[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

প্রতিপক্ষ যখন আওয়ামী লীগ

 


-প্রফেসর আবদুল মান্নান

পাঁচ কিস্তিতে অনুষ্ঠিতব্য উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ৯৭ টি উপজেলায় নির্বাচন বুধবার অনুষ্ঠিত হয়ে গেল । যে বিএনপি-জামায়াত জোট বিদেশী লবিষ্ট, কিছু অদূরদর্শী দলীয় নেতা আর তথাকথিত সুশীল সমাজের প্ররোচনায় গত ৫ই জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি সেই বিএনপি-জামায়াত জোটও এই উপজেলা নির্বাচনে শুধু অংশগ্রহণই করেনি ৯৭ টি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদের মধ্যে যৌথভাবে ৫৩টিতে জয়ীও হয়েছে এবং এর মধ্যে এককভাবে বিএনপি’র ভাগে আছে ৪১ জন চেয়ারম্যান । নির্বাচনের আগে ও নির্বাচনের দিন বিএনপি’র শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ বলেছিলেন এটি একটি পাতানো নির্বাচন যেখানে এক তরফাভাবে সরকারি দল তথা আওয়ামী লীগ তাদের বিজয় ছিনিয়ে নেওয়ার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ফেলেছে । আওয়ামী লীগ মাত্র ৩৪টি চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী হয়েছে । ভাইস চেয়ারম্যান পদেও বিএনপি-জামায়াত জোটের প্রার্থীরা আওয়ামী লীগের চেয়ে ভাল করেছে । জামায়াতের প্রার্থীদের বিজয়ের পিছনে কারণ হতে পারে এই সব এলাকার মানুষ পেট্রোল বোমা মেরে মানুষ খুন করা পছন্দ করেন আর এরাই হচ্ছে সেই সব মানুষ যাদের চরম অনিচ্ছা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু একাত্তরে তাদের একটি স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছিলেন ।

কারচুপির অভিযোগ এনে একাধিক নির্বাচনী এলাকায় বিএনপি নির্বাচন বয়কট করেছে আর তার প্রতিবাদে আটটি উপজেলায় আবার তারা হরতালও আহ্বান করেছে । আর মজার ব্যাপার হচ্ছে যে সকল এলাকায় তারা এই অভিযোগ এনে নির্বাচন বয়কট করেছে তার মধ্যে একাধিক উপজেলায় আবার তাদের প্রার্থীরাই বিজয় লাভ করেছেন । এখন রুহুল কবির রিজভি কি বলবেন জানি না । হয়তো বলবেন নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে মানুষ সব আসনে বিএনপি-জামায়াত জোটকে বিজয়ী করতো ঠিক যেমনটি বিভিন্ন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের পর বিএনপি নেত্রী বলেছিলেন নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে তাদের প্রার্থীরা আরো বেশী ভোটে বিজয়ী হতেন । তবে ইতোমধ্যে দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা হান্নান শাহ বলেই ফেলেছেন প্রশাসন হস্তক্ষে না করলে তারা আরো অনেক বেশী আসনে বিজয়ী হতেন । বিজয়ী প্রার্থী, নির্বাচন কমিশন আর সরকারকে প্রথম দফার উপজেলার নির্বাচনটি মোটামুটি নির্বিঘেœ অনুষ্ঠিত হওয়ার জন্য অভিনন্দন । কোন কোন জায়গায় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ঠিকই কিন্তু বাংলাদেশে নির্বাচনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে তা অপ্রত্যাশিত ছিল না । নির্বাচন কমিশন আরো একটু সতর্ক হলে এই সহিংসতাকে অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব ছিল । তবে ৫ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে জামায়াত-শিবির আর কোন কোন ক্ষেত্রে বিএনপি যে মাত্রায় সহিংসতা সৃষ্টি করেছিল তার তুলনায় উপজেলা নির্বাচনে সৃষ্ট সহিংসতা নস্যি ।

