[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

অন্য এক তারিক আলির সাথে এক অপরাহ্ন

 

 

প্রফেসর আবদুল মান্নান


আমাদের যৌবনকালের একজন নায়ক প্রায় দীর্ঘ ৪৩ বছর পর বাংলাদেশে ঘুরে গেলেন । এই নায়ক কোন সিনেমার নায়ক নন, রাজনৈতিক অঙ্গনের নায়ক, পাকিস্তানের বংশোদ্ভুত বৃটিশ নাগরিক তারিক আলি । বর্তমান প্রজন্মের সামনে ঠিক রাজনৈতিক অঙ্গনের নায়ক বলতে যা বুঝায় তেমন একটা নেই । থাকে সিনেমা বা ক্রীড়াঙ্গনের নায়ক । আমাদেরও ছিল সুচিত্রা সেন আর উত্তম কুমার আর ক্রীড়াঙ্গনে ছিল আবদুল হাফিজ কারদার, হানিফ মোহাম্মদ, ওয়েসলি হল বা নীল হার্ভে । তবে যারা রাজনীতি সচেতন তাদের কাছে রাজনৈতিক অঙ্গনের নায়কও ছিল । ষাটের দশকে দুই পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রচন্ড ঠান্ডা লড়াইয়ে ব্যস্ত । একদিন একদেশ এটম বোমা ফাটায় তো আরেক দিন অন্যদেশ । তখন একটি প্রচলিত বিশ্বাস ছিল যে যৌবনে সকলকে মার্কস্বাদে দীক্ষিত হতে হবে । ঢাকার ষ্টেডিয়াম মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় ষ্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্স চুঠিয়ে বাংলায় মার্কস্বাদ বিক্রি করছে । কোলকাতা হতে এলো নীহার কুমার সরকারের ‘ছোটদের রাজনীতি’ আর ‘ছোটদের অর্থনীতি’ । বলা যেতে পারে মার্কসিস্ট হওয়ার সহজ পাঠ । ষাটের দশকের শেষের দিকে যখন ভিয়েতনাম যুদ্ধ তুঙ্গে তখন প্রথমে আমাদের সামনে রাজনৈতিক নায়ক হিসেবে আবির্ভূত হলেন উত্তর ভিয়েতনামের রাজনৈতিক গুরু হো চে মিন । তরুণদের সামনে তখন কিউবা আর দক্ষিণ আমেরিকার মার্কসিস্ট বিপ্লবী চে গুয়েভেরা এক মহানায়ক । আজকের মতো ঘরে ঘরে তখন টিভি ছিল না । বিত্তবানদের বাড়ীতে ছিল রেডিও । আর ছিল হাতে গোনা কয়েকটি খবরের কাগজ । হঠাৎ একদিন খবর এলো সোভিয়েত ইউনিয়নের প্ররোচনায় পূর্ব বার্লিনের মাঝ বরাবর কাঁটা তারের বেড়া তুলে পুরো বার্লিন শহরটাকেই পূর্ব জার্মানি দু’ফালি করে দিয়েছে । সে এক লোমহর্ষক খবর বটে । শহর দু’ভাগ মানে পরিবার দু’ভাগ, জায়গা-জমিন-সম্পদ দু’ভাগ । ব্যাপারটা যেহেতু সোভিয়েত মন্ত্রে দীক্ষিত পূর্ব জার্মানী করেছে সেহেতু দেশের মার্কস্বাদে দীক্ষিতরাও বেশ শিহরণ অনুভব করলো । ঘটনা সেখানেই থেমে থাকলো না । বছর না ঘুরতেই কাঁটাতারের বেড়া জায়াগা করে দিল আস্ত একটা দেয়ালকে । ভিয়েতনামতো বটেই যেখানেই সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন সেখানেই সোভিয়েত ইউনিয়নের মদদ । এঙ্গোলা, কিউবা, বলিভিয়া, চিলি কোন জায়গাই বাদ যাচ্ছে না । মনে হচ্ছে সব দেশেই লাল ঝা-ার জয় জয়কার । যুক্তরাষ্ট্র অনেকটা আত্মরক্ষার ভূমিকায় । ইউরোপের তরুণরা শুরু করলো ভিয়েতনাম যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলন । সামনে থেকে যারা এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের মধ্যে আছেন পাকিস্তানের লাহোর হতে বিলেতে পড়ালেখা করতে আসা এক দারুণ বুদ্ধিদীপ্ত তরুণ, তারিক আলি । পারিবারিক ভাবে আলি পরিবার পাঞ্জাবের ক্ষমতাশালী ভূস্বামী হলেও বাবা সাংবাদিক মাজহার আলী খান বাম রাজনীতির সাথে আজীবন জড়িত । আইউব বিরোধী আন্দোলনে তিনি আর তার স্ত্রী তাহেরা মাজহার আলী খান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন । মওলানা ভাসানীর সাথে পরিবারটির একটি সুসম্পর্ক ছিল । তাহেরার বাবা সরদার সেকান্দার হায়াত খান এক সময় (১৯৩৭-৪২) পাঞ্জাবের মূখ্যমন্ত্রী ছিলেন । তিনিও বাম রাজনীতির একজন সমর্থক ছিলেন ।
