প্রথমপাতা  

সাম্প্রতিক সংবাদ 

 স্বদেশ

আন্তর্জাতিক

বাংলাদেশ কমিউনিটি

লাইফ স্টাইল

এক্সক্লুসিভ

বিনোদন

স্বাস্থ্য

বর্তমানের কথামালা

 শিল্প-সাহিত্য

 প্রবাসপঞ্জী 

আর্কাইভ

যোগাযোগ

 

 

 

 

 

 

 

যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে যতসব সন্দেহ, হতাশা আর অনিশ্চয়তা

 


প্রফেসর আবদুল মান্নান

এক দিনের ব্যবধানে দুটি সংবাদ সাধারণ জনগণের কাছে দারুণ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে । প্রথমটি ইতিবাচক ও স্বস্তির আর দ্বিতীয়টি হতাশার এবং সন্দেহের । প্রথমটি দীর্ঘ একযুগেরও বেশী সময় পর রমনা বটমূল বোমা বিষ্ফোরণ মামলার রায়, যাতে আট জন হরকাতুল জেহাদ জঙ্গিকে এই ভয়াবহ হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে আদালত মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করেছেন এবং একই সাথে ছয় জন জঙ্গিকে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয়েছে । ২০০১ সালের ১৪ই এপ্রিল বাঙালির উৎসব বাংলা নববর্ষ বরণের ছায়ানটের রমনা বটমূলের অনুষ্ঠানে এই বোমা বিষ্ফোরণে দশ জনের মৃত্যু হয় এবং অসংখ্য মানুষ আহত হয় । এই মামলার মূল দন্ডিত আসামী মুফতি আবদুল হান্নান বর্তমানে একুশে আগষ্ট বঙ্গবন্ধু এভেন্যুর বোমা হামলার জন্য অভিযুক্ত হয়ে আদালতে বিচারাধীন । শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য কোটালি পাড়ায় বোমা পুঁতে রাখার অভিযোগে মুফতি হান্নান মূল আসামী হিসেবে অভিযুক্ত । রমনা বটমূলের ঘটনার কখনো কোন বিচার হবে তা অনেকেই বিশ্বাস করেন নি । মামলাটির নিষ্পত্তি করার জন্য সরকারকে ধন্যবাদ দিতেই হয় । এই রায়ে ক্ষতিগ্রস্থরাতো বটেই দেশের মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে । রায়ের পর সাংবাদিকরা বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন এই জঙ্গিবাদের জন্ম আওয়ামী লীগের শাসনামলে । মির্জা ফখরুল ইদানিং কথায় কথায় দলের অন্যান্য অনেক নেতার মতো অসত্য কথা বলেন । তিনি হয়তো ভুলে গিয়েছেন ২০০৫ সালে তাঁর দল যখন ক্ষমতায় তখন বাংলাদেশের ৬৩টি জেলায় একই সময় ৪৫৯টি বোমা বিষ্ফোরণ ঘটিয়ে জঙ্গিরা তাদের আগমন বার্তা জানিয়ে দিয়েছিল । এছাড়াও বাংলাভাই ও শায়েখ আবদুর রহমান ২০০৫ ও ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট হতে সক্রিয় সহযোগিতা পেয়েছিল । ২০০১-০৬ মেয়াদের বিএনপি-জামায়াত জোটের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন বঙ্গবন্ধু এভেন্যুর শেখ হাসিনার জনসভায় তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে গ্রেনেড হামলার পর মুফতি হান্নানকে অভয় দিয়ে বলেছিলেন তিনি ইচ্ছা করলে ঢাকা সহ বাংলাদেশের যে কোন স্থানে নির্ভয়ে অবস্থান করতে পারেন । মুফতি হান্নানকে এই ব্যাপারে সার্বিক সহায়তা করেন জামিয়াতি উলামায়ে