[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

একজন যাদুকর-নাম তার ‘মজিবর’

 

 

প্রফেসর আবদুল মান্নান

পনেরই আগষ্ট তারিখটি বাংলা ও বাঙালির দিনপঞ্জিতে এক মর্ম্মন্তুদ শোকের দিন । এই দিনটিতে ১৯৭৫ সালে জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে তার ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়ীটিতে সপরিবারে একদল বিপদগামী সেনা বাহিনীর সদস্য হত্যা করেছিল । তাদের প্রত্যক্ষ ভাবে সার্বিক সহায়তা করেছিল বঙ্গবন্ধুর কিছু কাছের আস্থাভাজন মানুষ। আজকের এই দিনটিতে বঙ্গবন্ধু এবং ঐদিন এই ঘাতকদের হাতে নিহত সকল শহীদদের প্রতি বিনম্্র শ্রদ্ধা ।
সমসাময়িক ইতিহাসে এমন একটি নৃশংস ও পূর্ব পরিকল্পিত রাজনৈতিক হত্যাকান্ড বিরল ঘটনা । এই হত্যাকান্ডের সাথে ১৯৫৮ সালের চৌদ্দই জুলাইয়ের ইরাকের বাদশাহ দ্বিতীয় ফায়সালের সপরিবারে হত্যাকান্ডের সাথে কিছুটা মিল আছে। এদিন ইরাকি জেনারেল করিম কাসেম বাদশাহ দ্বিতীয় ফায়সালকে এক সামরিক অভ্যূত্থানের মাধ্যমে উৎখাত করে ইরাকে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে সামরিক তন্ত্রের গোড়াপত্তন করেন এবং অভ্যূত্থানের সময় রাজপ্রাসাদে বাদশা দ্বিতীয় ফায়সালের পরিবারের প্রায় একুশজন সদস্যকে হত্যা করা হয় । এই হত্যাকান্ডের সময় ফায়সালের মা পবিত্র কোরাণ তেলাওয়াতরত ছিলেন । পনেরই আগষ্ট যখন বঙ্গবন্ধুকে ঘাতকরা হত্যা করে তখন বাংলাদেশের সকল মসজিদে মুয়াজ্জিনদের সুললিত কণ্ঠে ফজরের নামাজের আযান ভেসে আসছিল । হয়তো বঙ্গবন্ধু কিছুক্ষণ পর নামাজের জন্য শয্যা ত্যাগ করতেন । ১৯৭৫ এর পনেরই আগষ্টে বঙ্গবন্ধুর ফজরের নামাজ আর পড়া হয় নি । প্রতি সপ্তাহের মতো সেদিন বঙ্গবন্ধুর জুমায়ার নামাজ পড়তেও আর যাওয়া হয়নি । পঁচাত্তরের পনেরই আগষ্ট ছিল শুক্রবার । তিনি একজন মুমিন ছিলেন এবং নিয়মিত নামাজ আদায় করতেন ।
কেমন ছিলেন বঙ্গবন্ধু নামের ওই যাদুকরি মহানায়ক, যাঁকে কয়েক বছর আগে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসি জনগণের ভোটে চিহ্নিত করেছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে অথবা কেনই বা তাঁকে এমন নৃশংসভাবে নিহত হতে হলো? এমন প্রশ্ন আমার প্রজন্মের অনেকের কাছে বর্তমান প্রজন্ম প্রায়শঃ করে থাকে । ক’দিন আগে একটি টিভির টকশোতে একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা মন্তব্য করেছিলেন সাধারণ মানুষ যাতে পুরো বিষয়টা সম্পর্কে সহজে জানতে পারে ঠিক সেভাবে আমরা যেন কথা বলি অথবা লিখি । তার সাথে দ্বিমত করার কোন সুযোগ নেই । বলি কেমন করে রাজনৈতিক অঙ্গনের একজন সাধারণ কর্মী জনগণের নেতা হয়ে উঠেন তা জানতে হলে সব চেয়ে সহজ পাঠ্য হলো বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’। সেটি পড়লে বুঝা যাবে কেন বঙ্গবন্ধু একটি জাতির জন্ম দিতে পেরেছিলেন, আর কেনই বা তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে লক্ষ লক্ষ বাঙালি নিজের জীবনকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য উৎসর্গ করেছিলেন । ১৯৯৪ সালে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর আমন্ত্রণে আমার টুঙ্গিপাড়া যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল । তবে সেই কাদের সিদ্দিকী এখনকার কাদের