প্রথমপাতা  

সাম্প্রতিক সংবাদ 

 স্বদেশ

আন্তর্জাতিক

বাংলাদেশ কমিউনিটি

লাইফ স্টাইল

এক্সক্লুসিভ

বিনোদন

স্বাস্থ্য

বর্তমানের কথামালা

 শিল্প-সাহিত্য

 প্রবাসপঞ্জী 

আর্কাইভ

যোগাযোগ

 

 

 

 

 

 

একজন অভিশপ্ত রাজনৈতিক চরিত্রের বিদায়

 


প্রফেসর আবদুল মান্নান

গোলাম আযম । এক নামেই তাকে বাংলাদেশের ষোল কোটি মানুষ চেনেন । চল্লিশ বছর আগে তাকে সাড়ে সাতকোটি মানুষ চিনতো এখন দেশের ভিতরে ষোল কোটি মানুষতো চেনেনই দেশের বাইরেও কোটি কোটি মানুষ এই অভিশপ্ত চরিত্রটিকে চেনেন । তার এই পরিচয় কোন ভাল কাজের জন্য নয় । তার এই ব্যাপক পরিচিতি কারণ তিনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালির বিরুদ্ধে পাকিস্তানের দখলদার সেনাবাহিনীকে শুধু সকল প্রকার মদদ দিয়েছিলেন তাই নয় নিজের রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামকে পাকিস্তানি ঘাতক সেনাবাহিনীর অবিচ্ছেদ্য অংশ করে তুলেছিলেন । ১৯৭১ সনে তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের আমীর । পরবর্তিকালে হয়েছিলেন জামায়াতে ইসলাম বাংলাদেশের আমীর । গোলাম আযম হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা ও গণহত্যার একজন মূর্তমান প্রতীক । একাত্তর সালে তার অপরাধের জন্য বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল বয়সের কথা বিবেচনা করে গোলাম আযমকে ৯০ বছরের কারাদন্ড দিয়েছিল । সেই কারাদন্ড ভোগ করা অবস্থায় তিনি গত বৃহষ্পতিবার রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে মৃত্যুবরণ করেন । বঙ্গবন্ধুকে তিনি বাংলাদেশে সৃষ্টিতে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য চরম ঘৃণা করতেন । সে বঙ্গবন্ধুর নামের হাসপাতালেই তার মৃত্যু হলো । খবরটি যখন প্রথম জানা যায় তখন আমি একটি প্রাইভেট টিভি চ্যানেলের এক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করছিলাম । সাথে অনুষ্ঠানের সঞ্চালক সহ আরো চারজন আলোচক উপস্থিত ছিলেন । সংবাদটি প্রচার করে সঞ্চালক আমাদের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলেন । শুধু বললাম সংবাদটি অনুষ্ঠানে এসেই শুনেছি, মারা গিয়েছেন কারাগারে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধীর দন্ড মাথায় নিয়ে, এর বেশী কিছু বলার নেই । অন্যরাও আমার কথার সাথে সুর মেলালেন । গত কয়দিন গোলাম আযমের মৃত্যু সংবাদ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ তোলপাড় চলছে । তোলপাড়ের অন্যতম ইস্যু তার মৃত্যু সংবাদটি কোন গণমাধ্যম কেমন ভাবে প্রচার করেছে তা নিয়ে । কেউ কেউ তাদের প্রক্রিয়ায় লিখেছেন বেশ কয়েকটি টিভি চ্যানেল গোলাম আযমের মৃত্যু সংবাদ প্রচার করে ‘ইন্নাহ লিল্লাহ..’ পড়েছে বা কোন কোন পত্রিকা তা লিখেছে । তাদেও মতে তা অনুচিত হয়েছে । একজন মুসলমানের মৃত্যুর পর ‘ইন্নাহ লিল্লাহ’ পড়াটা নিয়ম । কিন্তু গোলাম আযম যেহেতু দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন আর নিরাপরাধ মানুষ হত্যা করে নিজের হাতকে রক্তে রঞ্জিত করেছেন সে কারণে তিনি শ্বাসত ইসলামের মর্মবাণীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন । ইমাম আবু হুরাইরার মতে হযরত মুহাম্মদ (দঃ) বলেছেন ‘সেই ব্যক্তিই মুসলমান যার জিহ্বা আর হাত হতে সকল মানুষ নিরাপদ থাকে ।’ একাত্তরে গোলাম আযমের হাত ও তার জিহ্বার কারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে এমন কেউই নিরাপদ ছিলেন না । আর বড় প্রশ্ন যাদের হত্যাকান্ডে গোলাম আযম সহায়তা করেছেন তাদের মৃত্যুর পর তিনি কী ‘ইন্নাহ লিল্লাহ’ পড়েছিলেন ? একমাত্র জামায়াতের মূখপত্র ‘নয়া দিগন্ত’ গোলাম আযমের মৃত্যু সংবাদটি প্রধান সংবাদ (লিড নিউজ) করে তাকে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করেছে । তারা তার একটি সংক্ষিপ্ত জীবনীও ছেপেছে । কিন্তু সেই জীবনীতে ১৯৭১ সালকে চতুরতার সাথে গায়েব করা হয়েছে । একটি অনলাইন পত্রিকায় গোলাম আযমের কনিষ্ঠ সন্তান সালামান আযমী তার পিতা সম্পর্কে ‘সন্তানের চোখে অধ্যাপক গোলাম আযম’ শিরোনামে একটি পুরানো লেখা পুনমূদ্রণ করেছে যেখানে তিনি বলার চেষ্টা করেছেন তার পিতা কত বড় মাপের একজন মহান ব্যক্তি ছিলেন এবং কী অন্যায় ভাবে তার পিতাকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে কারাদন্ড দেয়া হয়েছে । জামায়াত-বিএনপি’র মতো সালমানও তার লেখায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ।
