[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

‘বাংলা বসন্ত’ কী অত্যাসন্ন?

 

 

প্রফেসর আবদুল মান্নান

যারা রাজনীতির সামান্য খোঁজ খবর রাখেন তারা ‘আরব বসন্ত’ শব্দ দু’টির সাথে নিশ্চয় পরিচিত । শব্দ দু’টির উদ্ভাবক পশ্চিমা দুনিয়ার গণমাধ্যম । আড়াই বছর আগের কথা । তখন আরব বিশ্বে স্বৈরতন্ত্রের পরিবর্তে গণতন্ত্র প্রবর্তনের দাবিতে জনগন রাজপথ বা শহরের কেন্দ্রস্থল দখল করে তুমুল গণআন্দোলন করছে । বলাবাহুল্য যারা এই আন্দোলন করছে তাদের সহায়তায় পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন আর ফ্রান্স । এক সময় এই দেশগুলির সহায়তা আর আস্কারায় মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলিতে স্বৈরতন্ত্রের জন্ম ও বিকাশ লাভ করেছিল । কিন্তু এক সময় যখন সে সব দেশের মানুষ দেখতে পেল স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার কারণে তারা কী ভীষণভাবে শোষিত ও নিপীড়িত হচ্ছে তখন তারা তাদের শাসকদের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠে এবং শেষ পর্যন্ত তিউনিসিয়া, ইয়েমেন, লিবিয়া, মিশর প্রভৃতি দেশে তুমুল গণ আন্দোলনের মাধ্যমে তারা স্বৈর শাসনের অবসান ঘটাতে সক্ষম হয় । কিন্তু বাস্তবে এই সব দেশে স্বৈর শাসনের অবসান হলেও বিকল্প কোন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান না থাকাতে সে সব দেশের মানুষ বর্তমানে অনেকটা তপ্ত কড়াই হতে জ্বলন্ত উনুনে পড়ার মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে । ইয়েমেন ছাড়া অন্যান্য দেশগুলিতে ধর্মীয় জঙ্গিবাদের তেমন একটা উৎপাত ছিল না । এই সব দেশে কোন ধরণের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বা দল না থাকাতে সেই দেশগুলিতে বর্তমানে ইসলামের নামে জঙ্গিবাদী রাজনীতি গেঁড়ে বসার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে । মনে করা হয়েছিল মোবারকোত্তর মিশরে পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন হবে কারণ সেখানে সেই নাসেরের সময় হতে নিষিদ্ধ থাকলেও মুসলিম ব্রাদারহুড তাদের রাজনীতির ধারা পরিবর্তন করে সুস্থ ধারায় ফিরে এসে মিশরে কিছুটা হলেও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করবে । তারা অন্য নামে (ঋৎববফড়স ধহফ ঔঁংঃরপব চধৎঃু) নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতা করে সরকার গঠন করে কিন্তু প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী নতুন ধারার রাজনীতির পরিবর্তে তারা সেই মধ্যযুগীয় রাজনীতিতে ফিরে যেতে আগ্রহী হয় এবং শেষ পর্যন্ত সামরিক বাহিনী কর্তৃক ক্ষমতাচ্যূত হয় । বিভিন্ন গণমাধ্যম বলছে মুরসী নেতৃত্বাধীন নির্বাচিত সরকারকে উৎখাতের জন্য সৌদি বাদশাহ মিশরের সেনাবাহিনীকে প্রচুর অর্থ যোগান দিয়েছিলেন । বিশ্লেষকরা এখন বলছেন তথাকথিত আরব বসন্ত অনেকটা ব্যর্থ হয়েছে এবং যেই সব দেশে মনে করা হয়েছিল রাজনৈতিক বসন্ত এসে গেছে দেখা যাচ্ছে সেই সব দেশের অবস্থা পূর্বের তুলনায় অনেক খারাপ হয়েছে । আরব বসন্ত দিয়ে লেখাটা শুরু করার কারণ হচ্ছে বাংলাদেশেও বর্তমানে অনেকেই মনে করেন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারকে হঠিয়ে দেশে পুনরায় জামায়াত-বিএনপি জোটকে ক্ষমতায় আনতে পারলে বসন্তের কিছুটা আমেজ পাওয়া যাবে । তাদের মতে আওয়ামী লীগ সরকারের চেয়ে অন্য যে কোন সরকার শ্রেয় । এখানে জামায়াতের নামটা আগে উল্লেখ করার কারণ হচ্ছে আগামী নির্বাচনে ঘটনা চক্রে যদি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে না পারে তা হলে ক্ষমতায় বিএনপি নয় আসবে মূলত হেফাজত