[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

এই সহিংসতার জন্য আমরা লজ্জিত

 

প্রফেসর আবদুল মান্নান

সদ্য সমাপ্ত দশম সংসদ নির্বাচন নিয়ে সারা দেশে গত মাস দুয়েক ধরে যে ধরণের আলোচনা-সমালোচনা, তর্ক-বিতর্ক আর চায়ের কাপে ঝড় চলছিল অনেককে হতাশ করে দিয়ে নির্বাচনটি হয়ে যাওয়ার পর তাকে ঘিরে চলমান আলোচনাগুলিতে আরো অনেক নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে । সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলিতে একেবারে ফাটাফাটি কারবার চলছে । পত্রিকা গুলি নিজেদের মতো করে এই নির্বাচনের খবর প্রকাশ করেছে । কোন কোনটির আবার অনলাইন সংষ্করণের সাথে পাঠকের হাতে যাওয়া ছাপানো কপিটির মিল থাকছে না । টিভি টকশোর কোন কোন আলোচকতো পারলে টিভি পর্দা ফেটে বের হয়ে পরেন । বেগম জিয়ার পূত্র তারেক জিয়াতো সেই সুদূর লন্ডন হতে এখন তালেবান ষ্টাইলে ভিডিও বার্তা পাঠাতে শুরু করেছেন । নির্বাচনের পূর্বরাতে তিনি তার ‘জাতির উদ্দেশ্যে‘ ভাষণ দেয়ার ষ্টাইলে দেশবাসীকে নির্বাচন বর্জন আর প্রতিহত আর প্রতিরোধ করার ডাক দিলেন । তার আহ্বানে খুব বেশী সাড়া না পেয়ে তিনি পরদিন আবার একই কায়দায় দেশবাসীর সামনে হাজির হলেন । বললেন এই নির্বাচন মানি না । একে বাতিল করতে হবে । তারেক তার পিতার ষ্টাইল ভালই রপ্ত করতে পেরেছেন । তার পিতা জেনারেল জিয়া বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো পাকিস্তানের আইউব খানের মতো টিভিতে উর্দি পরে জাতির উদ্দেশ্যে সালাম জানিয়ে দেশবাসীকে জানিয়ে দিয়েছিলেন তাদের উদ্ধার করতে তিনি এসে গেছেন । আমার পাড়ার একধা চরমপন্থি রাজনীতির কর্মী সাবেক সরকারি কর্মচারি জামাল চাচা, যিনি কখনো ভোটের রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন না, তাকে ভোটের দিন দেখি লাইনে দাঁড়ানো । সালাম দিয়ে জানতে চাই হঠাৎ কেন তিনি ভোটের লাইনে । জামাল চাচার জবাবে আমার আক্কেল গুড়ুম । বলেন ‘ওই তারেক জিয়ার বক্তৃতা আমাকে ভোটের লাইনে নিয়ে এসেছে। সে ভাষণ দিয়ে দেশের মানুষকে নসিহত করার কে ? Who is he?’ ছোটকাল হতে দেখেছি চাচা উত্তেজিত হলে ইংরেজিতে কথা বলেন । দেশের ইল্কেট্রনিকস মিডিয়ার এখন বাড়ন্ত অবস্থা । আওয়ামী লীগ সরকারকে যতই সমালোচনা করি না কেন টিভির লাইসেন্স দেয়ার ব্যাপারে তারা একেবারে দরাজ দিল । লাইসেন্স পায় একজন তা দ্রুত হাত বদল হয়ে যায় অন্য জনের হাতে । শেখ হাসিনা তাঁর প্রথম সরকারের সময় একটি টিভি চ্যানেল নিজে উদ্বোধন করেছিলেন যদিও এটি প্রধানমন্ত্রীর কাজ নয় । সেই টিভি এখন জামায়াতের অর্থে চলে বলে সকলের ধারণা । নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হচ্ছে তা দেখানোর জন্য রিপোর্টার লাইনে দাঁড়ানো একজন ভোটারের সামনে মাইক ধরে জানতে চান ‘ভোটার আইডি কার্ড’ আছে কী না । ওই লোক বলেন, না নেই । এবার রিপোর্টার বলেন ‘উনার ভোটার আইডি কার্ড নেই, অথচ উনি ভোট দিতে লাইনে দাঁড়িয়েছেন ।’ কেমন আহম্মকি কথা । তিনি কী জানেন না দেশে ‘ভোটার আইডি কার্ড’ বলে কোন জিনিষের অস্থিত্ব নেই । যেটি আছে সেটি অনেক ক্ষেত্রে ভুলে ভরা ‘জাতীয় পরিচয় পত্র ।’ ভোট দিতে কোন ‘ভোটার আইডি কার্ড লাগেনা । ভোটার নম্বর লাগে । ভোটার তালিকায় ভোটারের ছবি থাকে । ওটার সাথে মিললেই হলো । আওয়ামী লীগ সরকারে থাকার কারণে কত অপদার্থ আর অযোগ্য ব্যক্তি কত জায়গায় কলকে পেয়ে গেল । বিদেশী গণমাধ্যম গুলি এই নির্বাচনের উপর রিপোর্ট করতে গিয়ে নির্বাচন নিয়ে না যত কথা বলেছে তার চেয়ে বেশী উৎসাহী হয়েছে এই নির্বাচনকে ঘিরে দেশে সন্ত্রাসের মাত্রা কত উপরে উঠেছে তা জানাতে । পাঠকের মনে থাকতে পারে ক’দিন আগে যুক্তরাষ্ট্র হতে প্রকাশিত ‘ফরেন পলিসি‘ ম্যাগাজিন আগামী এক বছরে যে দশটি দেশ সংঘাতে ঝুঁকিপূর্ণ হবে তার তালিকায় বাংলাদেশকে স্থান দিয়েছে । সুতরাং এখানে এখন যদি বলা হয় দুটির মধ্যে একটি যোগসূত্র আছে তখন কী মন্তব্যটি ফেলে দেয়া যাবে ?
বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের দূর্ভাগ্য যে দেশে নির্বাচন আসলেই কোন কোন এলাকায় তাদের উপর সন্ত্রাসের খড়গ নেমে আসে । কে হারলো আর কে জিতলো সেটি বড় প্রশ্ন নয়, প্রশ্ন হচ্ছে তারা ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ, সুতরাং কিছু মানুষ নামের হায়েনা সব সময় মনে করে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তাদের উপর হামলে পরা তাদের ঈমানী দায়িত্ব । যারা এই অত্যাচারের শিকার হন তারা বেশীর ভাগই নিম্ন বিত্ত অথবা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ । ২০০১ সালের নির্বাচনের পর দক্ষিণ বঙ্গে এমন হামলায় কয়েকশত মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল, দেশ ছাড়া হতে হয়েছিল কয়েক হাজার । তাদের একমাত্র অপরাধ তারা নাকি আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিল অথচ কে কাকে ভোট দেয় তা জানার কোন উপায় নেই । তবে এটি ভ্রান্ত ভাবে ধারণা করা হয় সংখ্যালঘু মানেই তারা আওয়ামী লীগের সমর্থক সুতরাং যে কোন উপায়ে তাদের দেশ ছাড়া করতে হবে যাতে বাংলাদেশকে আবার একটা মিনি পাকিস্তান বানানো যায় এবং নব্য মুসলীম লীগাররা সব সময় ক্ষমতায় থাকে । বাস্তবে বর্তমানে সংখ্যা লঘু সম্প্রদায়ের অনেকে ভয়েই ভোট কেন্দ্রের ধারে কাছে যান না । ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের একদিন পর জামায়াত শিবিরের দূর্বৃত্তরা দিনাজপুরে, যশোর ও উত্তর বঙ্গের আরো অনেক জেলায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাড়ী ঘরে, দোকান পাটে যে লুটতরাজ আর অগ্নিসংযোগ শুরু করেছে তাতে জাতি হিসেবে আমাদের সকলের লজ্জিত হওয়ার কথা । জামায়াত শিবির এই ধরণের হামলা করার সাহস পেয়েছে বিরোধী দলের নির্বাচন প্রতিহত আর প্রতিরোধ করার ডাকের কারণে । এই সহিংসতা প্রতিরোধ করতে না পারা সরকারের বড় ব্যর্থতা । সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতো রামকৃষ্ণ মিশনের সদস্যের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলে হবে না । তাদেরতো এটা মনে রাখতে হবে এই দূর্বৃত্তদের হাতেই তাদেরই সহকর্মীরা নিয়মিত বিরতি দিয়ে মারা যাচ্ছে আর তাদের একটি অংশ যদি এই ধরণের সহিংসতায় নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে তাহলেতো এই দূর্বৃত্তরা এটি তাদের দূর্বলতা হিসেবে দেখবে । এমন দিন হয়তো আসবে যখন তারাও এই দূর্বৃত্তদের হাতে আক্রান্ত হবেন ।
