@
@
@
@
@ |
@
বিদ্যুৎ নিয়ে যত
রাজনীতি
@
প্রফেসর আবদুল মান্নান
গত শনিবার কোলকাতায় আমার বন্ধুর বাসায় বসে বাংলাদেশের একটি অন-লাইন পত্রিকা
খুলতেই দেখি প্রথমে যে সংবাদটি বেশ গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে তা হচ্ছে
বাংলাদেশে বেলা সাড়ে এগারটা হতে জাতীয় গ্রীডে বিদ্যুৎ বিপর্যয় । ওই সময়
সংবাদটিতে তেমন কোন বিস্তারিত ব্যাখ্যা ছিল না । শুধু বলা হয়েছে যান্ত্রিক
ত্রুটির কারণে এই বিপর্যয় । কর্তৃপক্ষ যতদ্রুত সম্ভব এই ত্রুটি সনাক্ত করে
বিদ্যুৎ সরবরাহ পুনরায় চালু করার চেষ্টা করছে । বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহে
বিঘœ ঘটা নতুন কিছু নয় । অন্য দেশেও এমন বিপর্যয় ঘটতে পারে এবং ঘটেছে । গত
সোমবার দক্ষিণ আফ্রিকায় ঘটেছে । আগামী দুই সপ্তাহ তাদেও চারটি প্রধান শহর
বিদ্যুত বিহীন থাকবে । এর আগে বাংলাদেশে ২০০৩ ও ২০০৭ সালে জাতীয় গ্রীড ফেল
করেছিল তাও বেশ দীর্ঘ সময় পর পুনরায় চালু হয়েছিল । দেশের ষাট ভাগ মানুষ
বিদ্যুতের উপর নির্ভরশীল । বাকি চল্লিশ ভাগ মানুষ বুঝতেই পারে না বিদ্যুৎ
কখন আসলো বা গেল । নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের উপর এই চল্লিশ ভাগের ছাড়া
আরো ব্যাপক জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন জীবন যাত্রা নির্ভর করে । বিদ্যুৎ সরবরাহ
বন্ধ থাকলে পানি, গ্যাস সরবরাহ, পেট্রোল পাম্পের তেল, ট্রেনের সিগনাল বাতি,
বিমান বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রম, রেল ষ্টেশনে টিকেট বিক্রি, মোবাইল ফোন
সার্ভিস, পত্রিকার অফিসের কার্যক্রম, রেডিও টিভির সম্প্রচার সব কিছুই
বিঘিœত হয় । খবরটা শুনে দেশে আমার কন্যাকে ফোন করি । সে বলে বেলা এগারটার
পর হতে বিদ্যুৎ নেই । তখন বেলা তিনটা । এপার্টমেন্টের জেনারেটর ক্লান্ত হয়ে
এখন জিরিয়ে নিচ্ছে । আধ ঘন্টা পরে আমার আর এক পরিচিতজনকে ফোন করি । সে বলে
ভারত বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে কারণ আজ নাটোরে বেগম জিয়ার পূর্ব
নির্ধারিত গুরুত্বপূর্ণ জনসভায় বক্তব্য রাখবেন এবং সেই বক্তব্য যাতে দেশের
মানুষ শুনতে না পারেন তার জন্য ভারতের এই ষড়যন্ত্র । ভারত হতে বাংলাদেশ
মাত্র ৪৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করে । কোলকাতা বিমান বন্দরে বসে আমার এক
অনুজ প্রতিম সাংবাদিক বন্ধুকে ফোন করে সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাই । সে বলে
তাদের কাছে যে সংবাদ আছে তাতে তারা জেনেছে ভারত হতে যে সঞ্চালন ভেড়ামারা
বিদ্যুৎ বিতরণ কেন্দ্রের মাধ্যমে বাংলাদেশে আসে সেই বিতরণ কেন্দ্রে সমস্যা
হয়েছে । বিকাল পাঁচটার সময় তা মেরামত করা হয়েছিল । চালু করার কিছুক্ষণ পরই
আবার আশুগঞ্জ বিতরণ কেন্দ্র ট্রিপ করে । রাতের ফ্লাইটে দেশে ফিরে দেখি
বিএনপিfর যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদের কণ্ঠেও একই সুর । তিনি ভারতের জায়গায়
সরকারের ষড়যন্ত্র বলে অবহিত করেছেন । রিজভী আহমেদ আর বিএনপিfর ভারপ্রাপ্ত
মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামকে ইদানিং বেশ পছন্দ করা শুরু করেছি । আমি
সাধারণত টিভি দেখার সময় পাই না কিন্তু সংবাদে এই দুfজনের বক্তব্য পেশ করার
সময় তা শোনার চেষ্টা করি কারণ দুজনের কথা বলার ষ্টাইল আর বক্তব্য দুটিই বেশ
আনন্দদায়ক । অনেকটা কমিকেল রিলিফ । এদিক দিয়ে আওয়ামী লীগ অনেক পিছিয়ে আছে ।
বাংলাদেশ বর্তমানে প্রায় এগারহাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে
