[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

বিএনপি’র ঘাঁড়ে সিন্দবাদের বুড়ো

 


-প্রফেসর আবদুল মান্নান

আরব্য রজনীর গল্পে আছে সিন্দবাদ সাতটি সমুদ্র যাত্রা করেছিলেন । প্রত্যেক যাত্রায় তার যতসব লোমহর্ষক অভিজ্ঞতা । সিন্দবাদের পঞ্চম যাত্রার গল্পে আছে তার কাঁধে এক বুড়ো সওয়ার হয়েছিল । বুড়ো আবার কাঁধে এমন প্যাঁচ কষে বসেছিল যে সিন্দবাদ বস্তুতপক্ষে বুড়োর ক্রীতদাসে পরিণত হয়েছিল । অবশেষে সিন্দবাদ বিশেষ শূরা তৈরী করে বুড়োকে পান করিয়ে তাকে হত্যা করে । সিন্দবাদতো বুড়ো থেকে নিস্তার পেতে একটা উপায় বের করেছিলেন কারণ তিনি বুড়োর জ্বালায় অতিষ্ট হয়ে উঠেছিলেন । কিন্তু বিএনপি‘র ঘাঁড়ে জামায়াত নামক যে বুড়ো বা দৈত্যটি গেড়ে বসেছে সকলের প্রশ্ন তার কী হবে কারণ বিএনপি নামক সিন্দবাদতো এই দৈত্যটিকে বদ করতে নারাজ । জামায়াত বিএনপি’র বর্তমান সম্পর্ক হচ্ছে অনেকটা দুজনে দুজনার মতো । অবশ্য এর আগে বিএনপি’র সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট তারেক জিয়া বলেছিলেন জামায়াত-বিএনপি একই মায়ের পেটের দুই ভাই । এটি এখন অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে সাম্প্রতিক কালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি’র যে রাজনৈতিক বিপর্যয় তার প্রধান কারণ বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের প্রধান শরিক জামায়াত-শিবিরের চরম সন্ত্রাস নির্ভর রাজনীতি আর দেশ ও সম্পদ বিধ্বংসীকারী কর্মকান্ড যা গত দেড় বছর ধরে চলে আসছে । আন্দোলনের নামে তাদের মানুষ পুড়িয়ে মারার মতো নজির বিহীন ভয়ানক অমানবিক কর্মকান্ডে বিএনপি’র অনেক গোঁড়া সমর্থককেও বিএনপি’র রাজনীতি হতে বিমুখ করেছে । ক’দিন আগে একজন অত্যন্ত দায়িত্বশীল বিএনপি ঘরাণার সরকারি কর্মকর্তা আমাকে বলছিলেন জামায়াতের খপ্পরে পরে বিএনপি তাদের নিজের পাকা ধানে মৈ দিয়েছে । নির্বাচনের আগে অনেকে তাদের ধারণা দিয়েছিল নির্বাচনে বিএনপি অংশ গ্রহণ করলে ভাল করবে এমন কী হয়তো সরকারও গঠন করতে পারে । কিন্তু জামায়াত নির্বাচনে যাওয়া হতে বিএনপিকে বিরত রাখতে পেরেছে কারণ বিএনপি’র ‘আন্দোলন’ আর জামায়াতের ‘আন্দোলন’ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন উদ্দেশ্যে । বিএনপি চাইছিল একটি অসাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দশম সংসদ নির্বাচন আর জামায়াতের উদ্দেশ্য ছিল যে কোন উপায়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারকে উৎখাত করে বিএনপি’র সাথে পিছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় গিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচারকে বানচাল করা । এই দুটি দলই দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ক্ষমতাকে সঠিক ভাবে বুঝতে সম্পূর্ণ ভাবে ব্যর্থ হয়েছে ।
আওয়ামী লীগের অনেক অক্ষমতা আর দূর্বলতা আছে কিন্তু আওয়ামী লীগের এখনো একটি রাজনৈতিক চরিত্র আছে আর আছে তৃণমুল পর্যায়ে কর্মী । অনেকেই আওয়ামী লীগের মতাদর্শের সাথে ভিন্নমত পোষণ করতে পারেন কিন্তু এই দুই দলের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে বিএনপি’র তেমন কোন রাজনৈতিক মতাদর্শ নেই । তাদের একমাত্র পুঁজি ভারত বিরোধিতা আর ধর্ম গেল রব তোলা । তারা বুঝতে পারে না সাধারণ মানুষ আগের যে কোন সময়ের তুলনায় এখন অনেক বেশী সচেতন । লক্ষ্য করলে দেখা যাবে বেগম জিয়ার চার পাশে যারা তাঁকে সব সময় ঘিরে থাকেন তারা প্রায় সকলেই সাবেক সামরিক বেসামরিক আমলা । তারা গুলশানের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষের আলো আঁধারে বিদেশীদের সাথে কথা বলতে পছন্দ করেন । তাদের টার্গেট শ্রোতা গুলশান বনানী আর বারিধারার সাফ কাপড়ের ভদ্রলোক যাদের অধিকাংশই নির্বাচনের দিন জনগণের সাথে লাইন ধরে ভোট দিতে যাবেন না । কিছু ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে । বিএনপি’র এই নেতারা মিডিয়ার সামনে আসলে আধা ইংরেজি আর আধা বাংলায় যা জনমানুষের কাছে দূর্ভেদ্য, তেমন ভাষায় কথা বলেন, আর সরকার অফেন্সিভে গেলে স্যুটেড ব্যুটেড অবস্থায় আত্মগোপন করেন । ইদানিং আবার তারা ভিডিও বার্তার সাহায্যে আন্দোলন পরিচালনা করার নতুন সংষ্কৃতি চালু করেছেন । মনে হচ্ছে বর্তমানে তাদের রাজনৈতিক গুরু আফগানিস্তানের তালেবান নেতা ওসামা বিন লাদেন অথবা মোল্লা ওমর । শুধু দেশের ভিতর হতে আন্দোলনের এমন আহ্বান আসছে তাই নয় দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক জিয়া লন্ডন হতেও আন্দোলনের এমন বার্তা পাঠাচ্ছেন । এমন তামাশা বাংলাদেশের রাজনীতিতে কখনো কেউ দেখেনি । যে রাজনৈতিক দল এমন নেতৃবৃন্দের উপর ভর করে সরকার বিরোধী রাজনীতি করতে চান তারা বোকার স্বর্গে বাস করেন ।

রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি‘র সমালোচকরা তাদের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ উত্থাপন করেন কিন্তু তারা যে একটি সন্ত্রাসী দল তেমন অভিযোগ একটা নেই । মিছিল করে যাওয়ার সময় তারা দু’চারটি গাড়িতে আগুন দেয়, পুলিশের সাথে মারদাঙ্গায় লিপ্ত হয় অথবা কোন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের সাথে সংঘাতে জড়িয়ে পরে কিন্তু ছাত্র শিবিরের মতো বলা যাবে না তারা গণ হারে প্রতিপক্ষের রগ কাটে, জবাই করে মানুষ হত্যা করে অথবা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নির্বিচারে সংখ্যালঘু আর আওয়ামী লীগ সমর্থকদের বাড়ী বা গ্রামে আগুন দেয় ।
এই যাবৎ ছাত্র শিবির যত সংঘাতে লিপ্ত হয়েছে তার অধিকাংশই ছিল ছাত্রদলের সাথে । আমার পূর্বের কর্মক্ষেত্রে জিয়া পরিষদের সভাপতি ডঃ এনামুল হকের ছেলে মুসাকে তো ওরা পিঠিয়েই মেরে ফেলেছিল । ছাত্রদলের রাজনীতির সাথে জড়িত আবদুল হামিদ ছাত্রদল ছেড়ে এরশাদের ছাত্রসমাজে যোগ দিয়েছিল । তার হাতের কব্জি কেটে কিরিচের মাথায় গেঁথে শিবির ভর দুপুরে ক্যাম্পাসে মিছিল করেছিল । তার বড় অপরাধ সে শিবিরের রাজনীতির একজন বড় বিরুদ্ধবাদী ছিল । ডঃ কাজী আহম্মদ নবী মনে প্রাণে জিয়ার আদর্শে বিশ্বাসী । তার একমাত্র ছেলে মুসফিক প্রগতিশীল রাজনীতিতে নুতন দীক্ষা নিয়েছে। এক গুলিতেই তাকে শেষ করে দিল শিবিরের সন্ত্রাসীরা । হেলালী অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র । ছাত্রদলের নেতা । তাকে দশজনে টেবিলের উপর চেপে ধরে চোখ তুলে নেয়ার চেষ্টা করছিল । সময়মতো শিক্ষকরা সেখানে হাজির না হলে হেলালি এখন অন্ধ হয়ে হয়তো বেঁচে থাকতো । ১৯৯৬ এর নির্বাচনে সে বিএনপি’র মনোনয়নে সংসদ নির্বাচন করেছিল । ১৯৯৪ সনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আর রাজশাহী মেডিকেল কলেজে যখন শিবির ছাত্রদলের উপর হামলা করে এক নারকীয় তা-ব চালিয়েছিল তখন ক্ষমতায় বেগম জিয়া । তিনি কিন্তু তার দলের আহত সদস্যদের একবারও দেখতে যান নি, গিয়েছিলেন সে সময়কার সংসদে বিরোধী দলের নেত্রী শেখ হাসিনা । দুই নেত্রীর মাঝে এটাই তফাৎ ।