[প্রথমপাতা]
|
এই বিজয় বাংলাদেশের আর তারুণ্যের
প্রফেসর আবদুল মান্নান
জামায়াত-বিএনপি’র যারা অন্ধ সমর্থক তাদের আওয়ামী লীগের রাজনীতির বিরোধিতা
করাটাই স্বাভাবিক কিন্তু অনেক সময় এই সমালোচনার লাগাম থাকেনা । দল হিসেবে
আওয়ামী লীগ সমালোচনার উর্দ্ধে নয় । ছাত্রলীগ আর যুবলীগ নামধারী কিছু
দূর্বৃত্ত নিয়মিত দলটির বারটা বাজাচ্ছে । ১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনের
প্রাক্কালে যখন প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের প্রচার তুঙ্গে
তখন চট্টগ্রামের এক জনসভায় বিএনপি নেতা কর্ণেল (অবঃ) অলি আহম্মদ শেখ
হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে বলেন সত্তরে নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে এককোটি মানুষ দেশ
ছাড়া হয়েছিল সুতরাং মানুষ এখন আর নৌকা মার্কায় ভোট দেবে না । অবশ্য কর্ণেল
সাহেবের এই ধরণের বক্তৃতা দেয়ার একটি সুখ্যাতি আছে । ২০০৬ সালের ১৬ই
সেপ্টেম্বর তার নিজের নির্বাচনী এলাকা চন্দনাইশের এক জনসভায় বলেছিলেন
‘জিয়াকে রাস্তায় ডেকে এনে যুদ্ধে নামিয়েছি, স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করিয়েছি ।
যেসব মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী খালেদা জিয়ার জুতা-স্যান্ডেল টানে তারাই কুকুরের
মতো ঘেউ ঘেউ করে আমার কথা বলে। কয়েকজন মন্ত্রী সারারাত মদ খেয়ে বদমায়েশি
করে মুক্ত বাজারের কথা বলে জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় । ১৫-২০ জন মন্ত্রীর
সিন্ডিকেট বছরে ২০ হাজার কোটি টাকা ঘুষ খায় ।’ (বাংলাদেশের তারিখ, মুহাম্মদ
হাবিবুর রহমান, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্টা ৪২৪) । মানুষ কিন্তু সত্তরে নৌকা
মার্কায় ভোট দিয়ে একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছিল । পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে
সপরিবারে হত্যার পর তেসরা নভেম্বর জেল খানার ভিতর জাতীয় চার নেতাকে খুন
করার পর দীর্ঘ একুশ বছর দলটি ছত্রভঙ্গ অবস্থায় ক্ষমতার বাইরে ছিল । কোন
একটি দল একুশ বছর ক্ষমতার বাইরে ছত্রভঙ্গ অবস্থায় থেকে পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে
আসা রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনা । আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে তা কিন্তু
ঘটেছিল এবং তার একটি প্রধান কারণ দলটির প্রতি দেশের সাধারণ মানুষের আস্থা,
যদিও কখনো কখনো কোন কোন নীতি নির্ধারকদের অপরিনামদর্শী কার্যকলাপের ফলে সেই
আস্থায় চিড় ধরেছে ।
অনেক বাধা বিপত্তি পার করে আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একুশ
বছর পর আবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় ফিরে আসে । সে সময় রাষ্ট্র পরিচালনায় শেখ
হাসিনার কোন পূর্ব অভিজ্ঞতাও ছিল না । বেগম জিয়ার সাথে তার তফাৎ হচ্ছে বেগম
জিয়া তাঁর স্বামীকে সেনা নিবাসে থেকে রাজনৈতিক দল গঠন করতে দেখেছেন, অনেক
কর্মকান্ডের সাক্ষী হয়েছেন আর অন্যদিকে শেখ হাসিনা তার পিতাকে বাড়ী থেকে
কারাগার আর কারাগার থেকে বাড়ীতে ফিরতে দেখেছেন । ডঃ ওয়াজেদ মিয়ার সাথে যখন
তার বিয়ে হয় তখন তার মাকে সেই বিয়ের সামান্য ব্যয় মেটানোর জন্য নিকটজনদের
কাছ হতে অর্থ ধার করতে হয়েছে । ঢাকায় বিয়ের অনুষ্ঠান করার মতো তার কোন
সংগতি ছিল না কারণ তখন তাঁর স্বামী শেখ মুজিব কারাগারে । শেখ হামিনার বাবার
অনুপস্থিতি পূরণ করেছিলেন চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ । ১৯৯৬এ
নির্বাচনের প্রাক্কালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল বিজয়ী হলে
সরকার বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচার করবে যা শেখ হাসিনার সরকার একটি নিয়মিত
বিচারিক আদালতে শুরু করেছিলেন কিন্তু দীর্ঘসূত্রিতার কারণে সেই বিচার তার
ওই মেয়াদে শেষ করে যেতে পারেন নি । ২০০১ এর নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় আসলে
