|
চলমান উপজেলা নির্বাচন হতে আওয়ামী লীগ কি শিক্ষা নিলো?
-প্রফেসর আবদুল মান্নান দেশে উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একটি নির্বাচন কেন্দ্রিক কর্মযজ্ঞ চলছে । এই কর্মযজ্ঞটি চলার কথা ছিল গত ৫ জানুয়ারি দশম সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে । দূর্ভাগ্য দেশের মানুষের যে সেই সম্ভাব্য উৎসবমূখর কর্মযজ্ঞ উপভোগ করা হতে মানুষ বঞ্চিত হয়েছিল বেগম জিয়ার নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের কিছুটা নির্বুদ্ধিতার কারণে । বেগম জিয়া আর তাঁর মিত্ররা দাবি করছিল সংবিধানের আওতা বহির্ভূত একটি অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন করতে । সেটি সম্ভব ছিল না কারণ ইতোমধ্যে দেশের সর্বোচ্চ আদালত এই ব্যবস্থা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সাথে সাংঘর্ষিক বলে বাতিল করেছে । যা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সাথে সাংঘর্ষিক তা কোন ভাবেই কার্যকর করা সম্ভব নয় । এমনটি করতে হলে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিবর্তন করতে হবে এবং তা একমাত্র সম্ভব নতুন একটি সংবিধান প্রণয়ন করার মাধ্যমে । তা আগামীতে করা হবে কি না তা নির্ধারণ করার দায়িত্ব একান্ত ভাবে রাজনীতিবিদদের । বর্তমান সংবিধান রেখে ১৮ দলের দাবি অনুযায়ী নির্বাচন করতে গেলে তা একটি রাষ্ট্রদ্রোহিতা মূলক কাজ হতে পারতো । অথবা ওই নির্বাচনের বিরুদ্ধে কেউ একজন সংক্ষুব্দ ব্যক্তি আদালতের শরণাপন্ন হলে নির্বাচনটিই ঝুলে যেত । এর ফলে দেশে কোন একটি তৃতীয় শক্তি ক্ষমতা দখলের পথ খুঁজে বের করা সহজ হয়ে যেত । সম্ভবত বেগম জিয়া বা তাঁর দল তাই প্রত্যাশা করেছিলেন । ৫ তারিখের নির্বাচন একটি আদর্শ সংসদ নির্বাচন ছিল না তা সকলে স্বীকার করবেন কারণ এখানে দেশের অন্যতম বৃহত্তম দল বিএনপি অংশ গ্রহণ করে নি কিন্তু এটা স্বীকার করতেই হবে এই নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হওয়ার কারণে দেশ একটি সাংবিধানিক সংকট হতে বেঁচে গিয়েছে । এই সংসদ সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচিত হয়েছে পাঁচ বছরের জন্য । সংসদ পাঁচ বছর থাকবে কি না তা নির্ধারণ করার দায়িত্ব একান্ত ভাবে সংসদ ও সরকারের । সরকার ইচ্ছা করলে সংবিধানে দেয়া ক্ষমতা বলে তার মেয়াদ নির্ধারণ করতে পারে । তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন দশম সংসদ নির্বাচনে অংশ নিলে বিএনপি নিশ্চিত ভাবে লাভবান হতো কিন্তু অংশ না নেয়াটা ছিল একটি কৌশলগত আত্মঘাতী ভুল এবং এই ভুল পদক্ষেপে ইন্ধন যুগিয়েছে দলের কিছু অপরিপক্ক পরামর্শদাতা, কিছু ফন্দিবাজ সুশীল ব্যক্তি আর এক শ্রেণীর মিডিয়া । ১৯৭০ এর ঐতিহাসিক নির্বাচনটি হয়েছিল একটি সামরিক শাসনের অধীনে এবং ইয়াহিয়া খান একটি অবশ্যই পালনীয় আইনগত বাধ্যবাদকতা ঘোষণা করেছিলেন যাকে বলা হয় লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক যার মূল বক্তব্য ছিল সেই নির্বাচনের মাধ্যমে যে গণপরিষদ নির্বাচিত হবে তা পাকিস্তানের জন্য একটি সংবিধান রচনা করবে তবে সেই সংবিধান ইয়াহিয়া খানের পছন্দ না হলে তা তিনি বাতিল করে দেবেন এবং সংসদও ভেঙ্গে দেবেন । এমন একটি অবস্থায় বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের প্রায় সকল রাজনৈতিক দল অনুরোধ করেছিলেন তিনি যেন সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করেন । এমন কি আওয়ামী লীগের মধ্যেও একটি অংশ ছিল যারা এমন একটি শর্তযুক্ত নির্বাচনে যাওয়াটা সমীচীন মনে করেন নি । পাকিস্তানের অন্যতম বৃহত্তম দল মওলানা ভাসানীর ন্যাপ নির্বাচন বর্জন করে আওয়াজ তুললো ’ভোটের