[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

আর একটি এক এগারোর প্রত্যাশীদের অপেক্ষা

 

প্রফেসর আবদুল মান্নান

পাঠকদের মনে থাকতে পারে ২০০৬ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে যখন অধুনালুপ্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রধান উপদেষ্টা নিয়ে দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মাধ্য টানাপোড়েন শুরু হয়েছিল ঠিক তখন গুলশানের একটি কনভেনশন সেন্টারে দেশের বেশ ক’জন বাঘা বাঘা সুশীল ব্যক্তি ‘যোগ্য প্রার্থী আন্দোলনের’ ব্যানারে জড়ো হয়েছিলেন এবং বলেছিলেন আসন্ন সংসদ নির্বাচনে তারা প্রত্যেক নির্বাচনী এলাকায় যোগ্য প্রার্থী মনোনয়ন দেয়ার জন্য আন্দোলন করবেন এবং অন্তত একজন প্রতিথযশা সুশীল ব্যক্তি ঘোষণা করেছিলেন যদি কোন আসনে তাঁদের প্রত্যাশিত ‘যোগ্য’ প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়া না হয় তা হলে তারা নিজেরাই সেখানে যোগ্য প্রার্থী দেবেন । সাংবাদিকরা এই বিষয়ে আর একজনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন এটি তাঁর ব্যক্তিগত মত । প্রথম সম্মানিত সুশীল পরবর্তী কালে একটি রাজনৈতিক দলও গঠন করেছিলেন । এটি ছিল ১/১১ এর পর সেনা সমর্থিত সরকারের পৃষ্টপোষকাতায় যে কটি কিংস পার্টি গঠিত হয়েছিল তার একটি । কিছুদিন পরই সেই পার্টির স্বাভাবিক মৃত্যুও হয়েছিল । এই সমাবেশের কুশিলবদের বেশ কয়েকজন পরবর্তী কালে মাইনাস টু ফর্মুলার জন্ম দিয়েছিলেন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য জোরালো ভূমিকা রেখেছিলেন । সেদিনের সেই সমাবেশটি আয়োজিত হয়েছিল বিদেশী একটি রাষ্ট্রের অর্থায়নে যা এখন অনেকটা পরিষ্কার । ১/১১ এর পর ইয়াজুদ্দিনের হাত ঘুরে রাষ্ট্র ক্ষমতা ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিন দখল করলে সেই সমাবেশে উপস্থিত বেশ কয়েকজন ফখরুদ্দিনের সরকারে যোগদান করেন এবং দু’একজন বিদেশে রাষ্ট্রদূতের চাকুরি বাগিয়ে নেন । আসন্ন দশম জাতিয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে এই সব কুশিলবদের কয়েকজন আবার সোচ্চার হয়েছেন । এই সুশীলদের কয়েকজন গত ২৮ ডিসেম্বর, শনিবার গুলশানের একটি অভিজাত হোটেলে আর এক নতুন ব্যানার ‘সংকটে বাংলাদেশ: নাগরিক ভাবনা’ একত্রিত হয়েছিলেন এবং সেই সমাবেশ হতে ডাক এসেছে ’নির্বাচন পিছিয়ে সমঝোতায় আসুন, সহিংসতা থামান ।’ এবার কিন্তু কোন ভূঁইফোড় সংগঠনের ব্যানারে এই সমাবেশের ডাক দেয়া হয়নি, ডাক দেয়া হয়েছে চারটি অতি পরিচিত নাগরিক সংগঠনের উদ্যোগে । অবশ্য প্রশ্ন উঠতে পারে এই সব নাগরিক সংগঠনের এমন একটি সমাবেশ করার দায়িত্বের মধ্যে পরে কী না । অনেকের মতে এই সমাবেশটিও একটি বিদেশী রাষ্ট্রের অর্থায়নে হয়েছে বলে ধারণা কারণ এই রাষ্ট্রটি যে কোন মূল্যে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় বিএনপি-জামায়াত জোটকে দেখতে চায় । তাদের এই প্রত্যাশা পূরণ করার জন্য দীর্ঘদিন ধরে দেশটি বাংলাদেশে বেশ তৎপর রয়েছে । তবে এটাও ঠিক যারা এই সমাবেশটিতে উপস্থিত হয়েছিলেন তাদের সকলের কাছে হয়তো পিছনের সব তথ্য নাও জানা থাকতে পারে এবং যারা সমাবেশে উপস্থিত হয়েছিলেন তাদের অধিকাংশই সমাজের সম্মানিত ব্যক্তি তবে সব সময় যে সব কিছুর গুঢ় রহস্য সঠিক ভাবে তারা বুঝেন তা বলা যাবে না । আবার অনেকে আছেন যারা পুরো বিষয়টি সম্পর্কে একটি সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এইসব সমাবেশে উপস্থিত হন ।
সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন সকলের শ্রদ্ধেয় সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক । গত ২৫ তারিখ তিনি একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সব সাংবিধানিক প্রক্রিয়া শেষ হয়ে গেছে তাই এখন আর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা সম্ভব নয় । পরের নির্বাচন কী ভাবে হবে তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে । সেই ব্যারিস্টার রফিক-উল-হকই শনিবার বললেন ‘দেশের স্বার্থে সমঝোতায় আসুন । সংবিধানের আলোকেই নির্বাচন পিছানো যাবে’ । একজন প্রতিথযশা সম্পাদক নিজের পত্রিকায় বেশ কিছুদিন ধরে লিখে যাচ্ছেন আসন্ন দশম সংসদ নির্বাচনের গ্রহনযোগ্যতা নিয়ে । তিনি বলছেন ৫ তারিখ যে নির্বাচন হচ্ছে তা স্বাভাবিক নির্বাচন নয় কারণ এই নির্বাচনে দেশের একটি প্রধান দল অংশ গ্রহণ করছে না । তার বক্তব্যের সাথে দ্বিমত করার কোন অবকাশ নেই । তবে এই পরিস্থিতির জন্য মূল দায় দায়িত্ব কার সেটি কখনো তিনি পরিষ্কার করে বলেন না । কোন কোন বক্তা বলেছেন সংসদ ডেকে সকল দলের মতামত নিয়ে সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে । কিন্তু যেই বিরোধী দল গত পাঁচ বছরে সংসদ অধিবেশনের নব্বই ভাগ সময় অনুপস্থিত থাকে, যেই সংসদে বিরোধী দলীয় নেত্রী শুধু মাত্র দশদিন নিজের সংসদ সদস্যপদ বাঁচানোর জন্য উপস্থিত থাকেন তাদের সংসদে আনতে তাঁরা কী ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন তা কিন্তু কেউই উল্লেখ করেন নি । এর আগে সরকারি দল একাধিকবার বিরোধী দলের উদ্দেশ্যে আহ্বান জানিয়ে বলেছেন সংসদে এসে আপনাদের কোন প্রস্তাব থাকলে তা পেশ করুন এবং সংবিধানের আওতায় হলে অবশ্যই তা বিবেচনা করা হবে । সেই আহ্বানেতো তারা সারা দেন নি । আদতে তারাতো সংবিধানই মানতে চান না । সমস্যা সমাধানে প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলীয় নেত্রীকে ফোন করলেন কিন্তু ফলাফল হলো উল্টা ।

