[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

ভারত-এক দেশ অনেক সরকার

 

 

প্রফেসর আবদুল মান্নান

ভারত একটি ব্যতিক্রমধর্মী দেশ কারণ এমন বৈপরীত্যে ভরপুর দেশ বিশ্বে অন্য কোথাও আছে বলে জানা যায় না । যেমন ধরুন ভাষা । সাংবিধানিক ভাবে ভারতের রাষ্ট্রভাষা একটি, হিন্দি, কিন্তু এই ভাষায় কথা বলে সে দেশের ৪১ ভাগ মানুষ । দক্ষিণ ভারতের মানুষ হিন্দি জানেনা বললেই চলে । দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে প্রচলিত আছে ইংরেজি । আবার রাজ্যগুলি ইচ্ছা করলে তাদের নিজস্ব ভাষাকে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ব্যবহার করতে পারে । সেদিক দিয়ে বিচার করলে এই মুহুর্তে ভারতে বাইশটি দাপ্তরিক ভাষা ব্যবহৃত হয় । এমন কী পূজা অর্চনাও বহুদা বিভক্ত । ক‘দিন পর শারদীয় দূর্গা উৎসব । যেখানে বাঙালি নেই সেখানে এই উৎসব অপরিচিত । ভারত একটি ফেডারেল রাষ্ট্র । রাষ্ট্রটি ২৮টি রাজ্য আর ছয়টি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে বিভক্ত । রাজধানী দিল্লীর আবার পৃথক সত্ত্বা । তারও একটি সরকার আছে, আছেন মূখ্য মন্ত্রী । সকলে দিল্লীবাসীর সরাসরি ভোটে নির্বাচিত । রাজ্যগুলি স্বায়ত্বশাসিত। আছে নিজস্ব আইনকানুন । অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত তারা নিজেরাই নিতে পারে কিন্তু কয়েকটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার এক্তিয়ার শুধুমাত্র কেন্দ্রের । এই গুলির মধ্যে আছে পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা আর অর্থনীতি । এই ধরণের ফেডারেল শাসন ব্যবস্থা চালু ছিল রোমান আর ওসমানিয় সাম্রাজ্যের আমলের ইউরোপে । তবে এটির একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে । যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে পঞ্চাশটি অঙ্গরাজ্যে বিভক্ত । এই সব অঙ্গরাজ্যের আবার নিজস্ব পতাকাও আছে । আছে রাজ্যের একটি নিজস্ব একটি পৃথক নাম, বা শ্লোগান । নিজস্ব আইন কানুনতো আছেই । এক রাজ্যে মৃত্যুদ- নিষিদ্ধ হলেও অন্য রাজ্যে তা আইনসিদ্ধ । কিন্তু কেন্দ্র যদি বিদেশ নীতি সম্পর্কে কোন সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে রাজ্যগুলির তা বিরোধিতা করার কোন ক্ষমতা নেই । যেমন এখন যদি ওবামা সাহেব বলেন ‘সিরিয়ায় সিরিয়ানরা সিরিয়ান মারছে। এখন আমরা সিরিয়ায় গিয়ে কিছু সিরিয়ান মেরে আসি যাতে কোন সিরিয়ান আর সিরিয়ানদের মারতে না পারে’। তখন কিন্তু টেক্সাসের রাজ্য সরকার বলতে পারবে না ‘আমাদের ছেলেরা সিরিয়ায় সিরিয়ান মারতে যাবে না ।’ কিন্তু ভারতবর্ষের বর্তমান অবস্থা দেখলে মনে হয় এমন একটি সিদ্ধান্ত সে দেশের একটি রাজ্য সরকার নিলেও নিতে পারে । তার প্রধান কারণ সম্ভবত দিল্লীর কেন্দ্রীয় সরকার একাধিক রাজ্য সরকারের কাছে নতজানু নীতি, পশ্চিম বঙ্গ রাজ্য সরকারের কাছেতো বটেই । এর একটি কারণ হচ্ছে কেন্দ্রে মনমোহন সিংএর সরকার একটি কোয়ালিশন সরকার এবং তার অংশীদাররা তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করলে ইউপিএ সরকার বেকায়দায় পরতে পারে । আর এমনিতে বর্তমানে ভারতের অর্থনীতিতে ভয়াবহ ধ্বস নামার ফলে কেন্দ্রীয় সরকারের অবস্থা বেশ নাজুক । এতো গেল রাজ্য সরকার আর কেন্দ্রের মধ্যকার সম্পর্কের কথা । তবে দিল্লীতে আর একটি অত্যন্ত অদৃশ্য সরকার আছে আর সেটি হচ্ছে সাউথ ব্লক । যারা সাউথ ব্লকের সাথে পরিচিত নন তাদের জ্ঞাতার্থে, এটি হচ্ছে কেন্দ্রীয় সচিবালয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ । এই অংশে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরতো আছেই আরো আছে পররাষ্ট্র আর প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় । অর্থ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীরা দক্ষিণ অংশে বসেন । দুটির মাঝখানে বেশ চওড়া রাজপথ । রাষ্ট্রপতি ভবনটাও কাছে । ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির কাছে সাউথ ব্লকে অবস্থিত বিদেশ মন্ত্রণালয় বেশ গুরুত্বপূর্ণ । পাকিস্তানের কাছে সমান ভাবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ও গুরুত্বপূর্ণ কারণ সেই দেশ ভাগের পর হতেই দু’দেশের মধ্যে একটি যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে ।
