|
জঙ্গিাবাদ, বারটিল লিন্টনার ও এক অপরাহ্ন
-প্রফেসর আবদুল মান্নান বাংলাদেশে যারা পত্র-পত্রিকার পাঠক তাদের অনেকের কাছে সাংবাদিক বারটিল লিন্টনার নামটি অপরিচিত নয় । ২০০২ সালের এপ্রিল মাসের ৪ তারিখ হংকং হতে প্রকাশিত বিখ্যাত সাময়িকী ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ পত্রিকায় Bangladesh-a cocoon of terror (বাংলাদেশ-জঙ্গিবাদের সূতিকাগার) শিরোনামে লিন্টনার লিখিত একটি প্রচ্ছদ প্রতিবেদন ছাপা হয় যার ফলে দেশে এবং দেশের বাইরে বেশ হৈচৈ পড়ে যায় কারণ এই সময় আফগানিস্তানে তালেবানদের তৎপরতা ছিল বেশ চোখে পরার মতো যদিও তত দিনে আফগানিস্তানের শাসন তাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। সেই প্রচ্ছদে হেফাজতি ষ্টাইলের মাদ্রাসার জঙ্গি ছাত্রদের একটি ছবিও প্রকাশিত হয় । প্রবন্ধে বলা হয় বাংলাদেশ একটি আদর্শ শান্তি প্রিয় মুসলিম প্রধান কিন্তু সেক্যুলার ভাবধারার দেশ হলেও কি ভাবে তা জঙ্গিবাদের অভয়ারণ্যে রূপান্তরিত হচ্ছে । এ নিয়ে তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকার তীব্র ক্ষোভে ফেটে পরে এবং বলে এই সব হচ্ছে বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি খর্ব করার জন্য আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্র । তার কিছুদিন পর একই বছর অক্টোবর মাসে বিশ্বখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনে এলেক্স পেরী লেখেন উবধফষু ঈধৎমড় শিরোনামে আর একটি প্রচ্ছদ প্রতিবেদন যাতে বলা হয় রাতের অন্ধকারে আফগানিস্তান হতে কেমন করে একটি জাহাজ বোঝাই আফগান তালেবান চট্টগ্রাম হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে । পরবর্তীকালে জানা যায় সেই তালেবানদের মধ্যে আল কায়দা নেতা আইমান আল জাওহিরিও ছিলেন এবং তিনি কয়েক মাস চট্টগ্রাম অবস্থান করেন এবং বিভিন্ন মাদ্রাসার শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের সাথে মত বিনিময় করেন । তা নিয়ে চার দলীয় জোট সরকার পুনরায় বেশ হৈ চৈ ফেলে দেয় এবং সেখানেও আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করে । এর কিছুকাল পর ২০০৪ সালের ২১ আগষ্ট বঙ্গবন্ধু এভেন্যুতে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গ্রেনেড হামলা করে ২৩ জন আওয়ামী নেতাকে হত্যা করা হয় । তখনো সংসদে দাঁড়িয়ে চারদলীয় জোটের একাধিক নেতা এই ঘটনার জন্য আওয়ামী লীগের অন্তঃ কলহকে দায়ী করেন । পাশের দেশ মায়ানমারের এক কালের রাজধানী রেঙ্গুনে (ইয়াঙ্গুন) সম্প্রতি দেখা হলো বারটিল লিন্টনারের সাথে । কথা হলো অনেকক্ষণ । জানা হলো অনেক না জানা কথা । লিন্টনার বর্তমানে থাকেন থাইল্যান্ডের পর্যটন শহর চেংমাইতে । সাংবাদিকতা আর জঙ্গিবাদ নিয়ে গবেষণা আর লেখালেখির সাথে এখনো বেশ সক্রিয়ভাবে জড়িত অেেছন । সম্প্রতি তার নতুন বই এৎবধঃ এধসব ঊধংঃ প্রকাশিত হয়েছে । সেই বইয়ে তিনি ভারত-বাংলাদেশ-মায়ানমার-চীন সীমান্তে জঙ্গিবাদের ভয়াবহ উত্থান সম্পর্কে লিখেছেন । লিন্টনারের বইতে চট্টগ্রামের দশ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনাও উল্লেখিত হয়েছে । লিন্টনার ইয়াঙ্গুন এসেছিলেন একটি আন্তর্জাতিক মিডিয়া সম্মেলনে যোগ দিতে । মিডিয়ার কেউ না হয়ে আমিও গিয়েছিলাম সেই সম্মেলনে একজন শ্রোতা হয়ে । পরিচয় হতেই লিন্টনারকে বলি বাংলাদেশে তার নামটি সুধি মহলে বেশ পরিচিত এবং আমি যখনই সুযোগ পাই তার লেখা আর বই এর কথা উল্লেখ করি । তার কাছে সময় চাই কথা বলতে । সানন্দে তিনি রাজি । বলেন পরদিন সম্মেলনের এক ফাঁকে বসা যাবে । খবর দেই বাংলাদেশ হতে আশা আমার আরো দুই অনুজপ্রতিম সাংবাদিককে। পরদিন অপরাহ্নের কফি ব্রেকের এক ফাঁকে আমরা চারজন বেশ রিলেক্সড্ মুডে বসি কথা বলতে । কথা বলছেন লিন্টনার আর শ্রোতা আমরা তিন জন । লিন্টনারের কথার ফাঁকে ফাঁকে দু’চারটি প্রশ্ন । একজন পর্যটক হিসেবে ভারত হতে ভুরুঙ্গামারী সীমান্ত দিয়ে ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিলেন লিন্টনার। ঘুরে বেড়িয়েছেন বাংলাদেশে । দেখেছেন অপার সম্ভাবনার একটি দেশকে । চারিদিকে এত সবুজ এবং এত পরিশ্রমী মানুষ । পরিচিত হয়েছেন অনেকের সাথে । সুইডিশ বংশোদ্ভুত লিন্টনার প্রেমে পরে যান দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার । সাংবাদিক হিসেবে যোগ দেন ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউতে । ঘর বাঁধেন বার্মার সান প্রদেশের সাং নুং এর সাথে । তার দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনে তাঁকে অনেক প্রতিকূল অবস্থা পাড়ি দিতে হয়েছে । একসময় তার প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল বার্মায় । উত্তর কোরিয়া গিয়েছিলেন ২০০৪ সালে । এখন যেতে পারবেন কী না না নিশ্চিত নন । বার্মা প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়েছে সম্প্রতি । নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকা কালিন যারা তার সোর্স হিসেবে তাকে সহায়তা করেছিলেন তিনি এবার তাদের সাথে বেশ সময় কাটিয়েছেন । এদের কয়েকজন বার্মার মিলিটারি জান্তার কারাগারে দীর্ঘ দিন অমানুষিক নির্যাতন ভোগ করেছেন । ২০১১ সাল পর্যন্ত বার্মায় কোন বিদেশি সাংবাদিকের প্রবেশাধিকার ছিল না । সকলে ব্যাঙ্কক হতে বিভিন্ন সোর্সের মাধ্যমে প্রাপ্ত সংবাদ বিশ্বের গণমাধ্যমে প্রচার করতো । সব অগণতান্ত্রিক সরকার স্বাধীন গণমাধ্যমকে ভয় করে । বার্মায় গণমাধ্যমের উপর হতে নিয়ন্ত্রণ কিছুটা শীতিল হলেও এখনো তা পুরো মাত্রায় স্বাধীন তা বলা যাবে না । সাংবাদিকদের চোখ কান খোলা রেখে কাজ করতে হয় । বিপদ কোন দিক হতে আসে বলা যায় না । ২০০২ সালে সাংবাদিক হিসেবে বাংলাদেশে ফিরে আসেন লিন্টনার । এপ্রিল মাসে লিন্টনারের বাংলাদেশ বিষয়ক প্রতিবেদন ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউতে প্রকাশিত হলে চারদলীয় জোট সরকার বলেছিল এই প্রতিবেদন লিখতে তাকে সহায়তা করেছিল আওয়ামী লীগ । লিন্টনার জানিয়েছেন কথাটি ঠিক নয় । বস্তুতপক্ষে তখন তার সাথে কোন আওয়ামী লীগ নেতার দেখাই হয়নি । ঢাকায় এক সাংবাদিকের (বর্তমানে প্রয়াত) বাড়িতে এক ঘরোয়া পার্টিতে বরং বিএনপি’র বেশ ক’জন সিনিয়র নেতা আর মন্ত্রীর সাথে পরিচিত হয়েছিলেন । তাদের জানিয়েছিলেন তিনি কয়েকদিনের মধ্যে চট্টগ্রাম যাচ্ছেন এবং সেখানে তিনি রোহিঙ্গা শরনার্থী শিবির সরেজমিনে পরিদর্শন করবেন । সেই সাংবাদিককে বঙ্গবন্ধু খুব স্নেহ করতেন । পরবর্তীকালে তিনি বঙ্গবন্ধুর কঠোর সমালোচক হয়ে উঠেন । বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর তিনি জিয়ার মন্ত্রী হন এবং পরবর্তীকালে তিনটি দেশে রাষ্ট্রদূত হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন । লিন্টনার ঢাকা হতে চট্টগ্রাম হয়ে উখিয়া টেকনাফে অবস্থিত রোহিঙ্গা শরনার্থী শিবির সফর করেন এবং অনেক রোহিঙ্গা নেতার সাথে কথা বলেন । তারা লিন্টনারকে পাহাড়ে অবস্থিত তাদের জঙ্গি ট্রেনিং ক্যাম্পে নিয়ে যান । তিনি দেখেন অনেক জঙ্গি সেখানে অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষণ নিচ্ছে যাদের কেউই রোহিঙ্গা নন । তারা প্রায় সকলে বাংলাদেশি এবং জামায়াত ও ইসলামী ছাত্র শিবিরের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত । তিনি আরো জানতে পারেন এই প্রশিক্ষণরত জঙ্গিদের মধ্যে কেউ কেউ আবার এসেছে ইন্দোনেশিয়ার সুলেভেসি দ্বিপ হতে । সেখানে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন আছে । তাকে জানানো হয় তাদের এই প্রশিক্ষণে সহায়তা করে আফগানিস্তানের তালেবান নেতা গুলবুদ্দিন হেকমতইয়ার আর এই প্রশিক্ষণ তত্ত্বাবধান করেন আবদুল কুদ্দুস বর্মি নামের একজন আরাকান ভিত্তিক হুজি নেতা । লিন্টনার জানান পরবর্তীকালে বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তন হলে কুদ্দুস করাচি চলে যান । তার সাম্প্রতিক অবস্থান সম্পর্কে লিন্টনার অবগত নন । তবে তার ধারণা কুদ্দুস করাচিতেই আছেন । তাকে মোট তিনটি জঙ্গি সংগঠনের নেতাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় । প্রথমটি আরাকান রোহিঙ্গা ইসলামিক ফ্রন্ট বা আরিফ । দ্বিতীয়টি আরাকান সলিডারিটি অরগানাইজেশন বা আরএসও । আর শেষেরটি হিযবুল ইসলাম । ‘আরিফ’ এর নেতারা তাকে একটি ছবির অ্যালবাম দেখতে দেন যাতে তাদের সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রশিক্ষণের ছবি আছে । তাকে বলা হয় তিনি ইচ্ছা করলে অ্যালবাম হতে ছবি নিতে পারেন । লিন্টনার বলেন তিনি বরং নিজেই ছবি তুলবেন । লিন্টনারের তোলা অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষণরত এমন একটি ছবি তার সাম্প্রতিক প্রকাশিত বই ‘গ্রেট গেম ইস্ট’ এ ছাপা হয়েছে । ছবিটি টেকনাফে তোলা । লিন্টনারের কাছে জানতে চাই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এমন জঙ্গি প্রশিক্ষণ চলছে তা কী সরকার জানতো বলে তার মনে হয় ? উত্তরে তিনি জানান এমন একটি কর্মযজ্ঞ সম্পর্কে সরকার জানবে না তা বিশ্বাসযোগ্য নয় । প্রশিক্ষণের পর কোথায় যায় এই সব জঙ্গিরা ? এমন প্রশ্ন করলে লিন্টনার জানান এরা কেউ কিন্তু আরাকানে গিয়ে রোহিঙ্গাদের পক্ষে যুদ্ধ করে না । রোহিঙ্গা মুসলমানরা খুবই দরিদ্র এবং তারা বর্তমানে প্রায় সকলেই সরকার নিয়ন্ত্রিত ক্যাম্পে বাস করেন । অনেক গ্রামই পুরুষ শূন্য । বেশীর ভাগই বাংলাদেশে, মালয়েশিয়া, থাইল্যা- বা মধ্যপ্রাচ্যে । বাংলাদেশ হতে ঘুষের বিনিময়ে পাসপোর্ট যোগাড় করে মধ্যপ্রাচ্য যাওয়া অনেক সহজ । সারজায় আরএসও’র একটি দপ্তর আছে এবং তারা রোহিঙ্গাদের রিলিফ সরবরাহের নামে সৌদি আরব, কুয়েত আর আরব আমিরাত হতে প্রচুর অর্থ সংগ্রহ করে এবং রিলিফের বদলে জঙ্গি প্রশিক্ষণে ব্যয় করে । এ ছাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প গুলিতে কর্মরত বেশ কিছু এনজিও এদের সহায়তা করে । লিন্টনারের ধারণা জঙ্গিদের দৃষ্টি বাংলাদেশের রাজনীতির দিকে যদিও তারা অন্য দেশের, যেমন আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত, বার্মা আর থাইল্যান্ডের জঙ্গিদের সাথেও কাজ করে । এই মুহূর্তে তাদের অবস্থান অনেকটা ভাড়াটে সৈন্যের মতো । লিন্টনারের মতে তাদের সাথে জামায়াতের সম্পর্ক সব চেয়ে বেশী । লিন্টনারের কাছে জানতে চাই তিনি কী মনে করেন বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান নিয়ে চিন্তিত হওয়ার মতো তেমন কিছু আছে ? তিনি জানান যদিও তিনি বেশ অনেকদিন বাংলাদেশে আসেন নি তবে সরকার আর জনগণ যদি সতর্ক না হয় তা হলে বিপদ থেকেই যাবে । সব শেষ প্রশ্ন ২০১৫ সালে মায়ানমারে যে নির্বাচন হওয়ার কথা আছে তা কী হবে ? উত্তরে তিনি জানান হবে তবে সেই নির্বাচনে যদি দেখা যায় বার্মায় সেনা বাহিনীর ক্ষমতা বিন্দুমাত্র খর্ব হয়েছে তবে দেশটি আবার তার পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাবে । প্রায় ঘন্টাখানেক কথা বলে উঠার আগে জানতে চাই বাংলাদেশে কবে আসছেন ? জবাবে বলেন ‘জানি না তবে সম্বভত এখন আবার বাংলাদেশে যাওয়ার সময় হয়েছে’ । লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় । মার্চ ১৫, ২০১৪
WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action.
|
লেখকের আগের লেখাঃ
|