প্রথম ধাপের পর দ্বিতীয় ধাপে ১১৭ উপজেলায় ২৭ ফেব্রুয়ারি, তৃতীয় ধাপে ৮৩ উপজেলায় ১৫ মার্চ, চতুর্থ ধাপে ৯২ উপজেলায় ২৩ মার্চ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আর সর্বশেষ পঞ্চম ধাপে ৭৪টি উপজেলায় নির্বাচনটি হবে ৩১ মার্চ । । সব নির্বাচন শেষে এই নির্বাচন নিয়ে সার্বিক বিশ্লেষণ করা সম্ভব । তবে তার আগে প্রথম ধাপের নির্বাচনটি সম্পর্কে শুধু একটি কথা বলা যায় এই ধাপে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা শোচনীয়ভাবে পরজিত হয়েছেন । যদিও এটি একটি স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার নির্বাচন এবং তা নির্দলীয়ভাবেই হয় কিন্তু বাস্তবে তা দলীয় রূপই নিয়েছিল কারণ প্রায় সব প্রার্থীর পিছনে দলীয় ছাপ ছিল আর নির্বাচনের দিন দলগতভাবে বিএনপি তো নির্বাচন কমিশনের কাছে গিয়ে তাদের কথিত কারচুপির বিরুদ্ধে অভিযোগও দায়ের করে এসেছে । আর বিকেলে বিএনপি আর আওয়ামী লীগের পক্ষ হতে যথাক্রমে রুহুল কবির রিজভি আর এইচটি ইমাম নির্বাচন বিষয়ে তাদের দলীয় অবস্থান প্রকাশ করেছেন । সব কিস্তির নির্বাচন শেষে যদি বর্তমান ধারাবাহিকতায় বিএনপি-জামায়াত জোট ভাল করে তাহলে নিশ্চিতভাবে তারা তাদের পূর্বের দাবির পূনরাবৃত্তি করে বর্তমানে অসাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিটার পূনরুল্লেখ করবেন। এই নির্বাচনের আরো একটি তাৎপর্য আছে । নির্বাচনের দিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিুউ মজিনা রাজশাহী জেলার কয়েকটি কেন্দ্রে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেন এবং তাদের দুই সদস্য বিশিষ্ট একটি দল নির্বাচন চলাকালীন সময়ে চট্টগ্রামে গিয়ে হেফাজতে ইসলামের শীর্ষনেতা মওলানা শফি সহ তাদের শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের সাথে সাক্ষাৎ করেন । উল্লেখ্য যে বুধবারের নির্বাচনে হেফাজতের সদর দপ্তর এলাকা হাটহাজারিতেও তাদের একজন প্রার্থী ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়েছেন । গত ৫ই জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনের আগে এক অজ্ঞাত কারণে অষ্ট্রেলিয়ার একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে আল-কায়দার প্রতিনিধি নেজামে ইসলামের প্রধান চট্টগ্রামের মুফতি ইজহারের লালখান বাজরের মাদ্রাসায় তার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন । তার কিছুদিন পর সেই মাদ্রাসায় বোমা বানানোর সময় এক ভয়াবহ বিষ্ফোরণে দুজন মাদ্রাসা ছাত্র নিহত হয় এবং ওই মাদ্রাসার একটি অংশ উড়ে যায় । এই যাবত পুলিশ মুফতি ইজহারকে গ্রেফতার করতে পারেনি । ড্যান মজিনার স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সময় নির্বাচনী কেন্দ্র পরিদর্শন করা,একই সময় তার দূতাবাসের একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিনিধি দলের হেফাজতের শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের সাথে একেবারে তাদের সদর দপ্তরে গিয়ে সাক্ষাত করা অথবা এর পূর্বে অষ্ট্রেলিয়া দূতাবাসের একটি প্রতিনিধি দলের বাংলাদেশের আল-কায়দার প্রতিনিধির সাথে দেখা করা- এইসব কোন কিছুই বিচ্ছিন্নভাবে দেখার সুযোগ নেই । আর মুফতি ইজহার যখন বেগম জিয়ার নেতৃত্বাধীন ১৯ দলীয় জোটের অন্তর্ভূক্ত একটি দলের প্রধান তখন বিষয়টি আরো বেশি গুরুত্ব বহন করে ।

