|
তোবার দেলোয়ারের উচিৎ ‘তওবা’ করা
প্রফেসর আবদুল মান্নান
একজন ক্ষমতাধর তথা অবার্চীন ব্যক্তির জন্য বাংলাদেশের অন্যতম রপ্তানি খাত
তৈরী পোষাক শিল্প আবারো দেশে এবং দেশের বাইরে সংবাদ পত্রের শিরোনাম হয়েছে ।
ব্যক্তিটি সকলের পরিচিত তাজরীন ফ্যাশনস’র মালিক দেলোয়ার হোসেন । এটি তোবা
গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান । ২০১২ সালে তাজরীন ফ্যাশনে আগুন লেগে ১১২ জন
হতভাগা গার্মেন্টস শ্রমিক নির্মম ভাবে প্রাণ হারিয়েছিলেন এবং এর ফলে
বাংলাদেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই রপ্তানি খাতটি মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে
পরে । সেই বিপর্যয় কাটিয়ে উঠার আগেই কিছু দন পওে ঘটে যায় রানা প্লাজা
দূর্ঘটনা যার ফলে পুরো খাতটাই ভয়াবহ সংকটে পরে । এই দূর্ঘটনায় রানা প্লাজার
নীচে চাপা পড়ে প্রায় এগারশত শ্রমিক মৃত্যুবরণ করেন । এই ফাঁকে মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা স্থগিত করে দেয় । বাংলাদেশের তৈরী
পোষাক খাত জিএসপি সুবিধা তেমন ভোগ না করলেও অন্যান্য পণ্যের রপ্তানি এই
সুবিধা বাতিলের মূল্য দেয়া শুরু করে । বাংলাদেশের তৈরী পোষাক রপ্তানির
বৃহত্তম বাজার ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন জিএসপি সুবিধা বাতিল না করলেও তারা নানা
ধরণের শর্ত আরোপ করা শুরু করে আর তাকে কেন্দ্র কওে নানাভাবে সুবিধা নিতে
শুরু করে ইইউর ক্রেতারা । সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয় বহির্বিশ্বে
বাংলাদেশের সুনাম । এর সুবিধা ভোগ করে ভারত সহ অন্যান্য দেশ সমূহ । তাজরীন
গার্মেন্টস সরাসরি রপ্তানি করলেও দেলোয়ারের মালিকানাধীন ঢাকার বাড্ডায়
অবস্থিত বর্তমান কারখানাটি যাকে নিয়ে এত তুলকালাম সেটি সাবকন্ট্রাক্টের কাজ
করতো অর্থাৎ অন্যদের জন্য পোষাক তৈরী করতো । তাজরীন ফ্যাশনস এর ভয়াবহ
দূর্ঘটনার পর দেলোয়ার হোসেনকে কোন প্রকারের আইনগত অসুবিধায় পরতে হয় নি বা
থানা আদালতে দৌড় ঝাঁপ করতে হয় নি কারণ তিনি বেশ ক্ষমতাধর । দিতে হয়নি কোন
পরিবারকে আইন অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ । অভিযোগ আছে তাকে অনৈতিক ভাবে আশ্রয়
প্রশ্রয় দিয়েছে পোষাক কারখানা মালিকদের সংগঠন বিজেএমইএ । অথচ এই একজন লোকের
কারণেই পুরো খাত নানা ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে । গত ৯ই ফেব্রুয়ারি দেলোয়ার
পুরানো মামলায় হাইকোর্টে জামিন নিতে গেলে আদালত তাকে জেল হাজতে পাঠায় । সে
থেকে দেলোয়ার জেল হাজতে আছেন এবং অপেক্ষায় থাকেন এক সময় সরকার আর শ্রমিকদের
জিম্মি করে তিনি জেল হাজত হতে বের হয়ে আসবেন । অনেকের ধারণা তার এই কৌশল
অবলম্বনে তাকে ইন্ধন যুগিয়েছেন বিজেএমইএ’র এক শ্রেণীর নেতা ও তার পরিবারের
সদস্যরা । সব শেষে তিনি তার এই অপকৌশলে সফলও হন । বর্তমানে দেলোয়ার একজন
মুক্ত মানুষ । যে কারখানার শ্রমিকরা দীর্ঘ তিন মাস বেতন ভাতা বা ঈদ বোনাস
না পেয়ে রাস্তায় নেমে এসেছেন সেই তোবা ফ্যাশনস এর শ্রমিক সংখ্যা মাত্র দেড়
হাজার এবং তাদের বকেয়া পাওনা মাত্র সাড়ে চার কোটি টাকা । অথচ এই কারখানা হতে
