[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

কোটা পদ্ধতি বিরোধী আন্দোলন আর মোল্লা দোপেয়াজার গল্প

 

 

প্রফেসর আবদুল মান্নান

মহাজোট সরকারের শেষ বছরটা তাদের জন্য মোটেও ভাল যাচ্ছে না । সাধারনতঃ সব সরকারের সময় এমনটি হয়েই থাকে । সকলে মনে করে শেষ বছরে এসে সরকারের অবস্থা কিছুটা নাজুক হয়ে থাকে এবং যার যা দাবি দাওয়া আছে তা নিয়ে সরকারকে চাপ দিতে পারলে তা পূরণ হওয়ার সম্ভবনা বেশী । শেষ বছরে কোন সরকারই কাউকে খালি হাতে ফেরাতে চায় না । এই ধারাবাহিকতায় বিসিএস পরীক্ষায় সকল ধরণের কোটা পদ্ধতি বাতিলের দাবিতে একদল অকৃতকার্য তরুণ তরুণী হঠাৎ করে পবিত্র রমজান মাস শুরুর আগের দিন হতেই প্রথমে ঢাকার এবং পরে দেশের অন্যান্য কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় শহরে রাজপথ দখল করে আন্দোলন শুরু করে । প্রথম দিকে সড়ক অবরোধ ছাড়া আন্দোলনকারীরা তেমন একটা দাঙ্গা হাঙ্গামা করেনি কিন্তু তারা তাদের এই আন্দোলন খুব বেশী সময়ের জন্য শান্তিপূর্ণ রাখতে পারে নি । তারা রমজানের প্রথম দিনে শাহবাগ চত্বর অবরোধ করার চেষ্টা করেছে পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবন ও অফিস ভাংচুর করেছে, এটিএন বাংলার গাড়ীতে হামলা করেছে, পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রার সঙ্গী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার শিক্ষার্থীদের বানানো ভাস্কর্যগুলোতে অগ্নিসংযোগ করেছে । উল্লেখ্য এই পরীক্ষা বা কোটা পদ্ধতির সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা তার উপাচার্যের কোন সম্পর্ক নেই । এই আন্দোলনকারীরা যে স্থান থেকে তাদের আন্দোলনের সূত্রপাত করেছে সেই একই স্থানে কিছুদিন আগে দু‘মাসেরও বেশী সময় ধরে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী সমর্থকরা রাতদিন অবস্থান করেছে কিন্তু কোথাও একটা ঢিল পরেছে তেমন কোন ঘটনা ঘটেনি । কিন্তু এর ব্যতিক্রম দেখা গেল গত বৃহষ্পতিবার । তার আগের দিন জনপ্রশাসনে (পাবলিক সার্ভিস) কোটা প্রথা বিলুপ্তির দাবি জানিয়ে এই পরীক্ষায় তাদের ভাষায় কোটা সংরক্ষণের কারণে পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া কয়েকশত তরুণ তরুণী একই স্থানে কয়েক ঘন্টা সড়ক অবরোধ করে শান্তিপূর্ণ ভাবে প্রতিবাদ করেছে, তাতে রমজানের আগের দিন জনজীবন চরম বিপর্যস্থ হয়েছে ঠিক তবে কোন দাঙ্গা হাঙ্গামা হয়নি যা পরদিন দেখা গেছে । এর প্রধান কারণ দ্বিতীয় দিন হতে এই আন্দোলন আর আন্দোলনকারীদের হাতে থাকেনি তা তাদের অজান্তে জামায়াত শিবির ছিনতাই করে নিয়ে গেছে এবং তাতে পরে ছাত্রদলের কিছু নেতা কর্মীও এসে যোগ দিয়েছে বলে খবরের প্রকাশ। পরে ছাত্রলীগের কিছু কর্মী এসে তাদের উপর হামলা করে তাদের সেখান হতে হঠিয়ে দিয়েছে । ছাত্রলীগ নামধারীদের এই ধরণের কর্মকান্ড কখনো সমর্থনযোগ্য নয় । এটি করতে হলে তার জন্য আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারি সদস্যরা আছেন । দ্বিতীয় দিন আন্দোলনকারীদের মধ্যে কতজন বিসিএস পরীক্ষার্থী ছিল তা বলা মুস্কিল কারণ এই সমাবেশ হতে বাংলাদেশের বেয়াল্লিশ বছরের ইতিহাসে এই প্রথমবার শ্লোগান উঠলো ‘মুক্তিযোদ্ধাদের দুই গালে জুতা মারো তালে তালে ।’ শাহবাগ চত্বরে এই শ্লোগান শুনে প্রথমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যে ত্রিশ লক্ষ মানুষ শহীদ হয়েছেন এবং যে সকল মা বোন তাদের সর্বস্ব খুইয়েছেন তাদের কাছে নীরবে ক্ষমা চেয়েছি এবং পরে ক্ষুব্দ হয়ে এই শ্লোগান যারা দিয়েছে তাদের অভিশাপ দিয়েছি । মনে মনে বলেছি যারা এই শ্লোগান দিয়েছে বাংলাদেশ না হলে তাদের অনেকেই বাসের হেল্পার হতো বা কাঁচা বাজারে তরকারি বিক্রি করতো তার বেশী কিছু নয় । বলা বাহুল্য এই শ্লোগানের জন্মদাতা জামায়াত শিবির অথবা তাদের রক্তধারণকারি প্রজন্ম, অন্য কেউ নয় । বাংলাদেশে হেফাজত নামের একটি মধ্যযুগীয় অর্ধ মূর্খদের সংগঠনের যখন জন্ম হয় তখন আমি লিখেছি এবং একাধিক টিভিতে বলেছি হেফাজতের তথাকথিত তের দফার আন্দোলন বেশি সময় তাদের হাতে থাকবে না । সেটি কখন যে জামায়াত শিবির ছিনতাই করে নিয়ে যাবে তা তারা টেরও পাবে না । এই কথাটি অনেকে বিশ্বাস করলেও দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য সরকার তা বুঝতে পারে নি এবং মে মাসের পাঁচ তারিখ হেফাজতকে মতিঝিলে সমাবেশ করতে দিয়ে পুরো রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে তুলে দিয়েছে এবং দিনভর এবং গভীর রাত পর্যন্ত তারা ঢাকার কেন্দ্রস্থলে এক নজির বিহীন তান্ডব চালিয়েছে । এটি সম্ভব হয়েছে কারণ হেফাজত তাদের অজান্তে জামায়াত শিবিরের পকেটে ঢুকে গেছে ।
শুধু বাংলাদেশেই নয় সরকারি চাকুরীতে কোটা ব্যবস্থা অনেক দেশেই আছে এমন কী যুক্তরাষ্ট্র বা জাতি সংঘেও । সে বিষয়ে পরে আসছি । চাকুরিতে এই কোটা বাংলাদেশের কোন নতুন আবিষ্কার নয় । যারা সংবিধানের দোহায় দিয়ে এই কোটা পদ্ধতির বিলুপ্তি চান তারা হয়তো পুরো বিষয়টা সম্পর্কে এক ধরণের অজ্ঞতায় ভুগেন অথবা জেনেও ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের জন্য বড়শি ফেলেন । কোটা পদ্ধতিতে নানা ধরণের অসংগতি থাকতে পারে এবং এটি স্বীকার করতে আমার মোটেও অসুবিধা নেই যে কোটা পদ্ধতির কারণে অনেক সময় মেধাবী প্রার্থীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে বঞ্চিত হন । মেধা বিষয়টাও অবস্য আপেক্ষিক । জনপ্রশাসন পরীক্ষার সাথে বিভিন্ন সময়ে আমার সম্পৃক্ত থাকার সুযোগ হয়েছে । আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হচ্ছে এই ‘মেধাবীদের’ অনেকেই কেরানির চাকুরী পাওয়ার যোগ্যতাও রাখে না । মাঝে মধ্যে কিছু ভাল প্রার্থী অবশ্যই পাওয়া যায় । এখন সত্যিকার অর্থে মেধাবীরা জনপ্রশাসন অথবা শিক্ষকতায় আসছেন না এর ফলে উভয় ক্ষেত্রই মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে । আমার বক্তব্যের সাথে অনেকের দ্বিমত থাকতে পারে তারপরও এটিই সত্য । তারপর আছে অন্য সমস্যা । একজন প্রকৌশলী যিনি ক্যাডার সার্ভিসে পরীক্ষা দিয়ে সরকারের সড়ক ও জনপথ বিভাগে কর্মরত আছেন দ্বিতীয়বার তিনি পরীক্ষা দিয়ে পাশ করলেন এবং তার প্রথম