কিন্তু অনেক সময় বিতরণ লাইনের সমস্যার কারণে সাত হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ
বিতরণ করতে গেলেই বিপত্তি ঘটে কারণ বিতরণ লাইনের সঞ্চালন ক্ষমতা সীমিত ।
বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয় তখন আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল চারশত সত্তর
মেগাওয়াট । যুদ্ধে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে সেই
উৎপাদন ব্যবস্থায়ও মারাত্মক বিঘœ ঘটেছিল । এছাড়া সঞ্চালন লাইন গুলি বেশীর
ভাগ জায়গায় বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব ছিল
না । বিদ্যুৎ, পানি বা গ্যাস উৎপাদন সমস্যার সমাধান করলে হবে না সরবরাহ
ব্যবস্থা যদি ঠিক না থাকে তা হলে উৎপাদন অর্থহীন হয়ে যেতে পারে । পানি বা
গ্যাস সংরক্ষণ করা যায় । বিদ্যুৎ যখন উৎপাদন তখন সরবরাহ । তাকে সংরক্ষণ করা
সম্ভব নয় । এক সময় ঢাকায় গোটা তিনেক লোহার বড় বড় পানির ট্যাংক তৈরী করা
হয়েছিল । যার একটি সম্ভবত এখনো ফকিরাপুল এলাকায় আছে । এই ট্যাংকগুলি কখনো
ব্যবহার করা সম্ভব হয় নি কারণ এখান হতে পানি ছাড়লে সঞ্চালন লাইনগুলি পানির
চাপে ফেটে যায় । এখন সেই সমস্যা মিটেছে কী না জানি না । যা হোক সাংবাদিক
বন্ধুকে ফোন করে বুঝতে পারলাম বিষয়টা সম্পূর্ণ যান্ত্রিক ত্রুটি এবং এক সময়
তা সেরে যাবে । তবে যারা বিদ্যুতের উপর পুরোমাত্রায় নির্ভরশীল তাদের ভোগন্তি
হবে এবং সেখানে নানা ধরণের ষড়যন্ত্র আবিষ্কারের প্রতিযোগিতা চলবে । রিজভী
আহমেদের বলার আগে ধারণা ছিল না বেগম জিয়া বক্তৃতা দিতে উঠলে দেশের মানুষ সব
কাজ কাম ফেলে তাঁর বক্তৃতা শোনার জন্য রেডিও টিভির সামনে বসে পরে ।
২০০৩ সালের কথা । তখন আমি যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরে অবস্থান করছি ।
যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের জীবন যাত্রার পুরোটাই বিদ্যুতের উপর নির্ভরশীল ।
কয়েক মিনিটের জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হলে সব কিছু অচল । গাড়ী ট্রেন বিমান
বন্দর চলবে না । পানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে । বাড়ীতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ
হওয়ার কারণে চুলায় রান্না চড়বে না । বিদ্যুৎ সরবরাহের সমস্যা যদি দীর্ঘায়িত
হয় মোটামুটি মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় মহা বিপর্যয় নেমে আসতে পারে ।
বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে আমার বন্ধু সতর্ক করে দিল খবরদার
রাস্তায় বের হবে না । একটু পর অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন এলাকায়
দোকানপাটে লুটতারাজ শুরু হয়ে যেতে পারে । এরপর দাঙ্গা পুলিশ এসে এলোপাতাড়ি
লাঠি চার্য শুরু করবে এবং সামনে যাকে পাবে তাকে আটক করে থানায় নিয়ে যাবে ।
এমন অবস্থার কথা শুনেছি তবে কখনো চাক্ষুষ দেখিনি । আমাদের এলাকা কিছুটা
শান্ত থাকলেও দূরে বেশ হৈ হট্টগোল আর গুলি টিয়ার গ্যাসের আওয়াজ শোনা
যাচ্ছিল । কিছুক্ষণ পর আগুনের লেলিহান শিখা । সারা রাত আর বিদ্যুৎ আসে নি ।
পরের দিনও না । মোট দুfদিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার উত্তর-পূর্ব অংশ বিদ্যুৎ
বিহীন অবস্থায় ছিল এবং এই সময় বিভিন্ন শহরে যে লুটপাট হয়েছে তার ক্ষতির
পরিমাণ কয়েক মিলিয়ন ডলার । মানুষের দূর্ভোগতো ছিলই । সে দিক দিয়ে বাংলাদেশে
শনিবারের প্রায় দশ ঘন্টার এই বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের কারণে তেমন কোন দূর্ঘটনার
কথা শোনা যায় নি । রাত সাড়ে আটটায় আমাদের বহনকারী বিমান যখন ঢাকার শাহজালাল
আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে নামার জন্য আকাশে চক্কর দিচ্ছে জানালা দিয়ে নীচে
তাকিয়ে দেখি দুfএকটি বিচ্ছিন্ন এলাকা ছাড়া সারা শহর অন্ধকার । বিমান বন্দর
সড়কে গাড়ীর বাতিগুলি দেখা যাচ্ছে । ইমিগ্রেশনে কর্মরত কর্মকর্তারা আপ্রাণ
চেষ্টা করেছে কিছুটা আলো অন্ধকার অবস্থায় দ্রুত তাদের কাজ সারতে কারণ বলাতো
যায় না আবার কখন বিমান বন্দরের ষ্ট্যান্ডবাই পাওয়ার হাউস ক্লান্ত হয়ে পরে ।
যথারীতি পরদিন সব পত্রিকায় শীর্ষ খবর ছিল আগের দিনের বিদ্যুৎ বিপর্যয় ।
ষড়যন্ত্র তত্ত্বতো ছিলই তার উপর ছিল নাশকতা তত্ত্ব । সব তত্ত্বের পিছনে
আবার জোড়ালো যুক্তি খাড়া করার আপ্রাণ চেষ্টাও ছিল । সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম
গুলিতো মোটামুটি সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে । দুfএকজন বলেই ফেলল
এই অপদার্থ আর eঅবৈধf সরকারের এই ব্যর্থতা কাঁধে নিয়ে কালই পদত্যগ করা উচিৎ
। একজন সাবেক আমলা ফেইস বুকে একটি হারিকেনের ছবি দিয়ে সরকারকে নসিহত করলেন
আগামী নির্বাচনে যেন আওয়ামী লীগ নৌকা মার্কার বদলে হারিকেন মার্কায়
নির্বাচন করেন । একজন আবার ফোঁড়ন কেটে বলেন eআরে ভাই ২০১২ সালের ৩০ ও ৩১
জুলাই উত্তর ভারতের ২২টি রাজ্যে বিদ্যুৎ ছিলনা এবং তার ফলে ৬০ কোটি মানুষ
বিদ্যুৎ বিহীন ছিল তাতে কী কংগ্রেসের নির্বাচনী মার্কা বদল হয়েছে ? কে শোনে
কার কথা । যাদের নেতা রিজভী আহমেদ আর মির্জা ফখরুল । তারা অন্যের কথা
শুনবেন কেন ?
শনিবারের বিদ্যুৎ বিপর্যয় কাটিয়ে দ্রুততম সময়ে সরকারের গৃহীত ব্যবস্থার
প্রশংসা না করলে এই কর্মযজ্ঞের সাথে যারা জড়িত ছিলেন তাদের প্রতি অবিচার করা
হবে । এরই মধ্যে সরকার এই বিপর্যয়ের কারণ খুঁজে বের করার জন্য তদন্ত কমিটি
গঠন করেছে । তারা তদন্ত শুরু করেছে । ইতোমধ্যে তারা সমস্যার প্রথম
উৎপত্তিস্থল ভেড়ামারা পরিদর্শন করে একটি অন্তবর্তিকালিন প্রতিবেদনও জমা
দিয়েছে । সম্পূর্ণ প্রতিবেদন জমা দিতে আরো এক মাস সময় লাগবে বলে তারা
জানিয়েছেন । যাদের সামান্যতম কারিগরি জ্ঞান আছে তারা বুঝবেন যে বিদ্যুৎ একটি
গ্রীডের মাধ্যমে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে সঞ্চালন করা হয় এবং গ্রীডের মাধ্যমে
বিভিন্ন পাওয়ার ষ্টেশনে বা সাব ষ্টেশনের মাধ্যমে তার শক্তি নিয়ন্ত্রণ করে
এলাকায় বিতরণ করা হয় । উৎপাদন পয়েন্ট হতে বড় সাব ষ্টেশনে আসে সেখান হতে ছোট
সাব ষ্টেশনে তারপর ব্যবহারকারিদের কাছে পৌঁছায় । সব ষ্টেশনেই সার্কিট
ব্রেকার থাকে । আজকাল প্রায় সব বাড়ীতেও এfরকম সার্কিট ব্রেকার থাকে । বিদ্যুৎ
সঞ্চালনে কোন ধরণের ত্রুটি থাকলে সার্কিট ব্রেকার ট্রিপ বা পড়ে যেতে পারে ।
বাড়িতে পরলে তা আমরা তুলে দেই। কিন্তু একটি পাওয়ার সাব ষ্টেশনে তা পরলে
ত্রুটি সনাক্ত না করে তেমন করে তুলে দিলে আরো বড় ধরণের বিপর্যয় ঘটতে পারে ।
তদন্তে হয়তো ত্রুটি ধরা পরবে । তবে সেটি হবে রোগ নির্ণয় । পরবর্তিতে রোগ
সারানোর ব্যবস্থা না নিলে রোগের পূনরাবৃত্তি যে কোন সময় হতে পারে ।
বাংলাদেশে এই ধরণের সমস্যার সনাক্তিকরণ প্রায় সময় হয় কিন্তু নিরাময়ের
ব্যবস্থা হয় না । আশা করি এই বার তেমনটি হবে না আর এক শ্রেণীর মানুষ
ষড়যন্ত্র ও নাশকতা আবিষ্কারের সুযোগও পাবে না ।
লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় । নভেম্বর ৫, ২০১৪
@
@
WARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
@
[প্রথমপাতা] |
@
@
@
লেখকের আগের লেখাঃ
[......লেখক আর্কাইভ]
|