গত ছয় মাসে ৩৯ কোটি টাকার পোষাক রপ্তানি হয়েছে । কারখানার ব্যবস্থাপনায়
নিয়োজিত ব্যক্তিরা বলেছেন তারা শ্রমিকদের বেতন ভাতা দিতে পারেন নি কারণ
মালিক জেল হাজতে এবং তার অবর্তমানে অন্য কেউ চেক সই করতে পারেন না এবং
ব্যাংকও কোন প্রকারের ঋণ দিতে রাজি নয় । বিষয়টি সম্পূর্ণ অসত্য কারণ এই
কারখানা হতে যারাই পোষাক তৈরী করিয়েছে তারা সকলেই আগাম অর্থ পরিশোধ করেছেন
এবং কারখানার শ্রমিকদের বেতন ভাতা বাদে অন্যান্য সকল প্রকারের খরচপাতি ঠিকই
চলেছে । কোন কারখানার মালিক অনুপস্থিত থাকলে অথবা কারাগারে থাকলে অথবা চেক
সই করতে কোন কারণে অক্ষম হলে সেই কারখানার বেতন ভাতা বন্ধ হওয়ার কোন নজির
নেই ।
বাংলাদেশের একটি প্রাচীন দৈনিক পত্রিকায় পারিবারিক কোন্দলের কারণে প্রায় এক
যুগ সকল প্রকারের ব্যাংক লেনদেন বন্ধ ছিল কারণ চেকে যৌথ স্বাক্ষরের প্রয়োজন
ছিল আর যারা এই স্বাক্ষরের জন্য ক্ষমতা প্রাপ্ত তাদের মধ্যে চরম বৈরী
সম্পর্কের কারণে এটি হয়েছিল । সেই পত্রিকার অফিসে খুন খারাবিও হয়েছে । সেই
পত্রিকার মাসিক বেতন ভাতা তোবা ফ্যাসনস হতে অনেক বেশী ছিল কিন্তু কর্মরত
সাংবাদিক বা শ্রমিকদের বেতন ভাতার জন্য কখনো রাস্তায় নেমে আসতে হয়নি কারণ
ব্যবস্থাপনা বিকল্প ব্যবস্থা করে রেখেছিল । এটাই প্রচলিত রেওয়াজ বা নিয়ম ।
একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সব সময় চলমান স্বত্বা। মালিক অনুপস্থিত বলে তার
কার্যক্রম যদি বন্ধ করে দিতে হয় তা হলে তেমন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে স্থায়ীভাবে
বন্ধ করে দিলেই ভাল কারণ তখন এত সব হাঙ্গামা হবে না । বিজেএমইএ তৈরী পোষাক
মালিকদের খুবই ক্ষমতাধর সংগঠন । কোন কারখানায় কোন প্রকারের দূর্ঘটনা ঘটলে
দেখা যায় তারা সব সময় তাদের সদস্যদের পাশে এসে দাঁড়ায় । অথচ তারা যদি একটু
বাস্তববাদি হয়ে সাহস করে দোষীকে দোষী বলতো তা হলে এতে তাদেরই লাভ সব চেয়ে
বেশী হতো । তা না করার ফলে সুযোগটা গ্রহণ করে একশ্রেণীর অসাধু শ্রমিক নেতা
যাদের পেশাই হচ্ছে বিজেএমইএ’র অপরিণামদর্শী কর্মকান্ডের সুযোগ নিয়ে নিরীহ
শ্রমিকদের সরলতাকে পুঁজি করে অপরাজনীতিতে লিপ্ত হওয়া এবং নিজেদের স্বার্থ
হাসিল করে এই খাতের বারটা বাজিয়ে দেশের সর্বনাশ করা । বাংলাদেশের অন্য কোন
শিল্পাঞ্চলে জামায়াতের কোন শ্রমিক সংগঠন না থাকলেও ঢাকার আশুলিয়া, টঙ্গী,
সাভারে তাদের ইসলামী শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন বেশ সক্রিয় । সামান্যতম
অজুহাতেই তারা পোষাক শিল্পখাতকে অস্থির করে তুলতে তৎপর থাকে । অনেক সময়
গুজব ছড়িয়েও শুরু হয় ভাংচুর আর নৈরাজ্য । এতে শুধু তৈরী পোষাক শিল্পই
ক্ষতিগ্রস্থ হয় না এই অঞ্চলে অবস্থিত অন্যান্য শিল্প কারখানাও অন্তর্ঘাত
মূলক কর্মকান্ডের শিকার হয় । তৈরী পোষাক শিল্পের খোঁজ খবর রাখেন আর শ্রমিক
নেত্রী মোশারেফা মিশুকে চেনেন না তা হতে পারে না । যেখানেই এই শিল্পে
অশান্তির সম্ভাবনা দেখা দেয় অথবা অশান্তি সৃষ্টি হয় মিশু সেখানে সকলের আগে
হাজির হন । তার বিরুদ্ধে মালিকদের অনেক অভিযোগ । মিশু বিদেশীদের স্বার্থে