সিদ্দিকী নন । নামে ব্যক্তি এক হলেও ১৯৯৪ সালের বা তার পূর্বের কাদের সিদ্দিকীর সাথে এখনকার কাদের সিদ্দিকীর কোন মিল নেই । তখন গোপালগঞ্জ হতে টুঙ্গিপাড়া যাওয়ার একমাত্র বাহন ছিল তিন চাকার রিকশা ভ্যান । টুঙ্গিপাড়া বাংলার হাজারো নিভৃত পল্লীর মতো একটি অজ পল্লী । সে দিন কথা বলেছিলাম বঙ্গবন্ধুকে যারা কাপড় ধোওয়ার ৫৭০ সাবান দিয়ে গোসল করিয়ে রেডক্রসের রিলিফের কাপড়ের কাফন পড়িয়ে কবর দিয়েছিলেন তাদের সাথে । সেদিন সেই বৃষ্টি ভেজা রাতে তারা তাদের ‘মজিবরের’ কথা শুনিয়েছিলেন আমাকে । তাদের শুনিয়েছিলাম কেমন করে তাদের ‘মজিবর’ বিশ্বের মানচিত্রটাকে বদলে দিয়ে বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছিলেন ।
অনেকের প্রশ্ন কী ছিল বঙ্গবন্ধুর যা তাঁর সমসাময়িক অন্যান্য নেতাদের ছিল না ? তাদের বলি সেই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার কোন যোগ্যতাই আমার নেই । তারপরও তারা শুনতে চায় । বলি সেতো এক মহাকাব্য হবে যোগ্য মানুষের হাতে পরলে । তারপরও বলি বঙ্গবন্ধু এমন একজন মানুষ ছিলেন যাঁর কথায় এবং কাজের মধ্যে কোন তফাৎ থাকতো না । তাঁর কথায় মানুষ আস্থা রাখতে পারতো । তিনি সহজে বাংলা ও বাঙালির কথা বলতে পারতেন । ১৯৬৮ সালে যখন বঙ্গবন্ধুর নামে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা রজ্জু করা হলো তখন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ১৯৬৯ সালে যে গণ অভ্যূত্থান সংগঠিত হয়েছিল তার পিছনে মূল কারণ ছিল কারাগার হতে শেখ মুজিবকে (তখনো তিনি বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত হন নি) মুক্ত করতে হবে । সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে তাঁকে বাংলার সাড়ে সাতকোটি মানুষযে অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছিলেন তার কারণ তিনি বলেছিলেন তার নির্বাচনী ইশতেহার হলো ঐতিহাসিক ছয় দফা । তিনি হয়তো নেতাজী সুভাস বসুর মতো বলেননি ‘আমাকে রক্ত দাও আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব’ । তবে মানুষ ঠিকই বুঝেছিলেন আওয়ামী লীগের ছয় দফার মধ্যে বাঙালির মুক্তি আর স্বাধীনতার বীজ বপন করা আছে ।
১৯৭০ এর ভয়াল ঘূর্ণিঝড় । বাংলাদেশে কমপক্ষে দশ লক্ষ মানুষ মারা গেল । পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান ঢাকা হয়ে পিকিং গেলেন । সময় হলোনা তার এই ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত এলাকা একটু ঘুরে দেখার অথবা বাংলার মানুষকে সহানুভূতি জানানোর । এমন কী ইয়াহিয়ার মন্ত্রী সভার একজন সদস্যও ইসলামাবাদের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ হতে বের হয়ে বাংলাদেশে এসে বাঙালির পাশে দাঁড়ানোর প্রয়োজন মনে করলেন না । বাঙালির প্রতি পি-ির শাসকদের কী এক চরম অবজ্ঞা । বঙ্গবন্ধু বললেন এই অবজ্ঞার জবাব বাংলার মানুষ আসন্ন নির্বাচনে তাদের ব্যালটের মাধম্যেই দেবেন । তারা তাই দিয়েছিলেন । পূর্ব বাংলার একশত ঊনসত্তরটি আসনের মধ্যে একশত সাতষট্টি আসনে বিজয় । পাকিস্তানের মোট তিনশত আসনের মধ্যে নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা । পাকিস্তানের সকল গোয়েন্দা সংস্থা ইয়াহিয়া খানকে এই ধারণা দিয়েছিল আওয়ামী লীগ বড়জোর সত্তর হতে আশিটি আসনে জয়ী হবে । গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য কদাচিৎ সঠিক হয় । বাকিটা ইতিহাস । আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস । ষড়যন্ত্র, বিশ্বাসঘাতকতা আর রক্তের ইতিহাস ।