সমর্থিত জামায়াত । সংসদে হয়তো বিএনপি’র সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকবে কিন্তু মূল ক্ষমতা থাকবে জামায়াত আর হেফাজতের হাতে । যারা মনে করেন জামায়াতের সাথে হেফাজতের একটি মতাদর্শগত পার্থক্য আছে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন । হেফাজত ঠিকই বুঝে শত্রুর শত্রু আমাদের বন্ধু, সুতরাং আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের নির্বাচনে পরাজিত করতে যা যা করার প্রয়োজন তারা সবটিই করবে । ইতোমধ্যে কোন রাখঢাখ না করে তারা এই মর্মে ঘোষণাও দিয়েছে । অন্যদিকে হেফাজতের ভিতরে এখন জেএমবি, হিযবুত তাহরীরের মতো জঙ্গিবাদী সংগঠনের সদস্যদেও সহজ অনুপ্রবেশ ঘটবে যেমনটি একাত্তরের পর আলবদর আলশামসের অনেক সদস্য মাওলানা ভাসানীর ন্যাপ সহ অনেক অতি বামপন্থী দলগুলিতে কায়দা করে ঢুকে গিয়েছিল । এই পরিস্থিতি নিয়ে বেগম জিয়া সহ খোদ বিএনপি’র মধ্যেও অনেকের অস্বস্তি আছে বলে শুনেছি । তাদের মধ্যে এই ধারণা হয়েছে সামনের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোন প্রকারে যদি আওয়ামী লীগকে পরাজিত করা যায় তা হলে জামায়াত দেশে অন্ততঃ তিন মাসের জন্য এক ভয়াবহ তা-ব চালাবে যার ফলে কোটি না হলেও কয়েক লক্ষ মানুষ পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে । এদের মধ্যে অনেককে দেশ ত্যাগও করতে হতে পারে । বিগত ২০০১ সালে নির্বাচনে জয় লাভের পর বিএনপি আর জামায়াতের ক্যাডাররা দক্ষিণ বঙ্গ. চট্টগ্রাম, পাবনা, যশোর, নোয়াখালি, কুমিল্লা প্রভৃতি জেলায় ধর্মীয় সংখ্যা লঘু সম্প্রদায়, সাধারণ আওয়ামী লীগের কর্মী ও সমর্থকদের উপর যে তা-ব চালিয়েছিল তা অনেককে ১৯৭১ সালের কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল । এমন তা-ব তারা ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনের পরও ঘটিয়েছিল তবে ২০০১ এর নির্বাচনের পর সংঘটিত তা-ব পূর্বের তা-বগুলিকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল । নির্বাচনের অব্যবহিত পর ক্ষমতায় ছিলেন বিচারপতি লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং তারপর বেগম জিয়া সরকার গঠন করেছিলেন । তারা সকলেই এই তা-বকে অস্বীকার করেছিলেন । আগামী নির্বাচনের পর এই দলগুলি সরকার গঠন করলে যে তা-ব সৃষ্টি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে তা কিন্তু জয় বা পরাজয়কে কেন্দ্র করে নয়, তা হবে বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে জামায়াত বিএনপি’র যে নেতৃবৃন্দের বিচার হচ্ছে তার পুরো প্রক্রিয়াটাকে বাঞ্চাল করার জন্য । শুরু হতে ট্রাইবুনালের বিচার সম্পর্কে বিএনপি তাদের বক্তব্য কেবল বিচারের তথাকথিত আন্তর্জাতিক মান ও স্বচ্ছতা সম্পর্কে সীমাবদ্ধ রেখেছেন । বলেছেন তারাও একাত্তরের অপরাধীদের বিচার চান । তবে তারা পরিষ্কার করেননি তাদের অবস্থান । বলেননি তারা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার পরও এই বিচার না করে কেন তারা এই অপরাধের সাথে যারা সরাসরি জড়িত ছিলেন তাদের রাজনীতিতে পুনর্বাসন করেছেন এবং তাদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলে দিয়েছেন । এই যাবৎ ছয়জন যুদ্ধাপরাধীর সাজা হয়েছে যার মধ্যে চারজনের মৃত্যুদ- । তা নিয়েও বিএনপি এতদিন মুখ খুলে নি । তবে সম্প্রতি ব্যারিস্টার মওদুদ ও সংসদে বিরোধী দলের চীফ হুইপ জয়নাল আবেদিন ফারুক তাদের সে অবস্থান হতে সরে এসে বলেছেন ক্ষমতায় গেলে তারা এই পুরো বিষয়টাকে পুনঃবিবেচনা করবেন । বাস্তবে তাদের দিয়ে এই কথা গুলি বলানো হয়েছে আর তাদের তা না বলেও উপায় ছিল না । হেফাজতের সমাজ বিধ্বংসী তের দফাকে বেগম জিয়া সমর্থন দিয়েছেন । সুতরাং ক্ষমতায় গেলে হেফাজত যে তাদের সেই তের দফা বাস্তবায়নে বাধ্য করার চেষ্টা করবে তা বলা বাহুল্য ।
