প্রথমপাতা  

সাম্প্রতিক সংবাদ 

 স্বদেশ

আন্তর্জাতিক

বাংলাদেশ কমিউনিটি

লাইফ স্টাইল

এক্সক্লুসিভ

বিনোদন

স্বাস্থ্য

বর্তমানের কথামালা

 শিল্প-সাহিত্য

 প্রবাসপঞ্জী 

আর্কাইভ

যোগাযোগ

@

@

@

@

@

@

@

eমহাকালে বিশ্বমানব গাইবে যে তাঁর গানf

@


প্রফেসর আবদুল মান্নান

এটি এখন অনেকটা দিবালোকের মতো পরিষ্কার যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ই বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর বীজ বপিত হয়েছিল । বাঙালি বাংলাদেশকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দখল হতে মুক্ত করতে দীর্ঘ নয় মাস একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল ঠিক আবার সেই বাঙালিদেরই একটি অংশ ছিল যারা কখনো চায়নি তাদের সাধের পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ নামের আর একটি স্বাধীন দেশের জন্ম হোক । এই দলে যেমন ছিল জামায়াত-মুসলীম লীগের ভাবধারার একটি বড় জনগোষ্ঠী ঠিক একই ভাবে ছিলেন আওয়ামী লীগের ভিতরে ঘাপটি মেরে থাকা আরেক দল পঞ্চম বাহিনী । আওয়ামী লীগ কখনো একটি বিপ্লবী দল ছিল না । এটিকে বড়জোর বলা যায় পাতি বুর্জোয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একটি মধ্য বাম পন্থি দল আর এই দলে যারাই শুরু থেকে নেতৃত্বে ছিলেন তাদের বেশীর ভাগের চরিত্রও তাই ছিল । তবে এটি সত্য আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতারা মুসলীম লীগের বিপরীতে দলটিকে সব সময় একটি গণমানুষের দল হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন । জন্ম থেকেই মুসলীম লীগের সাথে সাধারণ জনগণের কোন সম্পৃক্ততা ছিল না । দলের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যের কারণে আওয়ামী লীগকে অনেক চড়াই উৎরাই পার করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হয়েছে । একাধিকবার দলটি ভাঙ্গনের মুখে পরেছে, নেতৃত্ব শূন্য হয়েছে । কয়েকবার রাজনৈতিক দল হিসেবে এটি নিষিদ্ধও হয়েছে । এই দলের অন্যতম নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে বিচারের নামে দুfবার ফাঁসির মঞ্চের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া হয়েছে । এটি এই উপমহাদেশে একটি নজিরবিহীন ঘটনা । মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জুলাই মাসে আওয়ামী লীগেরই একজন প্রতিষ্ঠাতা নেতা, প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী খোন্দকার মোশতাক কোলকাতাস্থ মার্কিন কন্সাল জেনারেলের কাছে কুমিল্লা হতে নির্বাচিত সংসদ সদস্য জহিরুল কাইউমের মাধ্যমে গোপনে সংবাদ পাঠিয়েছিলেন শেখ মুজিবকে যদি মুক্ত করে দেয়া হয় তা হলে তারা মুক্তিযুদ্ধের সমাপ্তি টানবেন । এটি ছিল বাঙালির মুক্তির জন্য যুদ্ধের পিঠে ছুরিকাঘাত করার সামিল । এই প্রসঙ্গে প্রখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক ক্রিস্টোফার হিচেন্স তার ২০০২ সালে প্রকাশিত সারা জাগানো তথ্যবহুল গ্রন্থ eদি ট্রাইয়েল অব হেনরী কিসিঞ্জারf এ উল্লেখ করেন কিসিঞ্জার আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে শুরু হতেই বিভক্তি আনার চেষ্টা করেন । হিচেন্স তার এই গ্রন্থে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের আমলে বাংলাদেশ সহ বিভিন্ন দেশে যড়যন্ত্র, হত্যা ও ক্যূfর মাধ্যমে কী ভাবে বিভিন্ন নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করা হয়েছিল তার একাধিক চমকপ্রদ দালিলিক বর্ণনা দিয়েছেন । হিচেন্স তার গ্রন্থে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন অবমুক্তকৃত গোপন দলিলের বরাত দিয়ে লিখেছেন e১৯৭১ সালের ১১ই আগস্ট হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট নিক্সন, হেনরি কিসিঞ্জার ও আন্ডার সেক্রেটারি অব দি ষ্টেট জন আরউইনের মধ্যে এক সভা অনুষ্ঠিত হয় । সেই সভায় আরউইন রিপোর্ট করেন eকোলকাতায় বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের কয়েকজন নেতা ইয়াহিয়া খানের সাথে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বন্ধ করার ব্যাপারে কোলকাতাস্থ আমাদের কন্সাল জেনারেলের মাধ্যমে কথা বলতে চেয়েছেন (হুবহু অনুবাদ নয়)f । প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন এই ব্যাপারে জানতে পারেন এবং হিচেন্স লিখেছেন eএই সংবাদ জানাজানি হয়ে পরলে মোশতাককে ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে গৃহবন্ধি করা হয়f । ঘটনা এখানেই থেমে থাকেনি । সেই কন্সাল জেনারেল জর্জ আরউইনকে ভারত সরকার সে দেশে অবাঞ্ছিত (চবৎংড়হধ ঘড়হ এৎধঃধ) করে ভারত হতে বহিস্কার করে । বঙ্গবন্ধু হত্যার পিছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা সম্পর্কে পরে আসছি ।
একটি দেশে ষড়যন্ত্র, হত্যা, ক্যূ অথবা অন্য কোন অসাংবিধানিক পন্থায় একটি নির্বাচিত বৈধ সরকারকে উচ্ছেদ করতে হলে তার জন্য সাধারণত একটি ক্ষেত্র বা পটভূমি প্রস্তুত করতে হয় । বাংলাদেশ বা ১৫ই আগস্টের হত্যাকান্ডও এর ব্যতিক্রম ছিল না । এই সব কাজে সাধারণত গুজব, অসত্য, অর্ধ সত্য আর অতিরঞ্জিত তথ্য খুব কৌশলে জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য ব্যবহার করা হয় । এই কাজে দুটি প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করা হতে পারে । একটি হচ্ছে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক সংগঠন আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে গণমাধ্যম । বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয় দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু একটি সম্পূর্ণ যুদ্ধবিধ্বস্থ দেশের প্রথমে প্রধানমন্ত্রী ও পরে রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন । তাঁর সামনে দেশকে আবার এই ধ্বংস স্তুপের উপর দাঁড় করানো ছিল একটি বড় চ্যালেঞ্জ । এক কোটি ছিন্নমূল শরণার্থী দেশে ফিরছেন । দেশের ভিতর আছে আরো কয়েক লক্ষ ভিটে মাটি হতে উচ্ছেদ হওয়া উদ্বাস্তু । সব খ্যদ্য গুদাম খালি । ব্যাংকে নেই একটিও টাকা । পাকিস্তান সেনা বাহিনী আত্মসমর্পণের আগে সব ব্যাংকের ভোল্ট খুলে সব টাকা পয়সা হয় লুঠ করেছে অথবা কেরোসিন ঢেলে জ্বালিয়ে দিয়েছে । দেশের দুই প্রধান সমুদ্র বন্দর, চট্টগ্রাম ও মংলা, পাকিস্তান সেনা বাহিনী হাজার হাজার ভাসমান মাইন ফেলে সম্পূর্ণ অকেজো করে ফেলেছে । দেশের প্রধান দুটি রেল সেতু, হার্ডিঞ্জ আর ভৈরব সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত, তার সাথে বিধ্বস্ত হয়েছে প্রায় চার হাজার ছোট বড় ব্রীজ কালভার্ট । ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিমানবন্দর অকেজো । হাজার হাজার যুদ্ধ ফেরত মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে অস্ত্র । দেশের প্রশাসন চালানোর মতো কোন অভিজ্ঞ প্রশাসনিক কর্মকর্তা বা আমলা নেই । রাস্তায় খালি পায়ে পুলিশ । সীমান্ত পাহাড়া দেয়ার মতো কোন বাহিনী তখনো তৈরী হয় নি । বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরে যারা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন তারা ছিলেন এই দেশের পুলিশ আর সীমান্ত রক্ষীবাহিনী ইপিআর। সাথে ছিল ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট । সীমান্ত রক্ষী বাহিনীতে বাঙালী সদস্য সংখ্যা ছিল খুবই কম এবং এদের অনেকেই আবার মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন । বাঙালির প্রধান খাদ্য চাল । কিন্তু সেই চালের রোপন হতে শুরু করে ধান গোলায় তুলতে সময় লাগবে কম পক্ষে তিন হতে চার মাস । কিন্তু চাষীর ক্ষেত চাষ করতে যে পরিমাণের অর্থ প্রয়োজন তাও তার নেই । সেই সময় বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ছাড়া তিনটি রাজনৈতিক দল ক্রিয়াশীল ছিল-ন্যাপ (ভাসানী), ন্যাপ (মোজাফ্ফর), কমিউনিষ্ট পার্টি । আর আন্ডার গ্রাউন্ড পার্টি হিসেবে ছিল পূর্ব বাংলার কমিউনিষ্ট পার্টি ( মার্কসিষ্ট-লেলিনিষ্ট), ও বাংলাদেশ কমিউনিষ্ট পার্টি (মা-লে) । এই পার্টি গুলিতে আশ্রয় নিল মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী রাজাকার আলবদররা । এদের অনেকে আবার ভাসানী ন্যাপেও আশ্রয় পেল । জন্ম নিল সিরাজ সিকদারের পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি । তারা বাংলাদেশে গলাকাটা রাজনীতির প্রবর্তন করলো । এরা আজ এই পাটের গুদামে আগুন লাগায় তো কাল অমুক ব্যাংক লুট করে । এই সময় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে দুটি গোপন বেতার কেন্দ্রের সন্ধান পাওয়া গেছে বলে ভারত হতে প্রকাশিত হিন্দুস্তান স্টান্ডার্ডে ১৯৭২ সালের ৮ এপ্রিল খবর প্রকাশিত হলো । একটির নাম eবিদ্রোহী বাংলা রেডিওf অন্যটি eস্বাধীন মুসলীম বাংলা রেডিওf। এই সবের মধ্যে আবার একদল ফেরেববাজ রাতারাতি মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগার বনে গেল । এদের বলা হতো ষোড়শ বাহিনী কারণ এদের জন্ম ১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ সাল ।
একদিকে দেশের দুটি প্রধান বন্দর অচল । তার উপর দেশে ধান উৎপাদনে সময় লাগছে । যশোর অঞ্চলে ধানের ক্ষেতে পোকার আক্রমনে কয়েক শত একর জমির ধান সম্পূর্ণ রূপে নষ্ট হলো । সারা দেশে দেখা দিল উপর্যুপরি বন্যা । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পিএল-৪৮০ অধীনে খাদ্য সাহায্য বন্ধ করে দিল । অজুহাত হিসেবে তারা বললো বাংলাদেশ তাদের শত্রু দেশ কিউবায় পাটের ব্যাগ বিক্রি করেছে । খাদ্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র এক চরম অমানবিক আচরণ করে বাংলাদেশের সাথে । ১৯৭৪ সালে দেখা দেয় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ । ১৯৭২ সনের ২৫ ফেব্রুয়ারী মওলানা ভাসানীর পৃষ্টপোষকতায় আর সৈয়দ ইরফানুল বারীর সম্পাদনায় প্রকাশিত হলো সাপ্তাহিক eহক কথা।