[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

একাত্তরের চট্টগ্রাম: এই সময়

 


-প্রফেসর আবদুল মান্নান

ঐতিহাসিক ভাবে বিপ্লব তীর্থ হিসেবে খ্যাত চট্টগ্রামের অবস্থা কেমন ছিল ১৯৭১ এর মার্চে এমন প্রশ্ন আমাকে অনেকে করেন । ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর রমনা রেস কোর্সের সেই ঐতিহাসিক ভাষণের পর ৯ তারিখ বিনা টিকেটে নিজ শহর চট্টগ্রামে চলে যাই । বিনা টিকেটে ট্রেনে চড়ার কারণ ছিল কমলাপুর ষ্টেশনে গিয়ে দেখি সেখানে টিকেট বিক্রি করার মতো কেউ নেই । প্লাটফর্মে দাঁড়ানো গ্রীন এ্যরো ট্রেনে উঠে পড়ি । পথে থামতে থামতে রাত প্রায় একটায় ট্রেন চট্টগ্রাম বটতলি ষ্টেশনে পৌঁছে । ট্রেন হতে নেমেই শুনি চারিদিকে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান। ষ্টেশন রোডে তা একটু জোরে শোনা যাচ্ছে কারণ ষ্টেশনের পাশেই রেলওয়ে রেস্ট হাউজে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ গড়ে তুলেছে একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ যা সামাল দিচ্ছেন চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহম্মদ চৌধুরী । সেখানে রাত দিন আওয়ামী লীগ আর ছাত্র লীগ নেতৃবৃন্দের আনাগোনা । জহুর আহম্মদ চৌধুরী, এম এ হান্নান, ডাঃ আবু জাফর (পরে শহিদ), এম এ মান্নান সহ অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতারা দলীয় নেতা কর্মী ছাড়াও সাধারণ জনগণকে নানা ধরণের নির্দেশ দিচ্ছেন । ৯ তারিখের পর প্রায় প্রতিদিনই রেলওয়ের রেষ্ট হাউজে গিয়েছি আর নেতাদের নির্দেশ নিয়েছি । জহুর আহম্মদ চৌধুরী পাশের একটি কক্ষে রাতে থাকার ব্যবস্থাও করে ফেলেছিলেন । তাঁর একটা সুবিধা ছিল যে তিনি শ্রমিক রাজনীতি করতেন এবং রেল সহ সর্বস্তরের শ্রমিকরা একাত্তরের ২৬ মার্চ পূর্ব পর্যন্ত সকল কর্মসূচীতে তাঁকে সর্বাত্মক সহায়তা করেছিলেন । এই ঐতিহাসিক রেষ্ট হাউজটি বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনকে হস্তান্তর করা হয় । তারা এর নতুন নামকরণ করে মোটেল সৈকত । পরে তা ভেঙ্গে একটি আধুনিক মোটেল নির্মাণ করার পরিকল্পনা করা হয় । সেই মোটেল ভাঙ্গা হয় কিন্তু আজতক তা আর নির্মাণ করা হয় নি । আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ছাড়াও ন্যাপ (তখনও কমিউনিষ্ট পার্টি প্রকাশ্যে আত্মপ্রকাশ করেনি) ও ছাত্র ইউনিয়নও নিজ নিজ অবস্থান হতে চট্টগ্রামে আন্দোলনে জড়িত ছিল । বস্তুত পক্ষে ১ লা মার্চ ইয়াহিয়া খান ৩রা মার্চের ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য গণপরিষদ অধিবেশন স্থগিত করার পর হতেই ঢাকার মতো চট্টগ্রামেও রাজপথের আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে । এই আন্দোলনে এক দিকে নেতৃত্ব দেন চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের নেতৃবৃন্দ আর অন্যদিকে বুদ্ধিজীবীদের একটি বড় অংশ পাশাপাশি আর একটি আন্দোলন মঞ্চ গড়ে তোলেন । এই মঞ্চটি গড়ে উঠে মূলত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির । এতে যোগ দেন অধ্যাপক আবুল ফজল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এ আর মল্লিক, অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, অধ্যাপক আবদুল করিম, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক আলি ইমদাদ খান, অধ্যাপক জাকিউদ্দিন, অধ্যাপক মমতাজউদ্দিন আহমদ, অধ্যাপক ফজলি হোসেন, অধ্যাপক অনুপম সেন (শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক), অধ্যাপক আবু জাফর, অধ্যাপক আবদুল করিম সংষ্কৃতি কর্মি ডাঃ কামাল এ খান, মাহবুব হাসান, ন্যাপ নেতা শহিদুল্লাহ, ভাষা