[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

‘শেষ জিহাদ’ এর চুড়ান্ত প্রস্তুতি কী শুরু হয়ে গেছে?

 

 

প্রফেসর আবদুল মান্নান

অনুজ প্রতিম বন্ধু শাহরিয়ার কবির যখন টেলিফোনে জানালো বুধবার বিকেলে সে তার নির্মিত প্রামান্য চিত্র ‘The Ultimate Jihad’ (চূড়ান্ত জিহাদ) জাতীয় যাদুঘরের বেগম সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে প্রদর্শন করছে, প্রদর্শনীতে আমি আসলে সে খুশি হবে শাহরিয়ারের বিনয় দেখে আমি মোটেও অবাক হইনি । সে বরাবরই বিনয়ী । কোথায় খুশি হওয়ার কথা আমার তা না হয়ে খুশি হলো শাহরিয়ার । যাদুঘরের মূল ফটকে আমাদের অভ্যর্থনা জানালো ছবিটির অন্যতম নির্বাহী প্রযোজক কাজী মুকুল । বিকাল চারটায় প্রদর্শনী শুরু হওয়ার কথা থাকলেও শুরু হতে হতে প্রায় পোনে পাঁচটা কারণ অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ মহিউদ্দিন খান আলমগীর আসতে দেরী করছিলেন । তিনি নাকি তার দপ্তরে হেফাজতে ইসলামের নেতাদের সাথে সাথে কী সব রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলেন । অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে এখনো রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি মনে করেন হেফাজতের সাথে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা করা সময় আছে। তবে এই আলোচনা এতই গুরুত্বপূর্ণ ছিলযে শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠানে আর প্রধান অতিথির আসাই হয়নি । ‘দি আল্টিমেট জিহাদ’ ছবিটি গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক আর ওয়াশিংটন ডিসিতে আমাদের দূতাবাসে প্রদর্শিত হয়েছে । এই খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে প্রবাসী সাংবাদিক আনিস আহমেদ সকলের সাথে শেয়ার করেছেন । এই ‘জিহাদ’ শাহরিয়ার কবির নির্মিত তিনটি ছবির শেষ ছবি । এই ছবি ত্রয়ের মূল বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশ সহ সারা বিশ্বে ইসলামের নামে ধর্মীয় উগ্রবাদের উত্থান, রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার আর এই সব মৌলবাদী সংগঠনকে রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পৃষ্টপোষকতা । ছবিটিতে অবধারিত ভাবে জামায়াতে ইসলাম আর হেফাজতে ইসলামের কথা উঠে এসেছে এবং সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে ত্রিশের দশকে মিশরে হাসান আল বান্না আর সৈয়দ কুতুবের হাত ধরে মুসলিম ব্রাদারহুডের জন্মের কাহিনী এবং কী ভাবে এই ব্রাদারহুড দেশে দেশে তাদের জঙ্গি মতবাদ রপ্তানি করেছে । গত সোমবার মিশরের একটি আদালত ব্রাদারহুডকে সে দেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং তাদের সকল সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দিয়েছে ।
‘চূড়ান্ত জিহাদ’ ছবিটি নির্মানের জন্য শাহরিয়ার কবির যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, পাকিস্তান, মিশর, তুরষ্ক, আফগানিস্তান, ভারত সফর করেছেন, সেই সব দেশে কী করে বিভিন্ন নামে এই সব জঙ্গি সংগঠনের জন্ম ও বিকশিত হয়েছে তা বর্ণনা করেছেন । ছবিতে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রনব মূখার্জি, বৃটেনের হাউজ অব লর্ডস এর সদস্য লর্ড এভাবেরী, যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাস বিরোধী বিশেষজ্ঞ ব্রুস