[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

কাদের সহায়তায় বাংলাদেশ আফগানিস্তানের পথে?

 

 

প্রফেসর আবদুল মান্নান


এই লেখাটি যখন লিখতে বসেছি তখন খবর পেলাম গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে আমার এক প্রাক্তন ছাত্রের পারিবারিক মালিকানাধীন ষ্টান্ডার্ড গ্রুপের একটি পোষাক কারখানা কমপ্লেক্সে নাশকতাকারীরা আগুন লাগিয়ে সম্পূর্ণ ভস্মীভূত করে দিয়েছে । বাংলাদেশে যে ক’টি আন্তর্জাতিক মানের পোষাক প্রস্তুতকারী কারখানা আছে এটি তার অন্যতম । একবার আমি কয়েকজন ইউরোপীয় অধ্যাপককে এই কারখানা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম । তারা কারখানার পরিবেশ দেখে অভিভূত হয়ে বলেছিল বাংলাদেশে এমন কারখানা আছে তা তাদের দেশে অনেকে বিশ্বাস করতে চাইবে না । আমার সেই ছাত্র তাদের জানায় পোষাক প্রস্তুতকারী অঞ্চলে যখন কোন শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেয় তখন তার শ্রমিকরা রাত জেগে তাদের কারখানা পাহারা দেয় । সে বলে এই কারখানার মালিক যত না আমি তার চেয়ে বেশী আমার শ্রমিকরা । বৃহষ্পতিবার রাতে কারখানাটিতে অগ্নিসংযোগ করার আগে এলাকায় গুজব ছড়ায় যে কারখানার মালিক পক্ষ দু’জন শ্রমিককে গুলি করে হত্যা করেছে । যারা এই গুজবটি ছড়িয়েছে তারা সকলে বহিরাগত । কিছুক্ষণ পর স্থানীয় মসজিদ হতে মাইকে প্রচার করা হয় একজন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে । এরপরই এই অগ্নিকান্ডের খোঁজ নিয়ে জেনেছি এই অগ্নিকান্ডের সাথে ওই কারখানার কোন শ্রমিক জড়িত ছিল না, সকলে ছিল বহিরাগত এবং বলা বাহুল্য এই তষ্কররা বর্তমানে বাংলাদেশে রাজনীতির নামে চলমান নৈরাজ্য ও হিংস্রতার সুযোগ নিয়ে দেশটাকে দেউলিয়া করার নীল নক্সা বাস্তবায়নে দেশে এবং বিদেশে অবিরাম কাজ করে যাচ্ছে । যে সকল সুশীল ব্যক্তি ও এক শ্রেণীর মিডিয়া বর্তমান নৈরাজ্যকে প্রশ্রয় দিয়ে সব কিছুর দায় দায়িত্ব শেখ হাসিনার উপর চাপিয়ে রাত দিন হুক্কা হুয়া করেন তারা এই ব্যাপারে কী বলেন তা দেখার ইচ্ছা রইলো । হয়তো তারা একটি বিবৃতি দিয়ে বলবেন যারা এই ঘটনার জন্য দায়ী তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হোক । আবার তারা যে সব দল বা ব্যক্তির প্রতি অন্ধভাবে সহানুভূতিশীল এমন কোন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হলে তখন আবার তাকে ছেড়ে দেয়ার জন্য চিৎকার শুরু করবেন । এই কারখানা ধ্বংসে মালিক পক্ষের ক্ষতি হয়তো কিছুটা বীমা কোম্পানিগুলি পুশিয়ে দেবে । কিন্তু এই কারখানায় প্রায় বাইশ হাজার শ্রমিক কাজ করতো তাদের কী হবে ? শিপমেন্টের জন্য প্রস্তুত ছিল ১৯টি কাভার্ড ভ্যান ভর্তি তৈরী পোষাক তা সব পুড়ে ছাই । ক্রেতা এখন হয়তো অন্য দেশে তার পোশাকের উৎস খুঁজবে । এই অঞ্চলে পেশাদার শ্রমিক নেতা নামধারী যে সব ব্যক্তি কাজ করেন তারাও বা কী বলেন ? এখানে বেশ তৎপর জামায়াতের ইসলামী শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন । আমিনুল ইসলাম নামের একজন শ্রমিক অজ্ঞাত ব্যক্তিদের হাতে নিহত হলে যুক্তরাষ্ট্রের সে কী মাতম । ষ্টান্ডার্ড গ্রুপের কারখানায় অগ্নি সংযোগের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রই বা কী বলবে তা কী জানা যাবে ? আসলে ওয়াশিংটন