ইসলামের শীর্ষ নেতা মওলানা মহিউদ্দিন । ২০০৫ সালে ব্যর্থতার দায়ে তাঁর দায়িত্ব হতে আলতাফ হোসেনকে অব্যাহতি দিলে মুফতি হান্নান কিছুটা বিচলিত হয়ে পরেন । এরপরই ঘটে ৬৩ জেলায় যুগপত বোমা বিষ্ফোরণের ঘটনা । সারা দেশে এই ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে মুফতি হান্নানকে আটক করা হয় । ২১ আগষ্ট বঙ্গবন্ধু এভেন্যুতে গ্রেনেড হামলায় হরকাতুল জিহাদকে সার্বিক সহায়তা করে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা, জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা ও তৎকালিন প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর । ২১ আগষ্ট গ্রেনেড হামলার আগে হুজির নেতৃবৃন্দ বিএনপি’র সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট তারেক রহমানের সাথে হাওয়া ভবনে কমপক্ষে দু’বার বৈঠক করেন এবং তাঁর কাছ হতে আশীর্বাদ পাওয়ার পরই এই হামলা পরিচালিত হয় । মুফতি হান্নান এই সব বিষয় আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছেন । এই বিষয়ে গত ২৪ জুন ইংরেজি দৈনিক ডেইলি ষ্টারে বিস্তারিত বর্ণনা প্রকাশিত হয়েছে । সুতরাং মির্জা ফখরুল ইসলামের সাংবাদিকদের সামনে কথা বলার আগে এই সব বিষয়ে চিন্তা করা উচিত ছিল । বর্তমানে একুশে আগষ্টের গ্রেনেড হামলার মামলা আদালতে বিচারাধীন । দেশের মানুষ আশা করে ন্যায় বিচারের স্বার্থে যারাই এই ঘৃণ্য অপকর্মের সাথে জড়িত ছিলেন তাদের সকলকেই আইনের আওতায় এনে বিচার করা হবে ।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার গঠিত হলে সাধারণ মানুষ ধারণা করেছিল এবার একাত্তরের ঘাতকদের বিচার হবে । নির্বাচন পূর্বকালে ঘোষিত আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইস্তেহারে তেমন অঙ্গিকারও করা হয়েছিল । কিন্তু সেই বিচার শুরু করতে প্রায় এক বছরেরও বেশী সময় ব্যয় হয় । যেহেতু এমন একটি বিচার ঘটনার চল্লিশ বছর পর হচ্ছে সাধারণ মানুষ এই বিলম্বটুকু মেনে নেয় । গঠিত হলো আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল । শুরুতেই হোঁচট । প্রধান তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে যাকে নিয়োগ দেয়া হলো কিছুদিনের মধ্যে দেখা গেল তিনি এক সময় ছাত্র শিবিরের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন । চতুর্দিক হতে এই বিষয়ে নিন্দার ঝড় উঠলে তখন তার পরিবর্তে এই পদে অন্য আর একজনকে নিয়োগ দেয়া হলো । তারপরও বিচার শুরু হয় না । প্রসিকিউশন টিমে যাদের নিয়োগ দেয়া হলো তাঁদের তেমন পরিচিতি নেই । স্বাভাবিক কারণেই মানুষের মনে সন্দেহ । আর বিচার যাদের করা হচ্ছে তাদের প্রায় সকলেই জামায়াতের সদস্য । তাদের তহবিলে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা । কয়েক মিলিয়ন ডলার খরচ করে বিদেশে তাদের পক্ষ হয়ে জনমত সৃষ্টি করার জন্য নিয়োগ দেয়া