প্রথমপাতা  

সাম্প্রতিক সংবাদ 

 স্বদেশ

আন্তর্জাতিক

বাংলাদেশ কমিউনিটি

লাইফ স্টাইল

এক্সক্লুসিভ

বিনোদন

স্বাস্থ্য

বর্তমানের কথামালা

 শিল্প-সাহিত্য

 প্রবাসপঞ্জী 

আর্কাইভ

যোগাযোগ

 

 

 

 

 

 

কামারুজ্জামানের রায় বাস্তবায়ন কী ঝুলে গেল?
 


প্রফেসর আবদুল মান্নান

একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসীর দন্ডাদেশের রায় বাস্তবায়ন কী ঝুলে গেল? এমন প্রশ্ন ও সন্দেহ এখন সাধারণ মানুষের, বিশেষ করে যারা এই রায় দ্রুত বাস্তবায়ন দেখতে চায় তাদের মুখে মুখে । কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিকের সাথে এই নিয়ে কথা হচ্ছিল । তারাও একই আশঙ্কা প্রকাশ করলেন । আরো বললেন সরকারের উপর নিশ্চয় বিদেশী কোন শক্তির চাপ আছে নতুবা যে রায় গত ৩ তারিখ ঘোষিত হলো তা বাস্তবায়নে এত দিন লাগবে কেন? যুক্তি হিসেবে তারা বললেন সাঈদীর রায় যে ভাবে সুপ্রিম কোর্টে বদলে গেল তা থেকে কি কিছু আঁচ করতে পারছেন না? সাংবাদিক বন্ধুদের বলি দেশের সর্বোচ্চ আদালতের উপর আমাদের এখনো আস্থা আছে । সুপ্রিম কোর্ট ট্রাইবুনালের রায়ের কাগজ পত্র পর্যালোচনা করে যা যৌক্তিক মনে করেছেন তারা সেই মতেই রায় দিয়েছেন । এতে অন্য কিছু ভাববার কোন অবকাশ নেই । তাদের আরো বলি কাদের মোল্লার রায় বাস্তবায়নের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে দৃঢ়তা দেখিয়েছেন, যেভাবে তিনি আন্তর্জাতিক চাপ মোকাবেলা করেছেন, জাতিসংঘ মহাসচিব হতে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রী জন কেরীর অনুরোধ অগ্রাহ্য করেছেন তাতে আমাদের আশান্বিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে । মনে হলো না আমার দুই সাংবাদিক বন্ধু আমার কথায় তেমন আশান্বিত হলেন । তাদের কথা, ভুলে যাবেন না জামায়াত এই বিচার ঠেকাবার জন্য দেশে ও বিদেশে কোটি কোটি ডলার খরচ করছে ।
বাসায় এসে দেখি জামায়াতের বিদেশী আইন উপদেষ্টা বৃটিশ বংশোদ্ভুত ইহুদি ব্যারিষ্টার টোবি ক্যাডমেনের ফার্ম বেডফোর্ড রো ইন্টারন্যাশনালের দশ পৃষ্ঠা দীর্ঘ এক প্রেস রিলিজ ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে । ক্যাডমেন বাংলাদেশে এসে তার জামায়াতি যুদ্ধাপরাধী মক্কেলদের জন্য যা যা আদালতে বলতেন তার সবটুকুই মোটামুটি ওই প্রেস রিলিজে স্থান পেয়েছে । বার কাউন্সিলের অনুমোতি না মেলাতে তিনি বাংলাদেশে আসতে পারেন নি । ট্রাইবুনাল হতে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কার্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য যা যা লেখার প্রয়োজন তার সব টুকুই ক্যাডমেন তার প্রেস রিলিজে উল্লেখ করেছেন । একই দিন, অর্থাৎ সোমবার, কামারুজ্জামানের ছেলে হাসান ইকবাল সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন তার বাবাকে অন্যায়ভাবে ফাঁসির দন্ড দেয়া হয়েছে । তিন এই রায়কে ‘ন্যায়ভ্রষ্ট’ রায় হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন তারা রিভিউ করার সুযোগ পেলে তার বাবা খালাস পেয়ে যাবেন । হাসান ইকবালের সংবাদ সম্মেলন প্রায় সবি কটি গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পেয়েছে । আমাদের সব গণমাধ্যম সমালোচনার উর্দ্ধে নয় । অভিযোগ আছে জামায়াতের কোটি কোটি টাকার একটি বড় অংশ দেশের ভিতর ব্যায় হয়েছে ।
