[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

সাকাচৌ’র বিচারের রায়: পাপ বাপকেও ছাড়ে না

 

 

প্রফেসর আবদুল মান্নান

কথায় বলে পাপ বাপকেও ছাড়ে না । এই বাংলা প্রবাদটি আবার সত্য প্রমানিত হলো আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে দেয়া একাত্তরের যুদ্ধাপরাধি সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর (সাকাচৌ) মঙ্গলবার ফাঁসির আদেশ হওয়ায় । এই রায় প্রত্যাশিত ছিল এবং এই রায়ের জন্য আমাদের দীর্ঘ একচল্লিশ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে । একাত্তর সালে সারা চট্টগ্রামের মানুষ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী পরিবার আতঙ্কে ভুগেছে কারণ সে আর তার বাহিনী সারা চট্টগ্রাম , বিশেষ করে রাউজান, রাঙ্গুনিয়া আর গহিরা অঞ্চলে এবং চট্টগ্রাম শহরের সংখ্যালঘু অধ্যূশিত এলাকায় অগ্নি সংযোগ, গণহত্যা, ধর্ষণ, জোর পূর্বক ধর্মান্তরিতকরণ ইত্যাদি যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপারাধের সাথে জড়িত ছিল । তাদের শহরস্থ গুডস হিলের বাসভবনে খুলেছিলেন ভয়াবহ নির্যাতন কেন্দ্র এবং তা সাকাচৌ নিজেই পরিচলানা করতেন । মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে এসে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী দেশ থেকে পালিয়ে যান এবং বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর আবার বাংলাদেশে ফিরে আসেন । বঙ্গবন্ধু বিহীন বাংলাদেশে সাকাচৌ সব সময় নিজেকে নিরাপদ ভেবেছেন এবং কোন সময় ক্ষেপণ না করে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়েছেন। প্রথমে তার পিতার মুসলীম লীগ তারপর এনডিপি, পরে জাতীয় পার্টি এবং সব শেষে বিএনপি’র রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হয়েছেন । জাতীয় পার্টির মন্ত্রী এবং বিএনপিতে সাকাচৌ বেগম জিয়ার রাজনৈতিক উপদেষ্টা হয়েছেন । ক্ষমতার এত কাছাকাছি থাকার কারণে তিনি নিজেকে সব সময় আইনের উর্দ্ধে মনে করেছেন । শুধু তাই নয় তিনি সংসদে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার প্রতি অত্যন্ত অরুচিকর ভাষায় বক্তব্য রেখেছেন এবং এমন কী যে বেগম জিয়া তাকে রাজনৈতিক উপদেষ্টা বানিয়েছেন তাঁকে পর্যন্ত অশালিন ভাষায় অপমানিত করেছেন । আর জাতির দূর্ভাগ্য হচ্ছে সেই সাকাচৌকে বেগম জিয়া ওআইসিতে মহাসচিব পদে প্রতিদ্বন্ধিতা করার জন্য মনোনয়ন দিয়ে শুধু নিজেকেই অপমানিত করেননি পুরো জাতিকে অপমানিত করেছেন ।
সাকাচৌ ভুলে গিয়েছিলেন আইনের হাত অনেক দীর্ঘ এবং একটি সরকার যদি ইচ্ছা করে তা হলে অপরাধী যেই হোক না কেন তাকে আইনের সামনে দাঁড় করাতে পারে । সাকাচৌ’র ব্যাপারে তাই হয়েছে । যে দলটির নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে সেই আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসতে হয়েছে এবং একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা করতে হয়েছে । এই কাজটি মোটেও সহজ ছিল না কারন দীর্ঘ একচল্লিশ বছরে এই অপরাধীদের শিকড় অনেক গভীরে গিয়েছে এবং তাদের অনেক আন্তর্জাতিক মুরুব্বি সৃষ্টি হয়েছে । সাকাচৌ’র বেলায় সরকারের আরো একটা অসুবিধা ছিল আর তা হচ্ছে তার পরিবারের সাথে বঙ্গবন্ধু পরিবারের একটি সম্পর্ক সেই বিভাগপূর্ব সময় হতে ছিল । সাকার পিতা ফজলুল কাদের চৌধুরী আর বঙ্গবন্ধু কোলকাতায় এক সাথে রাজনীতি করেছেন । সেই কারনেই তার হয়তো একটি ধারণা ছিল বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা তার বিচারের ক্ষেত্রে কিছুটা নমনীয় হবেন । কিন্তু এই ব্যাপারে শেখ হাসিনা অত্যন্ত দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছেন এবং প্রমান করেছেন তার পিতার মতো তিনিও প্রয়োজনে সব ধরণের ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত । এই জন্য তাঁকে অভিনন্দন ।