আগে ভাত চাই ’ আর ‘ভোটের বাক্সে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ । মওলানা ভাসানী একজন বড় মাপের রাজনৈতিক নেতা ছিলেন কিন্তু অনেক সময় বাস্তবতাকে বুঝতে পারতেন না । কিন্তু বঙ্গবন্ধু অনেক দূরদর্শী নেতা ছিলেন । তিনি সকল বাধা উপেক্ষা করে সেই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন যার ফলাফল আজকের বাংলাদেশ। ২০১৪ সালের উপজেলা নির্বাচন নিয়ে যত হৈচৈ হচ্ছে ইতোপূর্বে তেমনটি দেখা যায় নি । এরশাদ প্রণীত উক্ত নির্বাচন এরশাদের আমলেই দু’বার অনুষ্ঠিত হয়েছিল কিন্তু সেই নির্বাচন সম্পর্কে তেমন একটা হৈচৈ হয়নি । বেগম জিয়া তৃণমূল পর্যায়ে ক্ষমতায়নে তেমন একটা বিশ্বাসী ছিলেন না এমন কি তাঁর স্বামী জেনালের জিয়া কর্তৃক প্রণীত গ্রাম সরকার বিষয়েও না । তিনি ক্ষমতায় এসে উপজেলা নির্বাচন ব্যবস্থা বাতিল করে দেন কিন্তু তার পরিবর্তে তৃণমূল পর্যায়ে প্রশাসনকে নিয়ে যেতে তেমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করার কোনরূপ আগ্রহ দেখান নি । শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সনে সরকার গঠন করলে তার আমলে উপজেলা পদ্ধতি পুনরুজ্জীবিত করা হয় এবং নারীর ক্ষমতায়নের অংশ হিসেবে উপজেলায় একজন মহিলা ভাইস চেয়্যারম্যান নির্বাচিত করার বিষয়টি অন্তর্ভূক্ত করে উপজেলা নির্বাচনে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেন । কিন্তু তাঁর সেই আমলে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল কিন্তু তাতে দেশের মিডিয়া আর সুশীল সমাজ এমন হুমড়ি খেয়ে পরে নি । শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে দ্বিতীয়বারের মতো সরকার গঠন করলে জাতীয় নির্বাচনের দু’মাসের মাথায় আর একটি উপজেলা নির্বাচন করেন কিন্তু ঐ যাত্রায়ও সেই নির্বাচন নিয়ে তেমন একটা হৈচৈ হয় নি । তবে পরবর্তীকালে উপজেলা পরিষদকে সঠিকভাবে ক্ষমতায়ন করতে ব্যর্থ হওয়ায় এবং স্থানীয় সংসদ সদস্যদের উপজেলা পরিষদের উপর খবরদারি করার সুযোগ করে দেয়ায় পরিষদের সদস্যরা তার তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দীর্ঘ দিন নিষ্ফল আন্দোলন করেন । কিন্তু উপজেলা নির্বাচনের আগে বা পরে কোন দল কত আসন পেল তা নিয়ে কেউ তেমন উচ্চবাচ্য করে নি কারণ এই নির্বাচনটিই হচ্ছে একটি স্থানীয় সরকার নির্বাচন এবং সংবিধানের আওতায় প্রণীত আইনের কারণে তা দলীয় পরিচয়ে হওয়ার কোন অবকাশ নেই । কিন্তু এইবার তার ব্যতিক্রম দেখা গেল । এই প্রথম বারের মতো শোনা গেল এই যাবত যে দুই দফায় নির্বাচন হয়েছে তাতে কোন দলের কত জন নির্বাচিত হয়েছেন তার একটি ধারাবাহিক হিসাব। দেশের প্রথম সারির দৈনিক পত্রিকা গুলি খুললেই দেখা যায় একেবারে গ্রাফ দিয়ে তারা বুঝানোর চেষ্টা করছে এই নির্বাচনে বিএনপি কত আসনে আওয়ামী লীগকে পরাজিত করেছে এবং জামায়াতের বিরুদ্ধে এত আন্দোলনের পরও তারা কত ভাল ফলাফল করেছে । আসলে বাংলাদেশের এক শ্রেণীর মিডিয়া যে কাজগুলি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর করবেন বলে ঠিক করে রেখেছিলেন তা তারা বিএনপি’র অসহযোগিতার কারণে করতে না পেরে উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে করেছে । অনেকটা দুধের স্বাধ ঘোলে মেটানোর মত । বলার অপেক্ষা রাখে না উপজেলা নির্বাচনটি যদিও নির্দলীয় একটি নির্বাচন এবং এই নির্বাচনের সাথে জাতীয় নির্বাচনের তেমন একটা সম্পর্ক নেই তথাপি তা নানা কারণে একটি দলীয় রং পেয়েছে, বিশেষত বিএনপি’র কাছে । প্রতি সন্ধ্যায় বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব এই বিষয়ে সাংবাদিকদের ডেকে নিয়মিত ব্রিফীং করছেন এবং তাদের মনোভাব তাদের মাধ্যমে