হলো নামকরা লবিষ্ট ফার্ম আর জাঁদরেল আইনজীবীদের । ট্রাইবুনাল প্রথম যার রায় দিল সেই বাচ্চু রাজাকার আগেই পুলিশের নজরদারি এড়িয়ে পালিয়ে গেছেন । মানুষের মনে আবার সন্দেহ । পুলিশ যে এই রাজাকারকে পালিয়ে যেতে দিল সেখানে কোন রহস্য নেই তো । মাঝপথে আবার একজন বিচারপতি তাঁর প্রবাসী বন্ধুর সাথে স্কাইপের মাধ্যমে মামলা নিয়ে যে শলাপরামর্শ করলেন তা ফাঁস করে দিল বিএনপি ঘরাণার একটি পত্রিকা । সেটা নিয়ে আবার হৈচৈ । সকলের প্রশ্ন এই বিচার নিয়ে হচ্ছেটা কী ? সংশ্লিষ্ট বিচারপতি পদত্যাগ করলেন । আবার বিচার শুরু হলো । এরই মধ্যে মিরপুরের কসাই কাদের মোল্লার রায় দেয়া হলো । যে সকল অপারাধে তাকে দোষী পাওয়া গেল সে সবের অনেকগুলিরই সাজা হওয়ার কথা মৃত্যুদ- । তা না হয়ে দেয়া হলো যাব্বজীবন কারাদ- । দেশের মানুষ অবাক । মামলার রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল দায়ের কথা আইনে নেই । এমন বিচারের জন্যতো তারা দীর্ঘ চল্লিশ বছর অপেক্ষা করেনি । সৃষ্টি হলো শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ । চারিদিকে সমালোচনা আর ধিক্কার । সরকার সংসদের মাধ্যমে আইন পরিবর্তন করে উচ্চ আদালতে আপিল করলো । সকলের অধীর আগ্রহের অপেক্ষার পালা শেষ হলো যখন একদিন দেশের সর্বোচ্চ আদালত রায় দিল মৃত্যুদন্ড যোগ্য অপরাধ গুলির জন্য কাদের মোল্লার ফাঁসী হবে । একাত্তরের আর একজন কসাই দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর অপরাধের জন্য যে দিন ট্রাইবুনাল ফাঁসীর রায় ঘোষণা করে সেদিনতো সারা দেশে জামায়াত-শিবিরের ভয়াবহ তা-বের কারণে মর্ত্যে নরকের আগুনের উত্তাপ নেমে এসেছিল । অনেক স্থানে অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল সরকার জামায়াত-শিবিরের তষ্করদের হাতে আত্মসমর্পণ করেছে । সর্বোচ্চ আদালতে সাঈদীর মামলার রায় অপেক্ষমান আছে বেশ অনেক দিন ধরে । এটি ঠিক আইনের একটি নিজস্ব গতি আছে । কিন্তু সাধারণ মানুষের ধৈর্য্যরেও একটা সীমা আছে । ঘাতক শিরোমনি গোলাম আজম একাত্তরে মৃত্যুদ-যোগ্য অপরাধ করেছেন এমন কথা বলেছেন ট্রাইবুন্যাল তাদেও রায়ে। বয়সের কথা চিন্তা করে তাকে দেয়া হলো যাবজ্জীবন কারাদন্ড । ভাল কথা, কিন্তু তাকে জামাই আদরে হাসপাতালে রাখতে হবে কেন ?
একাত্তরের ঘাতক বাহিনী আলবদরের সৃষ্টিকর্তা মতিউর রহমান নিজামী । ট্রাইবুনালে তার মামলার শুনানি চলেছে দীর্ঘ সময় ধরে । গত নভেম্বরে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমান রাখা হলো । তারপর হতে আরো তিনবার রায়টি অপেক্ষমান থেকেছে । প্রতিবারই নিজামীর আইনজীবীরা নানা অজুহাতে রায় দেয়া হতে আদালতকে বিরত রাখতে সক্ষম হয়েছেন । একবার ট্রাইবুনালের একজন বিচারপতি অবসরে গেলে বিবাদী পক্ষ আবদার করলেন মামলাটি আবার শুনানি করতে হবে । আদালত তাদের প্রতি সদয় হলেন । সব শেষে আদালত সকল জল্পনা কল্পনা