প্রথমপাতা  

সাম্প্রতিক সংবাদ 

 স্বদেশ

আন্তর্জাতিক

বাংলাদেশ কমিউনিটি

লাইফ স্টাইল

এক্সক্লুসিভ

বিনোদন

স্বাস্থ্য

বর্তমানের কথামালা

 শিল্প-সাহিত্য

 প্রবাসপঞ্জী 

আর্কাইভ

যোগাযোগ

@

@

@

@

@

@

বৃটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য কি অস্তাচলে?

@


প্রফেসর আবদুল মান্নান

স্কটল্যান্ডের এডিনবারা ক্যাসেল দুর্গের প্রবেশ দ্বারে দুটি বিশাল মূর্তি । একটি রাজা রবার্ট ব্রুসের অন্যটি স্কটল্যান্ডের জাতীয় মাসকট, দাঁড়ানো সিংহের । ট্যুর গাইড সেখানে পর্যটকদের দাঁড় করিয়ে বললেন এটি আমাদের জাতীয় বীর রবার্ট ব্রুসের মূর্তি, যিনি স্কটল্যান্ডকে ইংরেজদের কাছ হতে স্বাধীন করার জন্য দীর্ঘ বিশ বছর যুদ্ধ করেছিলেন । সর্বশেষ ১৩১৪ সালে ব্রুস ইংরেজদের পরাজিত করে স্বাধীন স্কটল্যান্ড প্রতিষ্ঠা করেন । স্কুল জীবনে এই সব ইতিহাস পড়তে হতো । শিরোনাম ছিল eএকবার না পারিলে দেখ শতবার f। ব্রুস স্কটল্যান্ডকে স্বাধীন করার পূর্বে সাতবার ইংরেজদের হাতে পরাজিত হয়েছিলেন । দাঁড়ানো সিংহটি সম্পর্কে গাইড বলেন এটি স্কটল্যান্ডের সিংহ, সব সময় দাঁড়ানো আর ইংরেজদের সিংহ সারা জীবন ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিল । শহরের মাঝখানে স্কটল্যান্ডের জাতীয় পার্লামেন্ট । সদর দরজা বন্ধ । সামনে কেউ একজন লিখে দিয়েছে একদিন যখন স্কটল্যান্ড স্বাধীন হবে এই দরজা খুলবে । এই সব ১৯৮৯ সনের কথা । এর মধ্যে নিশ্চয় অনেক কিছুরই পরিবর্তন হয়েছে । তবে যেই পরিবর্তনটির জন্য এক বিরাট সংখ্যক স্কট জনগোষ্ঠী সেই ১৭০৭ সাল হতে অপেক্ষা করছে সেটি তারা নিজেরাই গত ১৮ই সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত এক গণভোটে খারিজ করে দিল স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার বিপক্ষে ভোট দিয়ে । স্বাধীনতার পক্ষে পরেছে ৪৫ ভাগ আর বিপক্ষে ৫৫ ভাগ । ১৯৭৯ সালেও এমন এক গণভোটে মাত্র ২৭ ভাগ পক্ষে পরেছিল । ৪০ ভাগের বেশী না হলে সেই ভোটের কোন গুরুত্ব থাকে না । ১৭০৭ সালে স্কটল্যান্ড ও ইংল্যান্ড এক চুক্তি বলে দুই দেশকে এক করার সিদ্ধান্ত নেয় । সেই থেকে স্কটল্যান্ড গ্রেট বৃটেন বা যুক্তরাজ্যের অংশ । সাথে আছে ওয়েলস আর উত্তর আয়ারল্যান্ড । তারাও স্বাধীন হতে চায় কিন্তু চাহিদা স্কটদের মতো এত জোরালো নয় । আয়ারল্যান্ডের একটি অংশ আগেই স্বাধীন হয়ে গেছে ।
ইংরেজদের তুলনায় স্কটরা অনেক বেশী স্বজ্জন আর ভদ্র । তাদের একটি বড় অংশ স্কটিশ জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারা ধারণ করেন । স্কটদের নিজস্ব এক পাউন্ড নোটও আছে । এক সময় স্কটল্যাল্ড জাহাজ নির্মাণ, ব্যাংকিং, ইস্পাত, পাট প্রক্রিয়াকরণ, পর্যটন, আর হুইস্কি তৈরীর জন্য প্রসিদ্ধ ছিল । কালক্রমে বিশ্বায়নের যুগে এই সব শিল্পের অধিকাংশই বর্তমানে আর স্কটল্যান্ডের অর্থনীতিতে তেমন কোন অবদান রাখে না । পাট প্রক্রিয়াকরণ শিল্প অনেক আগেই পাটের নিজ দেশ বাংলাদেশ আর ভারতে হিজরত করেছে । ব্যাংকিং শিল্প বহুজাতিক ব্যাংকগুলির সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারে নি । জাহাজ নির্মাণ আর ইস্পাত শিল্প অর্থনৈতিক ভাবে তাদেও জন্য আর লাভজনক নয় । বাকি থাকলো পর্যটন আর হুইস্কি । স্কটল্যান্ড লাগোয়া উত্তর আটলান্টিক সাগরে তেলের প্রচুর মজুত আছে তবে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য উঠানামা করার কারণে তার উপর সব সময় নির্ভর করা যায় না । গ্রেট ব্রিটেনের বাজেটে তার অন্যান্য অঞ্চলের মতো স্কটল্যান্ডের জন্যও বরাদ্দ রাখা হয় তবে তা পর্যাপ্ত নয় । সকলের দাদা, বৃটিশ পার্লামেন্ট ওয়েষ্টমিনিস্টার যেখানে অবস্থিত, সেই ইংল্যান্ডের নিজের অর্থনীতিও তেমন একটা সুবিধাজনক অবস্থায় নেই । এর ফলে স্কটরা মনে করে তারা ওয়েষ্টমিনিস্টারের একচোখা নীতির কারণে অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার । দিন দিন বেকারত্ব বেড়েই চলেছে । বর্তমানে সারা স্কটল্যান্ডে বেকারত্বের হার ১৩ শতাংশের কাছাকাছি । স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টির (এসএনপি) নেতা এলেক্স স্যামন্ড ঘোষণা করেছিলেন তার দল নির্বাচনে বিজয়ী হলে তিনি স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার জন্য গণভোটের আয়োজন করবেন । স্বাধীন স্কটল্যান্ডের সম্ভাবনা অপার । গণভোটের জন্য প্রয়োজন হবে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি । ২০১১ সালের নির্বাচনে স্যামন্ডের দল এসএনপি জয়ী হয়েছিলো এবং স্যামন্ড গণভোটের জন্য বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের অনুমতিও আদায় করেছিলেন । eহাঁf ভোটের পক্ষে ব্যাপক প্রচারও চালিয়েছিলেন । প্রথম দিকে মনে হচ্ছিল ২০১৪ সালের গণভোটও ১৯৭৯ সালের ভাগ্য বরণ করবে । কিন্তু যতই দিন যায় ততই পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে । এলেক্স স্যামন্ড আর তার পক্ষের লোকজন জনগণকে বুঝাতে চেষ্টা করেন স্কটদের অবস্থার পরিবর্তন করতে হলে তাদের স্বাধীন হওয়ার কোন বিকল্প নেই । অনেকটা সত্তরের বাংলাদেশ । প্রমাদ গুনলেন ডেভিড ক্যামেরন সহ রক্ষণশীল, লেবার আর লিবারেল ডেমোক্রেটদের সকল বাঘা বাঘা নেতারা । রক্ষণশীল পার্টির নেতা ও বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন, লেবার পার্টির নেতা এড মিলিব্যান্ড আর লিবারেল ডেমোক্রেটদের নেতা নিক ক্রেগ ছুঠলেন স্কটল্যান্ডে । লেবার দলীয় নেতা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী এড মিলিব্যান্ড গিয়ে বলে আসলেন স্কটল্যান্ডকে আরো বেশী স্বায়ত্ব শাসন দেয়া হবে । এর অর্থ কী হতে পারে তা তেমন একটা কেউ বুঝলো না । বৃটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য বুঝি চিরদিনের জন্য অস্তগামী হওয়ার দ্বারপ্রান্তে । এমন সময় কী আর ঘরে বসে থাকা যায় ? স্কটল্যান্ড স্বাধীন হলে যুক্তরাজ্য হারাতে পারে জাতি সংঘে তার স্থায়ী আসনটি । ছিটকে পরতে পারে ইউরোপীয় ইউনিয়ন হতে । স্কটল্যান্ড ইউরোপের মূল ভূখন্ডের অনেক কাছে । ইংল্যান্ডের পরিবর্তে তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ দাবি করতে পারে । ইংল্যান্ড ইউরোপীয় ইউনিয়নে না থাকলে বিদেশী পুঁজি আসাটা সহজ হবে না । এতে অর্থনীতির উপর চাপ পরবে আরো বেশী । বৃটেনের প্রায় সব পারমানবিক সাবমেরিন যুদ্ধজাহাজ স্কটল্যান্ডের বন্দরে নোঙর করা । সেই সব চলে যেতে পারে স্বাধীন স্কটল্যান্ডের দখলে । বিশ্ব দরবারে বর্তমানে বৃটেনের যে খায়খাতির তাও আর থাকবে না । মহা ফ্যাসাদে ডেভিড ক্যামেরন আর ইংরেজ রাজনীতিবিদরা । তাহলে যে বৃটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য কখনো অস্ত যেত না এখন হতে তা কী শুধু ইংল্যান্ড বা পাশের দুfএকটা এলাকার উপরই দেখা যাবে? ঠিক এমনটি হয়েছিল শেষ মোগল সাম্রাটের আমলে । তখন মোগল সাম্রাজ্য দিল্লির লাল কিল্লার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পরেছিল । শেষ-মেষ একদা সুপার পাওয়ার বৃটেনের অবস্থাও কী তাই হবে ? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বৃটেন এমন মহাসঙ্কটে আর পরে নি । সব দলের নেতারা প্রকাশ্যে স্বীকার করলেন স্কটল্যান্ডের প্রতি অবিচারতো হয়েছেই তা অস্বীকার করি কী ভাবে ? কথা দিচ্ছি আগামীতে আর হবে না ।