সৈনিক চৌধুরি হারুন-উর-রশিদ, প্রমূখরা। তারা সর্বস্তরের জনগণকে সম্পৃক্ত করে প্রতিদিন লালদিঘীর মাঠে বিকালে আলোচনা সভা ও সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠানের অয়োজন করতেন । চট্টগ্রাম কলেজের বাংলার অধ্যাপক মমতাজউদ্দিন লিখেছিলেন নাটক ‘জল্লাদেও দরবার’ । এই নাটকে যার অভিনয় করেছিলেন তাদেও মধ্যে ছিলেন মাহবুব হাসান, সিএম রোজারিও, হাবিবুর রহমান উল্লেখযোগ্য । চট্টগ্রাম অবস্থিত প্রগতী ইন্ডাসট্রিজের তৎকালিন জিএম ছিলেন হাবিবুল্লা খান । তাঁর স্ত্রী সালমা খান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক । হাবিবুল্লাহ খান একটি গাড়ী দিয়ে শিক্ষকদের চলাচলের জন্য সার্বিক সহায়তা করেন । তাদের আরো সহায়তা করেছিল ছাত্রলীগ আর ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা ।
লালদিঘীর মাঠের পাশাপাশি চট্টগ্রাম কলেজ মাঠে (প্যারেড মাঠে) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রাক্তন ছাত্রদের উদ্যোগে আর একটি মঞ্চ স্থাপন করা হয় ২৪ মার্চ । এই মঞ্চ স্থাপনের পিছনে প্রাক্তন ছাত্র শামসুল হোসাইন, ওয়াহেদ আসগর চৌধুরী, আখতার আলি প্রমূখরা যথেষ্ট অবদান রেখেছিলেন । পরবর্তীকালে আবদুর রব পাকিস্তান সেনা বাহিনীর হাতে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন । এই মঞ্চ স্থাপনের পিছনে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালিন উপাচার্য অধ্যাপক এ আর মল্লিকও সাধ্যমতো সহযোগিতা করেন । অধ্যাপক মমতাজউদ্দিন ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ শিরোনামে একটি নাটক লেখেন প্রাক্তন ছাত্রদের জন্য যা চট্টগ্রাম বেতারের শিল্পীরা সহ অন্যান্য শিল্পীদের দ্বারা অভিনীত হয় ।
শহরে যখন বাঙালিরা আন্দোলনে লিপ্ত তখন চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি অবাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় অবাঙালিরা বাঙালিদের বিরুদ্ধে দাঙ্গা লাগানোর চেষ্টা করে । এর মধ্যে ফিরোজ শাহ কলোনি. শেরশাহ কলোনি, রউফাবাদ কলোনি অন্যতম । তাদের এই কাজে তারা কিছুটা সফলও হয়েছিল । বেশ কিছু বাঙালি তাদের হাতে নিহত হয়েছিলেন । ২২ তারিখের দিকে খবর পাওয়া গেল পশ্চিম পাকিস্তান হতে সোয়াত জাহাজ যোগে চট্টগ্রামে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর জন্য এক জাহাজ অস্ত্র চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছেছে কিন্তু সেই অস্ত্র খালাস করতে বাঙালি শ্রমিকরা অস্বীকার করেছে । এ নিয়ে বন্দরে বেশ উত্তেজনা । ২১ তারিখ চট্টগ্রাম সেনানিবাস পরিদর্শনে এলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আবদুল হামিদ খান । আসলে তার এই সফর ছিল সশরীরে এসে অবাঙালি পাকিস্তানি অফিসারদের আসন্ন ‘অপারেশন সার্চ লাইট সম্পর্কে অবহিত করা এবং তাদের করণীয় সম্পর্কে নির্দেশ দেয়া । এই কাজটি জেনারেল হামিদ অন্যান্য সেনানিবাসে গিয়েও করেছেন । ব্রিগেডিয়ার মুজুমদার ছিলেন তখন চট্টগ্রাম সেনানিবাসে সব চেয়ে সিনিয়র বাঙালি অফিসার । জেনারেল হামিদ ঢাকা ফিরে যাওয়ার সময় তাকে সাথে নিয়ে যান । ২৫ তারিখ বিকালে লালদিঘী মাঠে আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর এক গার্ড অব অনারে আওয়ামী লীগ নেতা এম আর সিদ্দিকি, জহুর আহমদ চৌধুরী, শেখ মোজাফ্ফর আহমদ (শহিদ), মিসেস নুরুন্নাহার জহুর সালাম গ্রহণ করেন । বস্তুত পক্ষে এই দিন চট্টগ্রামে এই অনুষ্ঠানটি ছাড়া অন্য কোন অনুষ্ঠান হয় নি কারণ ইতোমধ্যে বন্দর নগরীতে খবর পৌঁছে গেছে ইয়াহিয়া-মুজিব আলোচনা ভেঙ্গে গেছে । সংঘাত আসন্ন ।
