[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

হারিয়ে যাওয়া ছাত্রলীগের সন্ধানে

 


-প্রফেসর আবদুল মান্নান

বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয় আজ দূঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে এই লেখাটি লিখতে বসেছি কারণ ঠিক করেছিলাম ছাত্রলীগতো নয়ই বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতি নিয়ে আর কখনো কোথাও কিছু লিখবো না । মাস কয়েক আগে দৈনিক প্রথম আলোয় ছাত্র রাজনীতি আর ছাত্রলীগ নিয়ে আমার এক লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর বেশ তোপের মুখে পরেছিলাম । সে সময় আমার সাবেক কর্মক্ষেত্রে আমি অবাঞ্ছিত ঘোষিত হয়েছিলাম আর এক জন সাবেক ছাত্র নেতা টেলিফোনে আমার চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করেছিলেন । তার কাছে বিনীত অনুরোধ করেছিলাম আমার প্রতি বর্ষিত বাক্যবাণগুলি যেন তিনি লিখিত আকারে প্রকাশ করেন তা হলে তা দেশের মানুষ জানতে পারবেন । না, তিনি তা করেন নি বা করার প্রয়োজন মনে করেন নি । তবে সুখের বিষয় হচ্ছে সেই ঘটনার পর আমার পূর্বের কর্মক্ষেত্রের ছাত্রলীগ নামক সংগঠনটির একাধিক শীর্ষ পর্যায়ের নেতা আমাকে টেলিফোন করে ঘটনার জন্য দূঃখ প্রকাশ করেছেন এবং এও বলেছেন তারা চাপে পরে আমার বিরুদ্ধে এই ধরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং এই কাজে তাদের দূর্ভাগ্যজনক ভাবে ব্যবহার করেছেন দু’একজন শিক্ষক । এই শিক্ষকরা আবার বঙ্গবন্ধুর নাম বেচে খান এবং তাদের কেউ কেউ ভুল ভাবে মনে করেন তাদের পদ পদবি প্রাপ্তিতে আমি একটি বড় বাধা ।
গত কয়েক সপ্তাহে বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতি বিশেষ করে ছাত্রলীগের কিছু অনভিপ্রেত কর্মকা- সংবাদ পত্রের শিরোনাম হয়েছে । তবে এই কথাটি সত্য যে ছাত্রলীগ কোন অপকর্ম করলে মিডিয়া যে ভাবে সেই অপকর্মের সংবাদ পরিবেশনে ঝাঁপিয়ে পরে অন্যান্য ছাত্র সংগঠনগুলির বেলায় তেমনটি দেখা যায় না । যেমন সম্প্রতি বৃটেনের জেনস ডিফেন্স উইকলির একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ইসলামী ছাত্র শিবিরকে বিশ্বের তৃতীয় ভয়াবহতম সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকা ভুক্ত করেছে । কিন্তু খবরটি বাংলাদেশের অধিকাংশ গণমাধ্যমে খবর আকারে ছোট করে প্রকাশিত হয়েছে, তার বেশী কিছু নয় । শিবিরের সন্ত্রাসিরা যদি কোন একজন ছাত্রলীগের কর্মীর পায়ের রগ কাটে বা তাকে হত্যা করে তখন হয়তো ছাত্রলীগ কর্মীটির ছোট একটি ছবি ছাপা হয় কিন্তু ঘাতক সম্পর্কে বেশীর ভাগ মিডিয়া সংবাদ প্রকাশে তেমন কোন উৎসাহ দেখায় না । যদিও ছাত্রলীগের হাজার কিসিমের দোষ-ত্রুটি আছে, তাদের অপকর্মেরও কোন ঘাটতি নেই এবং যদিও অন্যান্য ছাত্র সংগঠনগুলি এই সব অপকর্মে কোন অবস্থাতেই পিছিয়ে নেই, শুধু সুযোগের অভাব হতে পারে, তথাপি সব সময় গণমাধ্যমে ছাত্রলীগই এই সব কর্মের জন্য শিরোনাম হয় । পাঠক যেন মনে না করেন ছাত্রলীগের প্রতি আমার বিশেষ কোন দূর্বলতার কারণে আমি এই সব লিখছি । না তা নয় । শুধু মাত্র কোন কোন সংবাদ মাধ্যমের এক চোখা নীতির উল্লেখ করছি । এই দেশের ইতিহাসে ছাত্রলীগের যে অসাধারণ অবদানগুলি আছে তাতো স্বীকার করতেই হবে । তবে ছাত্রলীগ নিয়ে গণমাধ্যমের যে একটি বাড়তি উৎসাহ আছে তা অনস্বীকার্য । সাম্প্রতিক কালের দুই একটি উদাহারণ দিয়ে বলি ।