অন্যান্য দেশের কথা জানি না তবে সার্বিক বিচারে মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে দিল্লীর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশকে তাদের ফুটনোট হিসেবে রেখেছে আর পশ্চিম বঙ্গের মমতা দিদিতো এখন দুদেশের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার জন্য যা যা করার প্রয়োজন তার কোন কিছুই করতে পিছপা হচ্ছেন না । স্বল্প দৃষ্টি সম্পন্ন এই মূখ্যমন্ত্রী এই বাস্তবতাটুকু বুঝতে সম্পূর্ণ রূপে ব্যর্থযে বাংলাদেশে বর্তমান সরকার ভারত তথা পশ্চিম বঙ্গ সরকারের সুবিধার জন্য যা যা করার প্রয়োজন তার চেয়েও কয়েকগুন বেশী করেছে । আর কিছু না বুঝুক এই মহিলারতো এটা বুঝতে পারা উচিৎ যে শেখ হাসিনার সরকার তার দেশে কঠোর হস্তে জঙ্গীবাদ দমন করার পর পশ্চিমবঙ্গ সহ পাশ্ববর্তী রাজ্যগুলি অন্তত বর্তমানে এই সমস্যাটার মুখোমুখি হতে হচ্ছে না । মমতা বা সাউথ ব্লকের আমলারা না বুঝলেও ভারতের সাধারণ জনগণ ঠিকই বুঝেন যে ভারতের জনগণের অকৃত্রিম বন্ধু বাংলাদেশ । কিছুদিন আগে সিএনএন-আইবিএন টিভি ভারতীয় ভোটারদের উপর এক জরিপ চালিয়ে বলেছে তারা বন্ধু হিসেবে বাংলাদেশকে সব চেয়ে বেশী বিশ্বাস করে আর সব চেয়ে কম করে পাকিস্তানকে । কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে ভারত পাকিস্তানের ব্যাপারে যত সময় ব্যয় করে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তার একভাগও ব্যয় করে না কারণ সম্ভবত তার ধরে নিয়েছে বাংলাদেশ তাদের কথার বাইরে কখনো যাবে না । তারা এই সত্যটি ভুলে যান যে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় সব সময় বঙ্গবন্ধু বা তার কন্যা শেখ হাসিনার মতো এমন উদার প্রধানমন্ত্রী নাও থাকতে পারেন । হয়তো তখন যে সরকারটি আসবে সেই সরকারটি নিজের দেশের নদীর উপর অস্থায়ী বাঁধ দিয়ে ভারতের একটি রাজ্যে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য বিশাল বিশাল যন্ত্রপাতি পরিবহনের ব্যবস্থা করবে না । আর সব চেয়ে বড় কথা বাংলাদেশকেতো সকলের আগে নিজের স্বার্থ দেখতে হবে । এটি অনস্বীকার্য আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারত সরকার আর তার জনগণ যে অসাধারণ ভূমিকা রেখেছে তা এই দেশের মানুষ চিরদিন স্মরণ রাখবে । তার অর্থ এই নয়যে বাংলাদেশ তার নিজস্ব স্বার্থ ভুলে গিয়ে সব সময় ভারতের স্বার্থ সংরক্ষণ করবে । এটি কোন সার্বভৌম দেশ করতে পারে না । করলে তা তোয়াযের পর্যায়ে পরবে ।
হয়তো দিল্লীর কেন্দ্রীয় সরকার বাংলাদেশের সাথে বিরাজমান অনেক সমস্যারই সমাধান চায় কিন্তু সরকারের ভিতর যে সরকারগুলি আছে তার জন্য তা সম্ভব হয় না । ধরা যেতে পারে তিস্তার পানিবন্টন বা ছিট মহল বিনিময় বা সীমানা চুক্তি । ছিট মহল বিনিময় চুক্তিতো বঙ্গবন্ধু আর ইন্দিরা গান্ধী বেঁচে থাকতেই সমাধান হয়ে যাওয়া উচিৎ ছিল । ১৯৭৪ সালে মুজিব ইন্দিরা চুক্তি হওয়ার পরপরই বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ তা অনুমোদন করেছে । কিন্তু এই যাবত তা করতে ভারত ব্যর্থ হয়েছে । এই ব্যর্থতার দায় একক ভাবেতো ভারতের অন্য কারো নয় । মনমোহন সিং অঙ্গীকার করেছিলেন এবার তা হয়ে যাবে । এই পর্যন্ত তা হলো না কারণ বিজেপি আর তৃণমূল তা রাজ্যসভায় উত্থাপন করতে দেবে না । তৃণমূলের সাফ কথা, জান দেবোতো পশ্চিম বঙ্গের এক ইঞ্চি জমিও বেহাত হতে দেব না । মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফরে আসার আগে বললেন এইবার পানি বণ্টন চুক্তি হবে । সাথে আসার কথা মমতা ব্যানার্জি সহ অন্যান্য পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলির মূখ্যমন্ত্রীরা । বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী চব্বিশ ঘন্টা আগেও জানালেন চুক্তি স্বাক্ষর হচ্ছে । সকলে এলেন, এলেন না শুধু মমতা কারণ তিস্তা চুক্তিতে তার সায় নেই । এই চুক্তি করলে নাকি তার রাজ্যের ক্ষতি হবে । উজানের নদীগুলি হতে একতরফা ভাবে পানি তুলে নেয়া আন্তর্জাতিক আইনের লংঘন । মমতা আন্তর্জাতিক আইনের থোড়াই তোয়াক্কা করেন । চীন বলছে তারা উজানে ব্রহ্মপুত্র নদে একাধিক বাঁধ দেবে । এতে ভারত বাংলাদেশ উভয়ই মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে । তখন দিদির তৃণমূল কী কিছু বলবে? নাকি সরকারের ভিতর এই সরকার তখন বিলুপ্ত হয়ে যাবে ?
আমাদের পনের বছর বয়সী কন্যা ফেলানী ২০১১ সালের জানুয়ারির ৭ তারিখ উত্তর বঙ্গে ভোর বেলায় সীমান্ত রেখা বরাবর ভারতের দেয়া কাঁটা তারের বেড়া পার হতে গিয়ে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর গুলিতে শুধু নিহতই হলো না তার নিথর দেহটি কাঁটা তারের বেড়ার উপর চার ঘন্টা ঝুলে রইলো । এই ছবিটি পরবর্তীকালে বিশ্বের প্রায় সকল গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে । এতে নিশ্চয় ভারতের ইমেজ বৃদ্ধি হয় নি । ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর গুলিতে বাংলাদেশীদের প্রাণ হারানোর ঘটনা কোন নতুন ঘটনা নয় যদিও প্রত্যেকবার ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী হতে শুরু করে, তাদের সব বড় বড় আমলা, এমন কী বিএসএফ প্রধান সকলে অঙ্গীকার করেন এরপর আর হবে না । কিন্তু কেউ কারো কথা শুনে না কারণ ওই সরকারের ভিতর সরকার। এ নিয়ে বাংলাদেশে গলাবাজিও কম হয় না । বর্তমানে গলাবাজিতে সকলকে টেক্কা দেন বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর । বলেন এই সব হত্যা হয় আওয়ামী লীগ সরকারে নতজানু বিদেশ নীতির কারণে । বাস্তবে বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে সীমান্তে বিএসএফ এর গুলিতে নিহত হয় ৪৩৬ জন । ফখরুদ্দিন সরকারের আমলে ১৭৯ জন । আর বর্তমান সরকারের আমলে এই যাবৎ ২৪৯ জন । মির্জা সাহেবের গলাবাজি করার কোন কারণ দেখি না । সুষ্ঠু রাজনীতি করলে বরং সকল হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করা উচিৎ । ফেলানীর ক্ষেত্রে মনে হলো এইবার বুঝি ভিন্ন কিছু একটা হবে । কিছুটা দেরিতে হলেও ভারত এই হত্যাকান্ডের জন্য বিচার বসালো । যার রাইফেল হতে গুলি ছুঁড়ে ফেলানীকে হত্যা করা হলো সেই অমিয় ঘোষকে বিএসএফ এর আদালতে (সেনা বাহিনীর কোর্ট মার্শালের আদলে) বিচারের মুখোমুখি করা হলো । ফেলানীর বাবা গিয়ে আদালতে সাক্ষ্য দিলেন । আদালত ঘাতককে বেকসুর খালাস দিল । বলতে দ্বিধা নেই এটিও হয়তো ওই সরকারের ভিতর সরকারের নির্দেশেই হয়েছে । অনেকেই বলছেন এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা উচিৎ । যতক্ষণ পর্যন্ত এই মিনি সরকারগুলি বাংলাদেশের ব্যাপারে দিল্লীর কেন্দ্রীয় সরকারের উপর খবরদারী করবে ততক্ষণ মনে হয় না ভারত বাংলাদেশের অমীমাংসিত সমস্যাগুলির সমাধান হবে আর তার জন্য খেসারত দুই দেশকেই দিতে হবে । ভারতের সামনে একটি সুযোগ এসেছিল বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের । সেটি তারা সরকারের ভিতর সরকারের কারণে হাতছাড়া করলো । সামনে পস্তাতে হতে পারে ।

লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় । সেপ্টম্বর ৯, ২০১৩

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