ইউরোপে ভিয়েতনাম যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলনের এক পর্যায়ে সেই আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়লো আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে । আন্দোলনের মশাল তখন যুক্তরাষ্ট্রের বাম আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী এঞ্জেলা ডেভিসের হাতে । বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস হতে ক্যাম্পাসে সেই আন্দোলনের ষ্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পরছে । ১৯৭০ সনের ৪ মে কেন্ট ষ্টেট বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভরত ছাত্রদের উপর ন্যাশনাল গার্ড গুলি চালালে চারজন ছাত্র ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করে । কেন্ট হতে কয়েক হাজার মাইল দূর থেকে আমরা মৃত কমরেডদের লাল সালাম জানালাম । এ’সময় পশ্চিমা বিশ্ব দুনিয়ার অন্যে প্রান্তে আর একটি অগ্নুৎপাতের সূত্রপাতের সাথে পরিচয় হলো, বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলন । সেই বিশ্বের মানুষ জানলো এই আন্দোলনের সামনের কাতারে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে পূর্ব বঙ্গের ছাত্র-জনতা এবং তাদের অন্যতম সেনাপতি তোফায়েল আহমদ । তারিক আলি, জন লেনন (বিটল্স খ্যাত) ইকো ওনো, এঞ্জেলা ডেভিসের পাশাপাশি ল-ন নিউ ইয়র্কের পত্রপত্রিকায় ছাপা হতে লাগলো বাংলা আর বাঙালির খবর । সত্তরের নির্বাচনের পর দৃশ্যে আবির্ভাব ঘটলো আর একজন কালজয়ী মহানায়কের, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব । সত্তরে তারিক আলি এলেন ঢাকায় । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলা ভবনের সামনে বটতলায় তিনি যখন লাখো ছাত্র জনতার জনসমুদ্রে বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করছিলেন তখন মনে হচ্ছিল তিনি তার পরনের লম্বা কুর্তার পকেট হতে বিপ্লবের আগুন বের করে তা চারিদিকে ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন । তারিক আলির সেই অপরাহ্নের বক্তৃতা কী যে এক উন্মাদনা সৃষ্টি করেছিল তা এখন বুঝানো যাবে না । ইউরোপে ফেরার আগে দেখা করতে ভুললেন না বঙ্গবন্ধুর সাথে । বঙ্গবন্ধু বটতলায় তারেক আলির দেয়া বক্তৃতার প্রশংসা করলেন ।
১৯৭০ হতে ২০১৩, দীর্ঘ ৪৩ বছরের ব্যবধানে বিশ্ব অনেক পাল্টে গেছে । পতন হয়েছে বার্লিন দেয়ালের, সাথে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের । বাম রাজনীতি এখন অনেকটা গৃহবন্দি । তারিক আলি এখন আর মার্কস্বাদ প্রচার করেন না । ইতিহাস আর সাহিত্য চর্চা করেন । সময় পেলে সিনেমা বানান । থাকেন বিলেতে । সময় পেলে পত্রিকায় বিশ্লেষণধর্মী কলাম লেখেন । নিজ দেশে মৌলবাদীদের কাছে অবাঞ্চিত কারণ তাদের মতে তিনি একজন নাস্তিক যদিও তিনি ইসলাম নিয়ে একাধিক বই লিখেছেন । ঢাকায় একটি গ্রন্থ মেলার আলোচনা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে সম্প্রতি ঢাকা ঘুরে গেলেন বর্তমানে সত্তর বছর বয়সী তারিক আলি । একটি উঁচু মাপের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এক পড়ন্ত বিকেলে তারেক আলির জন্য ‘ঐরংঃড়ৎু ধহফ ঋরপঃরড়হ’ (ইতিহাস ও কল্পকাহিনী) শিরোনামে একটি সেমিনার আয়োজন করেছিল । বেশ প্রশংসনীয় উদ্যোগ । হল ভর্তি শ্রোতাদের উপচে পড়া ভীড় । সত্তর বছর বয়সেও তারিক আলির গলার জোড় এবং বলার ভঙ্গি এতটুকু বদলায়নি । প্রায় একঘন্টা দর্শক শ্রোতাদের ধরে রেখেছিলেন । বললেন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে তিনি অবাক হন নি কারণ এটি অনিবার্য ছিল । তাঁর মতে সোভিয়েত রাষ্ট্র কাঠামো অতি মাত্রায় আমলাতান্ত্রিক হয়ে পরেছিল । সামরিক বাহিনীর পিছনে তাদের বিশাল ব্যয় ছিল সম্পূর্ণ ভাবে অযৌক্তিক । এর ফলে এক সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন আর্থিক সংকটে পরলে তার পতন তরান্বিত হলো । মানুষ ভুল ভাবে মনে করলো সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার একমাত্র বিকল্প মুক্তবাজার অর্থনীতি । বললেন তার পরিণতি