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী থাকার পর বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারী ল-ন দিল্লি হয়ে এক পড়ন্ত বিকেলে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু । আজকের প্রজন্মকে বুঝানো যাবে না কেমন ছিল সেই পড়ন্ত বিকেল বা কেমনই বা ছিল তখন বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থা ? সারা বাংলাদেশে আগের দিনই খবর হয়ে গিয়েছিল ১০ তারিখ সেই মহামানব আসবেন যাঁর অমর কীর্তি এই স্বাধীন বাংলাদেশ । সেই পড়ন্ত বিকেলে লক্ষ জনতা ছুটে গিয়েছিল সেই রমনা রেস কোর্স ময়দানে, যেখানে দাঁড়িয়ে সাতই মার্চ বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম ।’ দেশে ফিরেই বঙ্গবন্ধু বিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনের কঠিন দায়িত্বটা হাতে তুলে নিয়েছিলেন । প্রায় এক কোটি ছিন্নমূল শরনার্থী ভারত হতে দেশে ফিরছে । দেশের ভিতরে কমপক্ষে দুই কোটি উদ্বাস্তু । চারদিকে লাখ লাখ স্বজন হারানো মানুষের আহাজারি । বাতাসে তখনও বারুদের গন্ধ । দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা পলায়নরত পাকিস্তানি বাহিনী সম্পূর্ণ ধ্বংস করে রেখে গিয়েছে । তাদের পোতা ভাসমান মাইনের (বোমা) কারণে দেশের উভয় সমূদ্র বন্দরই অচল । ব্যাংকগুলোর ভল্ট শূন্য । খাদ্য গুদামগুলোতে নেই এক ছটাক চাল । বেসামরিক প্রশাসন সম্পূর্ণ বিপর্যস্থ । আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চীন-মার্কিন-সৌদি বলয় বাংলাদেশের জন্য একটি প্রচ- বৈরী পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছে । দেশের অভ্যন্তরে এ দেশীয় পাকিস্তানি দালাল ঘাতক রাজাকার-আলবদর, জামায়াত আর চীনপন্থী অতিবামরা মিলে প্রতিনিয়ত চালাতে শুরু করলো নানা ধরণের অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা । আজ এই পাটের গুদামে আগুন লাগে তো কাল ওই কারখানায় বিস্ফোরণ । সেই সব চ্যালেঞ্জ সফলতার সাথে মোকাবেলা করেছিল বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছরের সরকার কারণ তাদের কাছে সব কিছুর আগে ছিল দেশের স্বার্থ আর নেতৃত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব । যাঁর দৃঢ়তা ছিল আর ছিল এক যাদুকরি সম্মোহনী শক্তি । এই সাড়ে তিন বছরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের ভূখ- হতে ভারতীয় বাহিনীকে সসম্মানে নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে পেরেছিলেন । শরনার্থী আর উদ্বাস্তুরা পুনর্বাসিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে । এসেছিল দুই শতাধিক রাষ্ট্রের স্বীকৃতি । বাংলাদেশকে তিনি জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ, ওআইসি, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন সহ অন্যান্য বিশ্বসংস্থার সদস্য করতে পেরেছিলেন । দেশ স্বাধীন হওয়ার এক বছরেরও কম সময়ে তিনি একটি স্বাধীন দেশের জন্য এক অসাধারণ সংবিধান প্রণয়ন করে সকলকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন । তারপরও কেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে এই মহামানবকে জীবন দিতে হয়েছিল এমন প্রশ্ন অনেকের ।
