|
||||||||||||||||||
|
একজন নিঃসঙ্গ শেরপার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন
-প্রফেসর আবদুল মান্নান ১৭ই মে আওয়ামী লীগ প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস । শেখ হাসিনার যারা নিয়মিত সমালোচক তারা বলবেন তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিয়ে এত মাতামাতির কী হলো ? কেউ কেউ এমনও বলতে পারেন এটা এক ধরণের দালালি আর কি । তাদের বলে রাখি এ সবের কিছুই না । আমি শুধু সময়ের প্রেক্ষাপটে বিষয়টা নিয়ে যৎসামান্য আলোচনা করছি। দেশের কোটি কোটি মানুষ শেখ হাসিনাকে প্রতিদিন বিভিন্ন গণমাধ্যমের কল্যাণে দেখেন আর শুনেন তাঁর অনেক বক্তব্য বক্তৃতা । কিন্তু শেখ হাসিনাকে কাছ থেকে দেখার বা জানার সুযোগ অনেকেরই হয় না । তার দলের প্রায় সকলেই তাকে আবার ফেরেস্তা তুল্য মনে করেন আর তাঁর রাজনৈতিক সমালোচকরা তাঁকে একজন খল নায়কের বেশী চিন্তা করেন না। এ দুটির কোনটাই তাঁর বেলায় প্রযোজ্য বলে আমি মনে করি না । তিনি সকলের মতো একজন মানুষ । তাঁর অনেক দোষ ত্রুটি থাকতে পারে কিন্তু ক’জন এই বিষয়টা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করেন এই মহিলার একদিন সব কিছু ছিল একরাতেই তিনি সর্বহারা হয়ে গেলেন ? আমি ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্টের সেই ভয়াবহ কাল রাতের কথা বলছি । ১৯৭৫ সালের সেই কাল রাতে শেখ হাসিনা তাঁর স্বামীর সাথে জার্মানিতে ছিলেন । তখন তিনি শ্রেফ একজন গৃহবধু । ঘরকান্না করেন আর স্বামী সংসার দেখেন । সাথে ছোট বোন শেখ রেহানা । বড় বোনের কাছে ছোট বোনের বিদেশে বেড়াতে যাওয়া এটি বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেনীর সংষ্কৃতির অংশ । বঙ্গবন্ধু পরিবার কখনো মধ্যবিত্ত পরিবারের উপরে উঠতে পারে নি । বঙ্গবন্ধুর ঘরোয়া পরিবেশের অনেক ছবি দেখলে তা ষ্পষ্ট । ক’জন রাজনৈতিক নেতাকে গেঞ্জি গায়ে চেয়ারের উপর দু’পা তুলে পাইপ টানতে ছবিতে দেখা যায় ? তেমন ছবি বঙ্গবন্ধুর অজস্র আছে । তেমন এক পিতার কন্যা শেখ হাসিনা আর শেখ রেহানা । সেই পিতা স্বপরিবারে ঘাতকের বুলেটে প্রাণ হারালেন । এরপর দু’বোনের দীর্ঘ যাযাবর জীবন । জার্মানি হতে ইংল্যান্ড, তারপর ভারতের রাজধানী দিল্লিতে । সে সময় পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন ভারতের তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, অনেকটা মাতৃস্নেহে । দিল্লি হতে আকাশ পথে তিন ঘন্টায় ঢাকা আসা যায় । তখন সেটি সম্ভব নয় কারণ বাংলাদেশ সরকারের অনুমতি নেই । তখন ‘বঙ্গবন্ধু‘ শব্দটি উচ্চারণ করা দূরে থাকুক শেখ মুজিবের নাম নেওয়াটাই এক বিরাট অপরাধ । এমন পরিস্থিতিতে তাঁর কন্যা দেশে ফিরবেন তা এক কথায় অসম্ভব । ১৯৮২ সালের ১০ই অক্টোবর যখন বঙ্গবন্ধু উত্তর বাংলাদেশে প্রথম বারের মতো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটে বঙ্গবন্ধুর নামে আমি শোক প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলাম তখন সকলে শুধু অবাকই হন নি অনেকে আমাকে রাতে বাড়ীতে না থাকার পরামর্শও দিয়েছিলেন । সময়টি বাংলাদেশের জন্য এক ক্রান্তিকাল । তখন কিন্তু বঙ্গবন্ধু কন্যা বাংলাদেশে ফিরে এসেছেন কিন্তু তাঁর স্মৃতিবিজরিত ধানমন্ডি ৩২ নং বাড়ীতে তাঁর প্রবেশ নিষিদ্ধ । বঙ্গবন্ধুকে যখন হত্যা করা হয় তখন তাঁর বয়স ৫৫ এবং বাংলাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের বয়স মাত্র ২৭ । বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর আড়াই মাস পর ৩রা নভেম্বরে জেলে চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করা হয় । এই সব হত্যাকা-ের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব শূন্য করা । ঘাতকরা তা করতে অনেকটা সফলও