এই শিল্পকে ধ্বংস করার জন্য কাজ করেন । এই যাবত এই অভিযোগের তেমন কোন
প্রমাণ মিলেনি । তবে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন ও মিডিয়ার কাছে তিনি বেশ
পরিচিত । তোবা ফ্যাশনস নিয়ে সম্প্রতি যে অশান্তি সৃষ্টি হয়েছে সেখানে
অবধারিত ভাবে মিশু উপস্থিত ছিলেন এবং অনশনরত শ্রমিকদের সাথে একাত্মতা
প্রকাশ করে তাদের সাথে অনশনও করছেন । তবে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে তিনি অনশনরত
অবস্থায় একজন জার্মান সাংবাদিক থমাসকে গত ৬ই আগস্ট এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকার
দিয়েছেন । সেই সাক্ষাৎকারে মিশু থমাসকে তাদের চলমান আন্দোলন সম্পর্কে লিখতে
অনুরোধ করে বলেন তিনি যেন এই আন্দোলন সম্পর্কে ইউরোপে ও আমেরিকায় প্রচারের
ব্যবস্থা করেন । তিনি থমাসকে আরো কি কি লিখতে হবে তাও অনুরোধ করেন । তাঁর
এই সাক্ষাৎকর বর্তমানে ইউ-টিউবে পাওয়া যায় । তোবা গ্রুপের সমস্যা নিশ্চয়
কেউ সমর্থন করে না তার অর্থ এই নয় যে এই গুরুত্বপূর্ণ খাতটিকে ক্ষতিগ্রস্থ
করার জন্য একজন শ্রমিক নেতা অন্য আরেকটি দেশের একজন সাংবাদিককে অনুরোধ
করবেন । থমাস মিশুকে অনুরোধ করেন জার্মানির কোন কোন কোম্পানির পোষাক তোবায়
ফ্যাসনসে তৈরী হতো তার নাম যেন ই-মেইলের মাধ্যমে তাকে পাঠানো হয় । মিশু এই
প্রস্তাবে রাজি হন । মিশুর এই ধরণের বক্তব্যে বা অনুরোধে অথবা অবস্থানে আর
যাই থাকুক দেশপ্রেম ছিল না । এবার ঈদের আগে গুটিকয় গার্মেন্টস কারখানা ছাড়া
সব গুলিই আগাম বেতন ভাতা বোনাস দিয়েছে । সেই ব্যাপারে মিশুদের কখনো তেমন
কোন কথা বলতে শোনা যায় না । এই সব কারণেই সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে
মিশুরা প্রধানতঃ কাদের স্বার্থ রক্ষা করেন ?
তৈরী পোষাক শিল্পে শুধু মিশুরা নন দেলোয়াররাও আছেন যাদের কারণে এই শিল্প
অনেক বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয় । দেলোয়ারদের কারণে মিশুদের জন্ম হয় । দেলোয়ারদের
উচিৎ তাদের কারণে এই শিল্পের যারাই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন তাদের কাছে গিয়ে তওবা
করা এবং ক্ষমা চাওয়া । আর তা যদি সম্ভব না হয় তা হলে এই শিল্প হতে সরে গিয়ে
অন্য কোন ব্যবসায় হিজরত করা । এতে দেশেরতো বটেই এই শিল্পেরই লাভ । আর
বিজেএমইএ সব অন্যায়ে মালিকদের রক্ষা করার জন্য তাদের পাশে না দাঁড়ালে এতে
শেষতক তাদেরই লাভ । এই প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকতে হলে প্রত্যেকটা
পদক্ষেপই সুচিন্তিত ভাবে ফেলতে হবে । বুঝতে হবে বাংলাদশের এই গুরুত্বপূর্ণ
খাতটিকে ধ্বংস করার জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ভাবে নানা মুখী তৎপরতা চলছে ।
সেই তৎপরাতা মোকাবেলা করার প্রধান দায়িত্ব মালিকদের। সরকার শুধু সহায়ক
ভূমিকা পালন করতে পারে।
লেখক: সবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় । আগস্ট ৯, ২০১৪ ।
WARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
[প্রথমপাতা] |
লেখকের আগের লেখাঃ
[......লেখক আর্কাইভ]
|