চয়েস পুলিস সার্ভিস এবং দ্বিতীয়টা শুল্ক ও আবগারি । কেন বাবা তুমি তোমার পেশা পরিবর্তন করতে চাও? তার সোজা সাপ্টা উত্তর তার বন্ধুরা ওই দু’টি সার্ভিসে গিয়ে বেশ উন্নতি করেছে তাতে সে পেশা পরিবর্তনে উদ্ভুদ্ধ হয়েছে । আই কে গুজরাল তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী । একবার তিনি উত্তর ভারতের এক উন্নয়ন প্রকল্প উদ্ভোধন করতে গিয়েছেন । উদ্ভোধন শেষে তিনি প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সাথে মতবিনিময় করতে বসলেন । সবাই সচিব বা সমপর্যায়ের কর্মকর্তা । পরিচয় পর্বে জানা গেল তাদের মধ্যে একাধিক ব্যক্তি আছেন যাদের পড়া লেখা হয় চিকিৎসা শাস্ত্রে অথবা প্রকৌশল বিদ্যায় । প্রধানমন্ত্রী তাদের পেশা পরিবর্তনের হেতু জানতে চাইলেন । তাদের তাৎক্ষণিক উত্তর এই দেশে (ভারতে) চিকিৎসা করা বা একটা সেতু বানানোর চেয়ে তার উদ্ভোধন করাটা অনেক বেশী সম্মানের । সব প্রকল্পতো আর প্রধানমন্ত্রী উদ্ভোধন করতে আসবেন না তখন আমাদের ডাক পরে দুই একটি প্রকল্প উদ্ভোধনের । একজন সরকারি কলেজের বিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষক । তিন বছর চাকুরী হয়েছে তার। তিনি তার পেশা পরিবর্তনের শেষ সুযোগটা নিলেন । প্রথম চয়েস যথারীতি পুলিশ তারপর প্রশাসন । পেশা পরিবর্তনের কারণ জানতে চাইলে বলেন মাষ্টারিতে তেমন সম্মান নেই । কেউ মেয়ে বিয়ে দিতে চায় না । এখন পর্যন্ত অবিবাহিত । এটি বাংলাদেশের জনপ্রশাসনের ‘মেধাবীদের’ অবস্থা । যে কোন শিক্ষকই তার কথা শুনে ব্যথিত হওয়ার কথা । এখনো বিশ্বাস করি শিক্ষকতা পেশার মতো এত সম্মানের পেশা দ্বিতীয় আর একটাও নেই । এখনো ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বছর আগে ছাত্র ছিল তেমন কোন ছাত্রের সাথে দেখা হলে রাস্তায় হোক আর ট্রেন স্টেশনে বিনা দ্বিধায় পদধূলি নিতে কার্পণ্য করেন না । এতে অনেক সময় কিছুটা বিব্রত হলেও গর্বে বুকটা ফুলে উঠে । আমার শিক্ষককেও আমি তেমন সম্মান জানানোর চেষ্টা করি ।
কোটার বিরুদ্ধে যারা আন্দোলন করছেন তারা শুধু মাত্র দুটি কোটার বিরুদ্ধে তোপ দাগছেন । প্রথমটি মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা এবং দ্বিতীয়টি নারীদের জন্য সংরক্ষিত কোটা । এর আগে আমি লিখেছি মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ট না থাকলে আগামীতে যারা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করে অনেকের সাধের পাকিস্তানটাকে ভেঙ্গে দু’টুকরা করে দিল তাদের বিচার শুরু হবে । তার প্রথম আলামত মুক্তিযোদ্ধাদের দুই গালে তালে তালে জুতা মারতে চেয়ে শ্লোগান । বলা যেতে পারে ড্রেস রিহার্সেল শুরু হয়ে গেছে । দ্বিতীয় ক্ষোভটা নারীদের জন্য আসন সংরক্ষিত রাখার বিষয়টা । এরই মধ্যে মোটামুটি দেশের সচেতন মানুষ হেফাজতের আমীর আল্লামা শফি, যিনি ইদানিং তেতুল হুজুর নামে খ্যাতি অর্জন করেছেন তার মূল্যবান বয়ান শুনে থাকবেন । তিনি মেয়েদের বাড়ীর চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী থেকে ইসলাম নয় স্বামীর আসবাব পত্রের হেফাজত