হয়েছিল যার কারণে পরবর্তিকালে আওয়ামী লীগ বড় ধরণের সংকট আর ভাঙনের মুখোমুখি হয় । আজ বঙ্গবন্ধু মন্ত্রী সভার প্রথম পররাষ্ট্র মন্ত্রি ডঃ কামাল হোসেন আওয়ামী লীগের রাজনীতি হতে শুধু অনেক দূরেই নয় তিনি কারণে অকারণে আওয়ামী লীগের একজন বড় সমালোচকও । কিন্তু আওয়ামী লীগের সে সময়ের ক্রান্তিকালে তিনি ১৯৮১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারী তারিখে অনুষ্ঠিত দলের কাউন্সিল অধিবেশনে প্রবাসে থাকা শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি করার প্রস্তাব করে এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন । তাঁকে জোড়ালো ভাবে সমর্থন করেছিলেন আবদুল মালেক উকিল, সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দিন, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমদ সহ অনেকে । এদের অনেকেই দিল্লি ছুঠে যান শেখ হাসিনাকে সংবাদটি দিতে এবং দেশে ফিরিয়ে আনতে । শেখ হাসিনার দিল্লির প্রবাস জীবনের সংসার গুটিয়ে পরবর্তি আড়াই মাস সময় লেগেছিল ১৭ই মে দেশে ফিরতে । তিনি যখন দেশ ত্যাগ করেছিলেন তখন তাঁর বাবা, মা, চাচা, ভাই সকলে ছিল। ১৭ তারিখের সেই বর্ষণমূখর বিকেলে যখন তেজগাঁ বিমানবন্দরে বিমান হতে তিনি নামলেন তখন হুমায়ূন আহম্মদের নাটকের মতো তার ‘কোথাও কেউ নেই’ । আছে বিমান বন্দরের বাইরে অপেক্ষমান লক্ষ মানুষের ভালবাসা । ঠিক এমনি এক সময় ১৯৭২ সালের ১০ মার্চ তাঁর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকিস্তানের কারাগার হতে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলেন । তখন আকাশে পড়ন্ত বিকেলের রোদ ছিল । মানুষের মুখে হাঁসি ছিল আর ছিল আনন্দশ্রু । শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনে এসবের কিছুই ছিল না । তাঁর ভিতরে ছিল স্বজন হারানোর পর্বত প্রমাণ বেদনা আর মানুষের মন ছিল দূঃখে ভারাক্রান্ত । দেশে ফিরে শেখ হাসিনা দলের হাল ধরেছিলেন । দল তখন অনেকটা ভাঙা তরীর মতো । সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙ্গে পরেছে । দলের ভিতর উপদল আর কোন্দল । তবে আশার কথা হচ্ছে তখন দলের প্রতি বিশ্বস্থ ও অনুগত বেশ কিছু নেতা কর্মী ছিলেন যা বর্তমানে বিরল যার কারণে শেখ হাসিনাকে অনেক সময় একাই পাহাড় ঠেলতে হয় । এখন শেখ হাসিনাকে ব্যবহার করে অনেকে নিজের আখের গোছাতে সদা ব্যস্থ থাকেন । এই দীর্ঘ সময়ে দলে অনেক সুবিধাবাদি গোষ্ঠির জন্ম হয়েছে যারা দলকে নিছক উপরে উঠার সিঁড়ি হিসেবেই ব্যবহার করেন। দেশ এবং দলের আগে নিজেকে জুড়ে দেন । দেশে ফেরার পর হতে শেখ হাসিনাকে হত্যার একাধিক চেষ্টা হয়েছে যার মধ্যে ভয়াবহতম ছিল ২১ আগষ্টের বঙ্গবন্ধু আ্যভেন্যুর তার সমাবেশে গ্রেনেড হামলা । এসবের ভিতর দিয়েই শেখ হাসিনাকে ১৯৮১ সানের পর হতে পথ চলতে হয়েছে । তার এই পথ চলা কখনো কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না । দেশে ফিরে এক মর্মান্তিক পারিবারিক ট্রাজেডি সামলে উঠে দল গোছাতে বেশ সময় লেগেছিল শেখ হাসিনার । একটি বড় রাজনৈতিক দলের চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে পরলে অথবা দলটি নেতৃত্ব শূন্য হয়ে গেলে তাকে বাংলাদেশের মতো দেশে আবার দাঁড় করানো বেশ কঠিন কাজ যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ ভারতের ই-িয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস অথবা পাকিস্তানের মুসলিম লীগ । এক সময় কংগ্রেস একটি সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দল ছিল যাকে বর্তমানে তেমনটি আর বলা যাবে না । এখন এই দলকে আঞ্চলিক দলসমূহের সাথে নির্বাচনে হাড্ডা হাড্ডি লড়াই করতে হয় । রাতারাতি গজিয়ে উঠা ‘আম আদমী পার্টির’ মতো দলের সাথে নির্বাচন করে হেরে যেতে হয় । মুসলিম