ডিসিতে যে লবিষ্ট ফার্মের সাথে হিলারি ক্লিন্টন জড়িত তার সাথে আমিনুল ইসলামের সংশ্লিষ্টতা ছিল । সেই কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের বা হিলারির আমিনুল ইসলামের ব্যাপারে এত উদ্বেগ । যুক্তরাষ্ট্রের কাছের দেশ কলম্বিয়ায় প্রতি বছর গড়ে দুই শত শ্রমিক বা শ্রমিক নেতা নিহত বা গুম হয় কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কলম্বিয়ার ব্যবসাপাতিতে তার তেমন কোন প্রভাব পড়ে না । তবে নিশ্চয়ই আমিনুল ইসলামের হত্যাকারিদের বিচার চাইব । ফিরে আসি যে বিষয়টি নিয়ে লিখব ঠিক করেছিলাম সে বিষয়ে ।
গত ২০ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক উপকমিটিতে বাংলাদেশ নিয়ে একটি শুনানি হয়ে গেল । শুনানির শিরোনাম ছিল ‘চরম বিশৃঙ্খলায় বাংলাদেশ: খাদের কিনারায় একটি জাতি’? (Bangladesh in Turmoil: A Nation on the Brink?') । সাধারণত এত নেতিবাচক কোন শিরোনাম দিয়ে এই ধরণের শুনানি হয় না, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে হলো কারণ বাংলাদেশ এখন অনেক দেশের জন্য সুন্দরী ভাবির মতো । যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ভারত, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কোন দেশই বাদ যাচ্ছে না । অবাক কান্ড হচ্ছে এই বিষয়টি আমাদের অনেক বাঘা বাঘা সুশীল উপলব্দি করতে অক্ষম । সে দিন একজন বেশ বড় মাপের সুশীলকে একটি টিভি টকশোতে বলতে শুনলাম বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র বছরে হাজার তিনেক গাড়ী বিক্রয় করে এটিই বাংলাদেশে তাদের সব চেয়ে বড় স্বার্থ । এই প-িত সুশীল হয়তো জানেন না বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র তেমন কোন গাড়ীই রপ্তানি করে না । তারপরও এই সুশীলদের আমাদের মিডিয়াতে আকাশ চুম্বী কদর এবং তারা বেশ সমাদৃত। আসলে যে যত অসত্য কথা বলতে পারে বা মূর্খ, বিশেষ করে ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়াতে তার কদর তত বেশী । বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থানের (strategic location) গুরুত্ব বুঝার মতো মুরোদ এই সুশীলদের নেই ।
যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট ও কংগ্রেসে এমন অনেক কমিটি ও তার উপ-কমিটি আছে যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট নানা বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা অথবা শুনানি হয় । এই কমিটিগুলি অনেকটা বাংলাদেশের সংসদীয় কমিটির মতো । তফাৎটা হচ্ছে বাংলাদেশের সংসদীয় কমিটিতে অন্য দেশের বিষয় নিয়ে কোন আলোচনা হওয়ার রেওয়াজ নেই । যুক্তরাষ্ট্র বলে কথা । তারা যেহেতু বর্তমানে বিশ্বের একমাত্র মোড়ল সেহেতু তারা যে কোন দেশের বিষয় আশয় নিয়ে কথা বলতে পারে । এই আলোচনা স্বপ্রনোদিতও হতে পারে অথবা কোন একটি প্রেশার গ্রুপ নিজেরা বা লবিষ্ট ফার্ম নিয়োগ করেও এই শুনানির ব্যবস্থা করতে পারে । উপ-কমিটির শুনানির সার সংক্ষেপ মূল কমিটিতে পাঠানো হয় আর মূল কমিটি প্রয়োজন মনে করলে তা মার্কিন সরকারের কাছে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাঠাতে পারে । সরকার মূল কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ইচ্ছা করলে ব্যবস্থা নিতে পারে । তবে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে এই সব শুনানির তেমন কোন গ্রহণযোগ্য ও প্রত্যাশিত সমাপ্তি হয় না । তবে এই সব শুনানির একটা প্রচার মূল্য আছে । আবার সব সময় ইচ্ছা করলেও সব বিষয় নিয়ে যে কংগ্রেস বা সিনেট শুনানি করবে তাও নয় । এখন যদি কেউ বলে পাকিস্তানে মার্কিন ড্রোন হামলা নিয়ে অথবা মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা কর্তৃক সারা বিশ্বের সকল যোগাযোগ মাধ্যমে যে আড়ি পাতা হচ্ছে সে সম্পর্কে শুনানি করতে আগ্রহী তা সম্ভব নয় কারণ তা মার্কিন স্বার্থের পরিপন্থী হবে । অন্যদিকে এমন একটি বিষয় নিয়ে ভারত বা চীন যদি তাদের দেশে একটি শুনানি করতে চায় তাহলেও সে দেশের বিপদ হতে পারে ।
২০ তারিখের শুনানির মূল আবেদনকারী ছিল যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় । তারা বাংলাদেশে গত বছর দেড়েক ধরে নানা অজুহাতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর যে নিপীড়ন চলছে তার প্রতি বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এই শুনানির আয়োজন করতে কংগ্রেসকে অনুরোধ করে আসছিল । শেষ পর্যন্ত শুনানির দিন ধার্য করা হলো ২০ তারিখ এবং তা হবে উপ-কমিটিতে এবং তাতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বেশ কিছু প্রতিনিধিদের উপস্থিত থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয় যদিও তারা তাদের বক্তব্য তুলে ধরার কোন সুযোগই পান নি । তারা বুঝতেই পারেননি যে শুনানিটি ইতোমধ্যে বিরাট অংকের অর্থের বিনিময়ে জামায়াত ছিনতাই করে নিয়ে গেছে । এই প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে জঙ্গিবাদ ও নিরাপত্তা নিয়ে লেখা লেখি করেন ম্যডেলিন ব্রুকস । তিনি ক্যালিফর্নিয়ার এল-সেন্ট্রো হতে প্রকাশিত অন লাইন পত্রিকা আমেরিকান থিঙ্কারে এক নাতি দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন । সেই প্রতিবেদনে তিনি লিখেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ষ্টেট ডিপার্টমেন্ট ভ্রান্তভাবে বাংলাদেশকে একটি মডারেট মুসলিম দেশ হিসেবে চিহ্নিত করে যদিও এই দেশটিতে বিভিন্ন সময় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় কিছু ধর্মান্ধ মানুষের হাতে নিগৃহীত হয়েছেন । সামনে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আরো হুমকীতে পরতে পারে । তার মতে আওয়ামী লীগ কিছুটা হলেও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে বিশ্বাস করে কিন্তু তাদের বিপরীতে বিএনপি আর জামায়াত বাংলাদেশকে একটি ধর্মান্ধ মৌলবাদী রাষ্ট্র বানাতে চায় । তিনি আরো লিখেছেন, হয়তবা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন উত্থাপন করছেন কিন্তু আওয়ামী লীগ একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছে আর অন্যদিকে বিএনপি জামায়াত মিলে চেষ্টা করছে কী ভাবে ট্রাইবুনালের রায় বানচাল করা যায় । ম্যডেলিন ব্রুক্স এর মতে আওয়ামী লীগের রাজনীতির যত দোষ ত্রুটিই থাকুক না কেন বাংলাদেশকে একটি তালেবান রাষ্ট্রে রূপান্তর হওয়া হতে একমাত্র এই দলটিই বাঁচাতে পারে ।