করতে বলেছেন এবং বছর না ঘুরতেই বাচ্চা পয়দা করার ফতোয়া জারি করেছেন কারণ দেশে উম্মত বাড়াতে হবে। বলেছেন গার্মেন্টস সহ যারা অন্যান্য জায়গায় চাকুরী করেন তারা তার ভাষায় ‘জেনা’ (ব্যাভিচার) করে টাকা পয়সা রোজগার করেন । মেয়েদের ক্লাস ফোর ফাইভ পর্যন্ত লেখা পড়া করলেই চলবে ওর বেশী পড়া লেখা করার কোন প্রয়োজন নেই কারণ ওইটুকু পড়া লেখা করলেই একজন মেয়ে তার স্বামীর টাকা পয়সার হিসাব পত্র রাখতে পরবেন । বুঝতে হবে এই আন্দোলনকারীদের মাঝে তেতুল হুজুরের কিছু মুরিদেরও অনুপ্রবেশ ঘটেছে ।
এখন আসি সংরক্ষনের বিষয়ে । প্রথমে প্রাথমিক পর্যায়ের পরীক্ষায় এই কোটা বা সংরক্ষণ বহাল করা নিংসন্দেহে অনুচিত । যারাই সরকারকে এই বুদ্ধিটা দিয়েছেন তাদের মতলবটা মোটেও ভাল ছিল না। বর্তমান সরকারের শেষ সময়ে এসে এই নালায়েকরাও ঘোলা পানিতে বর্শি ফেলেছেন এবং তারা হয়তো প্রধানমন্ত্রীর খুব কাছের মানুষ । যুক্তরাষ্ট্রে লিন্ডন বি জনসন যখন প্রেসিডেন্ট (১৯৬৩-৬৯) তখন তিনি কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য সরকারি চাকুরিতে কোটা প্রথা চালু করেছিলেন । পরবর্তীকালে যে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারি অনুদান পায় সে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও ভর্তির জন্য কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য কোটা পদ্ধতি বাধ্যতামূলক করেছিলেন । এই কোটা পদ্ধতির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে অনেক মামলা মোকদ্দমা হয়েছে কিন্তু কোটা পদ্ধতি শুধু বহালই থাকেনি বরং কোন কোন ক্ষেত্রে তা সম্প্রসারিত হয়েছে । কোন কোন রাজ্যে আমেরিকান ইন্ডিয়ানদের জন্য কোটা পদ্ধতি চালু আছে আবার যুদ্ধ ফেরত কেউ যদি সরকারি চাকুরিতে ঢুকতে চায় সে সব সময় অগ্রাধিকার পায় । জাতি সংঘের সব সদস্য দেশের জন্য কোটা সংরক্ষিত আছে । এখন পর্যন্ত জানা মতে বাংলাদেশ মেধাবীদের অভাবের কারণে বেশীর ভাগ কোটা পূরণ করতে পারেনি । পাশের দেশ ভারতে সেই দেশ ভাগের পর হতেই বিভিন্ন পশ্চাদপর জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারি চাকুরি এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোটা পদ্ধতি চালু আছে । ২০০৪ সালে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজিব গোস্বামী এই কোটা পদ্ধতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে গায়ে কেরোসিন দিয়ে প্রকাশ্যে দিনের বেলায় আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন তবে তখন সফল হন নি। কয়েকবছর পর তিনি ওই ক্ষত নিয়েই মারা যান । তাতেও অবস্থার কোন হের ফের হয়নি । সব মিলিয়ে ভারতে গড়ে ৪৯.