f । যে মওলানা ভাসানীকে বঙ্গবন্ধু নিজের পিতার মতো শ্রদ্ধা করতেন সেই মওলানা ভাসানী হয়ে গেলেন সত্যিকার অর্থে বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রধান সমালোচক এবং এই সমালোচনার অধিকাংশই ছিল অসত্য ও অর্ধ সত্যের উপর ভিত্তি করে প্রচারিত । অথচ মওলানা ভাসানী ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি । ১৯৭৩ সনে আরব ইসরাইল যুদ্ধের পর সারা বিশ্বে দেখা দিল আর এক ভয়াবহ সংকট । আরব দেশগুলি তেলকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে তেলের মূল্য কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিলে বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে দেখা দেয় মারাত্মক অর্থনৈতিক মন্দা । চালের মূল্য চল্লিশ টাকা মন হতে বেড়ে কোন কোন স্থানে আশি টাকা পর্যন্ত হয়ে যায় । দেয়ালে দেয়ালে লেখা হলো eজয় বাংলার আরেক নাম আশি টাকা চালের দামe অথবা eজয় বাংলার আরেক নাম হরে কৃষ্ণ হরে রাম f। এর আগে মওলানা ভাসানীর eহক কথাf প্রচার করে, বাংলাদেশের সব সীমান্ত ভারতীয় সেনা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে এবং সে কারণে বাংলাদেশ হতে হাজার হাজার টন চাল ভারতে চোরা চালানের মাধ্যমে পাচার হয়ে যাচ্ছে । এটি কেউ অস্বীকার করবে না যে শুধু চাল নয় অনেক কিছুই এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী চোরাচালান অথবা গুদামজাত করেছে করেছে তবে তা হাজার হাজার টন চাল ছিল না কারণ ঐসময় বাংলাদেশ হতে এই পরিমাণের চাল চোরাচালান করার মতো অবস্থা ছিল না । ১৯৭২ সনের ৩রা সেপ্টেম্বর মওলানা ভাসানী ভূখা মিছিলের নামে রাজনৈতিক মাঠ গরম করার চেষ্টা করলেন । ১৯৭২ সনে মেজর জলিল, সিরাজুল আলম খান, আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বে গঠিত হলো বাংলাদেশের প্রথম বিরোধী দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদ । প্রথমে দলটির নাম ছিল এনএসপি । নামটি হিটলারের নাৎসি পার্টির সাদৃশ্য হলে তা পাল্টিয়ে রাখা হয় জেএসডি । বেছে নিল চটকদার শ্লোগান eবৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রf। এই তথাকথিত বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের আসল প্রবক্তা ছিলেন তাত্মিক নেতা, বাংলাদেশের রাজনীতির রহস্য পুরুষ সিরাজুল আলম খান, যিনি এখন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র পরিত্যাগ করে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন আর যখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোন ষড়যন্ত্রের আভাস পান তড়িৎ গতিতে দেশে ফেরেন । জাসদ আবার গণবাহিনী নামের একটি সশস্ত্র বাহিনী গঠন করে যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীদের হত্যা ও বঙ্গবন্ধু সরকারকে উৎখাত । এই এক জাসদই দেশের হাজার হাজারা মেধাবী তরুণ আর যুবককে রাতারাতি পরিণত করে ভয়াবহ সন্ত্রাসী বাহিনীতে। প্রতিষ্ঠিত হয় দলের দৈনিক পত্রিকা eগণকণ্ঠf যার প্রথম সম্পাদক ছিলেন কবি আল মাহমুদ । eহক কথাf আর eগণকণ্ঠf ছড়াতে থাকে নানা ধরণের গুজব যার মধ্যে