনীতিতে নতুন প্রজন্মের কেউ তেমন আসছে না । রাজনীতি অনেকটা পেশী শক্তির কাছে জিম্মি হয়ে পরছে । অনেকটা বাংলাদেশের রাজনীতির প্রতিচ্ছবি । ভারত বাংলাদেশের মধ্যে এই মুহূর্তে মমতার কারনে দুটি বড় অমীমাংসিত সমস্যা রয়ে গেছে । একটি প্রায় চল্লিশ বছর পুরানো সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন আর দ্বিতীয়টি তিস্তা পানি বন্টন চুক্তি । প্রথম চুক্তিটি সেই ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু আর ইন্দিরা গান্ধী স্বাক্ষর করেছিলেন । নিয়ম অনুযায়ী বাংলাদেশে সেই চুক্তি সাথে সাথে জাতীয় সংসদ অনুমোদন করে নেয় ভারত এখনা পারে নি। মাঝখানে চল্লিশ বছর পার হলো । এর আগে এই চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশের পক্ষ হতে তেমন কোন উদ্যোগ নেয়া হয় নি আর ভারতও গা করেনি । আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসলে আবার উদ্যোগ শুরু হয় । ভারতের কেন্দ্র সরকার বলে হবে । দিদি আর বিজেপি বলে হবে না কারণ তা হলে বাংলাদেশের লাভ বেশী । অদ্ভুত যুক্তি। দিদির তৃণমূল আর বিজেপি’র সমর্থন ছাড়া এই বিল লোক সভায় পাশ হবে না কারণ লোক সভায় ইউপিএ সরকারের প্রয়োজনীয় সংখ্যা গরিষ্ঠতা নেই । শুনেছি সীমান্ত চুক্তির ব্যাপারে দিদি একটু নমনীয় হয়েছেন । কেন্দ্র সরকার বলেছে লোক সভার সামনের শীত কালের অধিবেশনে সীমান্ত চুক্তি অনুমোদন হওয়ার সম্ভাবনা আছে । তবে সুনিলের মতে দিদি সকালে এক কথা বলেন আবার বিকেলে অন্য। অনেকটা আমাদের এরশাদ আর কী । তবে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি এই যাত্রায় যে হচ্ছে না তা অনেকটা নিশ্চিত । দিদি বলেন এই চুক্তি হলে পশ্চিম বঙ্গের নাকি ক্ষতি । কী ভাবে ক্ষতি তা তিনি খুলে বলেন নি । তবে এই দুটি চুক্তির বিষয়ে দ্রুত ফয়সালা না হলে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনে বিরোধী দল তা একটি ইস্যু করবে । অবশ্য বিরোধী দল কখনো ক্ষমতায় গেলে এই ব্যাপারে কিছু করার তেমন কোন মুরোদ আছে বলে মনে হয় না । তবে নির্বাচনে যদি কোন কারণে পরিস্থিতির রদবদল হয় তবে পশ্চিম বঙ্গ তথা ভারতবর্ষের যে কত বড় ক্ষতি হবে তা এখনো তারা হয়তো আঁচ করতে পারে নি । ভারত কখনো ঠিক মতো এটি উপলব্দি করতে পারে না অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশের সাথে অমীমাংসিত সমস্যাগুলি মীমাংসা করে ফেলা আসলে তাদের জন্য কতটা মঙ্গলজনক । মূল কথা হচ্ছে বাংলাদেশের বন্ধু জ্যোতি বসু অথবা তার নেতৃত্বাধীন বাম ফ্রণ্টও ক্ষমতায় নেই আর কোলকাতাও কোলকাতাতে নেই । বাংলাদেশ সম্পর্কে পশ্চিম বঙ্গ তথা কোলকাতার মানুষের দৃষ্টি ভঙ্গি আগের যে কোন সময়ের তুলনায় বন্ধুত্বসূলভ । রাজ্যের অদূরদর্শী রাজনীতি যত সমস্যা । কোলকাতা যেমন কোলকাতাতে নেই ঠিক তেমনি ওপারের রাজীতিও আর তার আগের যায়গায় নেই । সময় থাকতে দিদি তা উপলব্দি করবেন মনে হয় না । না করলে ষোল আনা লোকসান তার ।

লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় । অক্টোবর ৯, ২০১৩

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