যদিও কামারুজ্জামানের ছেলে একজন আইনজীবী এর আগে তাকে কখনো কোন সংবাদ সম্মেলন করতে দেখা যায় নি । আর এই সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তিনি দেশের সর্বোচ্চ আদালতের দেয়া রায়কে ‘ন্যায়ভ্রষ্ট‘ আখ্যা দিয়েছেন; আদালতকে অনেকটা চ্যালেঞ্জ করেছেন; তাও আদালত প্রাঙ্গনে বসে । বর্তমানে সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতির দায়িত্বে আছেন বেগম জিয়ার উপদেষ্টা খোন্দকার মাহবুব হোসেন যিনি একই কথা কামারুজ্জামানের রায়ের পর হতে বলে আসছেন । কামারুজ্জামানের রায় সম্পর্কে তার ছেলের এহেন মন্তব্য আদালত অবমাননা হবে কী না তা আদালতই নির্ধারণ করতে পারেন । জামায়াত তাদের নেতাদের ট্রাইবুনাল অথবা সুপ্রিম কোর্টে বিচারের জন্য সব ধরণের আইনী লড়াই চালিয়ে যায় । কিন্তু রায় যখন নিজেদের পক্ষে যায় না তখন বলেন এই রায় মানি না । তখন তারা দেশে চরম নৈরাজ্যের আর একটি নতুন অধ্যায় চালু করে ।
আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু সরকার যখন দালাল আইন করে এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দোসর ও দালালদের আটক ও বিচার করা শুরু করে তখন সরকার এই আইনে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনী লড়াই করার জন্য সরকারের পক্ষে অন্যতম প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল এই খোন্দকার মাহবুব হোসেনকে । বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর আগে এই দালালদের বিচার করার জন্য দেশে ৭৩টি ট্রাইবুনাল গঠন করা হয়েছিল । খোন্দকার মাহবুব হোসেন ও তার সহকর্মীদের চেষ্টায় তিন হাজার মামলার নিষ্পত্তি হয় এবং মৃত্যুদন্ডসহ ৭৫২ জনের সাজা হয় । বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর জিয়া ক্ষমতা দখল করে ১৯৭৫ সালের ৩১ আগষ্ট সেই দালাল আইন বাতিল করে সব সাজা প্রাপ্ত ব্যক্তিদের জেল হতে মুক্ত করে দেন । এদের একজন শাহ আজিজ, যাকে জিয়া পরবর্তিকালে তার প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছিলেন; আর মশিউর রহমান যাদু মিয়াকে বানিয়েছিলেন সিনিয়র মন্ত্রী । বিচারের জন্য অপেক্ষমান সহ মোট এগার হাজার পাকিস্তানি দালাল আর মানবতাবিরোধী অপরাধীদের জিয়া মুক্ত করে দিয়ে তাদের অনেককে নিয়ে তিনি পরবর্তিকালে বিএনপি গঠন করেছিলেন ।