[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

দশম জাতীয় সংসদের কাছে মানুষের প্রত্যাশা

 


-প্রফেসর আবদুল মান্নান

বুধবার ২৯ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হলো । বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে তৃতীয় বারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন । এর আগে বিএনপি প্রধান বেগম জিয়াও তিন বার প্রধানমন্ত্রীর শপথ নিয়েছিলেন কিন্তু দ্বিতীয়বার তিনি কয়েক দিনের বেশী এই পদে বহাল থাকতে পারেন নি । সেটি ১৯৯৬ সনের ১৫ই ফেব্রুয়ারির একদলীয় নির্বাচন পরবর্তী সময়ের কথা । তিনি যে সেই সংসদের পূর্ণ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী থাকতে চান নি তা কিন্তু নয়, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন গণ আন্দোলনের তোড়ে তাঁর সেই চেষ্টা ভেসে গিয়েছিল । সেই সংসদ সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে সংযোজন করেছিল যা ২০১১ সালে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থি বলে বাতিল ঘোষণা করেছে । সংশোধনীটি গোড়া থেকেই ত্রুটিপূর্ণ ছিল । গত ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদের যে নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হলো তাতে বিএনপি-জামায়াত সহ তাদের মিত্র দলগুলি অংশগ্রহণ করেনি কারণ তাদের ধারণা বাতিলকৃত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন না হলে তাতে তাদের পরাজয় নিশ্চিত । সংবিধান সম্মত বিধানে নির্বাচনে তাদের চরম অনীহা । বিএনপি-জামায়াত জোটের নির্বাচনে না যাওয়ার পিছনে তাদের নিজস্ব যুক্তিতো ছিলই তার উপর তাদের পিছনে ইন্ধন যুগিয়েছিল দেশের এক শ্রেণীর সুশীল সমাজ, কিছু মিডিয়া আর কিছু বিদেশী শক্তি । তারা ধারণা করেছিল বিএনপি-জামায়াত মিলে দেশে এমন একটা আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হবে যে আওয়ামী লীগ তাদের দাবি মেনে অসাংবিধানিক পন্থায় নির্বাচন দিয়ে তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার পথ সুগম করে দেবে । তাদের সেই ধারণা সম্পূর্ণ ভাবে ব্যর্থ হয়েছে কারণ বিএনপি কোন আন্দোলনের দল নয় এবং দলের নেতৃত্বে রাজনীতিবিদ বলতে যাদের বুঝায় তাদের তেমন কেউও নেই । দল পরিচালিত হয় অনেকটা স্বল্প দৃষ্টিসম্পন্ন সাবেক সামরিক-বেসামরিক আমলা আর বাস্তবতা বর্জিত কিছু তামাদি রাজনৈতিক ব্যক্তি দ্বারা । বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর দীর্ঘ দিন দলটি বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্টিত থাকলেও বিএনপি সঠিক অর্থে একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে উঠতে পারে নি । আর গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো এখন দলটির কাঁধে সোয়ার একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াত যা বিএনপি’র ভিতর ক্যান্সার ভাইরাসের মতো প্রবেশ করেছে । দ্রুত এর চিকিৎসা না হলে হয়তো দেখা যাবে বিএনপি নামক দলটির অস্তিত্বই বিলুপ্ত হয়েছে । তার উপর যোগ হয়েছে এই দল এখন কে চালায় সে প্রশ্ন । চিকিৎসার নামে লন্ডনে বিলাসি জীবন যাপনকারী বেগম জিয়ার জ্যেষ্ঠ পুত্র তারেক জিয়া, না ঢাকায় অবস্থানরত তার মা দলের চেয়ারপারসন বেগম জিয়া ? দীর্ঘ তেইশ বছর পর এই প্রথমবার একটি জাতীয় সংসদ গঠিত হলো যেখানে বিএনপি নামক দলটির কোন প্রতিনিধি থাকলো না । অন্যদিক হতে এই সংসদ আক্ষরিক অর্থে পবিত্র কারণ জামায়াত নামক যুদ্ধাপরাধীদেও দলটিও সংসদে নেই ।

