|
||||||||||||||||||
|
অবৈধ অস্ত্র, জঙ্গিবাদ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া
প্রফেসর আবদুল মান্নান চতুর্থবারের মতো বড় ধরনের অস্ত্রের চালান ধরা পড়লো বাংলাদেশে । ধারণা করা হচ্ছে এই সব অস্ত্রের গন্তব্য ছিল ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলে সক্রিয় উলফা উগ্র বিচ্ছিন্নতাবাদিরা । প্রথম চালানটি ধরা পরে ১৯৯১ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা । আচমকা ধরা পরে চট্টগ্রাম কক্সবাজার রোডে চকরিয়ায় দুই ট্রাক অস্ত্র আর গোলাবারুদ । সেই অস্ত্র সেনাবাহিনী তাদের হেফাজতে নিয়ে যায় । এরপর এই বিষয়ে আর কিছু শোনা যায় নি । ১৯৯১ সনে নির্বাচনে ক্ষমতায় এলো জামায়াত-বিএনপি জোট । ১৯৯৩ সনে বগুড়ায় ধরা পরলো কয়েক হাজার রাউন্ড গুলি । তারপর চট্টগ্রামের সেই বহুল আলোচিত দশ ট্রাক অস্ত্র । সেটাও অনেকটা হঠাৎ করে । আদালতে মামলা হলো । আদালতের রায়ে পরিষ্কার হলো এই অস্ত্র চোরাচালানের সাথে সরকারের রাঘব বোয়ালরা জড়িত । এই চোরাচালান সম্পর্কে তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়া অবহিত ছিলেন তা আদালতে অভিযুক্তরা তাদের বক্তব্যে বলেছেন । ১৯৯৫ সালের ১৭ই ডিসেম্বর ভারতের পুরুলিয়ায় এক রহস্যজনক বিমান হতে অস্ত্র ফেলা হলো । চারিদিকে বেশ হৈচৈ । ভারতের পত্রপত্রিকায় লিখলো এই অস্ত্রের চালান বাংলাদেশ হতে এসেছে । আকাশ পথে বয়ে এনে তা ভারতের ভূখন্ডে ফেলেছে একটি পোলিশ বিমান । বিমানটির ক্রু ছিল বৃটিশ ও লাটভিয়ার নাগরিক । তাদের গ্রেফতার করা হয় এবং ভারতের আদালত তাদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দেয় । সর্বশেষ গত ৪টা জুন হবিগঞ্জের চুনারঘাট উপজেলার ভারত সীমান্তবর্তী সাতছড়ি এলাকা হতে র্যাব ভূগর্ভস্থ বাংকারে একটি বিশাল অস্ত্র মজুদের সন্ধান পায় যা দিয়ে একটি ছোট খাট সেনা ব্যাটেলিয়নকে সজ্জিত করা যায় । ধারণা করা হচ্ছে এই অস্ত্রগুলি সেখানে মজুদ করা হয়েছিল প্রায় বিশ বছর আগে, আনুমানিক ১৯৯৩ সালে । সেখানে আরো অবিষ্কার হলো এই বিচ্ছিন্নতাবাদিদেও একটি বিশাল পরিত্যক্ত ক্যাম্প । তখনও বেগম জিয়া ক্ষমতায় । যে কোন কারণেই হোক এই বিশাল অস্ত্র ভান্ডার যারা মজুদ করেছিল তারা সময় মতো সেগুলি সেখান হতে নিয়ে যেতে পারে নি । যায়গাটি অনেকটা দুর্গম । স্থানিয়রা জানিছেন ২০০৭ পর্যন্ত এই বিচ্ছিন্নতাবাদিরা সেখানে অবস্থান করেছিল । সেই এলাকায় বাইরের কারো যাওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল । কয়েক বছর আগে ভারতের বহুল প্রচারিত সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ‘ইন্ডিয়া টুডে‘ ভারতে অবৈধ পথে অস্ত্র প্রবেশের বিভিন্ন রুটের উপর একটি প্রচ্ছদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে । সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল ভারতে অবৈধ পথে অস্ত্র প্রবেশের একাধিক রুটের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম । তখন এই বিষয়ে বাংলাদেশ কোন প্রতিবাদ করে নি । গত বিশ বছরে বাংলাদেশে এই সব অস্ত্রের চালান ধরা পরার পর এখন এটি একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য যে কেউ ইচ্ছা করলে এবং সরকার যদি সহায়তা করে এই কাজটি করা সম্ভব । হবিগঞ্জে এই বিপুল পরিমাণের অস্ত্র উদ্ধারের পর একাধিক তত্ত্ব বাজারে চালু হয়ে গেছে । একজন স্বঘোষিত নিরাপত্তা বিশ্লেষক মন্তব্য করলেন শেখ হাসিনার