প্রথমপাতা  

সাম্প্রতিক সংবাদ 

 স্বদেশ

আন্তর্জাতিক

বাংলাদেশ কমিউনিটি

লাইফ স্টাইল

এক্সক্লুসিভ

বিনোদন

স্বাস্থ্য

বর্তমানের কথামালা

 শিল্প-সাহিত্য

 প্রবাসপঞ্জী 

আর্কাইভ

যোগাযোগ

 

 

 

 

 

 

 

একচল্লিশ বছরের দীর্ঘ পথ চলা

 


প্রফেসর আবদুল মান্নান

প্রবাদ আছে কোন শিক্ষকের শিক্ষকতার বয়স বারো বছর হলে তিনি আদালতে সাক্ষ্য দেয়ার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেন কারণ ধারণা করা হয় তখন তিনি প্রকৃতস্থ থাকেন না। নির্দ্বিধায় বলতে পারি আমি অনেক আগেই সেই যোগ্যতা অর্জন করে ফেলেছি । ৬ আগষ্ট শিক্ষকতা পেশায় একচল্লিশ বছর পার করলাম। এই তথ্যটা ক্লাসে দিলে আমার এক ছাত্রী জানতে চায় ‘স্যার আপনার বয়স কত?’ তাকে বলি বয়সতো বলা যাবে না তবে ধরে নাও তোমার নানা আমার ছাত্র ছিলেন । ছাত্রীরতো ভিরমি খাওয়ার যোগাড়। কিভাবে এই পেশায় এত দীর্ঘ সময় চলে গেল তা বুঝতেই পারি নি আর এই না পারার প্রধান কারণ হচ্ছে এই পুরো সময়টা আমি আমার ছাত্র-ছাত্রীদের সান্নিধ্যে কাটিয়েছি এবং এই উচ্ছ্বল বয়সের প্রজন্মের সাথে মনে প্রাণে থাকলে বুড়ো হওয়ার সম্ভাবনা নেই । আমার ছাত্র-ছাত্রীদের আমি এতই ভালবাসি আর স্নেহ করি যে যখন আমার কাঁধের উপর দেশের অন্যতম ঝঞ্জা বিক্ষুব্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব বর্তালো তখনও কিন্তু আমি সেই দায়িত্ব পালনকালে নিয়মিত ক্লাস নিয়েছি পাছে যদি তাদের সাথে আমার যোগাযোগ ছিন্ন হয় । বলা বাহুল্য আজকাল যেমন অনেকেই উপাচার্য হওয়ার জন্য দৌঁড়-ঝাঁপ করেন আমার ক্ষেত্রে তেমনটি করতে হয়নি কারণ আমার কিছু সুহৃদ মনে করেছেন এই পদটি আমার প্রাপ্য এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সে সময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের আচার্য, তিনি আমাকে দায়িত্বটা দিয়েছিলেন ।
একচল্লিশ বছর শিক্ষকতা জীবন পার করার পর পিছন ফিরে তাকানো সমীচীন কারণ তখন হয়তো বুঝা যাবে কেমন ছিল এই দীর্ঘ সময় ? এই সময়ে শিক্ষক এবং প্রশাসক হিসেবে সফল ছিলাম না ব্যর্থ, তা বিচার করবেন আমার হাজার হাজার সাবেক আর বর্তমান ছাত্র-ছাত্রী আর আমার সহকর্মীরা । তবে আমি সব সময় বলি এই দীর্ঘ সময়ে আমি সব সময় তাদের নিয়ে গর্ব বোধ করেছি । এরা আমার সাথে না থাকলে আমার পথ চলা সত্যিকার অথের্ই কঠিন হতো । এই ধরুন কোন কোন ছাত্র সংগঠন । এখন তাদের অনেকেই মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয় কী ভাবে চলবে তা নির্ধারণ করবেন তারা, উপাচার্য তাদের কথায় উঠবস করবেন ।এই সব বিষয়ে সরকারি ছাত্রসংগঠন গুলি আবার অগ্রগামি । এখনতো একেকটা ছাত্র সংগঠন অভিভাবকদের জন্য আতঙ্ক, তাদেও মুর সংগঠন ভুবানোর জন্য যথেষ্ট । এমন ঘটনা আমার দায়িত্ব পালন কালে অকল্পনীয় ছিল । আবার এই ছাত্র সংগঠনগুলিকে ব্যবহার করেন এক শ্রেণীর নৈতিককা বর্জিত শিক্ষক যাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে ছলে বলে কৌশলে বর্তমান উপাচার্যকে হঠিয়ে ওই পদটি নিজে দখল করা যদিও এদের অনেকেরই একজন কেরানী হওয়ার যোগ্যতাও নেই । শিক্ষকতার মতো পেশায় তাঁদেও আসাটাও বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি বড় দূর্ঘটনা । দূর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে আর কয়েক বছরের মধ্যে এদের অনেকেই উপাচার্যের মতো পদ অলংকৃত করবেন । এর অনত্যম কারণ হবে এই সব নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধার চেয়ে শ্রেফ রাজনৈতিক পরিচয় আর ধান্ধাবাজি প্রাধান্য পাবে । মেধা আর রাজনৈতিক পরিচয়ের সংমিশ্রণ ঘটলে একজন উপাচার্য আদর্শ উপাচার্য হতেই পারেন । সেই প্রসঙ্গে অন্য আরেক সময় ।