একাধিক বক্তা আসন্ন ৫ তারিখের নির্বাচনকে স্থগিত করার কথা জোড়ালো ভাবে বলেছেন । কিন্তু সাংবিধানিক ভাবে তা কী সম্ভব ? সংবিধানের ১২৩ (৩) ধারায় নির্বাচন কখনৈ হবে সে সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘(ক) মেয়াদ-অবসানের কারণে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙ্গিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে (পাঁচ তারিখের নির্বাচন এই বাধ্য বাধকতায় অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে );... তবে শর্ত থাকে যে, যদি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের মতে, কোন দৈব-দূর্বিপাকের কারণে এই দফার নির্ধারিত মেয়াদে উক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব না হয়, তাহা হইলে মেয়াদের শেষ দিনের পরবির্তী নব্বই দিনের মধ্যে উক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে ।’ সাদামাটা কথায় বলতে হলে বলতে হয় নির্বাচন কমিশনকে এখন একটি দৈব-দূর্বিপাক আবিষ্কার করতে হবে । তা যদি সম্ভব হতো তা হলে পরবর্তি নব্বই দিনে নির্বাচন নিয়ে যাওয়া হয়তো সম্ভব হতো । এখন কোটি টাকার প্রশ্ন হচ্ছে বিরোধী দল সেই নির্বাচনে যাবে এমন প্রতিশ্রুতি কী উদ্যেক্তারা পেয়েছেন ? বেগম জিয়াতো বলেই দিয়েছেন তিনি শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী রেখে নির্বাচন করবেন না । এখন যদি তাত্ত্বিকভাবে ধরেও নিই রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে সংসদ ভেঙ্গে দিলেন যা কোন কোন সুশীল দাবি করছেন তাহলেতো রাষ্ট্রপতিকে আবার শেখ হাসিনাকেই প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেত ডাকতে হবে কারণ তিনি সদ্য বিদায়ী সংসদের সংখ্যা গরিষ্ট দলের নেতা । তখন কী হবে ? তখনতো একটি সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেবে । তখন হয়তো এই সমাবেশের আয়োজকদের কারো কারো কপাল খুলতে পারে । এই বিষয়ে একটি অত্যন্ত যুক্তিসংগত বক্তব্য রেখেছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী । তার বক্তব্যে তিনি বলেছেন ‘সকল পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হলেও নব্বই দিনের মধ্যে নির্বাচন না হলে সেটাও চিন্তার বিষয় ।’ সকলে ‘সমঝোতা সমঝোতা’ বলে অনেক কথাই বলেছেন । কিন্তু সেই সমঝোতার একটি বিষয় হচ্ছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে বিচারাধীন সকল ঘাতকদের ছেড়ে দিতে হবে । বিএনপি’র চালিকা শক্তি জামায়াতের এই মুহুর্তে এটাইতো একমাত্র দাবি । তখন সমঝোতার কী হবে ? বিএনপি’র নীতি নির্ধারকদের একজন শমসের মবিন চৌধুরী তার বক্তব্যে বলেছেন সংবিধান কোন পবিত্র ধর্ম গ্রন্থ নয় যে তাকে পরিবর্তন করা যাবে না । কিন্তু ত্রয়োদশ সংশোধনি বাতিলের রায়ে বলা হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থি । ভিত্তি ছাড়া যেমন ইমারত নির্মান সম্ভব নয় ঠিক তেমিন মৌলিক কাঠামো ছাড়া কোন গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রনয়ন সম্ভব নয় । তারাতো পণ করেছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া তারা কোন নির্বাচনে যাবেন না । সংবিধানের এই মৌলিক কাঠামো পরিবর্তন করলে কেউ একজন যদি দেশের উচ্চ আদালতে একটি রীট মামলা দায়ের করেন তখন কী হবে ?
আসলে যারা সেদিন এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন তাদের সকলের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্নœ না করেও বলা যায় বেগম জিয়া এই মুহুর্তে নির্বাচনে অংশ নিতে সত্যি সত্যি চায় কী না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে । ধরে নিলাম তিনি নির্বাচনে আসলেন এবং বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করলেন । তখন যুদ্ধাপরাধের বিচারের কী হবে ? তাঁর সাথে জামায়াত যেহেতু আছে তাদের সকল সাজা প্রাপ্ত নেতৃবৃন্দকেতো ছেড়ে দিতে হবে । বিডিআর বিদ্রোহ মামলায় ১৫২ জন বিডিআর সদস্যের মৃত্যু দ- হয়েছে । বেগম জিয়া কী এদের মৃত্যুদ- কার্যকর করার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেবেন ? এটি বলার অপেক্ষা রাখে না দেশের প্রত্যেকটা মানুষ শান্তি চায় আর সেই শান্তি আসতে হবে দেশের সংবিধানকে সম্মুন্নত রেখে । সংবিধানকে যদি আমরা সম্মান করি তাহলে দশম সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করার সময় শেষ হয়ে গেছে । সময় অনেক ছিল কিন্তু দূর্ভাগ্য বশত সেই সময়কে বিরোধী দল হেলায় ফেলায় নষ্ট করেছে । দশম সংসদ নির্বাচনে ভোট দিতে না যাওয়ার শান্তিপূর্ণ আহ্বান জানানোর অধিকার তাদের আছে কিন্তু কোন অবস্থাতেই জনজীবন বিপর্যস্থ করার কোন অধিকার তাদের বা অন্য কারো নেই । আর যারা আর একটি ১/১১ প্রত্যাশা করছেন দেশের মানুষকেও তাদের সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে । সব শেষে এল সালভাদোরের কবি রোক ডালটনের (Roque Dalton) একটি কবিতার কয়েকটি লাইন উল্লেখ করে লেখাটি শেষ করছি । লাইন ক‘টির মর্মার্থ উদ্ধার করার দায়িত্ব পাঠকদেও উপর ছেড়ে দিলাম । ডালটন লিখছেন :
'The least fascist among the fascists is also a fascist!’ (ফ্যাসিস্টদের মাঝে যিনি সব চেয়ে কম ফ্যাসিস্ট তিনিও একজন ফ্যাসিস্ট) । সকলের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক ।

লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় । ডিসেম্বর ২৯, ২০১৩

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ

[......লেখক আর্কাইভ]