[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

অপমানিত রাজনীতির কবির সভাস্থল

 

 

প্রফেসর আবদুল মান্নান


খুব যে কবিতা পড়ি তা বলা যাবে না । তবে জীবনে যে ক’টি কবিতা পড়েছি তার মধ্যে নির্মলেন্দু গুনের লেখা ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কী ভাবে আমাদের হলো’ কবিতাটা আমার পড়া শ্রেষ্ঠ কবিতা গুলির একটি । সেই অসাধারণ কবিতায় কবি ১৯৭১ এর ৭ই মার্চের সেই বিকেলের কথা বলেছিলেন যেই বিকেলে রাজনীতির কবি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তৎকালিন ঐতিহাসিক রমনা রেসকোর্স ময়দান, বর্তমান সোহরোওয়ার্দি উদ্যানে প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ জনতার সামনে কবির ভাষায় ‘গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর-কবিতাখানি: এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ।’ সেই পড়ন্ত বিকেলে যখন রাজনীতির কবি তাঁর অমর-কবিতাখানি শোনাচ্ছিলেন তখন আমার সুযোগ হয়েছিল সেই ময়দানে উপস্থিত থেকে সেই লক্ষ কণ্ঠের সাথে আওয়াজ তোলা-‘জয় বাংলা’ । সেই ময়দানের সাথে আমার প্রজন্মের একটি আত্মার যোগ আছে আর বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে আছে একটি অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক । এই ময়দানেই ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান জেনারেল নিয়াজী মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ডের প্রধান, জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেছিলেন । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রকাশ্যে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করার আর দ্বিতীয় কোন নজির নেই । স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান কারাগার হতে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী এই একই স্থানে তাঁর প্রথম জনসভায় ভাষণ দিয়েছিলেন । জিয়া ক্ষমতা দখল করে ইতিহাস হতে এই স্থানটির গুরুত্ব মুছে দিতে সেখানে স্থাপন করেছিলেন শিশু পার্ক । সদ্য প্রয়াত সাংবাদিক গিয়াস কামাল চৌধুরীর মতে তিনি তা করেছিলেন কারণ তিনি একজন হিন্দুর কাছে একজন মুসলমান আত্মসমর্পণ করেছিলেন তার কোন চিহ্ন রাখতে চান নি । ১৯৯৬ সনে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করে ঐতিহাসিক স্থানটির একটু দূরে নির্মাণ কাজ শুরু করেছিলেন স্বাধীনতার স্মৃতি স্তম্ভের । ২০০১ সালে বেগম জিয়া ক্ষমতায় এসে সেই স্তম্ভের নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দিয়েছিলেন । ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা পুনরায় সরকার গঠন করে সেই নির্মাণ কাজ শেষ করেছেন ।
২০১৩ সালে ২৫ অক্টোবর আর এক পড়ন্ত বিকেলে সেই রমনার ময়দানে আর একটি সমাবেশ হয়েছিল তবে এবার সেই সমাবেশে শ্রোতা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আর একটি ভিন্ন প্রকৃতির দর্শক শ্রোতা আর বক্তৃতা করেছেন একজন বীর উত্তমের স্ত্রী, যিনি এই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন তিন বার, বেগম জিয়া । আর সামনে যারা উপস্থিত ছিলেন তারা আত্মসমর্পণকারী নিয়াজীর এদেশীয় বংশধর একাত্তরের পরাজিত শক্তি জামায়াত শিবিরের সদস্যরা । কাগজে কলমে সমাবেশটি ছিল মূলত বেগম জিয়া নেতৃত্বাধীন আঠার দলীয় জোটের । বিএনপি নেত্রীর ধারণা ছিল বর্তমান সরকারের মেয়াদ ২৪ অক্টোবর শেষ হয়ে যাবে এবং সেই বিশ্বাসকে ধরে তাঁর দলের একাধিক নেতা আগাম ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলেন ২৫ তারিখ হতে দেশ চলবে বেগম জিয়ার হুকুমে এবং তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বেগম জিয়া তাঁর হুকুম এই সভা হতেই ঘোষণা করবেন । সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী অন্তর্ভূক্তির মাধ্যমে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে ত্রয়োদশ সংশোধনীর আলোকে সংবিধানে গৃহীত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়ে যাওয়ার পর হতে বেগম জিয়া আর তাঁর দল বলে আসছেন তারা পঞ্চদশ সংশোধনী মানেন না সুতরাং আগামী নির্বাচন পূর্বের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই হতে হবে, না হলে তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন না । তবে তা কী ভাবে সম্ভব সেই সম্পর্কে তারা কিছুই বলেন না যদিও তারা বুঝেন সংবিধানের বাইরে গিয়ে কিছু করা সম্ভব নয় এমন কী পূর্বের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাও ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয় কারণ আদালতের রায়ে পরিষ্কার বলা হয়েছে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একমুহুর্তের জন্যও রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা অনির্বাচিত কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হাতে ছেড়ে দেয়া উচিৎ নয় । রায়ে উচ্চ আদালত এই পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার শুধু মাত্র জনগণের নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্যগণ দ্বারা গঠিত হইতে পারে, কারণ, জনগণের সার্বভৌমত্ব ও ক্ষমতায়ন, গণতন্ত্র, প্রজাতান্ত্রিকতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংবিধানের নধংরপ ংঃৎঁপঃঁৎব (মৌলিক কাঠামো) এবং এই রায়ে উক্ত বিষয়গুলির উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হইয়াছে ।’ কিন্তু মুস্কিল হচ্ছে বেগম জিয়া এই সবের কোনা কিছুই মানতে রাজি নন বরং তিনি চান সামনের নির্বাচন তার মতো করেই হতে হবে । এই দাবিতে তিনি এবং তার জোট গত প্রায় দুইবছর ধরে আন্দোলন করে আসছেন এবং এই আন্দোলনের ফলে দেশে প্রচুর জান মালের ক্ষতি হয়েছে এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর বারজন সদস্য নিহত হয়েছেন যা স্বাধীন বাংলাদেশে একটি নজিরবিহীন ঘটনা ।
বেগম জিয়া তার মতো করে যে নির্বাচনের দাবি করে আসছেন তাঁর সেই আন্দোলনের মূল চালিকা শক্তি যত না তার দলের নেতা কর্মীরা তার চেয়ে বেশী জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসীরা । বেগম জিয়া হয়তো তার আন্দোলনের অংশ হিসেবে একটি হরতাল ডাকেন কিন্তু জামায়াত-শিবিরের দূর্বৃত্তরা আগের দিন হতে যানবাহনে অগ্নি সংযোগ আর মানুষ পুড়িয়ে মেরে জনমনে আতংক সৃষ্টি করা শুরু করে । আসলে বিএনপি‘র ডাকা কোন কর্মসূচী সফল করার মতো তাদের সাংগঠনিক শক্তি নেই বললেই চলে । তারা মূলতঃ জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসের উপরই তাদের সকল কর্মসূচী সফল করতে নির্ভরশীল হয়ে পরে এবং জামায়াত-শিবিরও বিএনপি’র কাঁধে ভর করে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের সকল সুযোগ গ্রহণ করে । বলাবাহুল্য এই মুহুর্তে তাদের একটাই এজেন্ডা আর তা হচ্ছে একাত্তরে মানবতাবিরোধী আর যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত তাদের দলের সকল শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের মুক্তি এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল ভেঙ্গে দেয়া । সামনের নির্বাচন কার অধীনে হলো বা হলো না এতে তাদের কিছু আসে যায় না বরং এই মূহুর্তে তাদের দলই নিষিদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনার মুখোমুখি । আঠারো দল কখনো কোন স্থানে সভা ডাকলে তাদের মধ্যে মঞ্চ এবং মাঠ দখল করার একটা প্রতিযোগিতা থাকে এবং সেই প্রতিযোগিতা বাস্তবয়ন করতে তারা সকাল হতেই তৎপর থাকে । এ‘নিয়ে তাদের সাথে বিএনপি আর ছাত্রদলের নিয়মিত সংঘর্ষও হয় এবং এই সব সংঘর্ষে সব সময় জামায়াত-শিবিরই জয়ী হয় । আঠারো দলীয় জোটে আর যে সব দল আছে তারা মূলত ওয়ান ম্যান পার্টি এবং তাদের একমাত্র রাজনৈতিক দর্শন হচ্ছে চরম ভাবে আওয়ামী লীগ বিদ্বেষ ।
