[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

সংবর্ধানার নামে তামাশা বন্ধ করা হোক

 


-প্রফেসর আবদুল মান্নান

১৯৬১ হবে । প্রায় বায়ান্ন বছর আগের কথা । সারা দেশে খবর রটে গেল ইংল্যান্ডের রানি এ্রলিজাবেত চট্টগ্রামে আসছেন । চারিদিকে এক হৈ হৈ কা- রৈ রৈ ব্যাপার আর সাজ সাজ রব । একেবারে রানির দর্শন । চাট্টিখানি কথা নয় । আসলে রানি তাঁর স্বামী সহ ভারত উপমহাদেশ সফরে বের হয়েছেন তাঁদের পুরানো প্রজারা কেমন আছেন তা দেখতে । আমাদের ও অন্যান্য স্কুলে খবর এলো রানিকে বরণ ও বিদায় জানাতে স্কুলের বাচ্চাদের রাস্তার দুই পাশে পাকিস্তানি আর বৃটেনের ঝান্ডা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে । মনে মনে আনন্দ আর ধরে না । আরো একটি বাড়তি আনন্দের সুসংবাদ দিল স্কুলের হেডমাস্টার মশায় । চট্টগ্রামের পতেঙ্গা হতে শহরের সার্কিট হাউজ পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় বিশ কিলোমিটার পথের দু‘ধারে দাঁড়িয়ে ঝান্ডা নাড়তে হবে এবং তার শুরুটা নাকি হবে আমাদের স্কুলকে দিয়ে । মাসটা ফেব্রুয়ারি শেষের দিকে । সকাল সাতটার স্কুল বাসে বিমান বন্দরে সকলে হাজির । বেলা দশটার দিকে রানি নামলেন । পিছনে পিছনে স্বামী প্রিন্স ফিলিপ । খোলা জীপে রানি শহরের দিকে যাত্রা করলেন । আমরা সকলে ঝান্ডা নেড়ে রানিকে স্বাগত জানালাম । মিনিটেই রানির গাড়ী দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে গেল । তারপর? তারপর সারাদিন বিমান বন্দরের ঝোপের আড়ালে সকলের আড্ডা । আমিতো তারাশঙ্করের আস্ত একটা উপন্যাসই শেষ করে ফেল্লাম। তখনো বিরানী প্যাকেট চালু হয়নি । দুপুরের খাওয়ার হিসেবে কে জানি একটি কলা আর দুই স্লাইস পাউরুটি দিয়ে গেল । আগেই স্কুল হতে বলে দিয়েছিল বোতলে পানি নিয়ে আসতে । দিন কিন্তু আর শেষ হয় না । এই পথে শহর দর্শন শেষে কখন আবার ফিরবেন রানি সেই অপেক্ষা । যে রানিকে স্বাগত জানানোর জন্য এত উৎসাহ দুপুরের পর হতে সেই রানিকেই মনে মনে গালাগাল দেয়া শুরু করলাম । মনে হচ্ছিল তিনি আমার একজন পরম শত্রু । বিকেলের দিকে রানি ফিরলেন । আবার ঝান্ডা উড়লো । রানি হাত নেড়ে রাজকীয় বিমানে ঢুকলেন । আমরাও পড়ি কী মরি করে বাসে উঠলাম । এবার বাড়ী ফিরতে হবে । ছোট বেলার এই ঘটনা আমদের মনে রানি সম্পর্কে বেশ নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল । জীবনে আর কাউকে এমন ভাবে স্বাগত অথবা বিদায় জানাতে কোথাও যেতে হয় নি । হঠাৎ করে এতদিনের পুরানো সব কথা মনে পরলো সাম্প্রতিক কালে নব নির্বাচিত সংসদ সদস্য অথবা মন্ত্রী পরিষদে স্থান পাওয়া কিছু ব্যক্তির অশোভন সংবর্ধনার বহরের কথা পত্র পত্রিকায় পড়ে ।

