প্রথমপাতা  

সাম্প্রতিক সংবাদ 

 স্বদেশ

আন্তর্জাতিক

বাংলাদেশ কমিউনিটি

লাইফ স্টাইল

এক্সক্লুসিভ

বিনোদন

স্বাস্থ্য

বর্তমানের কথামালা

 শিল্প-সাহিত্য

 প্রবাসপঞ্জী 

আর্কাইভ

যোগাযোগ

 

 

 

 

 

 

 

রাজনীতিতে বিনয় এখন দুর্বিনীত

 


প্রফেসর আবদুল মান্নান

প্রায় সব ধর্ম গ্রন্থে আছে দুটি জিনিষ মানুষের পতন অনিবার্য করে তুলে, প্রথমটি অহংকার আর দ্বিতীয়টি লোভ । নিরহংকার বা বিনয়ী হওয়া একজন সত্যিকারের রাজনৈতিক নেতার জন্য অপরিহার্য যা বর্তমান কালের নেতাদের কাছে কদাচিৎ দেখা যায় । সম্প্রতি দেশের একটি বহুল প্রচারিত বাংলা দৈনিকে আমার একটা লেখা প্রকাশিত হয়েছিল । লেখার নীচে ষাটটির মতো মন্তব্য ছিল যার সব গুলিই শালীনতা বর্জিত ব্যক্তিগত আক্রমণ । সুদূর ম্যানচেষ্টার হতে একজিন পিএইচডি পর্যায়ে গবেষণারত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক আমাকে ব্যক্তিগত ভাবে মেইল পাঠিয়ে অনুরোধ করেছেন আমি যেন সেই পত্রিকায় আর না লিখি । তাকে বলেছি আমার সমালোচক আমার বন্ধু আমি সেই নীতিতে বিশ্বাস করি তবে এটি ঠিক যে সব মন্তব্যের কথা বলছি সেগুলিতে সমালোচনার লেশ মাত্র ছিল না । আমার সেই সুহৃদকে বলেছি বিনয় আর ভদ্রতা জিনিষটা শুধু রাজনীতিবিদদের কাছ হতে নির্বাসিত তাই নয় কিছু শিক্ষিত মানুষও এখন এই সব বিষয় পরিত্যাগ করেছে । তা না হলে কী ভাবে ডঃ কামাল হোসেনের মতো একজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি তার সমবয়সী অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে মানসিক ভারসাম্যহীন বলতে পারেন ? পাল্টা অর্থমন্ত্রী ডঃ কামাল হোসেনকে ব্যর্থ মানুষ বলেছেন । প্রচলিত অর্থে এঁরা দু‘জনের কেউই রাজনীতিবিদ নন । রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে ডঃ কামাল হোসেন বঙ্গবন্ধুর আলোয় আলোকিত আর অর্থমন্ত্রী একজন সাবেক আমলা, ঘটনা চক্রে তিনি রাজনীতিতে এসে পরেছেন ।
আমাদের রাজনীতিবিদদের সমস্যা হচ্ছে তারা একবার কোন একটি পদ পদবি পেলে অথবা সংসদ সদস্য হয়ে গেলে অন্য সব কিছুকে তুচ্ছ জ্ঞান করেন । তারা একবারও চিন্তা করেন না পদ পদবি বা ক্ষমতা খুবই ক্ষণস্থায়ী । তাদের উদ্দেশ্যে দ্বাদশ শতকের প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ইমাম গাজ্জালির ‘নসিহত-ই-মূলক’ হতে কয়েকটি লাইন উদ্বৃত করতে চাই । তাঁর এই গ্রন্থটি তিনি রচনা করেছিলেন শাসনকর্তাকে উপদেশ দেয়ার জন্য । তিনি লিখেছেন ‘হে বিশ্বের শাসন কর্তা, চারটি বিষয় তুমি সব সময় তোমার সাথে রাখিবে- (১) ন্যায় বিচার; (২) প্রজ্ঞা; (৩) ধৈর্য্য আর (৪) বিনয় । চারটি বিষয় সব সময় পরিত্যাগ করিবে-(১) হিংসা; (২) ঔদ্ধত্য; (৩) হীনমন্যতা; আর (৪) বিদ্বেষ । ...যে সকল শাসনকর্তা তোমার পূর্বে আসিয়াছিল তাহারা সকলে চলিয়া গিয়াছেন এবং যাহারা তোমার পরে আসিবে তাহাও পূর্ব নির্ধারিত । তাহারা আসিবার পূর্বে তোমাকে সব সময় চেষ্টা করিতে হইবে যাহাতে তোমার প্রজারা তোমার অবর্তমানে তোমার শূণ্যতা অনুভব করে ’ । কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে আমাদের ক’জন রাজনীতিবিদের এই সব গুণাবলি আছে? অধিকাংশেরই কথাবার্তা আর চাল চলনে চরম ঔদ্ধত্য লক্ষণীয় । ছাত্র নেতা হতে শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ পর্যন্ত এই রোগে সংক্রমিত হয়েছে । মহাত্মা গান্ধি, বঙ্গবন্ধু, জওহরলাল নেহেরুর বিনয় কিংবদন্তি তূল্য । স্যার ফিরোজ খান নুন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন । সরকারি সফরে সস্ত্রীক ভারতে গেলেন । তাঁর স্ত্রী ভিকারুন্নেসা নুন ছিলেন অষ্ট্রিয়ান বংশোদ্ভুত । দিল্লির বিমান বন্দরে তাঁদের স্বাগত জানাতে এসেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু । বিমানের সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে বেগম নুনের হাই হীল জুতার একপাটি খুলে যায় । সকলের আগে নেহেরু ছুটে এসে জুতাটা কুড়িয়ে নিয়ে বেগম নুনকে নিজ হাতে পরিয়ে দেন । পরদিন এই ছবিটি ভারতের পত্র পত্রিকায় ছাপা হয় এবং নেহেরুর এই অসামান্য কীর্তিটি সকল মহলে প্রশংশিত হয় । বঙ্গবন্ধু তাঁর স্কুলের শিক্ষক হতে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন । তিনি তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন তাঁর সাথে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের সাথে অনেক বিষয়ে মতের মিল ছিল না । অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর পিতা ফজলুল হককে খুবই শ্রদ্ধা করতেন । তিনি বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন তিনি কখনো যেন তাঁর বক্তৃতায় ফজুলল হক সম্পর্কে কোন কটুক্তি না করেন । বঙ্গবন্ধু তাঁর পিতার কথা আজীবন মেনে চলেছেন । বঙ্গবন্ধু জীবনে অসংখ্য বক্তৃতা দিয়েছেন । তাঁর একটা বক্তৃতাও খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে তিনি তাঁর প্রতিপক্ষ সম্পর্কে কোন কটু বা অশালীন বাক্য ব্যবহার করেছেন । রাজনীতি হতে এই সংষ্কৃতিতো এখন অনেকটা নির্বাসিত ।
নারায়ণগঞ্জের সাত খুন নিয়ে এখন দেশে তোলপাড় চলছে । এই খুনের সাথে জড়িত হয়ে পরেছেন এলিট ফোর্স র‌্যাবের একাধিক সদস্য যাদের মধ্যে আছেন একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর মেয়ের জামাই । মন্ত্রী মশায় এর আগেও তার ছেলের অপকর্মের কারণে যথেষ্ট দূর্নামের ভাগী হয়েছিলেন । আওয়ামী লীগ ২০০১ সালের নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার অনেক কারণের মধ্যে এই সব কীর্তিমান ছেলে সন্তানদের আওয়ামী লীগ বিধ্বংসী কারণ ছিল অন্যতম। স্বাভাবিক কারণেই তাকে এবার সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিলেন তিনি তার মেয়ের জামাই যে এতবড় একটি অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত সে কারণে কী তার পদ থেকে তিনি পদত্যাগ করবেন ? তিনি বেশ ঔদ্ধত্যের সাথে বললেন প্রশ্নই আসে না । তাকে তার পদ হতে সরাতে পারে একমাত্র আল্লাহ আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা । তার পদত্যাগের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আল্লাহ আর প্রধানমন্ত্রীকে টেনে আনা একেবারেই অযাচিত ও নিরর্থক । তিনি ভুলে যান মর্তে ক্ষমতার মালিক জনগণ । জনগণ না চাইলে এক মুহূর্তও তিনি ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না । আইউব খান পাকিস্তানের লৌহ মানব ছিলেন । জনরোষের শিকার হয়ে তাকে বিদায় নিতে হয়েছিল । স্বৈরাচার এরশাদের বেলায়ও একই ঘটনা ঘটেছিল । রোমানিয়ার প্রেসিডেন্ট চসেস্কু নিজেকে অপ্রতিরোধ্য ভাবতেন । একবার যখন জনগণ তার বিপক্ষে চলে গেল তিনি এক মুহূর্তও আর ক্ষমতায় থাকতে পারলেন না । সস্ত্রীক জীবনটাও খোওয়াতে হয়েছিল । ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি একসময় অসম্ভব জনপ্রিয় ছিলেন । ১৯৭৭ সনের নির্বাচনে সেই ইন্দিরা গান্ধি হেরে গেলেন তাঁর নিজস্ব রায় বেরেলি আসনে জনতা দলের রাজ নারায়ণের কাছে । ইন্দিরা গান্ধি এমনিতে খুবই বিনয়ী ছিলেন । কিন্তু তিনি যখন দেশে জরুরি আইন জারি করেন তখন তিনি হঠাৎ করে বদলে যান । এক ধরণের ঔদ্ধত্য তাঁকে পেয়ে বসে । অনেকেই তাঁর এই পরিবর্তনের জন্য তাঁর উচ্চাভিলাষী বড় ছেলে সঞ্জয় গান্ধিকে দায়ী করেন । উইন্সটন চার্চিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বৃটেনের অসম্ভব জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। যুদ্ধ শেষের নির্বাচনে সেই চার্চিলই পরাস্থ হলেন লেবার দলের প্রার্থীর কাছে । ক্ষমতা অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। ইন্দিরা গান্ধি অথবা উইন্সটন চার্চিল তাঁদের কর্মের কারণে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন । ইন্দিরা গান্ধি আর চার্চিল দু‘জনই পরের বার নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আবার ক্ষমতায় ফিরে এসেছিলেন । চার্চিল সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কারও জিতেছিলেন ।
নারায়ণগঞ্জের কথা যখন এসেই গেল তখন ওসমান পরিবারের সন্তান শামীম ওসমানের কথাতো বলতেই হয় । বাংলাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের জন্মের সময় এই পরিবারটির গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল । কিন্তু ওসমান পরিবারের পরবর্তী বংশধররা সেই সুনামের ভাগিদার হতে পারেন নি । সত্যি হোক আর মিথ্যা হোক এই পরিবারের সন্তান শামীম ওসমান এলাকায় একজন গডফাদার হিসেবে চিহ্নিত । তিনি যখন কথা বলেন তার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বা কথা বার্তায় মোটেও বিনয়ের কোন চিহ্ন থাকে না । তার কথা শুনলে মনে হবে তিনি নারায়ণগঞ্জের মালিক । এমনি অবস্থা অন্য হয দলের যারা এলাকায় গডফাদার হিসেবে চিহ্নিত সকলের । বিএনপি দলীয় একজন সাবেক সংসদ সদস্য আছেন যিনি কথা বলার সময় মনে হয় তিনি কথা বলছেন না কারো সাথে ঝগড়া করছেন । একজন সাবেক মহিলা এমপি আছেন যিনি পারলে টিভির পর্দা ছিড়ে ঝগড়া করার জন্য বের হয়ে পরেন । অথচ এরা একটু বিনয়ী হলে কোন ক্ষতি ছিল না । একজন চীফ হুইপ সাতটি সরকারি বাড়ী দখলে রেখেছেন বলে পত্রিকায় সংবাদ প্রচারিত হয়েছে । তিনি নিজের পক্ষে সংসদে সাফাই গেয়েছেন । অভিযোগ যদি সত্য হয় তা হলে তা তার ক্ষমতার অপব্যবহার এবং লোভ । আর একজন মন্ত্রী বলেছেন তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন না, ক্ষমতা ভোগ করছেন মাত্র । এটি একটি চরম অহংকারপূর্ণ উক্তি । অহংকার পতনের অন্যতম কারণ হতে পারে ।
রবিবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ বলেছেন দলের জন্য কেউ অপরিহার্য নয় । মানুষ তার কথায় বিশ্বাস করতে চায় । বিনয় শব্দটি যাদের কাছে অপরিচিত, যাদের পরিচয় গডফাদার তাদের দলে রাখা কী এতই অপরিহার্য ? জনগণ আশা করে দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা এই বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করবেন । আওয়ামী লীগের যারা সমালোচনা করেন তারা সকলে আওয়ামী লীগের শত্রু নন । তাদের মধ্যে অনেকেই আছেন আওয়ামী লীগের নিঃস্বার্থ শুভাকাক্সক্ষী । আর যারা এই শুভাকাক্সক্ষীদের সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না তারা চাটুকার বৈ অন্য কিছু নয় । এই চাটুকাররাই পারে দলের বারটা বাজাতে ।

লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় । জুন ১০, ২০১৪

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ

[......লেখক আর্কাইভ]