৫ ভাগ চাকুরী কোটার মাধ্যম পূরণ করা হয় যার মধ্যে ১০ ভাগ হচ্ছে মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত । সেই দেশে মুসলমানদের পশ্চাদপর জনগোষ্ঠী মনে করা হয় কারণ তারা আধুনিক শিক্ষা দীক্ষায় অনেক পিছিয়ে পরেছে । বাংলাদেশে কোটার সুবিধা ভোগ করতে পারেন মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তানরা, আদিবাসী জনগোষ্ঠী, মহিলা এবং তার সাথে আছে বিভিন্ন জেলা কোটা । এই কোটা পদ্ধতির অবশ্যই সংস্কার করার যথেষ্ট সুযোগ আছে এবং সেই সংস্কারে সত্যিকার অর্থে মেধাকে লালন করার সুযোগ করে দিতে হবে এবং আবার সমাজে যারা সুবিধা বঞ্চিত তাদের স্বার্থও সংরক্ষণ করতে হবে তবে সকলের আগে দেশের জন্য যারা প্রাণ দিয়েছেন তাদের এবং তাদের পরিবারের সন্তানদের সম্মান অক্ষুন্ন রাখতে হবে । আজকের বাংলাদেশে যা কিছু প্রাপ্তি তা কিন্তু দেশের জন্য জান বাজি রেখে যারা একাত্তরে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল তাদের জন্য । তাদের যারা অসম্মান করেন হয়তো কিছুদিন পর তারা দাবি তুলবেন একাত্তরে যারা পাকিস্তানের হয়ে যুদ্ধ করেছিল তাদের সন্তানদের জন্যও কোটা প্রথা চালু করতে হবে । বর্তমানে পাকিস্তানে তাদের জন্য কিন্তু কোটা পদ্ধতি চালু আছে ।
লেখাটি শেষ করি কোটা পদ্ধতির উপর আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন একজন ব্যক্তির মন্তব্য দিয়ে । সৈয়দ আবুল মকসুদ আমাকে একবার বলেছেন তিনি বঙ্গবন্ধুর স্নেহের পাত্র ছিলেন । বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর অনেক অনুষ্ঠানে যথার্থভাবে তাঁকে সামনের কাতারে দেখা যায় । গণভবনের গণচায়ের দাওয়াতে আমাদের মতো নাদান বান্ধারা কখনো আমন্ত্রিত না হলেও মকসুদ ভাইকে সব সময় সেখানে উপস্থিত থাকতে দেখি । তাকে উপেক্ষা করা সম্ভব নয় কারণ তার পরিধেয় শ্বেতশুভ্র বস্ত্র । তিনি আমাদের গান্ধী । বন্ধু ওবায়দুল কাদের তাকে ঢাকার ভাঙ্গা রাস্তা মেরামতের কাজ দেখাতে ফ্ল্যাগওয়ালা গাড়ীতে নিয়ে ঘুরে বেড়ান । খুব সহজ সরল মানুষ এবং এ’কারণেই তিনি সহজে অন্যের কথায় বিভ্রান্ত হয়ে পরেন । তার বয়সে পরলে আমাদের অনেকেরই অবস্থা আরো খারাপ হতে পারে । ১২ জুলাই তারিখের দৈনিক সমকালে তিনি ‘সুযোগের সমতা চাই’ বলে কোটা পদ্ধতি নিয়ে একটি মন্তব্য প্রতিবেদন লিখেছেন । তার প্রতিবেদনের শেষে তিনি উল্লেখ করেছেন ‘যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক এফএফপি (ফান্ড ফর পীস) গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থ রাষ্ট্রের জরিপের ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে ৯ জুলাই । ১৭১ রাষ্ট্রের (আসলে ১৭৮টি) মধ্যে বাংলাদেশ ব্যর্থ রাষ্ট্রের তালিকায় ওপরেই স্থান পেয়েছে । কোটাপ্রথা অব্যাহত থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশ শীর্ষ ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবে ।’ মকসুদ ভাই বেয়াদপি নেবেন না আশা করি । বাংলাদেশে দুটি সংস্থা আছে যারা হরদম জনগণকে নানা ভাবে বোকা বানানোর চেষ্টায় বিরামহীন ভাবে কাজ করে যাচ্ছে । এদের অন্যতম হচ্ছে টিআইবি । এ নিয়ে অন্যত্রে আলোচনা করার ইচ্ছা রইল । আর আছে কিছু সংবাদ পত্র এবং ইলেক্ট্রনিকস্ মিডিয়া । বর্তমানে সকলের সম্মিলিত লক্ষ্য যে কোন ভাবে বর্তমান সরকারকে ফেলে দিতে হবে । সৈয়দ আবুল মকসুদকে জ্ঞান দানের ধৃষ্টতা আমার নেই । তিনি একটি পত্রিকা হতে ওই বিভ্রান্তিকর তথ্যটি পেয়েছেন । যুক্তরাষ্ট্রের