সংসদ নির্বাচনের পূর্বে অনেকের ধারণা ছিল যে যেহেতু নির্বাচনে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি অংশ গ্রহণ করছে না সেহেতু সেই নির্বাচন বা সংসদ বৈধতা পাবে না । ইতোমধ্যে তারা সকলে ভুল প্রমাণিত হয়েছেন কারণ নির্বাচনের পর দ্রুততম সময়ে বিশ্বের সকল গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র ও সংস্থা নতুন সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছে এবং অঙ্গিকার করেছে তারা এই সরকারের সাথে কাজ করবে । নির্বাচনটি সংবিধানের আওতায় হয়েছিল এবং তাতে ছোট বড় মিলিয়ে বারটি দল অংশ নিয়েছিল । নির্বাচনের পর বিভিন্ন মহল হতে নতুন সংসদের আয়ুষ্কাল নিয়ে ভবিষ্যৎবাণী করা শুরু হয়েছে । যুক্তরাষ্ট্র আগামী জুন মাসের মধ্যে একটি সকল দলের অংশগ্রহণ মূলক নির্বাচন প্রত্যাশা করে । ইউরোপীয় ইউনিয়ন কোন সময় সীমা বেঁধে না দিলেও আশা করে যত সত্বর সম্ভব এমন একটা নির্বাচন হবে তবে সেই নির্বাচনের আগে বিএনপিকে জামায়াতের সঙ্গ ছাড়তে হবে । ভারত বাংলাদেশে একটি স্থিতিশীল সরকার প্রত্যাশা করে নিজেদের স্বার্থে কারণ কৌশলগত দিক থেকে বাংলাদেশ ভারতের কাছে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী । বাংলাদেশে সংঘাত বা অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হলে তার ধাক্কা ভারতের বিভিন্ন রাজ্যেও আঘাত হানতে পারে । বিএনপি আশা করে এক বছরের মধ্যে এই সরকার বিদায় হবে এবং জনগণ তাদের পুনরায় ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনবে । আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছেন সংবিধান অনুযায়ী তারা পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত সুতরাং আইন সংগত ভাবে এই পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকতে তাদের কোন বাধা নেই । তারা এও জানে তাদের ক্ষমতাচ্যুত করার সক্ষমতা বিএনপি’র নেই । তারা যা পারে তা হচ্ছে জামায়াত নামক সন্ত্রাসী সংগঠনটির সহায়তায় আন্দোলনের নামে দেশে চরম নৈরাজ্য সৃষ্টি করে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করে তোলা । আর জামায়াতও এটা বুঝে রাষ্ট্র বা সরকার যদি তাদের সৃষ্ট সন্ত্রাস দমন করতে যথাযথ ব্যবস্থা নেয় তা হলে তারা বেশীক্ষণ টিকে থাকতে পারবে না । আর জনগণ চায় স্বস্তি, তাদের জান মালের নিরাপত্তা আর দেশে একটি সুশাসন । বাস্তবে বর্তমান সরকার কতদিন ক্ষমতায় থাকবে তা অনেকাংশে নির্ভর করে নতুন সরকার দেশ কেমন চালাচ্ছে তার উপর ।

