|
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে আদমজী পাটকল হতে দেবেন না
-প্রফেসর আবদুল মান্নান অনুজ প্রতিম জনপ্রিয় শিক্ষক ও সাহিত্যিক ডঃ জাফর ইকবাল বছর কয়েক আগে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় একটি কলাম লিখেছিলেন এই প্রশ্ন রেখে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলি কী আদমজী পাট কলের ভাগ্য বরণ করতে যাচ্ছে ? তখন চার দলীয় জোট সরকারের আমল । বছরের পর বছর লোকসান দিচ্ছে সেই অজুহাতে বিশ্ব ব্যাংকের পরামর্শে সরকার বিশ্বের বৃহত্তম পাট কলটি রাতারাতি বন্ধ করে দিল । পাট কলটি নিয়ে এই দেশের মানুষের একটি গর্ব ছিল । বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে আদমজী বন্ধ করলো আর একই বিশ্ব ব্যাংক ভারতকে একই সময় তিনটি পাট কল প্রতিষ্ঠা করার জন্য অর্থায়ন করলো । সেটি অন্য প্রসঙ্গ । যখন জাফর ইকবাল কলামটি লেখেন তখন ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের হানাহানিতে একজন নিরীহ ছাত্রের মৃত্যুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ । ছাত্র সংঘর্ষের কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হওয়ার ঘটনা নতুন কোন বিষয় নয় । সংষ্কৃতিটা সেই আইউব-মোনায়েম খানের জমানা হতে চলে আসছে । বর্তমানে তা সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়েছে । সম্প্রতি একই ধারাবাহিকতায় দেশের অন্যতম বৃহৎ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হলো । কিছু ফী বৃদ্ধির জটিলতায় বিশ্ববিদ্যালয়টি বন্ধ হলো । এমন ঘটনা কিন্তু নতুন কিছু নয় । একবার আমি আমার পূর্বের কর্ম ক্ষেত্রে চল্লিশ মাইলের বাস ভাড়া পাঁচ টাকা হতে সাত টাকায় বৃদ্ধি করাতে ছাত্রীরা আমাকে সতের ঘন্টা অবরোধ করে রেখেছিল । ২০১০ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন কিছু এককালীন ফী বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলি আন্দোলন গড়ে তুললে সেই আন্দোলন অনেকটা শান্তিপূর্ণ থাকলেও অচিরেই তাদের অজান্তে আন্দোলন ক্যাম্পাস দখলধারী ইসলামী ছাত্র শিবির ছিনতাই করে নিয়ে যায় এবং ক্যাম্পাসে ব্যাপক ভাঙচুর করে প্রায় কোটি টাকার উপর বিশ্ববিদ্যালয় সম্পদ ধ্বংস করে । অথচ এই সম্পদগুলি জনগণের অর্থে শিক্ষার্থীদের জন্য কেনা হয়েছিল । রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও ঠিক অনুরূপ আন্দোলন ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যম খবর দিচ্ছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সমস্ত ফী বৃদ্ধি নিয়ে আন্দোলন সেগুলি অধিকাংশই এককালীন দেয় । যেমন নন কলেজিয়েট ফী । পাঁচ শত টাকা হতে বাড়িয়ে তা এক হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে । এই ফী শুধু তাদের জন্যই প্রযোজ্য যাদের পরীক্ষা দেয়ার জন্য নুন্যতম ৭৫% ক্লাসে উপস্থিতি থাকেনা । যে ছাত্রটি এই নুন্যতম সংখ্যক ক্লাসে উপস্থিত থাকে না সে যদি পরীক্ষা দিতে চায় তাহলে তাকে জরিমানাতো দিতেই হবে । একজন ছাত্র সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে দু’বার সনদপত্র উত্তোলন করে । তাকে দুইশত টাকার পরিবর্তে পাঁচশত টাকা দিতে হবে । এতেই আপত্তি । যারা প্রধানতঃ এই আপত্তিটি তুলে তারা সমাজতন্ত্রের মন্ত্রে দীক্ষিত এবং মনে করে শিক্ষাকে বাণিজ্যিকী করণ করা চলবে না এবং শিক্ষা সুযোগ নয় এটি তাদের অধিকার । সমাজতন্ত্রের আদি জন্মস্থান সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে কখনো উচ্চ শিক্ষা সকলের অধিকার ছিল না । প্রাথমিক শিক্ষা সকলের অধিকার হিসেবে চিহ্নিত ছিল । উচ্চ শিক্ষায় কারা যাবে তা রাষ্ট্র ঠিক করতো । মধ্য ষাটের দশকে চীনের সাংষ্কৃতিক বিপ্লবের সময় সে দেশে সব বিশ্ববিদ্যালয় সাত