জনগণকে জানিয়ে দিচ্ছেন । অন্যদিকে এই ব্যাপারে আওয়ামী লীগের তেমন একটি গরজ আছে বলে মনে হয় না । দীর্ঘদিন লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকার পর গত সোমবার দলের সম্পাদক সৈয়দ আশরাফকে দেখা গেল নিজ দলের একটি সভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে বলছেন সরকার আগামীতে উপজেলা নির্বাচনও দলীয় পরিচয়ে করার চিন্তা ভাবনা করছে । তাহলে লড়াই হবে নৌকার সাথে ধানের শীষের, বদনার সাথে বোতলের না । তখন দলের নাম ভাঙ্গিয়ে কেউ বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করতে পারবে না । করলে তার বিরুদ্ধে দলীয়ভাবে ব্যবস্থা নেয়া যাবে যা বর্তমানে কার্যকরভাবে তেমন একটি সম্ভব নয় । অবস্য তার একদিন পরই তিনি আবার বললেন, না, স্থানিয় সরকার নির্বাচন নির্দলীয় ভাবেই হবে । দেশের বৃহত্তম দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা নিয়মিত এই ধরণের বক্তব্য দিলে মানুষ বিভ্রান্ত হয় । অনেকে প্রশ্ন করেন জামায়াতের বিরুদ্ধে এত আন্দোলন তারপরও তারা কী ভাবে এই নির্বাচনে এত ভাল করলো ? সেদিন একটি টকশোতে টেলিফোনে একজন প্রশ্ন করলেন তাহলে মানুষ কি পেট্রোল দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারার বিষয়টি অনুমোদন করলো ? বিষয়টি তেমন সরলিকরণ করলে হবে না । স্থানীয় নির্বাচনে অনেক সমীকরণ কাজ করে যা জাতীয় নির্বাচনে করে না । জামায়াত বর্তমানে আর নির্বাচন কমিশনে একটি নিবন্ধিত দল নয় । ইচ্ছা করলেও তারা আর জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না । অনেক জায়গায় তাদের সাথে বিএনপি’র নির্বাচনী সমঝোতা হয়েছে । নির্বাচনের রাজনীতিতে সেটি নতুন কোন বিষয় নয় এবং তাতে অসুবিধারও কিছু দেখি না । বরং আওয়ামী লীগের তাদের শরিকদের সাথে এই সমঝোতা করতে না পারাটা তাদের সাংগঠনিক দুর্বলতাকে আবারো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল । কোন কোন এলাকায় আবার জামায়াত বা বিএনপি’র সাথে আওয়ামী লীগেরও আঁতাতের কথা শোনা যায় । জামায়াতের বিশাল পরিমানের অর্থভান্ডার এখানে বড় ভূমিকা রেখেছে । ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি না আসাতে তাদের লোকসানতো ষোল আনা আর আওয়ামী লীগের কম পক্ষে বার আনা । কারণ যদি বিএনপি নির্বাচনে আসার ফলে একটি প্রতিদ্বন্ধিতাপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতো তা হলে আওয়ামী লীগ সাংগঠনিক ভাবে দলকে শক্তিশালী করতে পারতো যা এই মুহূর্তে দলটিতে নেই । আর উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি অংশ গ্রহণ করার কারণে তাদের লাভ ষোল আনা কারণ তার ফলে তারা তৃণমূল পর্যায়ে দলকে সংগঠিত করার একটা সুযোগ পেয়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রে তা তারা কাজেও লাগিয়েছে । আর আওয়ামী লীগ তা করতে ব্যর্থ হয়েছে । সম্ভবত আওয়ামী লীগ এখনো একটি ঘোরের মধ্যে আছে যার জন্য আগামীতে তাদের চড়া মূল্য দিতে হতে পারে । চলমান উপজেলা নির্বাচনের আরো তিনটি দফা বাকি আছে । এই তিন দফা নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ তার সাংগঠনিক দূর্বলতাগুলি কাটিয়ে উঠতে পারবে কিনা অথবা আদৌ চেষ্টা করবে কিনা তা এই মুহূর্তে কোটি টাকার প্রশ্ন । আজ না হোক কাল বিএনপি জামায়াত যৌথভাবে বর্তমান সরকারকে একাধিক দেশী ও বিদেশী শক্তির মদদে ধাক্কা দেয়ার চেষ্টা করবে । বর্তমান সংগঠন নিয়ে সেই ধাক্কা মোকাবেলা করা তেমন সহজ নাও হতে পারে । লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় । মার্চ ৫, ২০১৪
WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action.
|
লেখকের আগের লেখাঃ
|