রীডেল, বৃটেনের সংসদ সদস্য ও লেবার পার্টির সাবেক মন্ত্রী জিম ফিটজপেট্রিক, ভারতের জমিয়েতে উলামায়ে হিন্দের মাওলানা মাহবুব মাদানি, সাংবাদিক হিরন্ময় কারলেকার, পাকিস্তানের লস্করই তৈয়বার প্রতিষ্ঠাতা হাফিজ মুহাম্মদ সাঈদ, বাংলাদেশের ডাঃ নুজহাত চৌধুরী (আল-বদরদের হাতে নিহত ডাঃ আলিম চৌধুরীর কন্যা) সহ আরো অনেকেই এই বিষয়ে তাদের স্বাক্ষাৎকার ও মন্তব্য দিয়েছেন । এমন কী জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মওলানা মওদুদীর ছেলে সৈয়দ হায়দার ফারুখ মওদুদীর স্বাক্ষাৎকারও বাদ যায়নি । তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন যে জামায়াত বর্তমানে একটি সন্ত্রাসী সংগঠনে রূপান্তরিত হয়েছে । তাঁর স্বাক্ষাতকারে তিনি বলেছেন তার পিতা মৃত্যুর আগে তার সব সন্তানদের নিষেধ করে গিয়েছেন তারা কেউ যেন জামায়াতের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত না হন । আর জামায়াত সম্পর্কে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেনে জন ফিটজপেট্রিক । তার মতে বৃটেনে জামায়াত সে দেশের রাজনৈতিক দলগুলির চেয়েও অনেক বেশী শক্তিশালী ও সংগঠিত । তাদের অর্থ ভান্ডারও বেশ সমৃদ্ধ ।
ছবিটির উল্লেখযোগ্য দিক হলো এই ছবিতে এই বিষয়ে অনেক আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ একমত হয়েছেন যে আজ সারা বিশ্বে ইসলামের লেবাসে ধর্মীয় জঙ্গিবাদের যে উত্থান তার পিছনে যুক্তরাষ্ট্রের ভ্রান্ত পররাষ্ট্র নীতি অবদান অনস্বীকার্য । বছর তিনেক আগে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব হিলারী ক্লিনটন এক সাক্ষাৎকারে অকপটে স্বীকার করেছেন আফগানিস্তান হতে সোভিয়েত সমর্থিত নজিবুল্লাহ সরকারকে উৎখাত করার জন্য পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আই এস আই এর মাধ্যমে অর্থায়ন করে তালেবানি যোদ্ধা সৃষ্টি করা ছিল তাদের একটি ঐতিহাসিক ভুল । সেই তালেবানরা এখন ফ্রাংকেনষ্টাইন রূপী দানব হয়ে সারা বিশ্বকে অস্থিতিশীল করে তুলছে । তাদের গর্ভেই জন্ম হয়েছে আল-কায়দা সহ আরো নানা ধরণের জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী । অবশ্য এই সত্যটি যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বিশ্লেষক আর নীতি নির্ধারকরাই মানতেই চান না । তারা বলেন বিষয়টাকে এত সরলীকরণ করলে হবে না । অনেক সময় যুক্তরাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকরা ইতিহাসের বিপরীতে অবস্থান করেন এবং সুযোগ পেলেই ইতিহাসকে অস্বীকার করেন । এখানেও তার ব্যতিক্রম ছিল না । সবচেয়ে বড় উদাহরণ সিরিয়া বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান চরম ভ্রান্ত নীতি । আরব বিশ্বে বর্তমানে একমাত্র সেক্যুলার রাষ্ট্র হিসেবে টিকে আছে সিরিয়া । এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলিতে কামান আর ট্যাঙ্কের পিঠে করে গণতন্ত্র রপ্তানির নামে যুক্তরাষ্ট্র সহ অন্যান্য পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলির সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সেক্যুলার রাষ্ট্রগুলির অবলুপ্তি ঘটেছে । এটি ঠিক এইসব রাষ্ট্রে দীর্ঘ দিন ধরে স্বৈরশাসকরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠ ছিল তবে তাদের পিছনেও মূল চালিকা শক্তি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা শক্তি ।