কী হতে পারে তার জ্বলন্ত প্রমাণ গ্রীস, পর্তুগাল, স্পেন আর ইতালির চরম অর্থনৈতিক সংকট আর দেউলীয়া হওয়া । তার মতে ভেনিজুয়েলা, বলিভিয়া, কোস্টারিকা, ব্রাজিলের একটা অংশ ২০০৭-৮ এর বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা হতে মুক্ত থাকতে পেরেছে কারণ তারা সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার একটা সংমিশ্রন ঘটাতে পেরেছে । এক রহস্যজনক কারণে তিনি কিউবা সম্পর্কে একটি বাক্যও উচ্চারণ করেন নি । একজন শ্রোতা তার কাছে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা- সম্পর্কে তার মতামত জানতে চাইলে তিনি নির্দ্বিধায় বললেন বঙ্গবন্ধু বাকশাল কায়েম করে মত প্রকাশের স্বাধীনতা সঙ্কুচিত করেছিলেন সুতরাং এই নৃশংস হত্যাকা-টি অবধারিত ছিল । তার হয়তো এটি জানা নেই বাকশাল ব্যবস্থাটি কখনো কার্যকর করার সুযোগ বঙ্গবন্ধু পান নি । আর বাকশাল ব্যবস্থাকে সময়ের প্রেক্ষাপটে বিচার করতে হবে । তিনি একবারও বললেন না বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ে নিক্সন প্রশাসনের ভূমিকা অথবা সে সময়কার যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশে খাদ্য চালান নিয়ে নোংরা রাজনীতি যার ফলে চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ । তার কথায় মনে হয়েছে তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার ঘটনাটি দুঃখজনকভাবে অত্যন্ত ক্ষুদ্র দৃষ্টিকোন হতে দেখেছেন । বাকশাল গঠনে বাংলাদেশে কমিউনিষ্ট পার্টির ভূমিকাকে তিনি সমালোচনা করে বলেন এটি ছিল একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত । তার মতে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াতে সমাজতন্ত্রের কোন ভবিষ্যৎ নেই । তারেক আলি শ্রোতাদের জানালেন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রের কোন ভবিষ্যৎ নেই এবং এর বারোটা বাজিয়েছে পিএলও আর হামাস । সময় থাকতে প্যালেস্টাইন নেতাদের উচিৎ এক ইসরাইল-প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র মেনে নেওয়া । একপর্যায়ে বললেন ইউরোপের ইতিহাস বইতে ইউরোপীয় সভ্যতায় মুসলমানদের কোন অবদানের কথা পড়ানো হয়না । সেখানে মুসলমানদের ইতিহাস এক প্যারাগ্রাফে সীমাবদ্ধ। দুঃখজনক ভাবে তিনি একবারও বলেন নি পাকিস্তানে ইতিহাসই পড়ানো হয় না । বাংলাদেশ সম্পর্কে সেই দেশের সত্তর পরবর্তী প্রজন্ম সম্পূর্ণ অজ্ঞ । তার এই সব বক্তব্য শ্রোতাদের হতাশ করেছে ।
তারিক আলি সে দিন দুএকটি চরম সত্য কথা বলেছেন । তার মতে বর্তমানে বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক সংকট সেটি অনেকটা ১৯৪৭ সনের চেতনা বনাম ১৯৭১ সনের চেতনার লড়াই । ১৯৪৭ এর চেতনা চরমভাবে ভুল ছিল কারণ শুধু ধর্মের ভিত্তিতে কোন রাষ্ট্রের জন্ম হতে পারে না । বললেন সৌদি আরব দুটি বস্তু বিশ্বকে উপহার দেয় । প্রথমটি তেল আর দ্বিতীয়টি ওহাবি মতবাদ নির্ভর জঙ্গিবাদ । খোদ সৌদি আরবে ওহাবিদের সংখ্যা তেমন উল্লেখযোগ্য না হলেও এই মতবাদ তারা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে পেরেছে যা বিশ্বকে অস্থিতিশীল করেছে । ইরাক, আফগানিস্তান অথবা ইয়েমেনে গণতন্ত্র রফতানি করতে যুক্তরাষ্ট্র বেশ উৎসাহী কিন্তু সৌদি আরবের ব্যাপারে নিশ্চুপ । এই ক্ষেত্রে তাদের অভিমত মুসলমানরা গণতন্ত্রের জন্য প্রস্তুত নন । তবে এই তারেক আলির সাথে আমার দেখা এবং জানা তারেক আলির অনেক তফাৎ । মনে হলো তিনি চরম ভাবে বিভ্রান্ত। হয়তো বয়সের সাথে সাথে মানুষের চিন্তা চেতনাও বদলে যায় । সব শেষে সে দিনের আয়োজনের জন্য আয়োজকদের ধন্যবাদ দিতেই হয় ।

লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় । নভেম্বর ২১, ২০১৩

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ

[......লেখক আর্কাইভ]