নির্বাচনের আগে ও পরে এই নির্বাচনকে নানা ভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করার অবিরাম চেষ্টা হয়েছে । নির্বাচনের আগে সমঝোতা সমঝোতা বলে অনেকে গলা ফাটিয়েছেন । চেষ্টাও করেছেন কেউ কেউ । শেষে এসেছিলেন জাতি সংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত । শেষ পর্যন্ত তিনিও ব্যর্থ হয়ে ফিরে গিয়েছেন । কিন্তু বাস্তবতা কেউ তেমন একটা বুঝতে চান নি । বিএনপিতো এখন নিজের রাজনীতি বাদ দিয়ে জামায়াতের রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত । বিএনপি’র বর্তমান রাজনীতি দেশের সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক বাতিল হয়ে যাওয়া ত্রয়োদশ সংশোধনী আর জামায়াতের রাজনীতি হচ্ছে যে কোন উপায়ে হোক যুদ্ধাপরাধের দায়ে যারা অভিযুক্ত ও দ-প্রাপ্ত তাদের শীর্ষ স্থানীয় নেতৃবৃন্দের মুক্তি । বিএনপি’র ছাতার নীচে আশ্রয় নিয়ে তারা তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য আন্দোলনের নামে সাড়া দেশে গত দু’বছর ধরে তান্ডবে লিপ্ত । বেগম জিয়াতো প্রকাশ্যেই তাদের এই সব নেতাদের মুক্তি দাবি করেছেন এবং সোমবার বিবিসি’র সাথে এক সাক্ষাৎকাওে বলেছেন তিনি জামায়াতের সঙ্গ ছাড়তে পারবেন না । সুতরাং তারাতো কখনো চাইবে না বেগম জিয়া তাদের মাঝপথে ফেলে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করুক কারণ নির্বাচনে যে বিএনপি বিজয়ী হতে পারবে তার নিশ্চয়তাকে কে দেবে? এটি সত্য গত কয়েক মাসে নির্বাচন নিয়ে একাধিক জরিপ পরিচালিত হয়েছে এবং এগুলির বেশ কয়েকটি বলেছে দশম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি জিতবে । তবে বাস্তবে সব সময় এই সব জরিপ সঠিক অবস্থার প্রতিফলন করে না। যুক্তরাষ্ট্রে এমন জরিপ অনেক হয়েছে যেখানে যা ঘটেছে আর জরিপের ফলাফল ছিল উল্টো । নির্বাচনে জিতবে এমন নিশ্চয়তা পেলে বিএনপি নির্বাচনে হয়তো যেত কিন্তু তাতেও সন্দেহ আছে কারণ যে কোন কারণেই হোক বর্তমান অবস্থায় জামায়াতের খোয়াড়ে বিএনপি বাঁধা আছে । নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি নিয়ে যারা কথা বলেন তাদের উদ্দেশ্যে বলি গত দু’মাস ধরে হরতাল আর অবরোধের নামে সারা দেশে যে অচল অবস্থা সৃষ্টি করে রেখেছে বিএনপি-জামায়াত জোট তার কারণে ক’জন ভোটার ভোট দিতে নিজ গ্রাম বা বাড়ী যেতে পেরেছেন ? আমার বাসায় পাঁচ জন ভোটার । এক আমি ছাড়াতো আর কেউ এবার ভোট দিতে যেতে পারেনি কারণ সকলকে বিমানে নিয়ে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিলনা । আর নির্বাচনের আগের কয়েকদিন নির্বাচন প্রতিহত ও প্রতিরোধের নামে যে মাত্রার সহিংসতা হয়েছে তাতে একজন সাধারণ গ্রামের মানুষ যদি নির্বাচন কেন্দ্রে যেতে ভীত হয় তা হলে নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির গড় হারতো কম হবেই । তবে সব চেয়ে বড় কথা হলো এত সবের পরও অনেক কেন্দ্রে ভোটাররা নিজের জীবন হাতে নিয়ে ভোট দিতে গেছেন এবং তাদের অনেকেই ভোট দেয়ার অপরাধে ৬ তারিখের ডেইলি ষ্টারের প্রথম পৃষ্টায় প্রকাশিত দুজন ভোটারের মত পরিণতি ভোগ করেছেন ।
প্রধানমন্ত্রী ৬ তারিখ তার সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন তিনি সন্ত্রাসীদের কঠোর হস্তে দমন করবেন । দেশের মানুষ তাঁর এই বক্তব্যের বাস্তব রূপ দেখতে চায় । দেখতে চায় দিনাজপুর যশোরের মতো ঘটনা যেসব দূর্বৃত্তরা ঘটিয়েছে তাদের প্রত্যেককে গ্রেফতার করা হোক এবং আইন অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়া হোক । আর যারা এই নির্বাচনটি হয়ে গেল বলে হাহাকার করছেন তারাও নির্বাচন পরবর্তিকালের সহিংসতা উস্কে দেয়ার জন্য কম দায়ি নন । এই সহিংসতার জন্য জাতি হিসেবে আমরা লজ্জিত ।

লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্বদ্যিালয়। জানুয়ারি ৭, ২০১৪

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ

[......লেখক আর্কাইভ]