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বেগম জিয়ার অনেক সমর্থক আর উপদেষ্টা তাঁকে সান্ত¦না দিচ্ছেন । যে সব বিদেশী দূতরা তাঁকে কুপরামর্শ দিয়েছিলেন তারা এখন পারতপক্ষে আর তাঁর ধারে কাছে যেতে চান না । সংবাদপত্রের ভাষ্য অনুযায়ী অত্যন্ত শক্তিশালী দেশের একজন কূটনীতিককে বাংলাদেশে তাদের রাজনৈতিক চালের বিপর্যয়ের কারণে নিজ দেশে ফিরিয়ে নিচ্ছে । ২০০৬ সালেও ঠিক তেমনটি ঘটেছিল । বিদেশীরা এখন বলছেন বেগম জিয়াকে জামায়াতের সংস্পর্শ ছাড়তে হবে । এতদিনে তারা উপলব্দি করেছে জামায়াত একটি সন্ত্রাসী সংগঠন, কোন রাজনৈতিক দল নয় । এই দেশগুলিই দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছিল ‘জামায়াত একটি উদারপন্থী রাজনৈতিক দল’ । কিন্তু তারা বললেইতো আর বেগম জিয়া বা তার দল জামায়াতকে ছাড়তে পারবেন না । এক অদৃশ্য কারণে বিএনপি’র রাজনীতি জামায়াতের কাছে বাঁধা রয়েছে বলে বিশ্বাস । সোমবার সোহরোওয়ার্দি উদ্যানে বিএনপি তাদের প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়ার জন্ম বার্ষিকী উপলক্ষে জনসভা করল । প্রথমে শোনা গিয়েছিল এটি ১৮ দলের জনসভা । পরে জানা গেল এটি বিএনপি’র জনসভা । জামায়াতকে নাকি সভায় আসতে নিষেধও করা হয়েছিল । জামায়াত এসেছিল কিন্তু ব্যানার ছাড়া । সাথে ছিল হেফাজতের কয়েক হাজার নেতা কর্মী । মঞ্চেও জামায়াত নেতারা ছাড়া শরিক দলগুলির নেতারা উপস্থিত ছিলেন । চট্টগ্রামেও অনুরূপ একটি সমাবেশ হয়েছিল এবং সেখানে মঞ্চে জামায়াতের নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রেখেছেন । বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক মঞ্চে জামায়াতকে দেখে আর মঞ্চে উঠেন নি । নীচে বসে তার ছাত্রদের বলেছেন এখনো যদি বিএনপি’র বোধোদয় না হয় তা হলে তাদের ভবিষ্যতে ভাল তো কিছু দেখি না । বেগম জিয়ার সব উপদেষ্টা হিসেবে সামরিক বেসামরিক আমলা ছাড়াও আছেন বেশ কিছু ব্যারিস্টার নতুবা বাস্তব জীবন-জগৎ হতে বিচ্ছিন্ন কিছু বুদ্ধিজীবী আর সুশীল ব্যক্তি । একজন ব্যারিস্টার সেদিন বললেন সরকার জামায়াতকে নিষিদ্ধ করলে শতভাগ লাভ বিএনপি’র কারণ জামায়াতের সকলে কাতার বন্দী হয়ে বিএনপিতে যোগ দেবে । এই না হলে উপদেষ্টা । তিনি বুঝতে পারেন নি অথবা বুঝতে চান নি জামায়াত হচ্ছে একটি ভাইরাস । দেহে প্রবেশ করলে দেহটাকে ধ্বংস করে দেবে । জামায়াত যদি বিএনপি’র সাথে একিভূত হয় তা হলে বিএনপিও যে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হয়ে উঠবে তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় ।