আমার জীবনে যা সামান্য প্রাপ্তি তার পিছনে সব চেয়ে বড় অবদান আমার বাবা-মায়ের । দুজনেই প্রকৃত অর্থেই স্বশিক্ষিত, কিন্তু তাঁদের সন্তানরা প্রকৃত অর্থেই শিক্ষিত হয়ে উঠুক তা তাঁরা সব সময় চাইতেন । আমি অনেক সময় বলি আমার বাবা-মা দুজনেই সম্ভবত সময়ের আগেই জন্ম নিয়েছিলেন । ১৯৫৩ সনে বাবা আমাকে চট্টগ্রামের সব চেয়ে বনেদী স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন । তখন সেই স্কুলের সর্বনিম্ন শ্রেণীর বেতন ছিল বাইশ টাকা । স্কুলটির বয়স এখন ১৬৭ বছর । বোর্ডের এসএসসি পরীক্ষায় যখন মেধা তালিকায় স্থান হলো তখন সারা পাড়া জুড়ে সে কী হৈ চৈ । এইচএসসি, অনার্স, মাষ্টার্স কোন পরীক্ষায় আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয় নি । কখনো শিক্ষকতা পেশায় আসবো তেমন চিন্তা না ছিল আমার পরিবারের না ছিল নিজের । বাবা চাইতেন তাঁর মতো ছোট কোন ব্যবসাপাতি খুলে বসবো । আমি নিজে কি চাইতাম তা নিজেও জানতাম না । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শিক্ষক ডঃ আবদুল্লাহ ফারুখ আর ডঃ হাবিবুল্লাহ চাইতেন আমি কালই যেন বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেই । কেন জানি তেমন একটা আগ্রহ ছিল না । বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর ইচ্ছা ছিল সিভিল সার্ভিসে যোগ দিয়ে সিএসপি হবো । তখনকার দিনে কথিত ‘ভাল ছাত্রদের’ তাই প্রধান অভিপ্রায় ছিল । এরপর এসে গেল মুক্তিযুদ্ধ । সিএসপি হওয়া আর সম্ভব নয় । তারপর কী হওয়া যায় তা সত্যিকার অর্থে চিন্তা করতে ব্যর্থ হই । আসলে শিক্ষকতা পেশায় আসার পিছনে সম্ভবত সবচেয়ে বড় অবদান ছিল সে সময়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আবুল ফজলের । আমাদের পড়শি । তার দুই ছেলে আবুল মনসুর আর আবুল মোমেন আমার ছোট বেলার বন্ধু । সে সূত্রে ওই বাড়ীতে আসা যাওয়া । একদিন আবুল ফজল জানতে চাইলেন কী করছি । বলি কিছুই না । তিনি বলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে কেন যোগ দেই না? তাঁর সেই প্রশ্নে আমার জীবনের গতিটা একটা নতুন বাঁকে প্রবেশ করলো যে বাঁকে এখনো আছি ।
এই দীর্ঘ জীবনে ভাল মন্দ দেখেছি অনেক, বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাইরে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করার সুযোগ হয়েছে প্রচুর, ঘুরে বেড়িয়েছি বিশ্বের এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্তে কিন্তু সব সময় মনে হয়েছে বিশ্বে বাংলাদেশের মতো ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,’ আর এই দেশের মতো ভাল মানুষ অন্য কোথাওতো দেখি নি । ব্যতিক্রমতো আছেই । সত্তরের দশকে তখন যুক্তরাষ্ট্রে পড়া লেখা করি । তার ফাঁকে আমার এক শিক্ষকের গবেষণা সহায়ক । একদিন তিনি জানালেন তিনি আমাকে মার্কিন নাগরিকত্ব পাইয়ে দেবেন কারণ তিনি আমার কাজ খুব সন্তুষ্ট । তাঁকে বিনীত ভাবে বলি আমিতো দেশে ফিরে যেতে চাই কারণ ভিন দেশে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে থাকার কোন ইচ্ছাই আমার নেই । অভিজ্ঞতা হতে বলতে পারি স্কুল হতে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষক হওয়ার চ্যালেঞ্জ অনেক । একজন শিক্ষকের কখনো নিজেকে সব জান্তা মনে করা উচিৎ নয় । শিক্ষক অনেকটা একজন প্রশিক্ষকের মতো । শিক্ষার্থীদের হাতে ধরে জ্ঞান বিতরণ করাই তাঁর কাজ । শিক্ষার্থীর কাছ হতে শেখার আছে অনেক । আমার