একটু পিছনে ফিরলে দেখা যাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে যখন ইঙ্গ-ফরাসি শক্তি সাবেক ওসমানিয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত অঞ্চলগুলিকে রাষ্ট্রে রূপান্তর করছিল সে সব রাষ্ট্রের একটিকেও তারা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে সৃষ্টি করেনি । তার বদলে তারা সৃষ্টি করেছে রাজতন্ত্র কারণ একটি দেশে রাজতন্ত্র থাকলে সেই দেশের সম্পদ লুটপাটের সুবিধা অনেক বেশী । আর তেলের চেয়ে মূল্যবান সম্পদতো আর কিছু হতে পারে না । নতুন সৃষ্ট ইরাকে রাজা হওয়ার মতো কেউ ছিলনা । ট্রান্সজর্ডান হতে বাদশা হোসেনের জ্ঞাতি ভাই ফায়সালকে ধার করে আনা হয়েছিল । লিবিয়ায়ও শেষ পর্যন্ত কাউকে পাওয়া গেল না রাজা হওয়ার জন্য । খুঁজে বের করা হলো ইদ্রিস নামক একজন অথর্ব মেষ পালক গোত্র প্রধানকে । তিনিই হলেন ‘স্বাধীন’ লিবিয়ার প্রথম রাজা । রাজা যদি অথর্ব হয় তা হলে লুটপাটে আরো সুবিধা । ঠিক তেমটিই চলেছে গাদ্দাফি তাকে উৎখাতের আগ পর্যন্ত । অথচ ইঙ্গ-ফরাসি ঔপনিবেশিক শক্তি ইচ্ছা করলে এই সব দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করতে তাদের সহায়তা করতে পারতো । ইঙ্গ-ফরাসি ঔপনিবেশিক শক্তি এই সব দেশে রাজতন্ত্র সৃষ্টি করেছে আর যুক্তরাষ্ট্র চেষ্টা করেছে এই সব দেশকে কেন্দ্র করে সাবেক সোভিয়েত রাশিয়ার প্রভাব বিস্তার রোধ কল্পে তাদের ভাষায় একটি সবুজ বেষ্টনি তৈরী করতে অর্থাৎ এই রাষ্ট্রগুলি হবে পাশ্চত্য রাজনৈতিক ধ্যান ধারণার কট্টর সমর্থক কারণ তাদের মতে সোভিয়েত ইউিনিয়ন হচ্ছে একটি কমিউনিষ্ট দেশ আর কমিউনিষ্ট মানেই হচ্ছে নাস্তিক । এই নাস্তিক ঠেকাও আদর্শে বলিয়ান হয়ে একসময় এই নতুন সৃষ্ট রাজতন্ত্রগুলি পাশ্চত্য পরাশক্তি তথা যুক্তরাষ্ট্রের খপ্পরে পরলো । সৌদি আরবে প্রতিষ্ঠিত হলো প্রথম ওয়াহাবি রাষ্ট্র, যাদের রাষ্ট্রীয় মতাদর্শই হচ্ছে কট্টোর ধর্মীয় মৌলবাদ । শুরু থেকেই এই রাষ্ট্রের প্রধান পৃষ্টপোষক হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র যা তাদের ভ্রান্ত পররাষ্ট্র নীতির আর একটি উজ্জ্বল নিদর্শন । সিরিয়ায় বর্তমানে যারা বাসার আল আসাদকে উৎখাত করার জন্য গৃহযুদ্ধে সামিল হয়েছে তাদের বেশীর ভাগই আল কায়দার সদস্য । এদের পঞ্চাশ ভাগ এসেছে অন্যান্য দেশ হতে । আসাদ বিরোধী এই যোদ্ধদের অস্ত্র আর অর্থ দিয়ে সার্বিক সাহায্য করছে যুক্তরাষ্ট্র অথচ সারা বিশ্বের মানুষ জানে যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্বে আল-কায়দা বা জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে । আর যাই হোক ইরাক আর লিবিয়াতে উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদের কোন অস্তিত্ব ছিল না । কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ইতালি ও বৃটেনের সহায়তায় সাদ্দাম হোসেন আর কর্ণেল গাদ্দাফি উৎখাত হওয়ার পর এই দুটি দেশই বর্তমানে জঙ্গিবাদের প্রজনন ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে । সিআইএ, আইএসআই আর তালেবানদের সহায়তায় আফগানিস্তÍান হতেতো নাজিবুল্লাহ্র সেক্যুলার সরকার উৎখাত হলো, সোভিয়েত বাহিনীও চলে গেছে প্রায় দুই যুগ আগে কিন্তু শান্তি কী ফিরে এসেছে আফগানিস্তানে? নাকি এই অঞ্চল আগের যে কোন সময়ের চেয়ে এখন অনেক বেশী বিপদজনক । এর জন্য কাকে দায়ী করা যাবে?