প্রথম দফা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অনেকটা বিপর্যয়কর ফলাফল কী অপ্রত্যাশিত ছিল ? একেবারে দলকানা না হলে বলতে হয়, না, অপ্রত্যাশিত ছিল না, কারণ বেশীর ভাগ নির্বাচনী এলাকায় আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্ধী আওয়ামী লীগই ছিল ঠিক যেমনটি দেখা গিয়েছিল ২০০১ সালে সংসদ নির্বাচনে । সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কম পক্ষে আশিটি আসনে পরাজিত হয়েছিল নিজেদের দলীয় কোন্দলের কারণে নিজেদের বিদ্রোহী প্রার্থীর কাছে । সদ্যবিজয়ী উপজেলা চেয়ারম্যান বা অন্যান্যদের বিজয়কে খাটো করে না দেখেও বলা যায় এই নির্বাচনে পূর্বের ধারাবাহিকতায় অনেক গুলি আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা হেরেছেন শ্রেফ নিজেদের দলীয় কোন্দলের ফলে । কোন্দল এখন আওয়ামী লীগের জন্য একটি দলীয় ট্রেডমার্ক হয়ে পরেছে । এই কোন্দলটা যদি না থাকতো তাহলে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে এখনো একটি অপ্রতিরোধ্য দল হিসেবে নিজেকে পরিচিত করতে পারতো । উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের আগে দলীয় সভানেত্রী হতে শুরু করে একাধিক শীর্ষ পর্যায়ের নেতা প্রত্যেক উপজেলার স্থানীয় পর্যায়ের নেতাদের আহ্বান জানিয়েছিলেন তারা যেন প্রত্যেক উপজেলায় একজন করে প্রার্থী দেন এবং তার বিজয়ের জন্য কাজ করেন । কিন্তু তাদের সেই আহ্বান শুধু যে অরণ্যে রোদন ছিল তাই নয় অনেক উপজেলায় এই কোন্দলকে আরো উৎসাহ ভরে বাতাস দিয়েছেন হয় ওই এলাকা হতে মনোনীত কোন এক মন্ত্রী অথবা সংসদ সদস্য । স্থানীয় ভাবে হয়তো ঠিক করা হলো দলীয় প্রার্থী হবেন একজন কিন্তু তাকে নাকচ করে দিয়ে মন্ত্রী মহোদয় বা সংসদ সদস্য নিজেদের এক বা একাধিক প্রার্থী দাঁড় করিয়ে দিয়ে বিপর্যয় নিশ্চিত করেছেন । চট্টগ্রামের দুটি নির্বাচনী এলাকার কথা বলি । একটিতে বিদায়ী চেয়ারম্যান প্রতিদ্বন্ধিতা করছিলেন । এলাকায় তিনি বেশ জনপ্রিয় বলে জানা গেছে । কিন্তু একজন মন্ত্রী মহোদয় তাকে কোন বোধগম্য কারণ ছাড়া নিজের প্রতিদ্বন্ধী মনে করেন । সেই প্রার্থীর বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিলেন একজন প্রার্থী এবং বললেন এই প্রার্থীই হচ্ছে দলীয় প্রার্থী । যথারীতি বিএনপি প্রার্থীর কাছে উভয় প্রার্থীর হার। অথচ এই প্রার্থীদ্বয়ের প্রাপ্ত ভোট যোগ করলে বিএনপি প্রার্থী ধারে কাছেও নেই ।
আর একজন বিদায়ী চেয়ারম্যান যার সততা কিংবদন্তিতুল্য । বছর দুই আগে তিনি গুরুতর অসুস্থ হলে এলাকার মানুষ চাঁদা তুলে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিল । এবার দলীয় প্রার্থী । কিন্তু এলাকার আওয়ামী লীগের কর্মীদের অন্য চিন্তা । বিএনপি প্রার্থীর টাকাপয়সা খরচ করার যোগ্যতা অনেক বেশী । আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা কর্মীদের নৌকা ভিড়ল তার বন্দরে । ফলাফল যা হবার তাই হলো । এমন অবস্থা খুঁজলে আরো অনেক উপজেলায় মিলবে । সামনের নির্বাচনগুলোতেও এমনি হবে না তা কেউই হলফ করে বলতে পারবে না । এটি হচ্ছে আওয়ামী লীগের চরম সাংগঠনিক দূর্বলতার একটি সামান্য চিত্র এবং সাম্প্রতিক কালে যখনই দল হিসেবে আওয়ামী লীগ অথবা তাদের ভাবধারার কোন পেশাজীবী সংগঠন কোন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে তখন এমন কোন্দল বার বার মাথাচাড়া দিয়ে উঠে এবং যথারীতি একটি বিপর্যয় ঘটে আর আওয়ামী লীগ সেই বিপর্যয় হতে কোন শিক্ষা নেয় না ।
পাঁচ বছর অথবা দু’বছর পর হোক আগামী কোন একসময় একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে । এখনো যদি আওয়ামী লীগ দলীয় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে কোন্দল নিরসনে সমর্থ না হয় তা হলে আগামীতেও যে এমন সব বিপর্যয় ঘটবে না তার নিশ্চয়তা কে দেবে? ইতোমধ্যে যে সকল এলাকায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা নিজে দলের মন্ত্রী আর সংসদ সদস্যদের কারণে হেরেছেন তাদের অনেকেই ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন সামনের নির্বাচনে তারা তা সুদে আসলে পরিশোধ করে দেবেন । এমন অবস্থায় তাদের বিপর্যয় রুখে কার সাধ্য ?

দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ তার নিজের প্রতিপক্ষ হিসেবে কাজ করে আসছে এখন সময় এসেছে সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা । এটি কে করবেন তা কোটি টাকার প্রশ্ন ।

লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় । বর্তমানে শিক্ষক, ইউল্যাব, ঢাকা । ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৪

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ

[......লেখক আর্কাইভ]