এই এফএফপি বিশ্বের দেশগুলি দেশকে চারভাগে ভাগ করেছে এবং এর নাম দিয়েছে ব্যর্থ রাষ্ট্র সূচক (ঋধরষবফ ঝঃধঃব ওহফবী) । প্রতিবছর এই সময়ে তা তারা প্রকাশ করে । তাদের চারটি ভাগ । প্রথম ১ হতে ২০ রাষ্ট্র, সংকটাপন্ন (পৎরঃরপধষ), দ্বিতীয় ২১ হতে ৩৯, বিপদে (রহ ফধহমবৎ), তৃতীয়ত ৪০ হতে ৫৯, মাঝামাঝি (নড়ৎফবৎষরহব), এবং সর্বশেষ বাকীরা স্থিতিশীল এবং খুবই স্থিতিশীল (ংঃধনষব ধহফ সড়ংঃ ংঃধনষব) । কোথায় ছিল বাংলাদেশ ২০১২ এর আগে? ২০১০ এ ছিল ২৪তম অবস্থানে আর ২০১১ সনে ২৫তম । ২০১২ সালে তার উন্নতি হয়ে পৌঁছেছে ২৯তমে । এবং সর্বশেষ ২০১৩ সালের সূচকে বাংলাদেশে তার আগের বছরের অবস্থান ধরে রাখতে পেরেছ । সাথে আছে মিশর, শ্রীলংকা, নেপাল, উত্তর কোরিয়া, কেনিয়া । সব চেয়ে ভাল অবস্থানে আছে ফিনল্যান্ড, আর যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ১৫৯তম, জাপান ১৫৬ আর সৌদি আরব ১০২ । ১ হতে ১৭৮ সকলে কিন্তু ব্যর্থ রাষ্ট্রেরে তালিকায় । শুধু সূচকে তাদের অবস্থান নির্ধারণ করা আছে । শুনতে অনেকের খারাপ লাগলেও এই সরকারের আমলেই বাংলাদেলের এই উন্নতিটুকু হয়েছে যা সরকার কখনো জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারেনি কারণ সরকার নিজের ঢোল নিজে পেটানোর দর্শনে বিশ্বাস করে না কারণ সরকারে নীতি নির্ধারণ যারা করেন তারা বিদ্যাসাগরের তেমন ভক্ত নন । আর এই কারণেই জনগণ টিআইবি’র মতো প্রতিষ্ঠানের বক্তব্যকে অনেক বেশি বিশ্বাস করেন । আমার সহকর্মী ডঃ বিশ্বাসের মতে টিআইবিকে এত গুরুত্ব দেয়ার কারণ হচ্ছে বাংলাদেশে কাকের চেয়ে গন্ডমূর্খের সংখ্যা কয়েক গুণ বেশী । জানতে চাই কী ভাবে সে এটা বের করলো? বলে বিশ্বাস না হয় গুনে দেখতে পার । বলি তাতো অসম্ভব । তখন সে মোল্লা দোপেয়াজার গল্প শোনায় । মোল্লা দোপেয়াজা মুগল সম্রাট আকবরের একজন উপদেষ্টা ছিলেন বলে জানা যায় । বাদশাহ নামদার একদিন মোল্লার কাছে জানতে চান দিল্লিতে কাকের সংখ্যা কত ? মোল্লা একটু চিন্তা করে বলেন নব্বই লক্ষ নব্বই হাজার নয়শত নয়টি । বাদশা অবাক হয়ে মোল্লার কাছে জানতে চান তিনি কী ভাবে এই সংখ্যায় উপনিত হলেন ? মোল্লার উত্তর হুজুর গোস্তাকি মাফ করবেন। বিশ্বাস না হয় আপনি নিজে গুনে দেখতে পারেন । বেশী হলে বুঝবেন বাড়তি কাকগুলি দিল্লিতে আত্মীয়স্বজনদের কাছে বেড়াতে এসেছে আর কম হলে বুঝতে হবে এই শহরের কিছু কাক অন্য শহরে বেড়াতে গিয়েছে । ডঃ বিশ্বাস বলেন তার বক্তব্যের সত্যতা যাঁচাইয়ের জন্য প্রথমে যেন আমি কাক গোনা শুরু করি । পরে না হয় গ- মূর্খদের গোনা যাবে । শ্রদ্ধাভাজন সৈয়দ আবুল মকসুদকে বলি সকলে যতই চেষ্টা করুক কোটার জন্য বাংলাদেশকে কখনো ব্যর্থ রাষ্ট্রের শীর্ষ স্থানে পাবেন না। পাবেন ওই তেতুল হুজুর আর তাকে যারা নিঃশর্ত সমর্থন দেন তাদের কারণে। পারলে তাদের বিরুদ্ধে দু’কথা লিখেন জাতি উপকৃত হবে। প্রধানমন্ত্রী হতে সাধারণ মানুষ আপনাদের খুব সম্মান করেন।

লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। জুলাই ১৩, ২১০৩

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