‘চূড়ান্ত জিহাদ’ ছবিটিতে বার বার দুজন মুসলিম প্রধান দেশের নেতার কথা ঘুরে ফিরে এসেছে । এর একজন আধুনিক তুরস্কের জনক কামাল আতাতুর্ক আর অন্যজন বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব । একজন বিশ্লেষক বলেছেন দুজনের মধ্যে তফাৎ হচ্ছে আতাতুর্ক তুরস্ককে আধুনিক সেক্যুলার রাষ্ট্র বানিয়ে ছিলেন । আর মুজিব একটি রাষ্ট্র সৃষ্টি করে তার রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে সেক্যুলারিজমকে গ্রহণ করেছিলেন । তিনি স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ করে দিয়েছিলেন । আর আতাতুর্ক তার দেশকে অর্ধ শিক্ষিত মোল্লাদের খপ্পর হতে মুক্ত করার জন্য অনেক বিপ্লবী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন । তিনি তার দেশে এই অর্ধ শিক্ষিত মোল্লাদের দ্বারা পরিচালিত সব মাদ্রাসা বন্ধ করে দিয়েছিলেন আর অবাক করার বিষয় হচ্ছে সেই সব মাদ্রাসা খুলে দেয়ার জন্য তখন তার উপর চাপ সৃষ্টি করেছিল যুক্তরাষ্ট্র । পরবর্তীকালে সেই সব মাদ্রাসা খুলে দেয়া হলেও সেগুলিতে এখন শুধু ইমাম প্রশিক্ষণ দেয়া হয় । সাতান্নটি মুসলিম দেশের মধ্যে তুরস্ক একমাত্র দেশ যেটি সার্বিক ভাবে জাতি সংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী উন্নত দেশের একমাত্র তালিকা ভুক্ত দেশ (Developed Country) । আর বাংলাদেশে যত দিন শেখ মুজিব জীবিত ছিলেন ততদিন দেশটিকে তিনি একটি সেক্যুলার রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলর চেষ্টা করেছিলেন । ১৯৭৫ সনে তার মৃত্যুর পর দেশটি আবার পিছনে ফিরতে শুরু করে এবং এক সময় জামায়াত আর হেফাজতের মতো জঙ্গিবাদী আর সন্ত্রাস নির্ভর সংগঠনের জন্ম দিয়েছে । ছবিতে আর যে সকল মুসলমান প্রধান দেশের নেতৃবৃন্দ তাদের দেশকে ধর্ম নিরপেক্ষ দেশ হিসেবে তৈরী করতে চেষ্টা করেছেন তাদের মধ্যে আছে আলজেরিয়ার বেন বেল্লা, মিশরের গামাল আবদেল নাসের, ইন্দোনেশিয়ার আহমেদ সোয়েকার্নো আর পাকিস্তানের মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ । জিন্নাহ দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ করলেও তিনি শুরু হতেই পাকিস্তানকে একটি সেক্যুলার রাষ্ট্র হিসেবে চিন্তা করেছিলেন বলে বলা হয়েছে । সেটির কিছু প্রমাণ তিনি রেখেছেন পাকিস্তানের গণপরিষদে দেয়া তার প্রথম বক্তৃতায় যেখানে তিনি বলেছিলেন ‘আজ হতে পাকিস্তানে মুসলমান, হিন্দু, খৃষ্টান শিখ সকলে পাকিস্তানি।’ বাস্তবে গোঁড়া পাকিস্তানি মুসলমানদের দৃষ্টিতে জিন্নাহ কখনো মুসলমান ছিলেন না । তিনি ছিলেন ইসমাইলি সম্প্রদায় ভুক্ত খোজা এবং তার প্রিয় খাবারের তালিকায় ছিল শূকরের মাংস আর ফরাসি মদ । তার সাথে সাধারণ জনগণের কোন সম্পর্ক ছিল না । জিন্নাহর সৌভাগ্য বলতে হবে তিনি তার সাধের পাকিস্তানের বর্তমান অবস্থা দেখার আগেই ১৯৪৮ সনে তার মৃত্যু হয়েছিল । বেনবেল্লা আর সোয়েকার্নো সামরিক অভ্যূত্থানে উৎখাত হয়েছিলেন এবং ধারণা করা হয় এই অভ্যূত্থানের পিছনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদ ছিল । নাসেরের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল কিন্তু তারপরও তার দেশে রাষ্ট্রের শক্ত অবস্থানের কারণে বান্নার ব্রাদারহুড এই সেদিন পর্যন্ত সে দেশে প্রকাশ্যে কোন তৎপরতা চালাতে পারেনি ।