নতুন সংসদে প্রথাগত বিরোধী দল নেই বলে অনেকে হা হুতাশ করছেন । তারা জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দল হিসেবে মানতে নারাজ কারণ তারা সরকার ও বিরোধী দল উভয়ই আছে । গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিরোধী দলকে মনে করা হয় ছায়া সংসদ ও সরকার । তারা প্রয়োজনে ক্ষমতাসীন সরকারের বিভিন্ন কর্মকান্ডের গঠনমুলক সমালোচনা করবে, ভুল ভ্রান্তি ধরিয়ে দেবে এবং বিকল্প প্রস্তাব করবে । কিন্তু নবম সংসদে বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল তা করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে কারণ তারা সংসদের মেয়াদের প্রায় পুরো সময়টুকুই সংসদে অনুপস্থিত ছিল । বিরোধী দলীয় নেত্রী ৪১৮ দিনের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সর্বসাকুল্যে দশ দিন যদিও তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা সংসদ সদস্য হিসেবে সকল সুযোগ সুবিধা আর বেতন ভাতা নিতে কার্পণ্য করেন নি । যে কয়দিন তারা নিজেদের স্বার্থে উপস্থিত ছিলেন সেই ক’দিন তারা জনস্বার্থে কোন কথা না বললেও নিজেদের ও দলীয় স্বার্থে ঝগড়া-ঝাটি করে সংসদের সময় নষ্ট করেছেন এবং আর একদিন ফিরে আসবেন বলে অধিবেশন ত্যাগ করেছেন । ইতোমধ্যে জাতীয় পার্টি ঘোষণা করেছে তারা সংসদে যোগ্য বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করবে যদিও তাদের কয়েকজন সদস্য মন্ত্রী সভায় আছেন । দেশের মানুষ দেখতে চায় তারা অনুগত বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ না হয়ে সত্যিকার অর্থে তারা তাদের কথা রাখবেন । আর সরকারি দল যদি তাদের ভূমিকা পালনে বাধা হয় যে কোন সময় তারা সরকার থেকে পদত্যাগ করে সকলে বিরোধী দলের বেঞ্চে বসবেন । আর এই রকমের সরকার বা সংসদ বাংলাদেশ আবিস্কার করে নি । এমন সংসদ বা বিরোধী দল দক্ষিণ আফ্রিকা, বৃটেন, ভারত, পাকিস্তান প্রভৃতি দেশে বিভিন্ন সময়ে ছিল । তবে এটিও ঠিক এই ধরণের ব্যবস্থা অস্বাভাবিক অবস্থায় থাকলেও তা নিয়মিত ব্যবস্থা হিসেবে থাকা উচিৎ নয় । অন্যদিকে কোন রাজনৈতিক দল যদি নির্বাচনে না আসে তাকে জোর করেও নির্বাচনে আনা যাবে না । মালয়েশিয়া বা সিঙ্গাপুরকে আমরা উন্নয়নের মডেল রাষ্ট্র হিসেবে আখ্যায়িত করতে পছন্দ করি । কিন্তু সেই সব দেশে বস্তুত পক্ষে দীর্ঘ দিন ধরে এক দলীয় শাসন চলে আসছে । ইরাক বা মিশরে যুগ যুগ ধরে এক দলীয় শাসন ব্যবস্থা চালু ছিল । সেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা গণতন্ত্র রপ্তানি করতে চাইলে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ । দেশ দুটি এখন ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার দোরগোরায় উপনিত । তবে এই দুটি বা অন্যান্য রাষ্ট্রে কার্যকর বহুদলীয় গণতন্ত্রের অনুপস্থিতিতে সেখানে স্বৈরতন্ত্রের জন্ম হয়েছে । নিশ্চয় বাংলাদেশের কেউ প্রত্যাশা করেন না এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি হোক । এই যে বিএনপি নির্বাচনে না গিয়ে একটি বড় ধরণের ভুল করলো তাতে তো দল হিসেবে একশত ভাগ ক্ষতি তাদেরই । নির্বাচনে গেলে তাদের ভাল করার যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল । কিন্তু সম্ভবত সেটি বুঝার মতো ক্ষমতা তাদের ছিল না অথবা তারা বিপথে চালিত হয়েছে ।
নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে বিরোধী দল বিরাট ভুল করেছে আর সরকারি দল তথা আওয়ামী লীগ ভুল করবে যদি তারা এই দফায় জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী সুশাসন দিতে না পারে । সকলে মালয়েশিয়ার মাহাথির মোহাম্মদকে একজন রোল মডেল নেতা হিসেবে মানেন । কিন্তু রাষ্ট্র বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে তিনি একজন একনায়ক ছিলেন তবে তাঁর দেশের মানুষ তাঁকে পছন্দ করে কারণ তিনি নিজ দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে নিরলস পরিশ্রম করেছিলেন । শুরুতে শেখ হাসিনা একটি ক্লিন ইমেজের মন্ত্রী সভা গঠন করেছেন । যাদের বিরুদ্ধে সামান্যতম দূর্নীতি বা ক্ষমতার অপব্যবহারের অথবা অদক্ষতার অভিযোগও ছিল তাদের তিনি তাঁর নতুন মন্ত্রীসভায় ঠাঁই দেন নি । কেন্দ্রীয় কমিটির বেশীর ভাগই সংসদ সদস্য অথবা মন্ত্রী সভায় স্থান পাওয়ার যোগ্য । কিন্তু সেখান হতে মন্ত্রী হয়েছেন অল্প কয়েকজন । কোন যুগ্ম সম্পাদকই মন্ত্রী হন নি । সাতজন সাংগঠনিক সম্পাদকের মধ্যে মাত্র একজন প্রতিমন্ত্রী হয়েছেন । বাকী একুশজন সম্পাদক পদের মাত্র চারজন মন্ত্রী/প্রতিমন্ত্রী হয়েছেন । রক্তের সম্পর্ক আছে তেমন কাউকে এই দফায় শেখ হাসিনা মন্ত্রী করেন নি । এটি নিঃসন্দেহে একটি ভাল উদ্যোগ । মন্ত্রী সভায় যেমন আছেন ঝানু অভিজ্ঞ মন্ত্রী তেমন আছেন সৈয়দ মোহসিন আলীর মতো সমাজ কল্যাণ মন্ত্রী । স্কুলের অনুষ্ঠানে প্রকাশ্যে সিগারেটে সুখটান দিয়ে তিন বেশ হৈ চৈ ফেলে দিয়েছেন । ভাল দিক হচ্ছে তিনি তার এই অনাকাক্সিক্ষত কর্মের জন্য সাংবাদিকদের ডেকে ক্ষমা চেয়েছেন । এমন আনাড়ি মন্ত্রীদের জন্য সরকার একটি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারে ।
বিএনপি বিহীন জাতীয় সংসদে সরকারি দলের সামনে দেশে দূর্নীতি মুক্ত সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য একটি বড় সুযোগ এসেছে । দেশের মানুষ আশা করে বঙ্গবন্ধু কন্যা এই সুযোগের একশত ভাগ সদব্যবহার করবেন । তিনি ফন্দিবাজ, ধান্ধাবাজ, টেন্ডারবাজ, দূর্নীতিবাজ আর শিক্ষাঙ্গনের সন্ত্রাসীদের যদি দূরে রাখতে পারেন, তাদের সকল অপকর্ম যদি কঠোর হস্তে দমন করতে পারেন তা হলে ইতিহাস তাঁকে তাঁর পিতার মতো মনে রাখবে । আর এই সব কাজ করা মোটেও কঠিন নয় । প্রয়োজন সাহস এবং স্বদিচ্ছার যার ঘাটতি বঙ্গবন্ধু কন্যার অভাব থাকার কথা নয় ।

লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় । জানুয়ারি ২৯, ২০১৪

 

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ

[......লেখক আর্কাইভ]