ছিল জাতীয় রক্ষীবাহিনী ভারতীয় সৈন্য দ্বারা গঠিত, শেখ কামালের ব্যাংক ডাকাতির গল্প আর মেজর ডালিমের স্ত্রী শেখ কামাল কর্তৃক অপহরণ । আসলে বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তিকালে যুদ্ধ ফেরত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গঠন করেছিলেন জাতীয় রক্ষীবাহিনী কারণ এদের বেশীর ভাগেরই নিয়মিত বাহিনীতে যাওয়ার যোগ্যতা ছিল না । বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর এই সব রক্ষীবাহিনীকে কোন স্ক্রীনিং ছাড়াই বাংলাদেশ সেনা বাহিনীতে জেনারেল জিয়া আত্মিকরণ করেন । শেখ কামালের ব্যাংক ডাকাতি নিয়ে যে গল্পটি চালু করা হয় তা ছিল নিছক কল্পনা প্রসূত । শেখ কামালের ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন আজকের বিএনপি নেতা এক সময়ের মন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু । তিনি এই বিষয়ে একাধিকবার বলেছেন সেই রাতে তারা কয়েক বন্ধু মিলে একটি মাইক্রোবাসে দ্রুত গতিতে যাচ্ছিলেন মতিঝিলের ফাঁকা রাস্তা দিয়ে । পুলিশ গাড়ীটিকে থামাতে বললে তারা দ্রুত চলে যাওয়ার চেষ্টা করে এবং পুলিশ গাড়ী লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ে । এতে শেখ কামাল আহত হন । একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ নেতা গাজী গোলাম মোস্তাফার ছেলে, যিনি শেখ কামালের বন্ধু ছিলেন তিনি মেজর ডালিমের স্ত্রীকে উত্ত্যক্ত করার চেষ্টা করেন । এতে স্বাভাবিক ভাবে মেজর ডালিম ক্ষুব্দ হন এবং তিনি বঙ্গবন্ধুকে এর বিচার দেন । উল্লেখ্য ডালিমের পরিবার বঙ্গবন্ধু পরিবারের ঘনিষ্ঠ ছিলেন আর ডালিমের স্ত্রী শেখ রেহানার বান্ধবী ছিলেন । বহুদিন বেগম মুজিব ডালিম আর তার স্ত্রীকে নিজে রান্না করে খাইয়েছেন । বঙ্গবন্ধু গাজী গোলাম মোস্তাফাকে ডেকে এই বিষয়ে কথা বলেন এবং তাঁর ছেলেকে শাসন করতে নির্দেশ দেন । এখানে শেখ কামালের কোন ভূমিকাই ছিলনা । কিন্তু এতে ডালিম শান্ত না হয়ে গাজী গোলাম মোস্তাফার বাড়ীতে গিয়ে তাঁর বাড়ী তছনছ করেন এবং পরিবারের সদস্যদের শাসিয়ে আসেন । ডালিমের আচরণ সেনা সদর গুরুত্ব সহকারে নেয় এবং তাকে চাকুরী হতে বরখাস্ত করা হয় । এই সব ঘটনাকে অতিরঞ্জিত করে দৈনিক eগণকণ্ঠf আর eহক কথাf বাজারে প্রচার করে । ঢাকা হয়ে উঠে একটি গুজবের শহর ।
১৯৭৫ সনের জানুয়ারী মাসে বঙ্গবন্ধু বাকশাল প্রথার শাসন ব্যবস্থা প্রচলন করেন যে ব্যবস্থার অধীনে একাধিক রাজনৈতিক দলের পরিবর্তে দেশে একটি রাজনৈতিক দল থাকবে এবং সেই দলে সকলে সদস্য হওয়ার জন্য আবেদন করতে পারবেন । বাকশাল করার পিছনে উদ্দেশ্য ছিল আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্যান্য দলের নেতা নেত্রীদের দেশ গড়ার কাজে সম্পৃক্ত করা, অনেকটা জাতীয় সরকারের একটি বিকল্প ব্যবস্থা । ইদানিং অনেকেই বাকশালের তুমুল সমালোচনা করেন কিন্তু বাকশাল ব্যবস্থায় দেশ পরিচালনার পূর্বেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয় । এই ব্যবস্থা যথার্থ ছিল কিনা তা যাচাই করার কোন সুযোগ কখনো হয় নি । আর এই সব বিষয়কে সময়ের প্রেক্ষাপটে বিচার করা ভাল । প্রকাশ্যে যখন এইসব কর্মকান্ড চলছিল তখন পর্দার আড়ালে আরেক নাটকের মহড়া দেয়া হচ্ছিল। ১৯৭৩ সালে কিসিঞ্জার মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব নিযুক্ত হন । এর আগে তিনি নিক্সনের নিরাপত্তা উপদেষ্টা ছিলেন । পররাষ্ট্র সচিব হয়েই তিনি যে সকল মার্কিন কর্মকর্তা বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যার প্রতিবাদ করেছিলেন তিনি তাদের প্রত্যেককে এক ধাপ নীচে পদাবনতি করে দেন । ১৯৭৪ সালের অক্টোবর মাসে বঙ্গবন্ধু যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন এবং প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ডের সাথে এক সংক্ষিপ্ত বৈঠকে মিলিত হন । অত্যন্ত অসৌজন্যমূলক ভাবে কিসিঞ্জার সে বৈঠক বর্জন করেন । ১৯৭৪ সালের নভেম্বর মাসে কিসিঞ্জার সস্ত্রীক আট ঘন্টার সফরে বাংলাদেশে আসেন । সফর শেষে তিনি তিন মিনিটের একটি সংবাদ সম্মেলন করেন । সাংবাদিকরা তার কাছে তিন বছর পূর্বে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহরের জাহাজ fএন্টারপ্রাইজf কেন বঙ্গোপসাগরে পাঠিয়েছিলেন তা জানতে চাইলে তিনি তার কোন উত্তর না দিয়ে সংবাদ সম্মেলনের সমাপ্তি ঘোষণা করেন । হিচেন্সfর দেয়া তথ্য অনুযায়ী এর কয়েক সপ্তাহ পর ঢাকার যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের কয়েকজন কর্মকর্তা বাংলাদেশ সেনা বাহিনীর বাছাই করা কয়েকজন মাঝারি পর্যায়ের সেনা কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করেন যাদের মধ্যে ছিলেন কর্ণেল ফারুক আর লেঃ কর্ণেল রশিদ । রশিদ ছিলেন মোশতাকের ঘনিষ্ট আত্মীয় । বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর লেঃ কর্ণেল রশিদ ল-নের গ্রানাডা টেলিভিশনে প্রখ্যাত সাংবাদিক এন্থনি ম্যাসকেরানহাসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেন তিনি মার্চ মাসের ২৮ তারিখ জেনারেল জিয়ার সাথে এই বিষয়ে আলোচনা করেন এবং জিয়া তাকে বলেন তারা এগিয়ে যেতে পারেন তবে সিনিয়র অফিসারদের এই কাজে সরাসরি জড়িত না করলে ভাল হয় । রশিদ মোশতাকের সাথেও এই প্রসঙ্গে একাধিকবার আলোচনা করেন । সাক্ষাৎকারে কর্ণেল ফারুখ রহমানও একই রকম বক্তব্য দেন ।
১৯৭৫ সালে ডেভিড ইউজিন বোস্টার ছিলেন ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত । হিচেন্স লিখেছেন বোস্টার পরিকল্পিত অভ্যূত্থানের ব্যাপারে অবশ্যই জানতেন এবং তিনি তার দপ্তরের কর্মকর্তারা যে ফারুক-রশিদ গং এর সাথে যোগাযোগ রাখছেন এই ব্যাপারে কোন ব্যবস্থা নেয়া হতে বিরত থাকেন । বোস্টার আরো জানতেন তার দপ্তরে কর্মরত সিআইএfর ষ্টেশন চীফ ফিলিপ চেরী এই ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন । এই প্রসঙ্গে ফিলিপ চেরীকে আর এক মার্কিন সাংবাদিক লরেঞ্জ লিফসুলৎজ ১৯৭৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রশ্ন করলে তিনি প্রশ্নের সরাসরি কোন উত্তর না দিয়ে বলেন একটি দেশের দূতাবাসের সাথে অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তি সম্পর্ক রাখতেই পারেন ।