দশম সংসদ নির্বাচনের মনোনয়ন ও নতুন মন্ত্রী সভা গঠনের পর প্রধানমন্ত্রী বেশ বাহবা কুড়িয়েছেন কারণ তিনি ৪৮জন পুরানো সংসদ সদস্যকে মনোনয়ন আর পঁয়ত্রিশজন পুরানো মন্ত্রী সভার সদস্যকে তাঁর নতুন মন্ত্রী সভায় ঠাঁই দেন নি কারণ তাদের অনেকেই বিগত পাঁচ বছরে তাদের নিজস্ব কর্মকান্ডের কারণে নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন । অন্তত নতুন মন্ত্রী সভা দেখে মানুষ কিছুটা আশান্বিত হয়েছেন । সিনিয়র মন্ত্রীরা প্রায় সকলেই অভিজ্ঞতা সম্পন্ন । প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাদের সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য । তবে একজন উপদেষ্টা নিয়ে বিভিন্ন মহলের আপত্তি আছে এবং যারা এই উপদেষ্টার বিরুদ্ধে আপত্তি তুলেন তারা প্রায় সকলেই আওয়ামী লীগের শুভাকাক্সক্ষী । এই উপদেষ্টাকে না রাখলে প্রধানমন্ত্রীর তেমন কোন অসুবিধা ছিল না । তবে নতুন সরকারের শুরুতেই যে জিনিষটা সকলকে ধাক্কা দিয়েছে তা হচ্ছে কিছু সংসদ সদস্য আর মন্ত্রী সভার সদস্যের আচরণ আর তাদের নিজ নিজ এলাকায় দৃষ্টিকটু ভাবে সংবর্ধনা নেয়ার হিড়িক । নতুন সমাজ কল্যাণ মন্ত্রী সৈয়দ মহসীন আলী । গত সোমবার গেলেন সিলেটের এক স্কুলে মেধাবী ছাত্রদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করতে । ধুমপান না করে তিনি বেশিক্ষণ থাকতে পারেন না । মঞ্চে বসেই সিগারেট ধরিয়ে মনের সুখে সকলের সামনে কষে দিলেন এক টান । অথচ দেশের আইনে আছে প্রকাশ্যে ধুমপান করলে দুই শত টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। এমন সমাজ কল্যাণ মন্ত্রী কী সরকারে থাকতেই হবেই ? কল্যাণের বদলে তিনিতো সরকারের জন্য অকল্যাণের কারণ হতে পারেন । একই দিন তিনি গেলেন একটি কলেজে । শখ হলো তিনি একটি গান গাইবেন । সাথে ছাত্রদেরও গাইতে বলেন । এক ছাত্র আবার বেসুরা গলায় গাওয়া শুরু করলো । এতে মন্ত্রী মহোদয় ক্ষুব্দ হয়ে সেই ছাত্রকে লাথি আর কিল ঘুষি মেরে নিজের ক্ষমতা জাহির করলেন আর শেষে কলেজ কর্তৃপক্ষকে ছাত্রটিকে বহিষ্কার করতে বললেন । শেষ পর্যন্ত উপস্থিত শিক্ষকদের হস্তক্ষেপে বহিস্কার থামানো গেল । উপস্থিত দর্শক শ্রোতাদের অনেকেরই সন্দেহ হলো হয়তো মন্ত্রী মহোদয় হুঁসে নেই । এই সব সংবাদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ও অন-লাইন পত্রিকার মাধ্যমে দেশে এবং দেশের বাইরের লক্ষ লক্ষ মানুষ পড়েছে । পরদিন তা সংবাদ পত্রে বেশ ফলাও করে ছাপাও হয়েছে । নতুন মন্ত্রীসভার বয়স মাত্র সপ্তাহ দু’এক । এরই মধ্যে নতুন মন্ত্রী সভার একাধিক সদস্য এমন অনেক কাজ করেছেন যার কারণে নিশ্চিত ভাবে প্রধানমন্ত্রী আক্ষেপ করেছেন ।
এখন আসি সংবর্ধনার বিষয়টিতে । নব নির্বাচিত সংসদ সদস্য বা মন্ত্রীসভার সদস্যরা নিজ নিজ এলাকায় সফরে যাবেন । ভাল কথা । কিন্তু সেখানে স্কুলের কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের ঘন্টার পর ঘন্টা রোদের মধ্যে দাঁড় করিয়ে কেন তাদের সাথে অমানবিক আচরণ করা ? এটাতো একধরণের মানবাধিকার লঙ্ঘন । সংবর্ধনা যদি নিতেই হয় তাহলেতো তা নিজ দলের নেতা কর্মীদের কাছ হতে নেয়াটাই যুক্তিসঙ্গত । হোক না সেই সংবর্ধনা কোন এক খেলার মাঠে অথবা খোলা যায়গায়। তবে অবশ্যই রাস্তা বন্ধ করে নয় । সেখানে এলাকার মানুষ দেখুক তাদের নতুন নেতার দুর্বিনীতর বদলে বিনীত আর ভদ্র আচরণ । তারা উপলব্দি করুক এই নেতা তাদেরই একজন । এমন যদি হয় তা হলে সেই নেতার প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা আর আস্থা বাড়বে তা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় । এই যে বাচ্চারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে নেতার জন্য অপেক্ষা করছে তা শুধু অর্থহীনই নয় বরং বলতে হবে ওই নেতা শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন । এই বাচ্চাদের মাথার উপর কোন আচ্ছাদন