গত শনিবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে ছাত্রলীগের এক সাবেক নেতা তার সতির্থদের হাতে এমন ভাবে লাঞ্চিত হলেন যা এক কথায় শুধু নজিরবিহীনই নয় অভিনবও বটে এবং তা কোন কোন সংবাদপত্রে যে ভাবে প্রকাশিত হয়েছে তা আমার মতো একজন নগন্য পাঠকের মতে সাংবাদিকতার নীতির মধ্যে পরে না এবং মনে হয়েছে এমন একটি ছবি ও সংবাদ প্রকাশ করে তারা সকলে বেশ সুখ অনুভব করেছে। বাবুল এক সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন । সেটি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য চরম দূঃসময়ের কাল । একটি সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ের তখন আমি উপাচার্য । সেই অবরুদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়কে মুক্ত করার জন্য চট্টগ্রামের সকল প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠনতো আমাকে সে সময় সহায়তা করেছিলই এমন কী জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নেতারাও আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল কারণ এই বিশ্ববিদ্যালয়ে দখলদারি ছাত্র সংগঠনটির হাতে সব চেযে বেশী নিগৃহীত হয়েছে ছাত্রদলের নেতা কর্মীরা । পাশে দাঁড়িয়েছিল সরকার আর সাহস যুগিয়েছিল ছাত্রলীগ । অবশ্য এখন ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে যে ধরণের অপবাদ বা অভিযোগ শোনা যায় তখন তা তত শোনা যেত না । অন্ততঃ কোনদিন ছাত্রলীগের কোন একজন নেতা আমার কাছে এসে কাউকে চাকুরি দেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করেন নি । আমার বাসায় যখন মধ্যরাতে বোমা মারা হলো তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যক্তিগত ভাবে ফোন করে আমারা আর আমার পরিবারের খোঁজ নিয়েছেন আর আমার শহরের বাসায় দীর্ঘ দিন পুলিশ প্রহরার ব্যবস্থা করেছেন আর ছাত্রলীগের ছেলেরা এসে তাদের সহমর্মিতা জানিয়ে বলেছেন প্রয়োজনে তারা আমার বাসা পাহারা দেবেন । সেই সময়কার সেই ছাত্র নেতা বাবুল বিশ্ববিদ্যালয় হতে পাশ করে জমি জমার ব্যবসা করেন বলে শুনেছি এবং কেন্দ্রীয় আওয়ামী রাজনীতির সাথেও জড়িত । ছাত্র জীবনে বাবুল বেশ ভদ্র আর স্বল্পভাষি ছিলেন । পরবর্তি কালে তার চরিত্র যে ফুলের মতো পবিত্র তা আমি হলফ করে বলতে পারি না কারণ তার সাথে দীর্ঘদিন আমার কোন যোগাযোগ নেই । যেহেতু সে জমি জমার ব্যবসা করে এই ধরণের ব্যবসায় তার কিছু অপকর্ম থাকতেই পারে । কিন্তু সেটা ভিন্ন বিষয় ।
বাবুল গত শনিবার লাইব্রেরি অডিটোরিয়ামে গিয়েছিল সাবেক উপাচার্য প্রয়াত ডঃ আবু ইউসুফের স্মরণ সভায় যোগ দিতে । সিএনজি ট্যাক্সি হতে নামার সাথে সাথে আগে হতে প্রস্তুত থাকা একদল ছাত্র তাকে মারধর শুরু করে এবং গলায় একটি জুতার মালা পড়িয়ে দিয়ে তার ছবি তুলে তা তাৎক্ষণিক সামাজিক ওয়েবসাইটে আপলোড করে দেয় । যারা এই অপকর্মটি করেছে পত্র-পত্রিকায় তাদের পরিচয়ে বলা হয়েছে তারা ছাত্রলীগ কর্মী । আর পরদিন একই ছবি চট্টগ্রাম সহ দেশের একাধিক জাতীয় দৈনিকে প্রকাশ হয়েছে এই শিরোনামে ‘কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতার গলায় চবি ছাত্রলীগের জুতার মালা’ । ছবিতে দেখা যাচ্ছে বাবুলের জামা ছেঁড়া, পিছনে কেউ তার হাত দুটি শক্ত করে ধরে রেখেছে কিন্তু ওই অবস্থাতেই বাবুলের মুখে একটা করুণ হাসি । খবরে বলা হয়েছে ক্যাম্পাসে আধিপত্য নেই এমন একজনকে চবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ দেয়ার জন্য বাবুল চেষ্টা করছিলেন । কোথাও কোথাও লিখেছে শিবিরের সাথে সখ্যতা আছে তেমন কাউকে বাবুল ওই পদে অধিষ্টিত করতে চেয়েছেন । পরবর্তি কালে ছাত্রলীগের দুই একজন নেতা বলার চেষ্টা করেছেন এই ঘটনার সাথে তারা জড়িত নন কিন্তু বাস্তবটা হচ্ছে ঘটনা যারাই ঘটাক তার দায় দায়িত্ব অন্তত গণমাধ্যম ছাত্রলীগের উপর চাপিয়ে দিয়েছে এবং দেশের মানুষ তা বিশ্বাস করেছেন । এটা ছাত্রলীগের দূর্ভাগ্য যে বর্তমানে সাধারণ মানুষের কাছে তাদের যে ইমেজ তা মোটেও ইতিবাচক নয় । প্রশ্ন হচ্ছে এর জন্য কাকে দায়ি করা যাবে ? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাতো ছাত্রলীগের হাতে বই খাতা তুলে দিয়েছিলেন । সেই বই খাতা কোথায় গেল ?