লীগতো এখন বিলুপ্ত । বাংলাদেশে এক সময় মওলানা ভাসানীর ন্যাপ বেশ শক্তিশালী দল ছিল । একাত্তর পূর্ববর্তি সময়ে তার একটি সারা পাকিস্তানব্যাপী অবস্থান ছিল । কিন্তু সেই দলটিও নেতৃত্ব শূন্যতার কারণে বর্তমানে অনেকটা বিলুপ্ত । সে দিক দিয়ে আওয়ামী লীগ অনেকটা ভাগ্যবান যে এত ঝড় ঝাপটার পরেও ১৯৮১ পরবর্তি কালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তা শুধু উঠে দাঁড়ায় নি দীর্ঘ ২১ বছর পর দলটি ১৯৯৬ সনে জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছে । তিনি দেশে না ফিরলে আওয়ামী লীগও ন্যাপ বা মুসলীম লীগের মতো সংকটে পড়তে পারতো । শেখ হাসিনার আমলের আওয়ামী লীগ আর বঙ্গবন্ধুর আমলের আওয়ামী লীগের মধ্যে একটি বড় পার্থক্য হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর চারপাশে যারা ছিলেন তাদের মেধা আর যোগ্যতা ছিল প্রশ্নাতীত । দলের প্রতি তাদের আনুগত্য ছিল নিরঙ্কুশ । বঙ্গবন্ধু ক্ষমতার চেয়ে সংগঠনকে অনেক বেশী গুরুত্ব দিতেন কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন দল যদি সুসংগঠিত থাকে তা হলে অনেক কঠিন সময় মোকাবেলা করা সম্ভব । কিন্তু শেখ হাসিনা পিতার মতো তেমন ভাগ্যবতী নন । ১৫ই আগষ্টের পরই আওয়ামী লীগকে অনেকটা নেতৃত্বশূন্য করা হয়েছে । তাঁকে একেবারে শূন্য থেকে শুরু করতে হয়েছে কিন্তু তারপরও বলতে হয় তিনি যাদেরকে নিয়ে পথ চলা শুরু করেছিলেন তারা সকলেই যে শেখ হাসিনার সাথে শুধু যে পথ চলতে ব্যর্থ হয়েছেন তা নয় তাদের অনেকরই কীর্তিকলাপ তাঁকে আর দলকে অনেক সময় চরম বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে, দলকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে যার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ সাম্প্রতিক কালের নারায়ণগঞ্জ ট্র্যাজেডি আর কিছু অঙ্গ সংগঠনের লাগামহীন দুর্বৃত্তপনা । অনেকেই শেখ হাসিনাকে একজন নিঃসঙ্গ শেরপার সাথে তুলনা করেন । যদিও হয়তো কথাটির মধ্যে কিছুটা সত্যতা আছে কিন্তু বাস্তব হচ্ছে এখনো দলে এবং দলের বাইরে অনেক নিঃস্বার্থ কর্মী বা ব্যক্তি আছেন যাদের তিনি কাজে লাগাতে পারেন না আর এই না পারার কারণ হচ্ছে এরা তার কাছে পৌঁছাতে পারেন না । আজকের এই দিনে সব চেয়ে বড় প্রশ্নতো শেখ হাসিনার পর কে? এই মুহূর্তে এই প্রশ্নের কোন উত্তর জানা নেই । যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতীক এই দলটির ও তার প্রধান শেখ হাসিনার শুভাকাঙ্খী তারা কখনো চাইবেন না শেখ হাসিনা পরবর্তিকালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আবার একটি সংকটে পড়ুক । এটি সত্য আজকের এ দিনটিতে শেখ হাসিনাকে নিয়ে অনেক স্তুতি বাক্য পড়া বা লেখা হবে তবে স্তুতির বাইরে গিয়ে সকলকে দলের আগামী দিনের কথা চিন্তা করতে হবে । শেখ হাসিনা একাই অনেক প্রতিকূলতার মাঝেও দলকে অনেক দিয়েছেন । এখন সময় হয়েছে দলের তাকে কিছু দেয়া । এবং সেটা হতে পারে দলের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য এবং যারা দলের নেতৃত্বে আছেন তাদের নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকা । মানুষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চেয়ে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনাকে কম ভালবাসেন না । তাবে তারা সকলেই থাঁকে একজন সফল প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখদে চান । দেখতে চান তাঁর ভিতর দিয়ে তাঁর পিতার মতো একজন রাষ্ট্রনায়কের পূণর্জন্ম এ। তাঁর ব্যর্থ হওয়ার কোন সুযোগ নেই । তাঁর দীর্ঘায়ূ কামনা করি । লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় । মে ১৬, ২০১৪
WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action.
|
লেখকের আগের লেখাঃ
|