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য জাতি দীর্ঘ তেতাল্লিশ বছর অপেক্ষা করেছে । তাদের এই বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর জন্য একজন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় আসতে হয়েছে । কিন্তু এখন বাস্তবে দেখা যাচ্ছে অনেকটা ‘শেষ হইয়াও হইলোনা’র মতো অবস্থা । পরিস্থিতি আরো ধোঁয়াশা করেছে আইনমন্ত্রী আর এটর্নি জেনারেলের যতসব বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য । একজন বলেন এক সপ্তাহ পার হলে রায় কার্যকর হবে । অন্যজন বলেন রায়ের শর্ট কপির জন্য অপেক্ষা করতে হবে । এটি কারাগারে পৌঁছালে রায় কার্যকর শুরু হবে । রায়ের রিভিউ সম্পর্কে একজন বলেন রিভিউর কোন সুযোগ নেই । অন্যজনের বক্তব্য রিভিউ করতে পারেন তবে তা গ্রহণ করা না করা একান্তভাবে আদালতের এক্তিয়ার । একজন আবার বলেন ফাঁসির রায় বাস্তবায়ন করার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করার জন্য কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে । জানা মতে এই নির্দেশ দেয়ার এক্তিয়ার একান্তভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের । এই সব যখন চলছে তখন জামায়াতের অর্থে কোন কোন আন্তর্জাতিক মিডিয়া এই রায় এবং মামলা ও রায়ের বিরুদ্ধে নতুন করে প্রচারণা শুরু করেছে যার মধ্যে কাতার ভিত্তিক আল জাজিরা টিভি অন্যতম । এই টিভি চ্যানেলটি যুক্তরাষ্ট্র আর তার মিত্রদের ইরাক দখল সমর্থন করেছে । হোসনি মুবারক আর গাদ্দাফির ক্ষমতাচ্যুতিতে ইন্ধন জুগিয়েছে । মধ্যপ্রাচ্যে জঙ্গিবাদ উত্থানে সহায়তা করেছে । সাদ্দাম হোসেন আর গাদ্দাফি আর যাই হোক জঙ্গিবাদের সমর্থক ছিলেন না ।
এমনিতে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচার শুরু হয়েছে । একেকটা বিচার শেষ হতে দীর্ঘ সময় লাগছে । ট্রাইবুুনালে রায়ের জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে কয়েক মাস । তারপর তা যাচ্ছে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে । সেখানে আবার অপেক্ষার পালা । এক সময় শুনানি শেষ হয় । তারপর আবার রায়ের জন্য অপেক্ষা । অনেক সময় সেই অপেক্ষা যেন আর শেষ হয় না । মাঝখানে আবার সাঈদীর মতো রায় উল্টে গেলে ঘটে ছন্দ পতনের । এর মধ্যে নব্বই বছর সাজা প্রাপ্ত জামায়াতের মন্ত্র গুরু গোলাম আযমের হাসপাতালে মৃত্যু হয় । তার পরিবার বলে বিদেশে থাকা তার তিন ছেলে দেশে ফিরলে তাকে দফন করা হবে । তারা ঠিকই জানে এই তিন ছেলে বাপের জানাজায় অংশ নিতে দেশে আসবে না । জামায়াত সরকারকে বোকা বানিয়ে তিনদিন সময় নিয়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল হতে তাদের সব সমর্থক আর ক্যাডারকে জড়ো করে জাতীয় মসজীদ বায়তুল মোর্কারমে বিশাল জানাজার আয়োজন করে জামায়াতকে ত্রিশ লাখ শহীদ আর দুই লাখ লাঞ্চিত মা বোনের গালে থাপ্পর মারার সুযোগ করে নেয় । এই সবের মধ্যে শুরু হয়েছে কামারুজ্জামানের ফাঁসির নতুন অধ্যায়, মানুষ যাকে বলছে নতুন নাটক । বড় প্রশ্ন এই অনাকাঙ্খিত নাটকের শেষ কখন হবে । এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য দেশের মানুষকে অপেক্ষা করতে হবে । প্রশ্ন এই অপেক্ষা কত দীর্ঘ হবে?

লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় । নভেম্বর ১২, ২০১৪

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ

[......লেখক আর্কাইভ]