২৪ তারিখ সন্ধ্যায় প্যারেড মাঠে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আর ছাত্রদের নির্ধারিত বৈকালিক অনুষ্ঠান যথারীতি শুরু হয় । সভার পূর্বে তারা চট্টগ্রাম মুসলীম ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গন হতে একটি মৌন মিছিল নিয়ে প্যারেড মাঠে আসে । এই অনুষ্ঠান উপলক্ষে প্রাক্তন ছাত্ররা ‘আগুন’ নামে একটি স্মরণিকা প্রকাশ করে । আলোচনা অনুষ্ঠানের শেষে নাটক । নাটক যখন শেষ পর্যায়ে তখন হঠাৎ খবর আসে বন্দরে সোয়াত জাহাজ হতে অস্ত্র নামানোকে কেন্দ্র করে বড় ধরণের গোলযোগ হয়েছে এবং সম্ভবত বেশ কিছু শ্রমিক মারা গিয়েছেন । এই সংবাদ অগ্নি ষ্ফুলিঙ্গের মতো চারিদিকে ছড়িয়ে পরে । সভাস্থলে উপস্থিত বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রব হঠাৎ একটি বাঁশের মাথায় বাংলাদেশের পতাকা বেঁধে তা রাতের আকাশে উড়িয়ে দেন । তখন কে যে শিক্ষক আর কে যে ছাত্র অথবা কারা যে সাধারণ জনগণ তা বুঝা মুস্কিল হয়ে পরে কারণ সকলে সম্মিলিত কণ্ঠে গগন বিদারী শ্লোগান তোলেন ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা তোমার আমার ঠিকানা’, ‘জয় বাংলা’ প্রভৃতি । ৩রা মার্চ হতে ২৪ মার্চ পর্যন্ত চট্টগ্রামের বিভিন্ন পাড়া মহল্লায় তরুণ যুবকরা একটি কাজ বেশ সুচারু রূপে করে তা হলো হাতে লিখে বিভিন্ন পোষ্টারে শহরকে ছেয়ে ফেলা । আর সাধারণ জনগণ আগ্রাবাদ সড়ক, ষোল শহর সড়ক, বালু ছড়া সড়ক প্রভৃতি সড়ক গাছের গুড়ি কেটে আর নানা ধরণের প্রতিবন্ধকতা দিয়ে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে যাতে কোন অবস্থাতেই সেনা বাহিনী চলাচল করতে না পারে । ২৫ তারিখ দিবাগত রাতে মেজর জিয়ার অধীনে একদল বাঙালি সেনা সদস্যকে বন্দরে পাঠানো হয়েছিল সোয়াত জাহাজ হতে অস্ত্র খালাসের জন্য । জিয়া যদি এই সব প্রতিবন্ধকতার সম্মূখীন না হতেন তা হলে তাকে হয়তো বন্দরে কর্তব্যরত পাকিস্তানি সৈন্যরা তাঁকে হত্যা করতো । জিয়া যখন এই ব্যারিকেড সরাতে ব্যস্ত তখন ক্যাপ্টেন অলি (বর্তমানে এলডিপি নেতা) তাঁকে এসে খবর দেন ঢাকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে । এই কথা শুনে জিয়া ষোলশহরে অবস্থানরত তার ইউনিট ৮ম ইষ্ট বেঙ্গলে ফিরে গিয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন ।
২৫ তারিখ দিবাগত রাতে ঢাকায় কী হয়েছিল তা ”ট্টগ্রামের মানুষ ঠিক আঁচ করতে পারেন নি । তারা সকালে বিবিসি সহ অন্যন্য রেডিওতে শুনেছে ঢাকায় সেনা বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর ঝাঁপিয়ে পরেছে এবং বঙ্গবন্ধুকে বন্ধী করা হয়েছে । পরে জানা গেছে বঙ্গবন্ধু বন্ধী হওয়ার আগে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে যান । অবস্য ২৫ তারিখ দিবাগত রাতেই স্বাধীনতা ঘোষণা সম্বলিত একটি সাইক্লোষ্টাইল করা লিফলেট আন্দকিল্লা এলাকায় বিলি করা হয় । ২৬ তারিখ সূর্য ডোবার কিছু পর চট্টগ্রামে বন্দর এলাকা হতে যুদ্ধ জাহাজ ‘ বাবর’ আর ‘খাইবার’ হতে পাকিস্তান নেভি যখন শহরে নির্বিচারে গোলা বর্ষণ শুরু করে এক নারকীয় অবস্থার সৃষ্টি করে তখন মানুষ বুঝতে পারে তাদের সামনে কী দূর্দিন অপেক্ষা করছে । বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে চট্টগ্রামের অবদান স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে ।

[লেখাটি অনেকটা স্মৃতি নির্ভর । ভুলবশতঃ কারো কারো নাম বাদ পরতে পারে অথবা স্থান কাল পাত্র উল্লেখেও ভুল হতে পারে যা নিতান্তই অনিচ্ছাকৃত । তার জন্য আগাম ক্ষমা প্রার্থী । ]

লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় । মার্চ ২৩, ২০১৪

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ

[......লেখক আর্কাইভ]