প্রথমপাতা  

সাম্প্রতিক সংবাদ 

 স্বদেশ

আন্তর্জাতিক

বাংলাদেশ কমিউনিটি

লাইফ স্টাইল

এক্সক্লুসিভ

বিনোদন

স্বাস্থ্য

বর্তমানের কথামালা

 শিল্প-সাহিত্য

 প্রবাসপঞ্জী 

আর্কাইভ

যোগাযোগ

@

@

@

@

@

@

বাংলাদেশ হতে ভালবাসা নিয়ে 

@


প্রফেসর আবদুল মান্নান

বাইশ ঘন্টার এক ঝটিকা সফর শেষে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে বাংলাদেশ ছেড়ে গেলেন রোববার । ১৪ বছরের মধ্যে এটি কোন জাপানি প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর । শেষবার ২০০০ সালে জাপানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইয়োশিরো মোরি বাংলাদেশ সফর করেন । তখনো বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ২০১৪ সালেও তিনি স্বপদে বহাল আছেন । জাপান বাংলাদেশের বৃহত্তম উন্নয়ন সহযোগি দেশ । গত চল্লিশ বছরে বাংলাদেশকে জাপান আনুমানিক ১২ বিলিয়ন ডলার আর্থিক সহায়তা দিয়েছে । যুদ্ধবিধ্বস্থ বাংলাদেশকে পূনঃগঠনের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের পর যে কয়েকটি দেশ সাহায্য নিয়ে প্রথমে এগিয়ে এসেছিল তার মধ্যে জাপান অন্যতম । ১৯৭৩ সালের ১৭ই অক্টোবর এক সপ্তাহের সফরে প্রথম বারের মতো স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জাপান সফর করেন । সেই সফরে একাধিক দ্বিপাক্ষিক চুক্তি ও সম্মতি পত্র স্বাক্ষর হয়েছিল যার মধ্যে অন্যতম ছিল যমুনা নদীর উপর বহুমুখী সেতু নির্মাণের অর্থনৈতিক ও কারিগরি সম্ভাব্যতা যাচাইয় । সেই সফরের সময় বঙ্গবন্ধু টোকিওfর জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন । স্বাক্ষর করেছিলেন তাদের অতিথি বইfএ । গত ২৮ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একই প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করতে গেলে তাঁকে তাঁর পিতার সেই eজয় বাংলাf লেখা সম্বলিত স্বাক্ষরটি দেখালে তিনি আবেগে আপ্লুত হয়ে পরেন । সেই আনন্দঘন মূহূর্তে আমার সুযোগ হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর সফর সঙ্গী হিসেবে সেখানে উপস্থিত থাকার । ২৮ তারিখের সংবাদ সম্মেলনে একজন জাপানি সাংবাদিক প্রশ্ন করেন ২০১৬-১৭ মেয়াদে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্য নির্ধারিত অস্থায়ী আসনটি বাংলাদেশ জাপানের সমর্থনে তাদের প্রার্থীতা প্রত্যাহার করবে কী না । প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার কোন সরাসরি উত্তর না দিয়ে মুচকি হেসে বলেন সেটি তিনি দেশে গিয়ে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিবেন এবং জাপানের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে এলে সেখানে তাঁকে হয়তো একটা সারপ্রাইজ দেবেন । বাংলাদেশ এর আগে ১৯৭৯-৮০ ও ১৯৯৯-২০০০ সালে অস্থায়ী সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিল এবং শেষের বার নির্বাচনে বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্ধী ছিল জাপান । তখনো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শেখ হাসিনা । জাতিসংঘে বাংলাদেশের সক্ষমতা সম্পর্কে জাপান পুরো মাত্রায় ওয়াকিবহাল এবং এবারও দুfদেশের মধ্যে প্রতিদ্বন্ধিতা হলে ফলাফল ভিন্ন কিছু হওয়ার সম্ভাবনা কম ছিল । বাংলাদেশ বিশ্বাস করেছে জাতিসংঘের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্ষদের আলংকারিক সদস্য হওয়ার চেয়ে জাপানের মতো বিশ্বের তৃতীয় অর্থনৈতিক পরাশক্তির সাথে সহযোগিতার বন্ধনটাকে আরো মজবুত করা দেশের জন্য অনেক বেশী লাভজনক । সেদিন যেতে যেতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানতে চেয়েছিলাম আসলে বাংলাদেশ কী জাপানের পক্ষে নিজের প্রার্থীতা প্রত্যাহার করবে ? তিনি কোন উত্তর না দিয়ে একটু মুচকি হেসেছিলেন । নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্যদের খুব বেশী একটা ক্ষমতা থাকেনা কারণ কোন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ভোটাভুটি হলে তা পাঁচ বৃহৎ শক্তির যে কোন একটি ভেটো দিয়ে বাতিল করে দিতে পারে । নিরাপত্তা পরিষদে অস্থায়ী সদস্যের সংখ্যা দশ ।