চতুর ইংরেজদের সাথে সহজ সরল স্কটরা পারবেন কেন ? স্বাধীনতাকামীদের কাছে বার্তা পৌঁছে দিল স্বাধীন হতে পারো তবে বর্তমানে বৃটেনের যে বিশাল ধার দেনা আছে তার আনুপাতিক ভার তোমাদের নিতে হবে । স্পেন জানিয়ে দিল স্বাধীন স্কটল্যান্ড ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হতে চেষ্টা করলে তারা বাধা দেবে । স্পেনের একটি অংশের স্বাধীনতার দাবি আবার বহু পুরোনো । তেমন অবস্থা ফ্রান্সেরও । ওবামা খবর পাঠালেন স্বাধীন স্কটল্যান্ড, কখনো না । ইংরেজরা ঠিকই জানে কাকে দিয়ে সুতা টানালে কী কাজ হয় । তা না হলে কী তারা ভারতবর্ষে দুইশত বছর রাজত্ব করতে পারতো ? যুক্তরাজ্যে ১৭ই সেপ্টেম্বরের রাতটি ছিল দীর্ঘতম রাত । বেঁচে থাকা বৃটিশ সাম্রাজ্যের শেষ সূর্যটা কী কাল উদয় হবে? স্বাধীনতার পক্ষে স্কটরা মনে করলেন কালকেই পরাধীন স্কটল্যান্ডের শেষ সূর্যোদয় হবে । না কারো প্রত্যাশা সত্য হলো না । ইংরেজদের চাতুর্য্যের কাছে হেরে গেল স্কটদের সকল প্রস্তুতি । ১৮ তারিখ রাতে যখন ভোট গণনা শেষ হলো দেখা গেল ৫৫ শতাংশ স্কট নিজ দেশের স্বাধীনতা চায় না । শেষ মূহূর্তে তারা ঘাবড়ে গিয়ে থাকতে পারেন। কী ভাবে পরিশোধ হবে তাদের ভাগের এত বিশাল দেনা ? স্বাধীন হলেতো তাদের প্রতি ইংরেজদের আচরণ আরো বৈরি হয়ে যেতে পারে । আর ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ না পেলে তাতে ঘটতে পারে বিরাট অর্থনৈতিক বিপর্যয় । ১৯ তারিখ ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন তার ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের সরকারি বাড়ীর সামনে সাংবাদিকদের হাসি মুখে স্বস্তি প্রকাশ করে বললেন eআমরা আগের চেয়ে আরো শক্তিশালীf । পরাজয় মেনে স্কটল্যান্ডের ফার্স্ট মিনিস্টার ও স্বাধীনতাকামীদের নেতা এলেক্স স্যামন্ড তার মন্ত্রীত্বের পদ হতে ইতোমধ্যে ইস্তফা দিয়েছেন ।
১৮ তারিখের নির্বাচন ইংল্যান্ডে তথা বৃটিশ পার্লামেন্ট ওয়েস্টমিনিস্টারের জন্য হতে পারতো একটি অশনি সংকেত । এবার ৫৫ শতাংশ স্বাধীনতার বিপক্ষে ভোট দিয়েছে । আগামীতে, তা হতে পারে দশ কুড়ি বছর পর, এই ফলাফল উল্টে যেতে পারে যদি না নির্বাচনের পূর্বে দেয়া সকল প্রতিশ্রুতি বৃটিশ সরকার পূরণ না করে । ইংরেজরা সব সময় প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে তাও নয় । নির্বাচনের পূর্বে স্কটদের দেয়া প্রতিশ্রুতি ভাঙ্গার লক্ষণ ইতোমধ্যে দেখা দিয়েছে । তবে এই নির্বাচন যে বৃটেনকে রাজনৈতিক ভাবে নড়বড়ে করে দিল তা অনেক বিশ্লেষক স্বীকার করেছেন । এই প্রসঙ্গে লন্ডনের বহুল প্রচারিত গার্ডিয়ান পত্রিকায় ১৯ তারিখ রাজনৈতিক বিশ্লেষক জনাথন ফ্রীডল্যান্ড লিখেছেন eস্কটল্যান্ড একটি অসাধারণ বিপ্লবের জন্ম দিয়েছে । ওয়েস্টমিনিস্টার যেন তাকে নস্যাত করতে না পারেf। এই প্রজন্ম হয়তো স্বাধীন স্কটল্যান্ড দেখে যেতে পারবে না । হয়তো পরবর্তী প্রজন্ম ভিন্ন কিছু দেখতেও পারে । অনেকের প্রশ্ন বৃটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য কী তা হলে অস্তাচলে? হতেও পারে । সাম্রাজ্য চিরস্থায়ী হওয়ার নজির ইতিহাসে নেই ।

লেখক: গবেষক ও বিশ্লেষক । সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় । সেপ্টম্বর ২৩, ২০১৪

@

@

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

@

[প্রথমপাতা]

@

@

@

লেখকের আগের লেখাঃ

[......লেখক আর্কাইভ]