সাকার বিরুদ্ধে মোট তেইশটি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল । এর মধ্যে নয়টি অভিযোগ প্রমানিত হয়েছে । আটটি প্রমানিত হয়নি এবং রাষ্ট্রপক্ষ ছয়টি অভিযোগের বিষয়ে সাক্ষী হাজির করতে না পারায় সেগুলি আদালত আলোচনায় নেন নি । এটি স্বাভাবিক । যে গুলি প্রমানিত হয়নি বা আলোচনায় আসেনি তার চেয়েও গুরুত্ব পূর্ণ বিষয় হচ্ছে দীর্ঘ একচল্লিশ বছর পর প্রসিকিউশন নয়টি অপরাধ প্রমান করতে পেরেছেন । এটি তাদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। সেই চ্যালেঞ্জে তারা দক্ষতার সাথে মোকাবেলা করেছেন । তারজন্য তাঁদের অভিন্দন । যে সকল সাক্ষী সাক্ষ্য দিতে এসেছেন তারা নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন কারণ তাদের অনেক ভয় ভীতি দেখানো হয়েছিল যাতে তারা সাক্ষ্য দিতে না আসেন । তারা ভয়কে জয় করেছেন । জাতি তাদের কাছে চীর কৃতজ্ঞ থাকবে ।
মানবতা বিরোধী আর যুদ্ধাপরাধের বিচারের ব্যাপারে সব চেয়ে বেশী হতাশ করেছে দেশর অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি । বিএনপি দাবি করে তাদের দলটি মুক্তিযোদ্ধাদের দল । কিন্তু এই দলটি তার জন্ম লগ্ন হতেই একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের একট আশ্রস্থল হিসেবে গড়ে উঠেছে । তার সূত্র ধরেই সাকাচৌ আর আবদুল আলিমদের মতো ব্যক্তিদের এই দলে স্থান হয়েছে । শুধু তাই নয় তারা জামায়াতের মতো দেশের প্রধান সন্ত্রাসি দলের বর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ পৃষ্টপোষক । এই দলটি একাত্তরে যত প্রকারের যুদ্ধাপরাধ আর মানবতাবিরোধী অপরাধ হতে পারে তার সব গুলিই করেছে । বেগম জিয়া তাদের দলের এবং জোটের সকল সভায় বর্তমানে যে সকল অপরাধীর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে সাজা হচ্ছে তাদের মুক্তি দাবি করেন । অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়ে বিএনপি জামায়াতের মধ্যে বিলিন হওয়ার পথে । সাকাচৌর বিচারের রায়ের সাথে সাথে তার দলের সমর্থকরা ঢাকায় যানবাহনে অগ্নি সংযোগ শুরু করেছে আর চট্টগ্রামে এই রায়ের বিরুদ্ধে হরতালের ডাক দিয়েছে । এটির অর্থ চট্টগ্রামের মানুষকে চরম অপমান করা । চট্টগ্রামকে বলা হয় বিপ্লব তীর্থ । এই চট্টগ্রাম হতেই একাত্তর সালে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছিল । চট্টগ্রামই বাংলাদেশের একমাত্র জেলা যেখানে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরে ছাত্র শ্রমিক জনতা শুধু পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধই গড়ে তুলেনি রাস্তায় রাস্তায় তারা সশস্ত্র যুদ্ধ করেছে । সেই চট্টগ্রামে সাকাচৌ’র মতো একজন ঘৃন্য যুদ্ধাপরাধীর জন্য বিএনপির’র পক্ষে হরতাল আহ্বান করা হবে তা কিছুতেই সমীচীন নয় । এতে বিএনপি’র প্রাপ্তির বদলে ক্ষতিটাই বেশী । এই সত্যটা উপলব্দি করার মানুষের নিশ্চয় বিএনপিতে অভাব নেই । ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বিএনপি গত দু’বছর নানা ভাবে চেষ্টা করছে । তার অর্থ এই নয় যে যে কোন উপায়ে ক্ষমতায় যেতে হবে । তেমন যদি হয় সেই ক্ষমতা বেশী দিন স্থায়ি হয় না আর তার পরিণতি ভাল হয় না । সময় থাকতে এই সত্যটি উপলব্দি করতে পারলে ভাল ।
চট্টগ্রাম বাসীকে দীর্ঘ একচল্লিশ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে একাত্তরের রক্তের ঋণ শোধ করতে । সাকাচৌ’র বিচারের মধ্য দিয়ে সেই ঋণের কিছুটা হলেও শোধ হলো । তবে যতক্ষণ পর্যন্ত সাকাচৌ সহ সকল দ-প্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীদের রায় বাস্তবায়ন না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত এই রক্তের ঋণ পুরোটা শোধ হবে না । আশা করবো সরকার এই ব্যপারে দ্রুত ব্যবস্থা নেবেন এবং বিরোধী দল তথা বিএনপি সময় থাকতে বাস্তবতাটা উপলব্ধি করবে ।

লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় । অক্টোবর ১, ২০১৩

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