বেলায় তা শতভাগ সত্য । অন্যদিকে অনেক শিক্ষককে দেখেছি যাঁরা নিজেকে সবজান্তা মনে করেন । এর চেয়ে আত্মঘাতী চিন্তা আর কিছু হতে পারে না । শেখার আগ্রহ না থাকলে সফল শিক্ষক হওয়া কঠিন । কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রীর সফর সঙ্গী হয়ে জাপান গিয়েছিলাম । প্রধানমন্ত্রী আমাকে জাপানের প্রধানমন্ত্রী সিনজো আভের রাষ্ট্রীয় ডিনারে তাঁর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন উনি একজন শিক্ষক । পত্রিকায় লেখালেখিও করেন । আভের পাল্টা প্রশ্ন কী নিয়ে লিখি ? বলি আমি বাণিজ্যের ছাত্র তবে লিখি রাজনীতি, সমসাময়িক বিষয় আর অর্থনীতি নিয়ে । জাপানের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ব্যস্ত মানুষ । আমাদের প্রধানমন্ত্রী হাঁসেন । শেখার আগ্রহ না থাকলে এত সব বিষয় নিয়ে লেখা সম্ভব নয় । তখন উপাচার্য । একবার হত্যার উদ্দেশ্যে আমার উপর আক্রমণ আর একবার পরিকল্পনা হলো । ভাগ্যক্রমে দু’বারই বেঁচে গেলাম । প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগত ভাবে দু’বার ফোন করে আমার আর আমার পরিবারের খোঁজ নিলেন । আমিতো অভিভূত । এই একচল্লিশ বছরে পর যখন পিছনে ফিরে তাকাই আর আমার ছাত্র ছাত্রীদের সাফল্য দেখি তখন গর্বে বুক ফুলে উঠে । কেউ মাইক্রোসফ্ট এর ডাইরেক্টর আর কেউ বা বিশ্বের সেরা ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট। সচিব হিসেবে অবসর নিয়েছেন একাধিক জন । ছাত্র ভাগ্য আমার সব সময় ভাল ।
আনন্দের অনেক মুহূর্ত যেমন আছে আবার কিছু কিছু বেদনা আর দূঃখের স্মৃতিও আছে । তবে সব চেয়ে দূঃখের মুহূর্ত হচ্ছে যখন দেখি অতি নিকটজন আমার তথাকথিত ‘অপকর্মের’ ফিরিস্তি দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি লেখেন । ঘটনাচক্রে যখন সেই চিঠির কপি হাতে আসে স্তম্ভিত হই । তখন বার বার বিখ্যাত গজল গায়ক অনুপ জালোটার একটি গজলের কথা মনে পড়ে. ‘খঞ্জরসে কারো না বাত,না তালোয়ার সে পুছো, ম্যায় কতল হুয়ে ক্যায়েসে মেরে ইয়ার সে পুছো’। উপাচার্যের দায়িত্বটা ছিল আমার পরবর্তি নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত । সেই পরবর্তি নির্দেশটা এলো ১৩ই ফেব্রুয়ারী ২০০১ সালে । আমার কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র সম্পদ ছিল একটি ফ্যাক্স মেশিন । পরদিন সেই ফ্যাক্স মেশিনটা আমার এক সহকর্মীর গাড়ীতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা দিয়ে আসার সময় একজন বিশ্ববিদ্যালয় স্টাফ আমার পা ছুঁয়ে সালাম করে জানতে চান আমি কি বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যাবো ? বলি গেলেও পেশায় থাকবো । তিনি আরো জানাতে চান আমার একমাত্র সন্তান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমার গাড়ীতে না এসে অন্য আর দশজন ছাত্রছাত্রীর সাথে ট্রেনে কেন আসতো ? তাকে বলি ওই গাড়ীটা আমার নয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের জন্য । আমার কন্যা কেন ওই গাড়ীতে চড়বে? আমার এক সহকর্মীর মতে আমি খুব সেকেলে । বলি হতে পাওে, তবে ভালতো আছি । কন্যা আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক । এর চেয়ে বড় তৃপ্তি আর কী হতে পারে । আমার সকল ছাত্র-ছাত্রী, সহকর্মী সকলকে আমার বিনম্র শ্রদ্ধা আর ভালবাসা । এই দীর্ঘ একচল্লিশ বছরের সকল প্রাপ্তির তারাও ভাগিদার ।

লেখক : সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় । জুলাই ৫, ২০১৪

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ

[......লেখক আর্কাইভ]