অনেকে মনে করেন ১৮ দলীয় জোট যে বাতিল ঘোষিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য আন্দোলন করছে তা মেনে নিলে বোধ হয় সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে । তাও অনেকটা বোকার স্বর্গে বাস করার সামিল কারণ তখন দ্বিগুণ উৎসাহে জামায়াত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অপরাধের কার্যক্রম বন্ধ করে তাদের সকল নেতাদের মুক্ত করার আন্দোলনটা আরো সহিংস করবে এবং আরো জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হবে । হেফাজতও ঘোষণা দিয়ে রেখেছে তারা ঈদের পর তাদের সর্বশক্তি দিয়ে তাদের সেই তের দফা আদায়ের লক্ষ্যে মাঠে নামবে । বিএনপি’র সাদেক হোসেন খোকা লগি-বৈঠার চেয়েও কঠিন পতেক্ষেপের হুমকি দিয়ে রেখেছেন । সকলে মিলে যেটি করতে পারে সেটি হচ্ছে আর একটি ৫ মে’র শাপলা চত্তর এপিসোড মঞ্চায়নের চেষ্টা করা । হতে পারে এটা হবে কথিত বাংলা বসন্তের সূচনা । এই রমজান মাসে মধ্যপ্রাচ্যে, সৌদি আরবে, যুক্তরাষ্ট্রে ও যুক্তরাজ্যে যাকাত ফিৎরার নামে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের কাছ হতে কোটি কোটি টাকা সংগ্রহ করা হচ্ছে । এই সময় যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যেকটি বাংলা ভাষাভাষী টিভি চ্যানেল বাংলাদেশে মসজিদ মাদ্রাসার নামে অর্থ সংগ্রহের জন্য তাদের পুরো চব্বিশ ঘন্টাই তহবিল সংগ্রহকারিদের কাছে ভাড়া দিয়ে রেখেছে । ঈদের পর এই অর্থ দেশে আসবে এবং এবার এর সিংহভাগ ব্যয় হবে সরকার বিরোধী আন্দোলনের নামে দেশে চরম নৈরাজ্য সৃষ্টি করার জন্য, অনেকটা এই বাংলা বসন্ত সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে । এই বাংলা বসন্ত যদি সত্যি সত্যি বাস্তবায়ন হয় তা হলে তার শেষ পরিণতি কী হতে পারে? এই মুহুর্তে সার্বিক বিবেচনায় বলা যেতে পারে মধ্য প্রাচ্যে যা হয়েছে বা হচ্ছে তার চেয়ে ভিন্ন কিছু হওয়ার লক্ষণ দেখি না । আবার ধর্মীয় জঙ্গিবাদ আর সন্ত্রাসবাদের উত্থান, আবার বাংলাদেশে গত সাড়ে চার বছরে যা কিছু অর্জন তা জলে ফেলা, বাংলাদেশ আবার একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রের তালিকার উপরের দিকে উঠতে থাকা । এই অবস্থা পরিহার করার জন্য কী করতে পারে বর্তমান সরকার? অবশ্যই প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করা । বিএনপিকে বুঝতে হবে তারা যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি করছে তা বর্তমান সংবিধানের অধীনে সম্ভব নয় । আর তারা বিচারপতি খায়রুল হককেও তত্ত্ববধায়ক সরকার প্রধান চান না বলে ইতোমধ্যে জানিয়ে রেখেছেন । উচ্চ আদালতের রায়েও বিচারপতিদের এই ব্যবস্থা হতে দূরে রাখার কথা বলা হয়েছে । সুতরাং নতুন কিছু করতে হলে তা আলোচনার মাধ্যমে সংসদে গিয়েই করতে হবে । বিএনপি যদি মনে করে নির্বাচনে জয়ী হয়ে শান্তিতে থাকবেন তারাও বোকার স্বর্গে বাস করছেন । আর আওয়ামী লীগ তথা মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তির চেষ্টা থাকতে হবে নির্বাচনে ভাল করা । এই সবের কোন বিকল্প আছে বলে এই মুহুর্তে মনে হচ্ছে না। সমস্যার সমাধান শান্তিপূর্ণ উপায়ে করতে না পারলে দুই বড় দলের আম আর ছালা উভয়ই হারাতে হতে পারে। সকলে বিবেচনা করবেন আশা করি।

লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্লেষক । ১ অগাষ্ট, ২০১৩

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