গোলাম আযম ও তার দল তাকে ভাষা সৈনিক হিসেবে পরিচিতি দিতে পছন্দ করে । অনেকের প্রশ্ন তিনি কী ভাবে এই তকমার অধিকারী হলেন ? ১৯৪৮ সনে যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী ঢাকা সফর করেন তখন ঠিক হলো বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে ডাকসুর পক্ষ হতে একটি স্মারক লিপি দেয়া হবে । ১৯৪৮ সনে ডাকসুর সহ-সভাপতি ছিলেন অরবিন্দ বসু আর সাধারণ সম্পাদক গোলাম আযম । স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত ডাকসুর সভাপতি আর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হতেন পালাক্রমে, আবাসিক হল ভিত্তিক । স্বাধীনতা পরবর্তিকালে ছাত্রছাত্রীদের সরাসরি ভোটে প্রথম সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম । ১৯৪৮ সনে সাধারণ সম্পাদক ছিলেন গোলাম আযম । রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের শুরু থেকে এর বিরুদ্ধে মুসলীম লীগ সরকারের একটা বড় অভিযোগ ছিল এই আন্দোলন ভারত থেকে আসা হিন্দুদের মদদে হচ্ছে । লিয়াকত আলী খানের হাতে যদি স্মারক লিপিটা অরবিন্দ বসু দেন তা হলে লীগ সরকারের এই প্রচারণা আরো জোর পাবে । ঠিক হলো সহ-সভাপতির বদলে সাধারণ সম্পাদকই স্মারক লিপিটা প্রধানমন্ত্রীর হাতে দেবেন । গোলাম আযম সেই কাজটিই করেছিলেন । সেই এক কর্মের কারণেই তিনি ভাষা সৈনিক । মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি একাধিকবার বলেছেন ভাষা আন্দোলন মারাত্মক ভুল ছিল । কেউ কেউ তাকে আবার মওলানা ভাসানীর আদলে মজলুম জননেতা বলেও সম্বোধন করেন । কেন করেন তার কোন ব্যাখ্যা নেই । তবে সব কিছুকে ছাড়িয়ে গেছে তার একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের পরিচয় । ১৯৭১ সালে পুরো মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন সময়ে বাংলাদেশে সকল ধরণের অপকর্মের সাথে জড়িত থেকে যখন বুঝলেন তার সাধের পাকিস্তান ভেঙ্গে যাচ্ছে তখন তিনি ২২ নভেম্বর পাকিস্তানে চলে যান এবং সেখানে পরবর্তিকালে গঠন করেন ‘পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি’ । তার এই সংগঠনকে তিনি মধ্যপ্রাচ্যের আরব রাষ্ট্রগুলিতে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রচার চালানোর জন্য পরবর্তি কয়েক বছর ব্যাপক ভাবে ব্যবহার করেন । তার এই কাজে তকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভুট্টো ব্যাপক ভাবে সাহায্য করেন এবং মাহমুদ আলী নামক একজনকে সার্বক্ষণিক ভাবে তার জন্য নিয়োজিত করেন । ১৯৭৩ সনে এই কমিটির নামে গোলাম আযম লন্ডনে একটি দপ্তর খুলেন এবং সেখান হতে ‘সোনার বাংলা’ নামের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন যার একমাত্র উদ্দেশ্যই ছিল বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানো । ১৯৭৫ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানোর জন্য তিনি সৌদি আরব সফর করেন । এর আগে বাংলাদেশকে সৌদি আরব স্বীকৃতি না দেয়ার জন্য তিনি বাদশাহ ফায়সালেক সাত বার অনুরোধ জানান । সৌদি আরব বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর । তার প্রচারণার মূল বিষয় ছিল বাংলাদেশ হিন্দুরা দখল করে নিয়েছে এবং সব মাদ্রাসা ও মসজিদকে মন্দিরে রূপান্তরিত করেছে । এই গুলি পুনঃনির্মাণ করার জন্য মুক্ত হস্তে দান করার জন্য তিনি সকলকে আহ্বান জানাতেন । এই কথা বলে তিনি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি হতে কত কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তার কোন হদিস নেই । বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৩ সালের ১৮ই এপ্রিল আরো অনেকের সাথে গোলাম আযমের নাগরিকত্ব বাতিল করে ।