শাহরিয়ারের ছবির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল গত পাঁচই মে’র হেফাজত নামীয় কওমি মাদ্রসা ভিত্তিক একটি মধ্যযুগীয় উগ্র ধর্মীয় সংগঠনের ঢাকা দখল এবং তৎপরবর্তী সময়ে তাকে ঘিরে যে তান্ডব চালিয়েছে তার বর্ণনা। দেখানো হয়েছে সকলের অগোচরে বাংলাদেশে কী ভাবে এমন সব সংগঠন মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে এবং এই আশঙ্কাও প্রকাশ করা হয়েছে বর্তমান সরকারের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কতদিন বাংলাদেশ একটি সেক্যুলার রাষ্ট্রের চরিত্র ধরে রাখতে পারবে সে সম্পর্কে । আলোচনা পর্বে ডঃ মুনতাসীর মামুন জানালেন তারা চেষ্টা করেছিলেন ছবিটি বিটিভিতে প্রচারের জন্য কিন্তু কর্তৃপক্ষের অনীহার কারণে তা সম্ভব হয়নি । ডঃ মামুন এও মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার ঘোষণা করেছেন জামায়াত নামের এই সন্ত্রাসী সংগঠনটির বাংলাদেশে রাজনীতির করার কোন অধিকার নেই কিন্তু বাস্তব হচ্ছে জামায়াত শুধু বহাল তবিয়তে আছে তাই নয় বরং তারা দিন দিন আরো হিংস্র হয়ে উঠছে । তিনি প্রশ্ন করেন তা হলে কী আমাদের ধরে নিতে হবে বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রীর চেয়েও শক্তিশালী একটি মহল আছে ? শেখ হাসিনার বিগত সরকারের আমলে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে এবং বরেণ্য মিডিয়া ব্যক্তিত্ব আবদুল্লাহ আল মামুনের পরিচালনায় নির্মিত হয়েছিল ‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম‘ নামের একটি প্রামাণ্য চিত্র । অনেক চেষ্টা করেও সেই ছবি বিটিভিতে প্রদর্শন করা যায় নি । আসলে এটি একটি ঐতিহাসিক সত্যযে যখনই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে তখনই কিছু বর্ণচোরা ব্যক্তি বেশ চাতুর্য্যরে সাথে ক্ষমতার অন্দর মহলে ঢুকে পরেন এবং সব ধরণের সুযোগ সুবিধা দুহাত ভরে তুলে নেন । একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক আজীবন আওয়ামী লীগ আর শেখ হাসিনার একজন কট্টর সমালোচক ছিলেন । এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় কথায় কথায় বলতেন ‘এই যে আপনাদের আওয়ামী লীগ আর শেখ হাসিনা...’ । তিনি এখন আওয়ামী লীগের একজন উপদেষ্টা । আওয়ামী লীগ কাল ক্ষমতায় না থাকলে এদের হারিকেন দিয়েও খুঁজে পাওয়া যাবে না । প্রধানমন্ত্রী হয়তো শুনলে মনক্ষুন্ন হবেন, কিন্তু বাস্তব হচ্ছে তার চারপার্শ্বে যারা আছেন তাদের কয়েকজনকে বাদ দিতে পারলে তিনি এই যাত্রায় যা অর্জন করতে পেরেছেন তার অর্জন আরো অনেক বেশী হতো । মধ্যমেধার পরামর্শক দিয়ে খুব বেশী দূর যাওয়া যায় না ।
‘চূড়ান্ত জিহাদ’এর কথা শেষ করি ছবির প্রথম দিককার একটি দৃশ্য দিয়ে যেখানে দেখানো হয়েছে ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্ক শহরে আল কায়দা কর্তৃক টুইন টাওয়ার ধ্বংসের ফুটেজ দিয়ে । শিক্ষা হচ্ছে আপনি মুখে যত কথাই বলুন কাজের সাথে কথার মিল না থাকলে নিজ দেশেও আপনি নিরাপদ নন । পরাশক্তির নীতি নির্ধারকরা উপলব্দি করছেন কী এই বাস্তবতা ? বন্ধ করুন না জামায়াতকে ‘মডারেট ইসলামিক’ দল বলা । হয়তো পরিস্থিতির একটু উন্নতি হতেও পারে । ধর্মীয় জঙ্গিবাদের কাছে বাংলাদেশের পতন হলে আর কিছু বাকি থাকবে না । ধরে নিতে হবে বাংলাদেশ হচ্ছে জঙ্গিবাদ থামানোর শেষ সীমানা । এই সীমানা দেয়াল ভাঙ্গার জন্য এখন অনেকেই প্রস্তুত । তাদের পিছনে আছে সুশীল নামধারি একটি ধান্ধাবাজ মহল । তারা সকলে শুধু সুযোগের অপেক্ষায় আছেন । শাহরিয়ার কবির তার শেষ মন্তব্যে বলেছেন ১৯৭১ সনে আল বদরদের হাতে নিহত অনেকের গলিত দেহ পাওয়া গিয়েছিল এবার তারা বা তাদের সমর্থণে অন্য কেউ ক্ষমতায় আসলে কারো লাশও খুঁজে পাওয়া যাবে না । অনেকের প্রশ্ন বাংলাদেশে ‘শেষ জিহাদ’ এর চুড়ান্ত প্রস্তুতি কী শুরু হয়ে গেছে? প্রশ্নের উত্তর পেতে সামনের নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে ।

লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় । সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১৩

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