ব্রুক্স মনে করেন পুরো শুনানিটাই ছিনতাই করতে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী বিএনপি লবি জামায়াতের সহায়তায় কাজ করেছে এবং তার জন্য বিপুল অংকের অর্থের যোগান দিয়েছে বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে বিচারাধীন একাত্তরের অভিযুক্ত ঘাতক মীর কাসেম আলী । তিনি বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের লবিষ্ট ফার্ম ক্যাসেডি এন্ড এসোসিয়েটস্কে পাঁচ লক্ষ ডলারের বিনিময়ে নিয়োগ করেছেন এবং এই লক্ষ্যে এই ফার্মের ভাইস চেয়ারম্যান গ্রেগ হার্টলি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে রাতদিন কাজ করে চলেছেন । এই সব খবর আবার প্রকাশ করেছে হার্টলির নিজ শহর হতে প্রকাশিত দৈনিক সেন্ট লুই ডিসপ্যাচ । হার্টলি পাকিস্তান ভিত্তিক তালেবানী সংগঠনগুলির জন্যও কাজ করে থাকেন । ব্রুক্স প্রশ্ন তুলেছেন এই যে বহু প্রত্যাশিত পররাষ্ট্র বিষয়ক উপকমিটিতে যে শুনানিটি হলো তাতে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল নিয়ে যে অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে তার জন্য কে অর্থ যোগান দিয়েছে ? অথবা একই দিনে নিউ ইয়র্ক টাইমস এর মতো পত্রিকা কী ভাবে অভিন্ন সুরে একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করে এবং তাতে বাংলাদেশে বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের জন্য একক ভাবে আওয়ামী লীগকে দায়ী করে ? ব্রুক্স বিস্ময় প্রকাশ করে লিখেছেন এটি অবাক করার বিষয় হচ্ছে নিউ ইয়র্ক টাইম্স তাদের সম্পাদকীয়তে জামায়াতকে একটি বৈধ রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে আগামী নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করতে ওকালতি করেছে । শুনানি কালে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোন সদস্যকে কোন প্রকারের প্রশ্ন করার সুযোগ দেয়া হয় নি । ব্রুক্স ধারণা করছেন এই সব কর্মকা-ের জন্য ক্যাসেডির বিরাট ভূমিকা ছিল এবং তার জন্য বড় রকমের অর্থ ব্যয় করা হয়েছে । ব্রুক্স তার প্রতিবেদন শেষ করেছেন এই বলে জার্মানিতে নাৎসিদের ভোট দিয়ে জনগণ ক্ষমতায় বসিয়েছিল কিন্তু তারা সমগ্র ইউরোপকে ধ্বংস করে দিয়েছে । বাংলাদেশও বর্তমানে এমন একটি খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে এবং তারপর হয়ত এর পরিনতি হবে একটি সম্পূর্ণ জঙ্গিবাদী রাষ্ট্রে । তিনি প্রশ্ন করেছেন নিউ ইয়র্ক টাইম্স এর মতো একটি পত্রিকা কেন এমন একটি ধ্বংসাত্মক সম্পাদকীয় লিখতে গেল ?
শুনানিতে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতও একজন দর্শক হিসেবে সামনের কাতারে বসেছিলেন । এই অধিবেশনে দু’জন বাঙালি লিখিত প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন । একজন যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যাপনারত ডঃ আলী রিয়াজ অন্যজন বাংলাদেশ হতে উড়ে যাওয়া স্বঘোষিত নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অবঃ) এ এম এন মুনিরুজ্জামান । তিনি বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব ছিলেন এবং বেগম জিয়ার একনিষ্ঠ ভক্ত হিসেবে পরিচিত । বাংলাদেশে তার ইন্সটিটিউট অব পিস এ- সিকিউরিটিস ষ্টাডিজ নামের একটা দোকান আছে । এই সব দোকানের অর্থ কারা যোগান দেয় তা আল্লাহ মালুম । কী এক কারণে যেন তিনি এখন সকল সেনা নিবাসে অবাঞ্চিত ঘোষিত হয়েছেন বলে জানা গেছে। আলী রিয়াজ একজন ভাল গবেষক, বাংলাদেশে