অবসান ঘটিয়ে বললেন রায় হবে সোমবার, ২৩ জুন । সারা দেশের মানুষের অধীর আগ্রহে অপেক্ষা । নিজামীর বিপক্ষে যারা সাক্ষ্য দিয়েছিলেন তারা সকাল হতে জড়ো হতে লাগলেন আদালত প্রাঙ্গনে । হাজির কয়েকশত মিডিয়া কর্মী । বিদেশ হতে ফোন । কী হলো ভাই জানাবেন । একসময় নিজামীর আত্মীয়স্বজন আর তার কৌশলীরা বেশ খোশ মেজাজে আদালত প্রাঙ্গনে এসে হাজির হলেন । এরই মধ্যে খবর রটে গেল রায় হচ্ছে না কারণ নিজামী অসুস্থ বা অসুস্থ হওয়ার ভান করেছেন । হাসপাতালের ডাক্তার নাড়ি টিপে বললেন হাঁ আসামী সত্যি অসুস্থ । সুতরাং তাকে রায় ঘোষণার সময় ট্রাইবুনালে হাজির করা যাবে না । এই মর্মে চিঠি গেল আদালতে । আইন বলে রায় আসামীর সামনেই ঘোষণা করতে হবে । আসামী যদি জামিন নিয়ে পলাতক থাকেন, অথবা দীর্ঘ সময় সত্যি অসুস্থ থাকেন কিংবা আদালতে আসতে অস্বীকৃতি জানান তবেই তার অনুপস্থিতিতে রায় ঘোষণা হতে পারে অন্যথা নয় । বিচারকরা নিজেদের মধ্যে শলাপরামর্শ করে জানিয়ে দিলেন আজ রায় হচ্ছে না । একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সাবেক উপাচার্য ডঃ আনোয়ার হোসেন ক্ষুব্দ হয়ে বললেন পুরো ঘটনা সন্দেহজনক । এটির তদন্ত হওয়া উচিত । বিএনপি আবার সব কিছুতেই দিল্লির ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করতে পারদর্শী । দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আ স ম হান্নান শাহ ঘোষণা করলেন দিল্লির ইশারায় এই রায় ঘোষণা করা হয় নি । আর রায় যদি ঘোষণা করা হতো তা হলে তিনি নির্ঘাত বলতেন এই রায় দিল্লির ইশারায় হয়েছে কারণ ২৩ তারিখ ভারতের বিদেশ মন্ত্রী সুষমা সরাজ বাংলাদেশে তিন দিনের সফরে এসেছিলেন ।
নির্ধারিত দিনে রায় ঘোষণা না হওয়াতে দেশের মানুষ শুধু চরম হতাশই নয় নানা রকমের সন্দেহের জাল বুনছেন । সরকারের সাথে বোধ হয় জামায়াতের একটি সমঝোতা হয়ে গেছে । হতে পারে জামায়াতের বিশাল অর্থ ভা-ারের কিছু অর্থ হয়তো বা এদিক সেদিক গেছে । নাকি মধ্য প্রাচ্যের কোন রাষ্ট্রের চাপ ছিল সরকারের উপর ? এরই মধ্যে কারা কর্তৃপক্ষ এক প্রতিবেদনে আদালতকে জানালো নিজামীর শারীরিক অবস্থা আগের চেয়ে ভাল তবে সম্পূর্ণ সুস্থ নন । সামনে রমজান মাস । তাহলে কী নিজামীর মামলার রায় ঝুলেই গেল? আর দশটা কাজের মতো ভরসা একমাত্র প্রধানমন্ত্রী । তিনি ক’দিন আগে বলেছেন কাদের মোল্লার ফাঁসীর রায় কার্যকর না করার জন্য বান কী মুন হতে শুরু করে জন কেরী, কারো ফোন বাদ যায় নি । তিনি কারো কথা না শুনে আইনকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দিয়েছেন । মানুষ আশা করে এবারও তার ব্যতয় ঘটবে না । আইন আদালত আর বিচার ব্যবস্থা নিয়ে জনগনের সন্দেহ ভাল নয় ।

লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় । জুন ২৮, ২০১৪

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ

[......লেখক আর্কাইভ]