আমার প্রজন্মের কাছে ছাত্রলীগ অথবা ছাত্র রাজনীতির কথা বলতে তা ষাটের দশকে তাদের সোনালী যুগের কাহিনী । বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণআন্দোলন, সত্তরের নির্বাচনে ছাত্রলীগের ভূমিকা, মহান মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র সংগঠনগুলির বিরত্ব গাঁথার কাহিনী । পরবর্তি কালে স্বৈারাচার বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে তাদের ভূমিকাও ইতিহাস স্মরণ করবে । ছাত্রলীগ মানে আমার কাছে বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে গড়া একটি সংগঠন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠায় যার নেতা কর্মীদের ভূমিকা অপরিসিম । এই ছাত্র নেতাদের একজন, খালেক নেওয়াজইতো ১৯৫৪ সনের নির্বাচনে মুসলীম লীগের পরাক্রমশীল নেতা পূর্ব বঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনকে পাকিস্তানের প্রথম প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে শোচনীয় ভাবে পরাজিত করেছিলেন । এই ছাত্রলীগ একদিন এই দেশের রাজনীতিতে শুধু একজন শেখ মুজিব বা তাজউদ্দিনকে জন্ম দেয় নি এখান হতে উঠে এসেছেন নূরে আলম সিদ্দিকি, তোফায়েল আহমেদ, আ স ম অবদুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখন, শাহজাহান সিরাজ প্রমূখরা । এক চরম প্রতিকূল পরিবেশেও ডাকসুর সহ সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন সুলতান মোহাম্মদ মনসুর । আজ যে মন্ত্রী পথে পথে ঘুরে তাঁর দায়িত্ব পালন করার জন্য নিরলস পরিশ্রম করেন সেই ওবায়দুল কাদের এই ছাত্রলীগেরই সৃষ্টি । আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাওতো এক সময় ছাত্রলীগের নেত্রী ছিলেন । এটি সত্য ইতোপূর্বে যে সকল ছাত্র নেতা ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দিয়েছেন তারা সকলে তাদের রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারেন নি । কেউ কেউ রাজনীতি হতে ছিঠকে পরেছেন আবার অন্যরা সুবিধাবাদিতার রাজনীতির সাথে হাত মিলিয়েছেন । সম্প্রতি রাজশাহী আর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে দু’জন ছাত্র অজ্ঞাত আততায়ীদের হাতে নির্মম ভাবে খুন হলো । গণমাধ্যম সহ অনেকে এই হত্যাকান্ডের জন্য অবধারিত ভাবে ছাত্রলীগকে দায়ি করলো যদিও এই দুটি ঘটানার এখনো কোন সাক্ষি নেই । আবার রাজশাহির ঘটনার জন্য ছাত্রলীগ দায়ি করলো ছাত্র শিবিরকে । আসল ঘটনা কী তা জানা যাবে সঠিক তদন্তে যা আবার এ’দেশেসহজে হয় না । এই সব ঘটনার প্রেক্ষাপটে নতুন করে আবার দাবি উঠলো ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি বন্ধের । আমি মনে করি না এটি একটি সঠিক সমাধান । সমাধন পেতে হলে এই সব ঘটনার জন্য যারাই দায়ি তাদের খুঁজে বের করে যথাযোগ্য শাস্তি দিতেই হবে । ইদানিং দেখা যায় এক শ্রেনীর শিক্ষক তাদের ক্ষুদ্র স্বার্থে ছাত্রদের নিয়মিত ব্যবহার করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় যার উৎকৃষ্ট উদহারণ । কারা এই সব শিক্ষক তা সকলেই জানেন । তাদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় আইনেই ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা আছে । যতক্ষণ পর্যন্ত সেই মতে ব্যবস্থা নেয়া না হচ্ছে ততক্ষন পর্যন্ত ক্যাম্পাসে শান্তি ফিরবে না । আর ছাত্রলীগের হাতে প্রধানমন্ত্রী যে বই খাতা তুলে দিয়েছিলেন তা তাদের আবার হাতে তুলে নিতে হবে । ছাত্রলীগ নেতাদের এটা মনে রাখতে হবে যেহেতু সরকারে আওয়ামী লীগ সেহেতু তারাই সব সময় দূরবিনের দৃষ্টি সীমার মধ্যে । সেই দূরবিনে তারা কী ভাবে দৃষ্টিগোচর হতে চান তা তাদেরই ঠিক করতে হবে । ছাত্রলীগ তার পূরানো ঐতিহ্য ফিরে পাক এটাই প্রত্যাশা ।

লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় । এপ্রিল ৮, ২০১৪

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ

[......লেখক আর্কাইভ]