একজন পরিচিত নাম এবং ইতোমধ্যে তিনি বাংলাদেশের মাদ্রাসা শিক্ষা ও মৌলবাদের উত্থান সম্পর্কে বেশ কয়েকটি গবেষণাধর্মী গ্রন্থ রচনা করেছেন । বর্তমানে তিনি ওয়াশিংটন ডিসি’র উড্রো উইলসন সেন্টারে গবেষণারত । এই সেন্টার মূলত মার্কিন কর্পোরেট হাউজ আর ষ্টেট ডিপার্টমেন্টের অর্থে পরিচালিত হয় । উপ-কমিটিতে পনেরজন সদস্য থাকেন, সেদিন সাকূল্যে চারজন উপস্থিত ছিলেন । কমপক্ষে আটজন সদস্য উপস্থিত না থাকলে সেই শুনানির কোন গুরুত্ব থাকে না । শুনানিতে সভাপতিত্ব করেন উপ-কমিটির চেয়ারম্যান স্টিভ শ্যাবট । কিছু দিন আগে তিনি বাংলাদেশে সফর করে গিয়েছেন । তার অবস্থান কালে বাংলাদেশে জামায়াত-বিএনপি’র ডাকে হরতাল চলছিল । তিনি ফিরে গিয়ে বেগম জিয়াকে আগামী দিনের সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আখ্যায়িত করে তার ভ’য়সী প্রসংসা করেছিলেন । আরো উপস্থিত ছিলেন এশিয়া হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিনিধি জন সিফটন । এশিয়া হিউম্যান রাইটস ওয়াচ পদে পদে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্গন আবিস্কার করে । তারা মনে করে ‘অধিকারের’ আদিলুর রহমানের মতো বাংলাদেশে দ্বিতীয় কোন মানবাধিকার কর্মী নেই । আরও মনে করে শাপলা চত্ত্বরে হেফাজতিদের উপর হঠাৎ পুলিশি এ্যাকশনে কয়েকশত মাদ্রাসা হুজুরের প্রাণহানি হয়েছে ।
স্টিভ শ্যাবট শুনানির শুরুতে বাংলাদেশ সম্পর্কে দুএকটি ভাল কথা বলে কোন কারণ ছাড়া তার বক্তব্যে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল সম্পর্কে চরম অসম্মান ও অবজ্ঞাসুলভ মন্তব্য করেন । তার এই সূচনা বক্তব্য শুনে মনে হয়েছে তিনি জামায়াতের লিগ্যাল প্যানেলের একজন সদস্য । বাংলাদেশের এক মাত্র দৈনিক সংবাদ ছাড়া এই বিষয়টি কোন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি । আর কিছু না হোক অন্ততঃ একটি দেশের একটি বৈধ আদালত নিয়ে অন্য আর একটি দেশের একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির এমন চরম দায়িত্বহীন বক্তব্য রাখা যৌক্তিক ছিল কী না সে সম্পর্কে প্রশ্ন করা যেত ।
আলী রিয়াজের প্রবন্ধটা অনেকটা একাডেমিক । তিনি বিভিন্œ সময়ে বাংলাদেশের নির্বাচন প্রসঙ্গে আলোচনা করেছেন কিন্তু জিয়ার আমলের নির্বাচন নামক তামাশার কথা বলতে ভুলে গেছেন । ২০০১ সালের নির্বাচনের পর বাংলাদেশে জামায়াত-বিএনপির যৌথ উদ্যোগে সংখ্যালঘু আর আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীদের উপর যে ভয়াবহ নির্যাতন নেমে এসেছিল সে সম্পর্কে কেউই আলোচনার প্রয়োজন মনে করেন নি । আগামী নির্বাচনে যদি বিএনপি-জামায়াত জোট বিজয় লাভ করে তা হলে তারা যুদ্ধাপরাধ আর মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে যারা দ-িত হয়েছেন অথবা এই বিচারের কী হবে তা পরিষ্কার নয় বলে আলী রিয়াজ মন্তব্য করেছেন । তিনি হয়তো বেগম জিয়ার একাধিকবার জনসম্মূখে বলা বক্তব্য মিস করেছেন যেখানে তিনি বলেছেন ক্ষমতায় গেলে তিনি সব রাজবন্দীদের (যুদ্ধাপরাধী) মুক্ত করে দেবেন, ট্রাইবুনাল বাতিল করবেন এবং যারা এই বিচারের পিছনে আছে তাদের বিচার করবেন । ত্রয়োদশ সংশোধনী নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আর দশজনের মতো আলী রিয়াজ দুই টার্ম এই ব্যবস্থা রাখা