বছরের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল । বাংলাদেশের মতো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় বিনামূল্যে উচ্চ শিক্ষা বিশ্বের অন্য কোন দেশে আছে বলে জানা নেই । বৃটেন বা যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভর্তুকি নেই বললেই চলে । সে সব দেশে প্রাথমিক শিক্ষার প্রায় পুরোটাই ভর্তুকির উপর চলে । সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র ও বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান নিয়মিত বিপুল পরিমাণের অর্থ বিশ্ববিদ্যালয় কোষাগারে অনুদান হিসেবে দিয়ে থাকে । তার উপর আছে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়ালেখা করার জন্য বিভিন্ন প্রকারের সহজ শর্তে ঋণ । ষাটের দশকে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাসে বার টাকা বেতন দিতাম । এখন তা বৃদ্ধি হয়ে ত্রিশ টাকা হয়েছে । হলে থাকলে বর্তমানে একজন ছাত্রকে সর্বসাকুল্যে বছরে চার হাজার তিনশত টাকার মতো বেতন ও অন্যান্য ফী দিতে হয় । মঞ্জুরি কমিশনের হিসাব মতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রের পিছনে রাষ্ট্রের তথা জনগণের দেয় গড়ে ভর্তুকি বছরে পৌণপুণিক খাতে আনুমানিক পঁয়তাল্লিশ হতে পঞ্চাশ হাজার টাকা । বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ভর্তুকির পরিমাণ কয়েক গুণ বেশী । যারা এই সব আন্দোলনের সাথে জড়িত থাকেন তাদের অনেকেরই পকেটে থাকে কয়েক হাজার টাকা দামের মোবাইল ফোন আর তার পিছনে মাসে খরচ হয় আরো কয়েকশত টাকা । আবার এর ভিন্ন চিত্রও আছে । পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী আসে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার হতে । এরা হলে হয় সিট পান না অথবা সিট পেতে হলে বড় ভাইদের মাসোহারা দিতে হয়, না হয় মেসে থাকতে হয়, পড়ার খরচ চালানোর জন্য টিউশনি করতে হয় । কিন্তু যাদের পকেটে বিশ পঞ্চাশ হাজার টাকার মোবাইল ফোন তাদেরও এই শেষে উল্লেখিত শিক্ষার্থীদের মতো একই পরিমাণের বেতন ও অন্যান্য ফী দিতে হয় । এখন কেউ যদি বলেন এই সমস্যা দূর করতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয় বেতন ও ফী’র মাঝে বিভিন্ন স্তর থাকা বাঞ্চনীয়, যেমনটি অন্য দেশে আছে, তখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে নিশ্চিত ভাবে যুদ্ধাবস্থা শুরু হয়ে যাবে । শিক্ষা সংকোচন নীতি প্রস্তাব করছি মনে করে আমকে অনেকে শাপান্ত করবেন । আমি নিশ্চয় তা করছিনা । আমি চাই প্রত্যেক যোগ্যতা সম্পন্ন ও মেধাবী ছাত্র যেন বাস্তবসম্মত উচ্চ শিক্ষা হতে কোন ভাবেই বঞ্চিত না হয় । ইদানিং কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকটি বিভাগে সান্ধ্যকালীন কোর্স চালু হয়েছে । এটি একটি মহলের কাছে কোন বোধগম্য কারণ ছাড়া গ্রহণযোগ্য না হলেও বলতে হয় তা প্রশংসনীয় উদ্যোগ । আমাদের সমাজের একটি বিরাট সংখ্যক জনগোষ্ঠী আছেন যাদের হয়তো ডিগ্রী পর্যায় পর্যন্ত পড়ালেখা করে চাকুরিতে ঢুকতে হয় । তাদের জন্য এই সান্ধ্যকালীন কোর্সগুলি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার একটি বড় সুযোগ এনে দিয়েছে । এক সময় আমাদের দেশেও বড়দের জন্য সান্ধ্যকালীন স্কুলের ব্যবস্থা ছিল । নিঃসন্দেহে এটিও একটি ভাল ব্যবস্থা ছিল যা এখন আর দেখা যায় না । আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণাটাই হচ্ছে তা সারা বছর দিনে চব্বিশ ঘন্টা জ্ঞান চর্চার জন্য উন্মুক্ত থাকবে । সেখানে কোর্সটা সান্ধ্যকালীন না দিনের বেলায় তা বিবেচ্য হওয়ার বদলে বিবেচ্য হওয়া উচিৎ দুই বেলার পড়ালেখার মধ্যে কোন তারতম্য হচ্ছে কী না । কোন একজন শিক্ষক যদি দিনের বেলায় ক্লাস ফাঁকি দিয়ে সন্ধ্যা