ব্যারিস্টার মওদুদের আইনী মারপ্যাঁচের শিকার হয়ে সেই বিচারের আর কোন
অগ্রগতি হয়নি ।
২০০৮ এর নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা আর তার দল নির্বাচনী ইস্তেহারে অঙ্গিকার
করেন বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করলে তারা বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচার কাজ
সমাপ্ত করবেন এবং একই সাথে একাত্তরে যারা যুদ্ধাপরাধ আর মানবতাবিরোধী
অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত তাদের তিনি বিচারের মুখোমুখি করবেন । এই সব
অপরাধীদের অনেককেই জেনারেল জিয়া এবং তাঁর স্ত্রী বেগম জিয়া কিন্তু
প্রধানমন্ত্রী হতে শুরু করে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী বানিয়েছেন । শেখ হাসিনা
তাঁর কথা রেখেছেন । বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচার কার্য শেষ করেছেন এবং সেই রায়
কার্যকর করেছেন । একটু দেরীতে হলেও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের
বিরুদ্ধে বিচার কাজ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে শুরু করেছেন এবং
ইতোমধ্যে ছয়জনের বিচার কাজ শেষ করেছেন । এই বিচার কার্য বানচাল করার জন্যও
জামায়াত দেশের ভিতরে এবং দেশের বাইরে কোটি কোটি ডলার ছিটিয়েছে বলে সংবাদে
প্রকাশ, একশ্রেণীর সুশীল সমাজ আর মিডিয়াকে নিজেদের পক্ষে আনতে সফল হয়েছে,
আন্তর্জাতিক লবিষ্ট নিয়োগ করে দেশের বাইরে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে ।
অনেক দেশী এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা এই ট্রাইবুনালকে বিতর্কিত করার চেষ্টা
করেছে কিন্তু সরকারের দৃঢ়তার কারণে খুব বেশী সফল হতে পারে নি এবং
ট্রাইবুনাল শুধু তার নিজম্ব গতিতেই চলেনি সার্বিক বিচারে এই ট্রাইবুনাল এই
ধরণের বিচারে একটি আন্তর্জাতিক মানদ- স্থির করতে সক্ষম হয়েছে । দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধের পর হতে এই পর্যন্ত বিশ্বের অনেক দেশে যুদ্ধাপরাধ আর
মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অনেক ট্রাইবুনালে অনেক অপরাধীর বিচার হয়েছে এবং
হচ্ছে । কোন আদালত বাংলাদেশের ট্রাইবুনালের মতো এত স্বচ্ছ এবং খোলামেলা ছিল
না । কোন আদালত কোন অপরাধীকে রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ দেয়নি যে সুযোগ
বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের ক্ষেত্রে রয়েছে । জিয়া যখন
কর্ণেল তাহেরকে ফাঁসিকে ঝুলিয়ে হত্যা করেছিল অথবা তার শাসনামলে দুই হাজারের
অধিক সামরিক বাহিনীর সদস্যকে বিচারের নামে প্রহসন করে কারাগারের ভিতরে
রাতের অন্ধকারে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিলেন তখন তাদের কোন আপিলের সুযোগ ছিল না ।
ট্রাইবুনালের প্রত্যেক রায়কে কেন্দ্র করে জামায়াত শিবির সারা দেশে বেপরোয়া
তা-ব চালিয়ে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি করেছে । দুঃখজনক হলেও সত্যি সেই তা-বের
বেলায় প্রধান বিরোধী দল হয় নিরব থেকেছে অথবা পরোক্ষ ভাবে সমর্র্থন যুগিয়েছে
। সাড়ে সাত মাস আগে যখন ট্রাইবুনাল মিরপুরের কসাই নামে খ্যাত কাদের
মোল্লাকে একাত্তরে নরহত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্থ করা সত্ত্বেও প্রত্যাশিত
মৃত্যুদ- না দিয়ে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করে তখন এই রায়ের বিরুদ্ধে
সারা দেশের তরুণ প্রজন্মের সাথে সাথে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভুদ্ধ সকলে
ফুঁসে উঠে প্রতিবাদ করেছে। সৃষ্ট হয় লক্ষ তরুণের সমন্বয়ে শাহবাগের গণজাগরণ
মঞ্চ । প্রথম দিকে বিএনপির কয়েকজন শীর্ষ পর্যায়ের নেতা এই মঞ্চের পক্ষে
তাদের সমর্থন জানালেও কিছু দিন না যেতেই বেগম জিয়া আন্দোলনকারীদের আখ্যায়িত
করেন নাস্তিক হিসেবে । অনেকটা বেগম জিয়া আর তার দলের পরোক্ষ প্ররোচনায়
হত্যা এবং আহত করা হয় কয়েকজন আন্দোলনকারীকে । হুমকীতে পরে যায় আন্দোলনের