যেত এ মর্মে আদালত রায় দিয়েছেন বলে বিভ্রান্তিকর বক্তব্য রেখেছেন । এটি রায় ছিল না, ছিল পর্যবেক্ষণ এবং তাতে বলা ছিল সংসদ চাইলে এই ব্যবস্থা আরো দুই টার্মের জন্য রাখা যেতে পারে তবে সেই ব্যবস্থা হতে বিচারপতিদের বাদ দিতে হবে এবং এই সরকারে যারা থাকবেন তারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হওয়া বাঞ্চনীয় কারণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এক মুহুর্তের জন্যও কোন দেশের শাসন ভার অনির্বাচিত কোন ব্যক্তির হাতে যাওয়া উচিত নয় । বিদেশে বসে স্বদেশ দেখা সব সময় সহজ হয় না ।
জন সিফটন জানালেন বাংলাদেশ বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র হতে যে জিএসপি সুবিধা পায় তা ঝুঁকির মধ্যে পরবে । সিফটন জানেন না বাংলাদেশ তৈরী পোষাক খাতে যে জিএসপি পায় তা নাম মাত্র বরং বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে তৈরী পোষাক খাতে যে শুল্ক দেয় তা অন্য সব দেশের চেয়ে কয়েকগুন বেশী, প্রায় শতকরা পনের ভাগ । যে যৎসামান্য জিএসপি সুবিধা বাংলাদেশ পায় তাও বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র বাতিল করেছে । সিফটন আরো বলেছেন বাংলাদেশে এভাবে রাজনৈতিক সংঘাত চললে জাতিসংঘে বাংলাদেশের যে শান্তি রক্ষাকারী বাহিনী আছে তাও অসুবিধায় পরবে । সিফটন হয়তো জানেন না হিউম্যান রাইট্স ওয়াচ কমিটির কথায় যুক্তরাষ্ট্র বা জাতি সংঘ তাদের সিদ্ধান্ত নেয় না । তিনি আরো বলেছেন হরতালের সময় বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অতিরিক্ত শক্তি প্রদর্শন করে । দেশের মানুষতো মনে করে তাদের যতটুকু শক্তি প্রয়োগ করা উচিৎ তারা ততটুকু করে না । বাসে মানুষ পুড়িয়ে মারলেও পুলিশতো তেমন কিছু করছে না যদিও যারা এই ধরণের কাজ করে অথবা রেল পথে নাশকতা চালায় অন্য কোন দেশে হলে তাদের পুলিশ সরাসরি গুলি করতো । পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জনগণের টাকায় পালা হয় জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য । প্রয়োজনের সময় রবীন্দ্র সঙ্গীত গাওয়ার জন্য নয় । এই বিষয়ে মনিরুজ্জামানের বক্তব্যও জন সিফটনের মতো । তিনি আরো জানালেন বিরোধী দলের প্রতি সরকারের আচরণের কারণে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটবে । জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটবে বিএনপি জামায়াতের সহায়তায় সরকারি দলের কারনে নয় । সব শেষে বলতে চাই মূলত দেশে এবং বিদেশে বাংলাদেশ নিয়ে বিভিন্ন মহলের একটি গভীর ষড়যন্ত্র চলছে এবং এদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশে অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন নয়, মূল বিষয় হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানো আর বাংলাদেশকে একটি আফগানিস্তান অথবা পাকিস্তান বানানো । এতে বিরোধী দল সহায়তাতো করছেই আরো করছে বাংলাদেশের এক শ্রেনীর সুশীল ব্যক্তি, কিছু মিডিয়া আর কোন কোন বিদেশী শক্তি । বাংলাদেশ আফগানিস্তান বা পাকিস্তান হলে সেখানে সহজে গণতন্ত্র রফতানি করা যাবে ।

লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় । নভেম্বর ৩০, ২০১৩

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ

[......লেখক আর্কাইভ]