শুক্রবারের সমাবেশ কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর আঠারো দলীয় সমাবেশ থাকেনি তা বস্তুত পক্ষে হয়ে যায় জামায়াত শিবিরের একটি সমাবেশ যাতে বেগম জিয়া মূলত সভাপতিত্ব করেছেন । সকাল হতেই ঢাকার আশে পাশের এলাকা হতে জামায়াত শিবিরের সন্ত্রাসীরা সোহরোওয়ার্দী উদ্যানের জনসমাবেশ স্থলে অবস্থান নেয়া শুরু করে এবং তাদের হাতে যে সব ব্যানার ছিল তার সবগুলিতেই ছিল একাত্তরে মানবতাবিরোধী আর যুদ্ধাপরাধের দায়ে তাদের যে সকল নেতা দ-িত হয়েছেন তাদের মুক্তি দাবি করে ছবি যুক্ত ব্যানার আর সেই সব ব্যানারের কয়েকটি তারা স্বাধীনতা স্তম্ভের সীমানা প্রাচীরেও সেঁটে দিয়েছিলেন । তাদের ব্যানারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল বাতিল করার দাবিও করা হয় । বেগম জিয়া তাঁর বক্তৃতায় পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন তিনি ক্ষমতায় গেলে সকল রাজবন্দীদের (পড়ুন যুদ্ধাপরাধীদের) মুক্ত করে দেবেন এবং তিনি যত না পুলিশ হেফাজতে থাকা তাঁর দলের নেতা কর্মীদের মুক্তি দাবি করেছেন তার চেয়েও বেশী করেছেন জামায়াত-শিবিরের নেতা কর্মীদের মুক্তি দাবি। এই ঐতিহাসিক ময়দানে বেগম জিয়ার এই ধরণের সমাবেশ ছিল আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি চরম চপেটাঘাত । এতে যে কোন মুক্তিযোদ্ধাই শুধু ব্যথিত নয় চরমভাবে অপমানিত হবেন এবং মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ শহীদ অভিশাপ দেবেন । বেগম জিয়া তাঁর বক্তৃতায় বলেন আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যে যদি আলোচনা শুরু না হয় তা হলে রোবরার হতে টানা তিনদিনের হরতাল শুরু হবে ।
দেশের নানাজন চলমান সংকট নিরসনে বার বার বলছেন দুই নেত্রীর মধ্যে একটি সংলাপ শুরু হলে সংকট অনেকটা কেটে যাবে । শনিবার সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেগম জিয়াকে বহু প্রত্যাশিত ফোনটি করেছিলেন । দিনেও কথা বলার চেষ্টা করেছেন । সংযোগ সম্ভব হয়নি । সন্ধ্যায় দুই নেত্রী সাঁয়ত্রিশ মিনিট কথা বলেছেন । প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়াকে সোমবার গণভবনে আলোচনার সূত্রপাত ও নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন । অনুরোধ করেছেন জনস্বার্থে তিন দিনের হরতাল যেন প্রত্যাহার করা হয় । বেগম জিয়া তা সরাসরি প্রত্যাখান করে বলেছেন হরতাল প্রত্যাহার করা তার পক্ষে সম্ভব নয় কারণ এটি আঠারো দলের হরতাল যদিও তার ঘোষণাটি ছিল আলোচনার উদ্যোগ না নিলে হরতাল হবে । উদ্যোগতো নিলেন প্রধানমন্ত্রী লাভ কী হলো ? আসলে বিরোধী দলের নেত্রীর পক্ষে জামায়াতের অনুমোদন ছাড়া এক পাও নড়া সম্ভব নয় বলে মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে । এটি এখন পরিষ্কার যে তার উদ্দেশ্যে যে কোন উপায়ে ক্ষমতায় যাওয়া সংলাপ আলোচনা সব কিছুই হচ্ছে কথার কথা । তবে প্রধান মন্ত্রী বেগম জিয়াকে ফোন করে ঔদার্যেও পরিচয় দিয়েছেন তার জন্য তিনি মহিমান্বিত হয়েছেন ।

লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় । অক্টোবর ২৭, ২০১৩

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ

[......লেখক আর্কাইভ]