অস্ট্রেলিয়া হতে আমার এক অনুজ প্রতিম সাংবাদিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মন্তব্য করেছে বিশ্বব্যাংকের অনুরোধে জাইকা পদ্মা সেতু হতে সরে গিয়েছিল আর শেখ হাসিনা জাপানের প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে নিরাপত্তা পরিষদের প্রার্থীতা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন । বেগম জিয়া কূটনৈতিক চালে শেখ হাসিনার সাথে পারবেন কেন ? তার মন্তব্যের গুরুত্ব আছে । অবশ্য বিএনপি বাংলাদেশের প্রার্থীতা প্রত্যাহারকে সমর্থন করে নি । বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা, আমাদের এককালের পররাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন চৌধুরী বলেছেন এটি একান্ত দলীয় সিদ্ধান্ত । তার মতে এমন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সকল রাজনৈতিক দলের সাথে পরামর্শ করার প্রয়োজন ছিল । এটি একটি নজিরবিহীন মন্তব্য কারণ এই সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্যই দেশে একটি সরকার থাকে । বর্তমান সরকারকে বিএনপি স্বীকার না করতে পারেন, সেটি তাদের বিষয় । তবে একজন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব যদি eউইন উইনf পরিস্থিতি না বুঝেন তা হলে তা দুঃখের বিষয় । মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের সমূদ্র সীমার নিষ্পত্তি হলে রাতের এক টিভি টকশোতে চারদলীয় জোট সরকারের আমলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোরশেদ খান মন্তব্য করেছিলেন যে বিষয় নিয়ে মিয়ানমারও সন্তুষ্ট সেটিতে বাংলাদেশের বিজয় কী ভাবে হলো বুঝা গেল না । eউইন-উইনf পরিস্থিতি শুধু শমসের মবিন বুঝেন না তা নয় অনেকেই বুঝেন না ।
শিনজো আবের এই ঝটিকা সফর হতে কী পেল বাংলাদেশ? শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক জাপান সফরের সময় শিনজো আবে ঘোষণা করেছিলেন আগামী ৪-৫ বছরে জাপান বাংলাদেশকে ৬ বিলিয়ন অথবা ৬০০ কোটি মার্কিন ডলার আর্থিক সহায়তা দেবে । শিনজো আবে জাপান সরকারের এই অঙ্গিকারের কথা বাংলাদেশে এসে পুনরুল্লেখ করেছেন । এরই মধ্যে ১.২২ বিলিয়ন ডলার দেয়া হয়েছে । প্রধানমন্ত্রী আবের সাথে জাপানের ২২টি বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানের ১৫০ জন প্রতিনিধি এসেছিলেন । প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথেও বাংলাদেশের পঞ্চাশ জন ব্যবসায়ী প্রতিনিধি নিজ খরচে জাপান সফর করেছেন । উভয় সফরেরই অন্যতম উদ্দেশ্য দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক কী ভাবে বৃদ্ধি করা যায় তা নিয়ে আলাপ আলোচনা করা । দুfদেশের মধ্যে আন্তঃদেশীয় বাণিজ্য সব সময় জাপানের অনুকূলে থেকেছে । গত অর্থ বছর জাপানে বাংলাদেশের রফতানি ছিল মাত্র ৮৬২ মিলিয়ন ডলার আর যার বিপরীতে বাংলাদেশ জাপান হতে আমদানী করেছে ১.২৫ বিলিয়ন ডলার । তবে বাংলাদেশের আগ্রহ সব সময় রফতানি বৃদ্ধির চেয়ে বাংলাদেশে জাপানি পুঁজি আকৃষ্ট করা কারণ জাপানে জনসংখ্যা দ্রুত কমছে আর তাদের অভ্যন্তরীণ বাজার ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত হচ্ছে । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে জাপান বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ পণ্য উৎপাদনকারি দেশ ছিল । বর্তমানে জাপানে এই পণ্য উৎপাদনকারি প্রতিষ্ঠান গুলি আছে ঠিক তবে তাদের বেশীর ভাগ পণ্যই অন্যদেশে উৎপাদিত হয় কারণ জাপানের উৎপাদন খরচ দিয়ে সে দেশের পণ্য অন্য দেশে রফতানি করা প্রায় অসম্ভব । এখন জাপানের টয়োটা গাড়ী হতে শুরু করে মিৎসুভিসির পাওয়ার প্লান্ট তৈরি বা সংযোজন হয় চীন, ভারত, ব্রাজিল, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, মেক্সিকো, মালেয়শিয়া প্রভৃতি দেশে কারণ এই সব দেশে উৎপাদন ব্যয় অনেক কম । তবে চীন প্রতিযোগিতার একাধিক অস্ত্র হারাতে বসেছে কারণ চীনেও এখন শ্রমিকদের মজুরী ও পরিবহন ব্যায় বাড়তির দিকে যার ফলে চীন এখন ধীরে ধীরে কম মূল্যের পণ্যসামগ্রী, বিশেষ করে তৈরী পোষাক ও অন্যান্য ভোগ্য পণ্য প্রস্তুত বন্ধ করে দিচ্ছে । চীন তাদের দেশের নাগরিকদের জন্য পোষাক বাংলাদেশ হতেও আমদানী করছে ।
