|
সামনের লড়াই আরো দীর্ঘ ও কঠিন হবে
-প্রফেসর আবদুল মান্নান ২৬ মার্চ বাংলাদেশের ৪৪তম স্বাধীনতা দিবস । তিন লক্ষ বাঙালি এই দিনে ঢাকার জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে বেলা এগারটায় সমবেত হয়ে সরকারি উদ্যোগে এক সাথে জাতীয় সঙ্গীত গাইবেন বলে ঘোষণা করা হয়েছিল । এই ছাড়াও দেশের সকল জেলায় যে যেখানে আছেন এই সময়ে সেখানে দাঁড়িয়ে জাতীয় সঙ্গীত গাইবেন । দেশের বাইরেও বাঙালিরা এই সময়ে একই ধরণের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন । চট্টগ্রামের খেলাঘরের শিশুদের সাথে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে এসেছিলাম । বাংলাদেশের সাংষ্কৃতিক আন্দোলনে খেলাঘরের অবদান অপরিসীম । কিন্তু সংগঠনটি যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে এখন আগের মতো তত সক্রিয় নয় । তারপরও বিভিন্ন জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে । বেলা ১১ টার কিছু আগে পরিচয় হলো বাক ও শারীরিক প্রতিবন্ধী কলেজ পড়–য়া রাজুর সাথে । রাজু জন্ম থেকে কথা বলতে পারে না । কিন্তু এই অনুষ্ঠানে তার অংশগ্রহণ ঠেকিয়ে রাখা যায় নি । তার বন্ধুরা জানালো যেকোন জাতীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে রাজু বেশ উৎসাহ বোধ করে । চৈত্রের কাটফাটা রোদে সকলের সাথে রাজুও গাইলো ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি ।’ রাজুর গাওয়াটা সে ছাড়া কেউ শুনলো না তাতেই সে মহাখুশি । রাজু আমাদের নতুন প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধা । এদের হাতেই বাংলাদেশের ভবিষৎ । জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডের অনুষ্ঠানটিও শেষ হলো । লাখো কণ্ঠের সাথে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে প্রধানমন্ত্রী আর তাঁর মন্ত্রী পরিষদের সদস্যরাও গাইলেন ‘আমার সোনার বাংলা...।’ আশা করা হচ্ছে এই বিশাল কর্মযজ্ঞটি গিনেস বুক অব রেকর্ডসে স্থান পাবে । এই অনুষ্ঠানের জন্য অর্থ সংগ্রহ নিয়ে কম সমালোচনা হয় নি । ইসলামী ব্যাংককে বলা হয় জামায়াতের একটি স্বীকৃত আর্থিক প্রতিষ্ঠান । তারা এই অনুষ্ঠানের ব্যয় মেঠানোর জন্য তিন কোটি টাকা প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে দিয়েছিল । এই নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তির প্রচন্ড আপত্তি আর ক্ষোভ। মন্ত্রীরা কেউ বলেন এই ব্যাংক হতে তিন কোটি টাকা নেয়া হয়েছে, কেউ বলেন নয়া হয়নি । শেষ পর্যন্ত সরকার ঘোষণা করতে বাধ্য হলো তিনকোটি টাকা ওই ব্যাংককে ফেরত দেয়া হয়েছে । বর্তমান ও পূর্বের সরকারের একটি বড় দূর্বলতা হচ্ছে সময় মতো ঠিক কাজটি করতে না পারা । শুনেছি এই টাকা ফেরত দেয়ার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর একটি উদ্যোগ ছিল । তার জন্য তাঁকে ধন্যবাদ । বাসায় এসে দেখি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই লক্ষ কণ্ঠে ‘আমার সোনার বাংলা..’ গাওয়ার সচিত্র সংবাদটি ইতোমধ্যে ব্যাপক ভাবে প্রচারিত হয়েছে । পাশাপাশি অন্য আরেকটি দৃশ্য । বেশ কিছু ব্যক্তির এই অনুষ্ঠানটি নিয়ে প্রথম হতেই ভীষণ আপত্তি । কী দরকার ছিল এত টাকা ব্যয় করে এমন একটি অনুষ্ঠান করার ? একজন হিসাব করে দেখালেন জাতীয় প্যারেড মাঠের অনুষ্ঠানে ৫৪ কোটি টাকার অপচয় করা হয়েছে । অন্য একজন হিসাবের খাতায় তা ৯০ কোটি টাকা বলে উল্লেখ করলেন এবং মন্তব্য করলেন এই টাকা গরীব মানুষের মাঝে বিলি করে দিলে ছওয়াবের কাজ হতো । একজন বেশ বিরক্ত কারণ এই চৈত্রের দুপুরে স্কুলের কোমলমোতি বাচ্চাদের এমন অমানবিক কষ্ট দিয়ে সরকার একটি অমার্জনীয় অপরাধ করেছে । পুরো অনুষ্ঠানটিকে হাল্কা করার জন্য একজন একটি পোষ্টে একটি ছবি সংযোজন করলেন যেখানে দেখা যাচ্ছে কিছু ছোট ছোট কাগজের পতাকা মাটিতে পরে আছে তার উপর দিয়ে একজন তরুণী হেঁটে যাচ্ছেন । ঠাট্টা করে মন্তব্যে লেখা আছে ‘মুক্তি যুদ্ধের চেতনা !’ হতে পারে ঘটনাটি সত্য অথবা তা আংশিক ফটোশপ করা । তবে সত্য হলে ঘটনাটি অবশ্যই নিন্দনীয় । আয়োজকদের আরো সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন ছিল । তবে এটা ঠিক যিনি এই ছবিটি শেয়ার করেছেন তিনি তা কোন মহৎ উদ্দেশ্যে করেন নি । এবার আসি আগের রাতের একটি টকশো নিয়ে যৎসাম্যন্য আলোচনায় । বেশ জনপ্রিয় একটি প্রাইভেট টিভি চ্যানেলের সংবাদপত্র ভিত্তিক নিয়মিত টকশো । অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জাঁদরেল অধ্যাপক আর অন্যজন একজন সিনিয়র সাংবাদিক । এ’দিন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের তদন্ত সংস্থা ধর্মভিত্তিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ সহ নয় ধরণের অপরাধের প্রমাণ পেয়েছে এবং তার উপর ভিত্তি করে সংগঠনটির বিরুদ্ধে চূড়ান্ত রিপোর্ট তৈরি করেছে । রিপোর্টে দল হিসেবে নিষিদ্ধের পাশাপাশি জামায়াতের আদর্শ নিয়ে রাজনীতি নিষিদ্ধের সুপারিশ করা সহ তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের সুপারিশও করা হয়েছে । এই প্রসঙ্গে সঞ্চালক সেই বিজ্ঞ অধ্যাপকের কাছে তার মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি সকল দশর্ককে অবাক করে দিয়ে বলেন এতে তিনি একটি অবৈধ সরকারের ফ্যাসিস্ট চেহারা দেখতে পাচ্ছেন । এই অবৈধ সরকার এমন একটা অগণতান্ত্রিক কাজ করতে পারে না । তার মতে এটি মনে রাখা ভাল এই দলটি দেশে একটি বৈধ রাজনৈতিক দল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, সরকারে ছিল এবং সদ্য চলমান উপজেলা নির্বাচনে বেশ ভাল করছে (তার জন্য অবস্য আওয়ামী লীগের অন্তর্দন্ধকে ধন্যবাদ দিতে পারে )। জামায়াতের অবস্থান বর্তমানে তৃতীয় । এতে বুঝা যায় তাদের উপর মানুষের সমর্থন আছে । তাদের নিষিদ্ধ করাটা খুবই অন্যায় হবে । অধ্যাপক মহোদয়ের মন্তব্য শুনে মনে হচ্ছিল খোদ গোলাম আযম টিভি’র সামনে তার দলের পক্ষে বক্তব্য রাখছেন । আমি নিশ্চিত গোলাম আযম বক্তব্য রাখলে এমন জোড়ালো এবং নির্লজ্জভাবে বক্তব্য রাখতেন না । তিনি আরো একটু কৌশলি হতেন । আমরা অনেক সময় প্রশ্ন করি স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পরও এত বাচ্চা আলবদর কোথা হতে আসে ? একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক যদি প্রকাশ্যে এমন কথা বলেন তা হলে তিনি তার ছাত্রদের দেশ ও দেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে কী শিক্ষা দেবেন ? দূঃখের বিষয় হচ্ছে এমন শিক্ষকের কমতি নেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে । জার্মানি বা ইউরোপের অন্য যে কোন দেশে নাৎসিবাদ নিয়ে কোন একজন শিক্ষক যদি প্রকাশ্যে এমন কথা বলতেন তা হলে নির্ঘাত তার চাকুরি যেত । কিন্তু সব সম্ভবের দেশে তা সম্ভব নয় । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানিতে শুধু নাৎসি পার্টিকেই নয় তাদের সকল অঙ্গ সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল । বঙ্গবন্ধুও সাংবিধানিক ভাবে জামায়াত সহ সব ধর্মাশ্রয়ী দলকে স্বাধীনতার পর নিষিদ্ধ করেছিলেন । এর আগে প্রবাসী সরকার তা নিষিদ্ধ করেছিল নির্বাহী আদেশে । সেই বিজ্ঞ অধ্যাপক সেখানে থেমে থাকেন নি । তিনি আরো বলেন জামায়াতের উপর অবৈধ সরকার নাকি ষ্টীম রোলার চালিয়ে তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকিয়ে দিয়েছে । সঞ্চালক আর সেই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী সাংবাদিক যখন জানতে চান এই জামায়াত শিবির ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পূর্বে যে এত মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করলো, রেল লাইন তুলে ফেলল অথবা চাঁদে সাঈদীকে দেখা যাওয়াকে কেন্দ্র করে সংখ্যালঘুদের গ্রামে এমন সব ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালালো তার কী হবে? বিজ্ঞ অধ্যাপকের চটজলদি উত্তর, তারাতো তাদের উপর যে অত্যাচার চালানো হচ্ছে তার জবাবে এইসব করতে বাধ্য হয়েছে । সেই রাতে সাংবাদিক বন্ধু সব কিছুর জুৎসই সম্ভাব্য উত্তরসেই দিয়েছিলেন । তিনি বললেন ভুললে চলবে না এই জামায়াতকে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর জিয়াই রাজনীতি করার লাইসেন্স দিয়েছিলেন । তিনি শাহ আজিজের মতো যুদ্ধাপরাধীকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছিলেন । জিয়াই গোলাম আযমকে দেশে ফিরিয়ে এনেছিলেন । তার স্ত্রীর শাসনামলে গোলাম আযম নাগরিকত্ব ফিরে পান । তিনি যুদ্ধাপরাধীদের তাঁর মন্ত্রী সভায় ঠাই করে দেন । বাংলাদেশের ৪৪ বছরের ইতিহাসে সাড়ে তেইশ বছর স্বাধীনতা বিরোধীরাই ক্ষমতায় ছিল । এই সময়ে অনেক ব্যক্তি তাদের কাছ হতে কৃপাধন্য হয়েছেন । সুতরাং স্বাধীনতা দিবসের পূর্ব মুহূর্তে তাদের পক্ষে বলার মানুষের অভাব হওয়ার কথা নয় আর বর্তমান সরকারও কোন অবৈধ সরকার নয় । তিনি বেশ হতাশ হয়ে বলেন তিনি ধারণা করতে পারেন নি তাকে এমন একটি রাতে এই সব বিষয় নিয়ে কথা বলতে হবে । অধ্যাপক মহোদয় তার বক্তব্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে চলমান বিচার নিয়েও প্রশ্ন তোলেন । শুধু বলতে বাকি রেখেছেন পারলে তিনি এই বিচারকার্য এখনই বন্ধ করে জামায়াতের সব বন্দীদের মুক্ত করার জন্য জামায়াত শিবিরের সন্ত্রাসীদের নিয়ে রাজপথে মিছিল বের করতেন । ফিরে আসি স্বাধীনতা দিবসের বাক্ ও শারীরিক প্রতিবন্ধী রাজুর প্রসঙ্গে । রাজুর নানা প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও সে দেশপ্রেমে উদ্ভুদ্ধ হয়ে চৈত্রের দুপুরে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে গিয়েছিল । আর সেই অধ্যাপক মহাশয় তার কয়েক ঘন্টা আগে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের জন্য মাতম করছিলেন । দেশপ্রেমে উদ্ভুদ্ধ সেই রাজুর তুলনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকতো মানসিক প্রতিবন্ধী । বাংলাদেশে এমন মানসিক প্রতিবন্ধী অসংখ্য । সেই কারণেই আগামীতে বাংলাদেশের মানুষকে, বিশেষ করে যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে তাদের আরো দীর্ঘ এবং কঠিন লড়াই করতে হবে । সেই বিজ্ঞ অধ্যাপকের উচিৎ তাঁর সামান্যতম অনুশোচনাবোধও যদি থাকে তাহলে তাঁর সেই রাতের বক্তব্যওে জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া । লেখক : সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় । মার্চ ২৭, ২০১৪
WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action.
|
লেখকের আগের লেখাঃ
|