সরকার সব সময় যে বলে তাদের শাসনামলে বাংলাদেশ হতে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদিদের সহায়তা দেয়া বন্ধ হয়েছে তা মোটেও সত্য নয় । এখন যখন বলা হচ্ছে এই অস্ত্রভান্ডার সাতছড়ির ভূগর্ভে ১৯৯৩ সনে রাখা হয়েছিল তখন কিন্তু সেই নিরাপত্তা বিশ্লেষক চুপ । তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট কমিটি হিয়ারিংএ বাংলাদেশে অসাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচনের পক্ষে ওকালতি করতে গিয়েছিলেন । আবার একটি মহল এই তত্ত্ব প্রচার করছে যে এটি র্যাবের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করার জন্য একটি সাজানো নাটক । এটিও ধোপে টেকে না এই কারণে ওই অঞ্চলের ত্রিপুরা পল্লীতে প্রায় অর্ধ শতাধিক আধিবাসী বসবাস করে । কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন কুড়ি বছর পর কেন এই উদ্ধার অভিযান ? আর একদল তাত্ত্বিকের মতে যেহেতু কিছুদিন পর ভারতের নতুন সরকারের পরাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা সরাজ বাংলাদেশে আসার কথা রয়েছে সেহেতু এই অস্ত্র উদ্ধার এই সময় এই কারণেই করা হয়েছে যাতে মোদী সরকার এটি বুঝে তাদের পূর্বাঞ্চলে শান্তি বজায় রাখতে আওয়ামী লীগ সরকারকে কতটুক প্রয়োজন । তাত্ত্বিকদের সর্বশেষ তত্ত্ব হচ্ছে আসলে এই অস্ত্র ভান্ডারের তথ্যটি ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ সরকারকে দেয় এবং বাংলাদেশ সরকার তার নিয়মিত গোয়েন্দা সংস্থাকে না দিয়ে তা র্যাবকে দেয় এবং তাদের দিয়ে এই অস্ত্র উদ্ধারের আয়োজন করে যার ফলে তা র্যাবের ‘অবনতিশীল’ ভাবমূর্তি উদ্ধারে সহায়তা করে । ঘটনা যাই হোক বাস্তব সত্যটা হচ্ছে হবিগঞ্জে আরেকটি বিরাট অস্ত্রের চালান উদ্ধার হয়েছে এবং নিয়মিত বিরতি দিয়ে বাংলাদেশে এই রকম অস্ত্র উদ্ধার ভারত বাংলাদেশ উভয়ের নিরাপত্তার জন্য বিরাট হুমকি । ভারতের পূর্বাঞ্চল অনেক দিন ধরে নানা উগ্রপন্থি বিচ্ছিন্নতাবাদিদের কর্মকান্ডে অস্থিতিশীল । ব্যতিক্রম শুধু আওয়ামী লীগ সরকার যখন সরকারে থাকে । বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে বেগম জিয়ার আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছেন ভারতের পূর্ব সীমান্তে যারা যুদ্ধ করছে তারা বিচ্ছিন্নতাবাদি নন বরং তারা তাদের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছেন যেমন করে বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে করেছিল । ব্যারিস্টার মউদুদের এই কথার সাথে বিএনপি-জামায়াত পন্থি একাধিক বুদ্ধিজীবী আর সুশীল সমাজের সমর্থকও সুর মিলিয়েছিলেন । তারা আরো বলেছিলেন এই স্বাধীনতাকামীদের সহায়তা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব । ভারতের পত্রিপত্রিকা খবর দিচ্ছে মোদী সরকার আন্তর্জাতিক মাফিয়া ডন দাউদ ইব্রাহিমকে আটক করার জন্য নানা ভাবে চেষ্টা করছে । অথচ এই দাউদ ইব্রাহিমের সাথে বেগম জিয়ার জেষ্ঠ্য পুত্র তারেক রহমান অন্তত দুইবার, একবার ভারতে আর দ্বিতীয়বার দুবাইতে দেখা করেছেন । সেই সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেছিল সে সময় বাংলাদেশের একটি শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থা । চট্টগ্রামে দশ ট্রাক অস্ত্রের চালানটির সাথে একাধিকবার তারেক জিয়া এবং এই গোয়েন্দা সংস্থাটির নামও এসেছে । বলা হয়েছে এই বিশাল অস্ত্র চালানের অর্থের যোগান দিয়েছে