বঙ্গবন্ধু আর স্বাধীন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র সেই মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল হতে । একাত্তরের সেপ্টেম্বর মাসে কুমিল্লা হতে নির্বাচিত সংসদ সদস্য জহুরুল কাইউম ষড়যন্ত্রের অন্যতম হোতা খোন্দকার মোশতাকের হয়ে কোলকাতায় নিযুক্ত মার্কিন কন্সাল জেনারেলের সাথে দেখা করতে চেয়েছিলেন । মোশতাকের বার্তা ছিল যুক্তরাষ্ট্র চাইলে তিনি স্বাধীনতার বদলে পাকিস্তানের সাথে কনফেডারেশনের প্রস্তাব গ্রহণ করার জন্য মুজিবনগর সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করতে পারেন । তবে তার জন্য বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে হবে । ওয়াশিংটন হতে এই প্রস্তাব ঝুঁকিপূর্ণ হবে এই অজুহাতে তা বাতিল করে দেয়া হয়েছিল । এই স্বীকারোক্তি মিলেছে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালিন পররাষ্ট্র সচিব হেনরী কিসিঞ্জারের আত্মজীবনী মূলক গ্রন্থ ‘মাই হোয়াইট হাউস ইয়ার্স’ গ্রন্থে । বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও এই ষড়যন্ত্র থেমে থাকে নি । একজন রাষ্ট্রপতিকে সপরিবারে হত্যা করতে প্রয়োজন একটি সূক্ষ্ম পরিকল্পনা আর তাঁর কাছের মানুষের সার্বিক সহযোগিতা যা একাত্তরের ঘাতকরা প্রস্তুত করতে পেরেছিল । প্রথমেই তারা সফলভাবে বঙ্গবন্ধুকে তাঁর একান্ত আস্থাভাজন, বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন হতে বিচ্ছিন্ন করতে পেরেছিল । তাঁর একান্ত কাছে যেতে পেরেছিল কয়েকজন । ঘাতক বাহিনীর অন্যতম সেনা কর্মকর্তা মেজর ডালিম (তখন সেনা বাহিনী হতে অপসারিত) বঙ্গবন্ধুর অন্দর মহলে প্রবেশ করতে পেরেছিল । আর এক ঘাতক কর্ণেল রশিদ এপ্রিল মাসে সামরিক বাহিনীর তৎকালিন উপপ্রধান জেনারেল জিয়াকে তাদের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিল । জিয়া বলেছিলেন যেহেতু তিনি একজন সিনিয়র সেনা অফিসার তাদের কর্ম পরিকল্পনার সাথে তিনি সরাসরি সম্পৃক্ত হতে পারবেন না । প্রখ্যাত সাংবাদিক এন্থনি মাসকেরানহাসের সাথে ল-নে এক টিভি সাক্ষাৎকারে রশিদ এই বক্তব্য দিয়েছেন । জিয়ার উচিৎ ছিল এই তথ্যটি যথাস্থানে পৌঁছে দেয়া । তা তিনি করেন নি । বঙ্গবন্ধু জিয়াকে পূত্রবত স্নেহ করতেন এবং শুধু তাঁর জন্যই তিনি সেনা বাহিনীতে উপ-প্রধানের পদটি সৃষ্টি করেছিলেন । ওই পদে পরবর্তীকালে আর কাউকে নিয়োগ দেয়া হয় নি । জিয়া ছিলেন বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রধান বেনিফিসিয়ারী । বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই দেশে বিভিন্ন সময়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানোর চেষ্টা করা হয়েছে এই কথা বলে মুসলমানদের পবিত্র ভূমি পাকিস্তান ভেঙ্গে হিন্দুদের বাংলাদেশ বানানো হয়েছে এবং এটি একটি হিন্দু ভারতের করদ রাজ্য । ছোট্ট একটি ঘটনা কেমন করে বড় হতে পারে তার একটি নমুনা । সেটি ১৯৭৩ সালের কথা । সাভারের একটি তামাকের হিন্দু দোকানদার একটি উর্দু ম্যাগাজিনের পাতা দিয়ে বাজারবারে তামাক বিক্রি করছিলেন । বাজারে রটে গেল ব্যাটা হিন্দু পবিত্র