জাপানের অর্থনৈতিক চালিকা শক্তি তাদের উৎপাদন ব্যবস্থা বা ম্যানুফ্যাকচারিং যা আর নিজ দেশে সম্ভব হচ্ছে না । একটি সময় আসবে যখন চীন হতেও তারা তাদের কর্মকান্ড ধীরে ধীরে গুটিয়ে ফেলবে এবং পুঁজি নিয়ে অন্য কোন গন্তব্যস্থল খুঁজবে । বিশ্বায়নের যুগে পুঁজির কোন দেশ বা জাতীয়তা নেই । এই যে বাংলাদেশের তৈরী পোষাক শিল্প নিয়ে আমরা এত গর্ব করি দেখা যাবে আগামী দুfদশক পর এই খাতের আর বৃদ্ধি হচ্ছে না কারণ এই শিল্পে যারা পুঁজি বিনিয়োগ করেন তারা তাদের কলকারখানা বন্ধ করে অনত্র, হতে পারে তা মিয়ানমার বা ক্যাম্বোডিয়ায় হিজরত করেছেন । এমনটি ঘটেছিল মঙ্গোলিয়ায়। ২০০৪ সালে যখন বস্ত্র খাত হতে কোটা পদ্ধতি উঠে গেল তখন মঙ্গোলিয়ার বিশটি তৈরী পোষাক কারখানা রাতারাতি বন্ধ করে দিয়ে পুঁজি বিনিয়োগকারীরা চীনে চলে গিয়েছেন । বেকার হয়েছিল বিশ হাজার শ্রমিক । ধরে নিতে হবে বাংলাদেশের তৈরী পোষাক খাতের রমরমা অবস্থা চিরস্থায়ী নয় । আমাদের নিজেদের পুঁজি খুবই সীমিত । সুতরাং বাংলাদেশের প্রয়োজন ম্যানুফ্যাকচারিংfএ পুঁজি বিনিয়োগ, যা এখন খুবই নগণ্য কারণ এই খাতে পুঁজি বিনিয়োগ করলে তা তুলে আনতে সেবা খাতের চেয়ে অনেক বেশী সময় প্রয়োজন হয় । বাংলাদেশে যেটুকু বিদেশী পুঁজি আসছে তার সিংহ ভাগই সেবা খাতে । এই খাত কর্মসংস্থান করে যৎসামান্য । যেমন বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ টেলিকম কোম্পানি মাত্র চার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান করেছে । কিন্তু একটি গাড়ী সংযোজন কারখানা, বস্ত্রকল, পেট্রোকেমিক্যাল, জাহাজ নির্মাণ কারখানা, ঔষধ প্রস্তুতকারী কারখানা অথবা ইস্পাত কারখানা অনেক বেশী মানুষের কর্মসংস্থান করে যা ষোল কোটি মানুষের বাংলাদেশে প্রয়োজন এবং যা জাপানের পক্ষে এই দেশে করা সম্ভব । কিন্তু বাস্তবে তা হয় নি কারণ আমাদের সক্ষমতার অভাব । কথায় কথায় আমরা বলি আমাদের সস্তা শ্রম আছে । কিন্তু তাদের প্রশিক্ষণের কোন ব্যবস্থা না থাকাতে তাদের উৎপাদনশীলতা এই অঞ্চলে সর্বনিম্ন । বলি আমাদের আছে বন্দর । কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে নিয়মিত যে ভানুমোতির খেল হয় তা দেখে কেন ভিন দেশের কেউ এদেশে পুঁজি বিনিয়োগ করতে আসবে ? গ্যাসের অভাবে চট্টগ্রাম সহ দেশের অনেকগুলি কলকারখানা চালুর অপেক্ষায় আছে । চট্টগ্রামে গেলে মনে হয় এই শহরে বাংলাদেশ সরকারের কোন অস্তিত্ব নেই । এই শহরে সরকারের ভিতর সরকার তার ভিতরে আরো অনেক সরকার । কে যে আসল সরকার তা বুঝা মুস্কিল ।
শুধু জাপান নয় বাংলাদেশে আরো অনেক দেশীয় পুঁজি আসবে তবে তার জন্য চাই সক্ষমতা বৃদ্ধি । শুধু সস্তা শ্রম আর বন্দরের কথা বললে হবে না । প্রয়োজন সুশাসন, দূর্নীতি বন্ধ করা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা, দক্ষ জনশক্তি আর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা । ২০১৩ সালে দশম সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশে যে নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছিল তেমনটি হলে জাপান নয় ভূটানও বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আসবে না । প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে তাঁর সফর সঙ্গী হয়ে বুঝেছি কেন অনেকে বলেন তাঁর সাথে তাল মিলিয়ে কাজ করা দুরুহ । এমন কথা যদি তাঁর সরকারের অরো দশ কুড়ি জন সম্পর্কে বলা যেত তা হলে বাংলাদেশ যেত পারতো অনেক দূর । শুধু জাপান নয় সব দেশের সাথে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব অটুট থাকুক।

লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। সেপ্টেম্বর ৮, ২০১৪

@

@

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

@

[প্রথমপাতা]

@

@

@

লেখকের আগের লেখাঃ

[......লেখক আর্কাইভ]