পাকিস্তানের কুখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই আর তা এসেছে দুবাই ভিত্তিক পাকিস্তানি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান আরএকে’র মাধ্যমে । আইএসআই এর সাথে চার দলীয় জোট সরকারের একটি নিবিড় সম্পর্ক ছিল যা এখন ওপেন সিক্রেট । শেখ হাসিনার বিগত সরকারের সময় দাউদ ইব্রাহিমের একজন বড় মাপের সহচর ব্রাহ্মণবাড়িয়া হতে গ্রেফতার হয়েছিল । ভারতের পূর্ব সীমান্তে শুধু যে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদি সংগঠন গুলি সক্রিয় তা নয় । এই অঞ্চলে মায়ানমারের কমপক্ষে সাতটি বড় ধরণের সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদি সংগঠন তাদের অন্তর্ঘাত মূলক কর্মকান্ড পরিচালনা করে এবং তারা ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদিদের সাথে একটি নিবিড় সখ্যতা গড়ে তুলতে পেরেছে । মায়ানমারের একটি বিশাল অঞ্চল এই বিচ্ছিন্নতাবাদিরা নিয়ন্ত্রণ করে । তাদের কর্মকান্ড চীন সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত । কোন কোন বিশ্লেষক মনে করেন এই বিচ্ছিন্নতাবাদিরা যদি এক হতে পারতো তাহলে তারা সহজেই মায়ানমারের আরো বিস্তীর্ণ এলাকা দখল করে নিতে পারতো । এক সময় এই সব বিচ্ছিন্নতাবাদির সাথে যোগ দিয়েছিল নেপালের মাওবাদিরা । নেপালে রাজতন্ত্রের অবসান হওয়ার পর সেই সম্পর্ক আর নেই । সুইডিশ বংশোদ্ভুত সাংবাদিক বারটিল লিন্টনার দীর্ঘদিন ধরে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া জঙ্গবাদের উত্থান নিয়ে কাজ করেন । দুই দশকেরও বেশী সময় ধরে অধুনা লুপ্ত বহুল প্রাচারিত সাপ্তাহিক ফার ইস্টার্ন রিভ্যুতে সাংবাদিকতা করেছেন । বর্তমানে তিনি থাইল্যন্ডের চেংমাইতে থাকেন । বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে তিনি ‘বাংলাদেশ এ ককুন অব টেরর’ লিখে বেশ হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিলেন । সম্প্রতি তার প্রকাশিত বই ‘গ্রেট গেম ইস্ট‘ বেশ আলোচিত হচ্ছে । তিনি তাঁর সেই বইতে লিখেছেন কী ভাবে জামায়াত কক্সবাজার টেকনাফের রোহিঙ্গ শিবরকে জঙ্গিবাদ প্রশিক্ষনের জন্য ব্যবহার করে এবং এই জঙ্গিরা কী ভাবে প্রশিক্ষণ শেষে অন্যদেও জন্য ভাড়া খাটে । গত মার্চ মাসে এই ব্যপারে তাঁর সাথে রেঙ্গুনে আমার দীর্ঘ সময় ধরে আলাপ হয় । তিনি বলেন রোহিঙ্গা শিবিরের এই জঙ্গিদের প্রায় সকলেই ইসলামী ছাত্র শিবিরের কর্মী। তার বইতে তেমন একটি প্রশিক্ষণরত দলের ছবি ছাপা হয়েছে যেটি তিনি নিজে টেকনাফে তুলেছেন । এই জঙ্গিদের সাথেও ভারতের আর মায়ানমারের বিচ্ছিনতাবাদিদেও সম্পর্ক রয়েছে । থাইল্যান্ড, মায়ানমার, ভারতের পূর্ব সীমান্ত আর বাংলাদেশ জঙ্গিবাদ লালনের একটি উর্বর অঞ্চল হয়ে উঠতে পারে যদি এই দেশের সরকারগুলি এই জঙ্গিবাদ দমনের জন্য তাদের মধ্যে কার্যকর সমঝোতা সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয় । জঙ্গিবাদের প্রসার ঘটলে ক্ষতি হবে সাধারন মানুষের আর দেশের ভাবমুর্তির । ভারতবর্ষের পূর্ব সীমান্তে পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের মতো কোন একটি অবস্থা সৃষ্টি হোক তা নিশ্চয় কেই চাইবে না । তা যদি সত্য হয় তা হলে এই অঞ্চলের সব দেশেরই সতর্ক হওয়ার এখনই সময় । লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যলয় । জুন ৬, ২০১৪
WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action.
|
লেখকের আগের লেখাঃ
|