নেই । খাওয়ার কোন পানি নেই । টয়লেটে যাওয়ার কোন আয়োজন নেই । সময় মতো খাওয়ার কোন ব্যবস্থা নেই । এর ফলে আমার ছোট কালে রানির প্রতি যে একটা নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হয়েছিল তাদেরও ঠিক ওই নেতার প্রতি অনুরুপ ধারণা সৃষ্টি হতে বাধ্য । এতো গেল সংবর্ধনার কথা । তার উপর আছে কোন কোন এলাকায় অতিথিকে দামি উপহার দেয়ার প্রতিযোগিতা । ভারতে এক সময় নেতাকে টাকায় ওজন করার রেওয়াজ ছিল । এখন কত বিশাল ফুলের মালা পরানো যায় তার প্রতিযোগিতা । বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে একজন সংসদ সদস্যকে সোনার মুকুট দেয়া হয়েছিল উপহার স্বরূপ । তা নিয়ে চারিদিকে কম হৈচৈ হয়নি । এবার একজন প্রতিমন্ত্রীকে উপহার হিসেবে দেয়া হয়েছে একটি সোনার নৌকা । বুদ্ধিমান মন্ত্রী সেই নৌকা বিক্রি করে তার অর্থ একটি এতিমখানায় দান করে দিয়েছেন । এই সবের উপর আছে তোরণ সংষ্কৃতি । মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রী আসবেন তার জন্য জন জীবন বিপর্যস্থ করে শত শত তোরণ । এই সব তোরণ আবার চাঁদার টাকায় নির্মিত । আর এই চাঁদা যে সকলে স্বেচ্ছায় দেয় তাও কিন্তু নয় । এতে কী লাভ তা বুঝা মুস্কিল । আর তোরণ যে শুধু নেতাকে বরণ করার জন্য নির্মান করা হয় তা নয় । উরষ, মিলাদ, জসনে জুলুস, বিবাহ শাদী এমন কী এলাকার নামকরা সন্ত্রাসী জেল হতে ছাড়া পেলেও তাকে বরণ করার জন্য তোরণ নির্মান করে জন জীবনকে হর হামেশাই বিপর্যস্ত কওে তোলা হচ্ছে । এই সব বন্ধ করা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর দায়িত্ব । তারা কখনো সেই দায়িত্ব পালন করেন না ।
কিছু সংখ্যক সংসদ সদস্য আর মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রীর এই দূর্বিনীত আচরণের কথা পড়ে এবং জেনে সোমবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এই সব বন্ধ করার জন্য নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে বলে সংবাদে প্রকাশ হয়েছে । ওই নির্দেশনার আলোকে একটি পরিপত্র জারি করে বলা হয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের রাস্তায় দাঁড় করানো যাবে না । এই ধরণের কাজকে ‘অনৈতিক কার্যক্রম’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে । বলা হয়েছে এই নির্দেশনা অমান্য করলে সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও পরিচালনা পর্ষদেও বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে । এখন প্রশ্ন হচ্ছে সব সময় কী প্রধান শিক্ষকদের ইচ্ছায় এই সব কর্মকান্ড করা হয়? না, তা করা হয় না । স্থানিয় রাজনৈতিক পান্ডারা অনেক সময় প্রধান শিক্ষককে স্কুলের বাচ্চাদের রাস্তায় দাঁড় করাতে বাধ্য করেন । তাদের সম্পর্কে সরকারি নির্দেশনায় কিন্তু কিছু বলা হয় নি । সরকারি নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার্থীদের অভিভাবক সহ দেশের মানুষ আশা করে সংবর্ধনার নামে এই সব তামাশা বন্ধ হবে এবং দেশের বিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার জন্য বরং জনপ্রতিনিধিরা সচেতন থাকবেন । তবে এর আগেও এমন নির্দেশনা জারি করা হয়েছিল । কাজ হয়নি কিছু । আশ করি এইবার শিক্ষামন্ত্রনালয় এই ব্যপারে আরো সচেতন হবে । আর প্রধানমন্ত্রীকে সময় থাকতে অনুরোধ করি যে সকল মন্ত্রী তাঁর সরকারের জন্য অস্বস্তির কারণ হয় তাদের মন্ত্রী সভায় রাখা একান্ত অপরিহার্য কী না তা তাঁকে সময় সময় চিন্তা করে দেখতে হবে । আর একটি প্রস্তাব হচ্ছে সরকার নতুন মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের করণিয় সম্পর্কে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করতে পারেন ।

লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় । জানুয়ারী ২৮, ২০১৪

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ

[......লেখক আর্কাইভ]