অসংখ্য তরুন নেতা নেত্রী । কিন্তু কোন কিছুই দমিয়ে রাখতে পারেনি এই অদম্য
তারুণ্যকে । এই রায়ের বিরুদ্ধে সরকার ও কাদের মোল্লার আইনজীবীরা দেশের
শীর্ষ আদালতে আপিল করেন । সরকার করে এই অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তির জন্য আর
মোল্লার আইনজীবীরা করেন তার শাস্তি মওকুফের জন্য । মোল্লার পক্ষে যারা এই
মামলায় কৌশলী ছিলেন তাদের বেশ কয়েকজন বিএনপি’র শীর্ষস্থানীয় নীতি নির্ধারনী
নেতৃবৃন্দ ।
মঙ্গলবার দেশের শীর্ষ আদালত কাদের মোল্লার প্রাপ্য শেষ রায়ে তাঁকে
মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করেছেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে কয়েক মিনিটের মধ্যে তার
প্রধান কৌশলী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছেন । তার
দুই পাশে ছিলেন বিএনপি’র ব্যারিস্টার মাহবুব হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ
আহমেদ, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া আর আইনজীবী তাজুল ইসলাম ।
বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তাজুল ইসলাম বলেছেন ‘এই প্রথম কোন দক্ষিণ
এশীয় বিচারিক আদালতে দেয়া শাস্তি আপিল আরো কঠোর করা হয়েছে ।‘ তার এই
মন্তব্যটি সঠিক নয় । ২০০৫ সালের ১৮ নভেম্বর ভারতের একটি বিচারিক আদালত
চারজনকে একটি ফৌজদারি মামলায় সাতবছর কারাদ- দেয় । ২০০৭ সালের ৮ অক্টোবর
পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্ট তাদের সাজা বাড়িয়ে যাবজ্জীবনে উন্নীত করে ।
আপিল বাড়ানো যায় না এই যুক্তি নাকচ করে ভারতের সুপ্রীম কোর্ট এই রায় বহল
রাখে । ১৯৮৪ সালে মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট ওয়াজম্যান বনাম সুপ্রীম কোর্ট
মামলায় বলেন ‘আপিলে অভিযুক্তকে আরো কঠোর দ- দেয়া হলে তাতে পঞ্চম সংশোধনীতে
(যুক্তরাষ্ট্রের) দেয়া অধিকার বা ডিউ প্রসেসের নীতির লঙ্ঘন বলে গণ্য হবে না
।’ বিশ্বের অন্য আন্তর্জাতিক আদালতে যুদ্ধাপরাধীদের সাজা বৃদ্ধি বা হ্রাস
উভয়েরই নজির আছে । এই বিষয়ে তথ্য সম্বলিত সাংবাদিক মিজানুর রহমান খানের
একটি চমৎকার মন্তব্য প্রতিবেদন বুধবার দৈনিক প্রথম প্রথম আলোয় প্রকাশিত
হয়েছে । আর মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার ১৯৭৩
সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনে হচ্ছে কোন ফৌজদারী আইনে নয় । সুতরাং ফৌজদারী
বিধির ধারা বা উপধারা এখানে কার্যকর নয় । মুস্কিল হচ্ছে প্রতিনিয়ত উচ্চ
আদালতে কিছু আইনজীবী কথার মারপ্যাঁচে দেশের সাধারণ মানুষকে বোকা বানানোর
চেষ্টা করেন এবং কখনো কখনো সফলও হন । উচ্চ আদালতের রায়ে কাদের মোল্লার যে
ফাঁসির রায় হয়েছে তা তার কৃতকর্মের ফল । আইনের অধীনে এই রায়ের জন্য দেশের
তরুণ প্রজন্ম দেশের রাজপথে দীর্ঘদিন আন্দোলন করেছে । এটি তাদের জয় । এটি
বাংলাদেশের জয় ।
শুরুর কথায় ফিরে যাই । আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে দেশের মানুষ ঠকে মন্তব্যটি
খুবই নিষ্ঠুর এবং অসত্য । পছন্দ করি আর নাই করি ওই দলটির কারণেই দেশটি আজকে
স্বাধীন এবং দেশের যে যৎসামান্য অর্জন তা এই স্বাধীনতার কারণে । আওয়ামী
লীগের যে সকল দোষত্রুটি আছে তা যদি তারা শোধরাতে পারে তা হলে এই দলটি
বহুদূর যেতে পারে কিন্তু তার জন্য চাই নেতেৃত্বের আরো একটু দূরদর্শিতা । সব
শেষে দেশের মানুষ কাদের মোল্লার রায় দ্রুত বস্তাবয়ন দেখতে চায় । গণজাগরণ
মঞ্চের নতুন প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধাদের অভিবাদন । তারুণ্যের জয় হোক।
লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় । সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৩
WARNING:
Any unauthorized use
or reproduction of
'Community' content is
strictly prohibited
and constitutes
copyright infringement
liable to legal
action.
[প্রথমপাতা] |
লেখকের আগের লেখাঃ
|