কোরাণ শরিফ ছিঁড়ে এখন তামাক বিক্রি করছে । আর যায় কোথায় বাজার শুদ্ধ মানুষ হামলা করলো তামাকের দোকানে । কোন রকমে পালিয়ে দোকানি প্রাণ বাঁচালো । কবি দাউদ হায়দার দৈনিক সংবাদে এক কবিতা লিখে সেই যে ১৯৭৩ সনে দেশ ছাড়া হলেন এখনো দেশে ফিরতে পারেন নি । ১৯৭৪ সালের জুন মাসে পাকিস্তানের তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভূট্টো বঙ্গবন্ধুর আমন্ত্রণে ঢাকা সফরে আসেন । ভূট্টো যেন ঢাকা সফরের সময় ব্যাপক সংবর্ধনা পান সেই উদ্দেশ্যে পাকিস্তান প্রেমিরা গোপনে ব্যাপক আয়োজন করেছিল । এই কাজে তাঁদের সার্বিক সহযোগিতা করেছিল এই দেশের বহুল প্রচারিত একটি জাতীয় দৈনিক যাঁর মালিক বঙ্গবন্ধুর একান্ত স্নেহ ও আস্থাভাজন ছিলেন । তাদের সেই আয়োজন ব্যর্থ হয়নি । ভূট্টোর আগমনের সময় তেঁজগাও বিমান বন্দরে ব্যাপক জনসমাগম হয়েছিল । বাংলাদেশ আবার খুদে পাকিস্তানের দিকে যে যাত্রা শুরু করেছে এটি তার প্রথম নমুনা । এই ঘটনা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আড়াই বছরের মাথায় । ভূট্টো উপহার স্বরূপ পাকিস্তান হতে ছোট এক বস্তা বাসমতি চাল বঙ্গবন্ধুকে পরিহাস করার জন্য উপহার দিয়েছিলেন কারণ তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে চালের দামের উর্দ্বগতি ছিল (একমন ষাট থেকে আশি টাকা) । দেয়ালে রাতের আঁধারে শ্লোগান লেখা হলো ‘আশি টাকা চালের দাম হরে কৃষ্ণ হরে রাম ।’ দূর্ভাগ্য বঙ্গবন্ধুর দূর্ভাগ্য বাংলাদেশের তখনও বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারেন নি ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের জাল গুটিয়ে আনছে ।
১৯৭৪ সনে বাংলাদেশের দূর্ভিক্ষের ইতিহাস এখনো গবেষকদের কাছে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা । বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের প্রথম উপ-প্রধান (প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু চেয়্যারম্যান) ডঃ নুরুল ইসলাম তাঁর গ্রন্থ গধশরহম ড়ভ ধ ঘধঃরড়হ: ইধহমষধফবংয এ লিখেছেন ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে চালের উৎপাদন ১৯৭৩ সালের চেয়ে বেশী হয়েছিল । একই বছরের জুলাই আগস্ট মাসের ভয়াবহ বন্যায় দেশের তখনকার একমাত্র বৈদেশিক অর্থ উপার্জনকারী ফসল পাটের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল । একই সাথে কৃষকদের পরবর্তী আমন চাষেও ব্যাপক ব্যাঘাত সৃষ্টি করেছিল । এমনিতে সে সময় আন্তর্জাতিক বাজারে অস্বাভাবিক হারে তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে খাদ্য পণ্যের মূল্য চড়া ছিল তার উপর বাংলাদেশের এক শ্রেণীর গণমাধ্যম এই সংবাদ ছড়িয়ে দিল যে বাংলাদেশে আউশ ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে এবং আমন ফসলের উৎপাদন ব্যাহত হবে । এই সংবাদে আড়তদাররা খাদ্য মজুদ শুরু করে দিল । ফল হলো আরো চড়া খাদ্য মূল্য । পরিস্থিতি উন্নয়নে সহায়তা করতে পারতো যুক্তরাষ্ট্র তার পিএল-৪৮০ খাদ্য সহায়তার অধীনে । কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তা করা হতে বিরত থাকে এবং অজুহাত হিসেবে তারা বলে বাংলাদেশ তাদের শত্রু দেশ কিউবার কাছে চটের ব্যাগ বিক্রি করেছে । এটিযে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে একটি চরম অপরাধ তা কিন্তু বাংলাদেশের কাছে জানা ছিল না অথবা যুক্তরাষ্ট্রও এই ‘মহামূল্যবান’ তথ্যটি বাংলাদেশকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি । ডঃ নুরুল ইসলাম তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন একদিন সেনাবাহিনীর উপপ্রধান জেনারেল জিয়া তাঁর দপ্তরে দেখা করতে আসেন এবং বলেন বাংলাদেশ হতে প্রতি মাসে পাঁচ হতে দশ লক্ষ টন চাল ভারতে চোরা পথে চলে যাচ্ছে । তিনি জিয়ার কাছে জানতে চাইলেন কী ভাবে এত বিশাল পরিমাণের চাল ভারতে পাচার হচ্ছে? জিয়া এর কোন সদুত্তর দিতে না পেরে অনেকটা ক্ষুব্দ হয়ে ফিরে গিয়েছিলেন । ষড়যন্ত্রের রশিটা তখন আরো কাছে। ডঃ নুরুল ইসলাম পরবর্তী কালে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বড় বড় দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের কাছে তাদের খাদ্য সাহায্য বন্ধের পুরো ঘটনার ব্যাখ্যা শুনতে চেয়ে ব্যর্থ হয়েছিলেন । তারপর দৈনিক ইত্তেফাকে ছাপা হলো অর্ধ পাগল সেই বিখ্যাত বাসন্তির জাল পড়া ছবি । বলা হলো দূর্ভিক্ষের কারণে মানুষের এতই দূর্দিন যে পরিধেয় বস্ত্র না থাকার কারণে এখন মহিলারা পর্যন্ত মাছ ধরার ছেঁড়া জাল পরে থাকতে হচ্ছে । পরবর্তীকালে ফটোগ্রাফার নিজেই স্বীকার করেছিলেন ওটি আসলে একটি সাজানো ছবি ছিল । পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে দেশে এক দলীয় শাসন ব্যবস্থা বাকশাল কায়েম করেন । তিনি তাঁর নিকটজনদের বলেছিলেন এটি অনেকটা একটি আপদকালীন শাসন ব্যবস্থা । তিনি এই কারণেই তা করেছেন যাতে বিভিন্ন মত ও পেশার মানুষ দেশ গঠনে ভূমিকা রাখার সুযোগ পায় । কিন্তু বাকশাল ব্যবস্থা প্রয়োগ হওয়ার আগেই বঙ্গবন্ধুকে ঘাতকদের তপ্ত বুলেটে প্রাণ দিতে হয় । হয়ে যান তিনি বাংলা আর বাঙালির ইতিহাসের এক ট্রাজিক হিরো । মোশতাক আগের দিন রাত বারটা পর্যন্ত বত্রিশ নম্বরের বাড়িতে ছিলেন । ঘাতকদেও তিনি নামকরণ করেছিলেন ‘সূর্যসন্তান’ ।অনেকে কথায় কথায় বাকশালের তুমুল সমালোচনা করেন । কিন্তু সেই ব্যবস্থার ভাল মন্দ বিচার করার কোন সুযোগইতো কখনো সৃষ্টি হয় নি ।
বাঙালি সেই পঞ্চাশের দশক হতে দেশের বিভিন্ন ক্রান্তিকালে আওয়ামী লীগ আর তার কা-ারি ‘মজিবর’এর দিকে তাকিয়ে থাকতেন । তারা মনে করতেন তাঁর কাছে এমন এক যাদুকরি শক্তি আছে যাতে তাদের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে । সেই তাকানোটা আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো সত্তরের নির্বাচন আর তার পরবর্তীকালে । এখন সেই আওয়ামী লীগ আর আছে কিনা তা কোটি টাকার প্রশ্ন । তবে এটিতো ঠিক জনমানুষের সেই ‘মজিবর’তো নেই । ঘাতকরা তাকে ১৯৭৫ এর পনেরই আগষ্ট ছিনিয়ে নিয়ে গেছে । এই দিনে সেই মহানায়কের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই বিখ্যাত গায়ক ভূপেন হাজারিকার কণ্ঠে:
যদি হিমালয় আল্পস-এর সমস্ত জমাট বরফ
একদিন গলেও যায়, তবুও তুমি বাংলার
যদি গঙ্গা ভলগা হোয়াংহো নিজেদের
শুকিয়ে রাখে,
যদি ভিসুবিয়াস ফুজিয়ামা একদিন জ্বলতে জ্বলতে জ্বলেও যায়
তবুও তুমি বাংলার ।
জয়তু মহানায়ক, জয়তু বঙ্গবন্ধু

লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। ১৫ আগষ্ট, ২০১৩

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