বেলায় অথবা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিতে বেশী আগ্রহী থাকেন তাহলে তাকে অবশ্যই তা হতে নির্বৃত্ত করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে ব্যবস্থা নিতে হবে । তেমন আইন না থাকলে সে রকম আইন করতে হবে । আর একজন শিক্ষক সপ্তাহে কয়টা ক্লাস নিতে পারবেন তা নির্ধারিত আছে । প্রয়োজনে তা বলবৎ করতে হবে । তবে তাকে দিনের বেলায় ক্লাস নেয়াটাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে । কোন কোন বিদগ্ধ শিক্ষাবিদকে বলতে শুনেছি সান্ধ্যকালীন কোর্সে পড়ালে দিনের বেলার পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশে দেরী হয় । কথাটি একেবারেই অমূলক । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদ অথবা আইবিএতে সান্ধ্যকালীন কোর্স চালু আছে আবার তাদের পরীক্ষার ফলাফল দিতে কখনো দেরী হয় বলে শোনা যায় না । চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বিভাগের ষাটজন পরীক্ষার্থীর ফলাফল দিতে দুই বছর সময় ক্ষেপন করলে পরীক্ষার্থীরা কেক কেটে তা উদযাপন করেছিল । দেরীর কারণ ছিল পরীক্ষা কমিটির সভাপতি চট্টগ্রামে থাকার চেয়ে ঢাকা থাকা বেশী পছন্দ করেন কারণ তিনি মনে করেন ঢাকায় থাকলে তার বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার সুযোগটা বেশী হয় । তবে বেশীর ভাগ বিভাগে ফলাফল সময় মতোই প্রকাশিত হয় । সুতরাং সমস্যাটা অন্য জায়গায় । আর একজন পন্ডিত বললেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পিছনে অন্য আর একটি কারণ হচ্ছে সান্ধ্যকালীন কোর্সের পড়ালেখা দ্রুত শেষ হবে কারণ এখানে বিনা কারণে পড়া লেখার কোন ব্যাঘাত ঘটবে না । ফলাফল তাড়াতাড়ি প্রকাশিত হবে এবং তারা দিনের বেলা পড়–য়াদের তুলনায় চাকুরীর ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকবে । এটি একটি হাস্যকর যুক্তি কারণ প্রথমেতো দিনের বেলায় পড়ালেখায় কেন ব্যাঘাত ঘটবে ? ব্যাঘাত কারা ঘটায় ? তাতে ক্ষতি কার? সেই প্রশ্নের জবাবতো আগে মিলতে হবে । যারা ব্যাঘাত ঘটায় তাদের যদি ভর্তুকি ছাড়া পড়ালেখা করতে হতো তা হলে তারা এই ব্যাঘাত ঘটানোর কথা চিন্তাই করতো না । রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রোববারের ঘটনা যারাই ঘটাক সত্যটা হচ্ছে ছাত্রলীগের কিছু নেতা কর্মীর হাতে আগ্নেয়াস্ত্র দেখা গেছে । নেতা কর্মী যে দলেরই হোক তার হাতে এমন অস্ত্র প্রদর্শন কোন অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নয় । কোন কোন মহল হতে এদের পক্ষে সাফাই গাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে । তাতে এরা আরো সাহসী হয়ে উঠবে । সরকারের নিজেদের স্বার্থে এখন উচিৎ হবে প্রত্যেক দুর্বৃত্তকে আইনের আওতায় এনে সাজা দেয়া ঠিক যেমনটি বিশ্বজিৎ হত্যাকান্ডের বেলায় হয়েছিল । সংসদে প্রধানমন্ত্রীও তা অঙ্গিকার করেছেন । মনে রাখা ভাল বাংলাদেশের মতো দেশে বড় পরিসরে উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণার এখনো আশা ভরসা হচ্ছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় । প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় শুধু সম্পূরক ভূমিকা পালন করতে পারে আবার তার অনেকগুলিই নানা সমস্যায় জর্জরিত । সুতরাং দেশের উচ্চশিক্ষার প্রসার ও গুণগত মান রক্ষা করতে হলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে আদমজী পাট কলে রূপান্তরিত হতে দেয়া চলবে না । আর মনে রাখতে হবে একজন মেধাবী শিক্ষার্থীও যেন অর্থাভাবে উচ্চ শিক্ষা হতে বঞ্চিত না হয় । লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় । ফেব্রুয়ারি ৫, ২০১৪
WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action.
|
লেখকের আগের লেখাঃ |