বঙ্গবন্ধুকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে উৎখাত ও হত্যা করার জন্য ক্ষেত্র তৈরী করেছিলেন তাঁর একান্ত ঘনিষ্ট কিছু ব্যক্তি, মওলানা ভাসানীর ন্যাপ, জাসদ, হক কথা, দৈনিক গণকণ্ঠ আর তাঁর আস্থাভাজন কিছু আমলা, যেমন মাহবুব উল আলম চাষী আর আবদুল মোমেন খান (তিনি বঙ্গবন্ধুর খাদ্য সচিব ছিলেন, বিএনপি নেতা ডঃ মইন খানের পিতা) । জিয়া ১৯৭৫ সালে আবদুল মোমেন খানকে তাঁর উপদেষ্টা পরিষদে ঠাঁই দিয়েছিলেন । মওলানা ভাসানী মোশতাককে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন । মওলানার অন্যতম সাগরিদ কাজি জাফর, রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনো পাকিস্তানের ভুট্টোর পিপলস পার্টির আদলে ১৯৭৩ সালে গড়ে তুলেছিলেন নিজেদের দল ইউনাইটেড পিপলস পার্টি । ১৯৭৫ সনের ৩রা নভেম্বর জেল হত্যার পর দিন তারা জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলন করেন এবং সেখানে কাজি জাফর বঙ্গবন্ধু হত্যাকে সমর্থন করে বক্তব্য রাখেন (বাংলাদেশ অবজার্ভার, ৫ নভেম্বর) । তৈরী করা ক্ষেত্রকে ব্যবহার করে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করেছিল এক দল সেনা সদস্য আর তাদের নানা ভাবে সহায়তা করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঠিক যেমন ভাবে চিলির প্রেসিডেন্ট আলেন্দকে হত্যা করা হয়েছিল ১৯৭৩ সালে । বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশে ফিরে এসেছিল পাকিস্তানের ভাবধারার রাজনীতি যার প্রধান পৃষ্টপোষক ছিলেন জেনারেল জিয়া, যাঁকে বঙ্গবন্ধু পুত্রবৎ স্নেহ করতেন । তাঁর জন্য সেনাবাহিনীতে তিনি সৃষ্টি করেছিলেন উপ-সেনা প্রধানের পদ । তার ভাঙ্গা ঘর জোড়া লাগিয়ে দিয়েছিলেন । বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় দোষ ছিল তিনি শত্রু মিত্রের মধ্যে তফাৎ করতে পারতেন না বা করতে চাইতেন না যে দোষটি সম্ভবত তাঁর কন্যার মধ্যেও সংক্রমিত হয়েছে । বঙ্গবন্ধুর মৃত দেহ যখন ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাসভবনের সিঁড়ীতে পরে আছে তখন তাঁর দলের ২৫ জনকে নিয়ে মোশতাক তাঁর মন্ত্রীসভা গঠন করেন । এটি ঠিক এদের কেউ কেউ বন্দুকের নলের ভয়ে এই শপথ নিয়েছিলেন তবে বেশীর ভাগই স্বেচ্ছাই শপথ নিয়েছিলেন । বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর দীর্ঘ একুশ বছর আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে ছিল । এই দীর্ঘ একুশ বছরে বাংলাদেশ শত বছর পিছিয়ে গেছে । এটি সত্য জিয়া বা ভাসানী কেউ এখন বেঁচে নেই কিন্তু তাঁদের উত্তরসুরিরাতো এখনো বহাল তবিয়তে রয়ে গেছে এবং তারা আগের যে কোন সময়ের তুলনায় আরো শক্তিশালী আর সংগঠিত । সুশীল সমাজের নামে তাদের মিত্র হয়েছে অনেক । হয়ত তারা সকলের অগোচরে তাদের পনেরই আগস্টের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার নিয়মিত হুমকী দিয়ে আসছে আর বঙ্গবন্ধু কন্যা চেষ্টা করছেন তাঁর পিতার অসামাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে । তাও তিনি যে নির্বিঘেœ করতে পারছেন তা নয় । বাধ সাধছে অনেক সময় তাঁরই দলের কিছু অপরিনামদর্শি নেতা-কর্মী । পনেরই আগস্টের সকল শহীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ।

লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় । আগস্ট ১৩, ২০১৪

@

@

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

@

[প্রথমপাতা]

@

@

@

লেখকের আগের লেখাঃ

[......লেখক আর্কাইভ]