১৯৭৮ সালের ১১ই আগষ্ট জিয়াউর রহমানের সরকার গোলাম আযমকে পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের অনুমতি দেয় । এই জিয়াউর রহমানই বঙ্গবন্ধু সরকার কর্তৃক সাংবিধানিক ভাবে নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াত সহ সকল ধর্ম ব্যাবসায়ি দলকে স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতি করার অনুমতি দেন । পাকিস্তানি নাগরিক গোলাম আযমকে জামায়াত ১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর তাদের আমীর নির্বাচিত করে । তবে তিনি বাংলাদেশে ফেরার পর হতেই জামায়াতের মূল নীতি নির্ধারক ছিলেন । গোলাম আযম ও অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ১৯৯১ সনে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের দাবিতে গড়ে উঠে ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’। শহীদ জননীর এই আন্দোলনের ষ্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পরে সারা বাংলাদেশে । তার নেতৃত্বে আয়োজিত হয় গণ আদালত যেখানে গোলাম আযম আর তার দোসরদের প্রতীকী বিচার হয় এবং তাদের মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা হয় । সেই সময় বেগম জিয়া ক্ষমতায় । তার সরকার শহীদ জননীসহ এই গণ আদালতের সাথে যারা জড়িত ছিলেন তাদের ২৪ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতা মামলা দায়ের করে এবং মামলা মাথায় নিয়ে শহীদ জননী বাংলাদেশ হতে অনেক দূরে যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যু বরণ করেন । জিয়াউর রহমান হোক আর বেগম জিয়া তাদের দু’জনের সাথেই গোলাম আযম ও জামায়াতের একটি আত্মার সম্পর্ক ছিল ।
গোলাম আযম বা যুদ্ধাপরাধীদের অনেক সুহৃদ প্রায়শঃ বলে থাকেন বঙ্গবন্ধু সরকারতো যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করে দিয়েছেন তাহলে আবার তাদের বিচারের প্রশ্ন কেন আসবে ? তারা ভুল বলেন । বঙ্গবন্ধু ঘোষিত সাধারণ ক্ষমা সকলের বেলায় প্রযোজ্য ছিল না । সুনির্দিষ্ট ভাবে যারা মানবতা বিরোধী অপরাধের সাথে জড়িত ছিল তারা এই ক্ষমার আওতার বাইরে ছিলেন, যাদের শীর্ষে ছিলেন গোলাম আযম । ২০০৮ সংসদ নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা অঙ্গিকার করেছিলেন তিনি ক্ষমতায় গেলে এই যুদ্ধাপরাধীদের তিনি বিচার করবেন । তিনি তাঁর কথা রেখেছেন । আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল গঠিত হয়েছে এবং গোলাম আযম সহ তার একাধিক সাথী ঘাতকদের সেই ট্রাইবুনালে বিচার হয়েছে । এদের কয়েক জনের মৃত্যুদন্ড ও কয়েকজনের আমৃত্যু কারাদন্ড হয়েছে । মুক্তিযুদ্ধ ও তার পরবর্তি প্রজন্ম শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ । গোলাম আযমকে আবার ‘অধ্যাপক’ গোলাম আযমও বলা হয় । তিনি ১৯৫০ হতে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত রংপুর কারমাইকেল কলেজে শিক্ষকতা করেছেন । চার বা পাঁচ বছর কলেজে শিক্ষকতা করলে কেউ ‘অধ্যাপক’ হয় না । এটি হতে হলে অনেকগুলি ধাপ পার হতে হয় যা গোলাম আযম হন নি । গোলাম আযম একাত্তরে সব সময় বলতেন ‘পাকিস্তান হচ্ছে বিশ্ব ইসলামের আবাস । সুতরাং পাকিস্তানের অখন্ডতা না থাকলে জামায়াতের কর্মীদের বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই’ । গোলাম আযমের পাকিস্তানের অখন্ডতা বাংলাদেশের ত্রিশ লাখ শহীদ আর আড়াই লক্ষ নির্যাতিত মা-বোন ১৯৭১ সালে ভেঙ্গে দিয়েছেন । সুতরাং গোলাম আযমের মরদেহ দাফন করার জন্য অবশিষ্ট পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয়াটাই যুক্তিসংগত ছিল । যে দেশের জন্মের তিনি বিরোধীতা করেছেন, যে দেশের পবিত্র মাটির সাধে ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত মিশে আছে সেখানে গোলাম আযমের কবর দেয়াটা মোটেও সমীচীন নয় । গোলাম আযম বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি অভিশপ্ত চরিত্র । বাংলাদেশের মানুষ এই চরিত্রটিকে চিরদিন রাজনীতির একজন খলনায়ক হিসেবেই মনে রাখবেন ।

লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় । অক্টোবর ২৫, ২০১৪ ।

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ

[......লেখক আর্কাইভ]