কোন কোন বিএনপি সমর্থক পেশাজীবী বিএনপিকে বাহবা দিচ্ছেন এই বলে তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে নাকি মানুষ ৫ তারিখ ভোট দিতে যান নি । তারাও বিএনপি’র ৫% ভোট তত্ত্বে বিশ্বাস করেন । ৫ তারিখ অনেক কেন্দ্রে ভোট কম পরেছে সত্য কিন্তু তা শ্রেফ বেগম জিয়া বা বিএনপি’র আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঘটেছে তা বিশ্বাস করা এক প্রকারের চরম আহাম্মকী । যে মাত্রায় সহিংসতা নির্বাচনের আগের কয়েকদিন হয়েছে তাতে স্বাভাবিক ভাবে মানুষ ভোট দিতে যাবে তাতো আশা করা যায় না । বেগম জিয়ার এই সব সর্বনাশা সমর্থক গোষ্ঠী তাঁকে মনে করিয়ে দেন নি নির্বাচনের আগের রাতে যদি দুই শত স্কুল, মাদ্রাসা আর কলেজ ভোট কেন্দ্র হওয়ার ‘অপরাধে’ জামায়াত-বিএনপি’র দূর্বৃত্তরা আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দেয় তা হলে সেই সব কেন্দ্রে কোন ভরসায় ভোটাররা ভোট দিতে যাবেন ? ২০০৮ সালের নির্বাচনে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ একক ভাবে ৪২% ভোট পেয়েছিল । নির্দয়ভাবে এখান হতে ৫%-৭% ভোট ছাঁটাই করলেও আওয়ামী লীগের একেবারে ‘দলকানা’ ভোটার ৩২% হতে ৩৫% । নির্বাচন ঠেকানোর নামে জামায়াত-বিএনপি’র সন্ত্রাসীরা যদি সারা দেশে এই ভয়াবহ তা-ব না চালাতো তাহলে আওয়ামী লীগ কম পক্ষে তাদের এই ভোটগুলিতো পেত । নির্বাচন কমিশনের দেয়া ৪০% হিসাব বিশ্বাস না করেন তাই বলে ৫% বিশ্বাস করতে হবে কেন ? বিএনপি’র কাঁধ হতে জামায়াত নামক সিন্দবাদের সেই দৈত্য বা বুড়োটাকে তারা নামাবে কী না সেই সিদ্ধান্ত একক ভাবে তাদের । কিন্তু দেশে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ধারা বজায় রাখতে হলে দেশে একাধিক সুস্থধারার রাজনৈতিক দল প্রয়োজন । তেমন একটি দল হিসেবে বিএনপি নিজেকে গড়ে তোলার চেষ্টা করতে পারে । তাদের উপলব্দি করতে হবে এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগকে পাঁচ বছরের আগে ক্ষমতাচ্যুত করার ক্ষমতা তাদের নেই । আওয়ামী লীগ অন্য চিন্তা করলে তা ভিন্ন কথা । বাস্তববাদী হওয়া মঙ্গল ।

লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় । জানুয়ারি ২১, ২০১৪

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ

[......লেখক আর্কাইভ]