|
এক ঢিলে অনেক পাখি বধ
প্রফেসর আবদুল মান্নান
আমি অনেকটা নিশ্চিত পাঠকদের অনেকে শর্মিলা বোসের নাম ভুলে গেছেন । ভুলে
যাওয়ারই কথা কারণ ইতিহাস খলনায়ক আর ইতিহাস বিকৃতিকারীদের মনে রাখে না ।
নবাব সিরাজুদ্দৌলা ১৭৫৬ সালের ২০ জুন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছ হতে
কোলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম দূর্গ দখল করার পর ১৪৬ জন ইংরেজকে বন্দী করে
দূর্গের একটি স্বল্পপরিসর কক্ষে আটকে রাখেন যার মধ্যে শ্বাস বন্ধ হয়ে ১২৩
জনের মৃত্যু হয় বলে ইংরেজ ঐতিহাসিকরা প্রচার করেন । তারা এটিকে নামকরণ
করেছিলেন অন্ধকূপ ট্রাজেডি। এই ঘটনার প্রায় একশত ষাট বছর পর ১৯১৬ সালের ২০
মার্চ বাঙালি ইতিহাসবিদ অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় কোলকাতা ইতিহাস পরিষদের এক
সেমিনারে তাঁর গবেষণালব্দ প্রবন্ধ প্রকাশ করে বলেন সেই ছোট কক্ষে চেষ্টা
করেও তিনি ১৪৬ জন মানুষকে ঠেলেঠুলে ঢুকাতে পারেন নি এবং পুরো ঘটনাটিই ছিল
নবাব সিরাজুদ্দৌলাকে একজন বড়মাপের নৃশংস খলনায়ক বানানোর ইংরেজদের অপচেষ্টা
। গত ডিসেম্বরে আমি নিজে সেই স্থানে সরেজমিনে পরিদর্শন করে বুঝেছি ইংরেজরা
কতবড় মাপের ফেরেববাজ ছিল ।
২০১১ সালে নেতাজি সুভাষ বোসের নাতনি শর্মিলা বোস বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ
নিয়ে 'Dead Reckoning: Memories of the 1971 War' শিরোনামে এক গ্রন্থ লিখে
সে সময় চারিদিকে হৈচৈ ফেলে দেন । শর্মিলা দাবি করেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে
বাংলাদেশ ও ভারতে যে ত্রিশ লাখ মানুষ হত্যা অথবা আড়াই লাখ নারী নির্যাতনের
সংখ্যা উল্লেখ করা হয় তা একেবারেই অতিরঞ্জিত । তিনি আরো লিখেন টিক্কা নিয়াজি
সহ পাকিস্তানি জেনারেলরা সাধারণতঃ ভাল মানুষ কিন্তু বাংলাদেশের যুদ্ধে
তাদের অনেককে হিরো হতে জিরোতে পরিণত করেছে । তিনি দাবি করেন তার এই গ্রন্থটি
গবেষণা লব্দ ও প্রাথমিক তথ্য ও উপাত্তের উপর ভিত্তি করে রচিত । তার এই
গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় যখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসি’র উইথড্রো
উইলসন সেন্টারে রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করছিলেন । তাদের সহায়তায় গ্রন্থটি
প্রকাশিত হয় । শর্মিলা বোসের এই গ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি বাংলাদেশে
তুমুল সমালোচনার মুখে পরেন । শর্মিলার বই নিয়ে হৈ চৈ হওয়ার কারণ তিনি
নেতাজির নাতনি আর নেতাজি পরিবারের অন্য সকলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাধ্য
মতো সহায়তা করেছেন । অক্সফোর্ড শিক্ষিত শর্মিলার জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের
বোস্টন শহরে ১৯৫৯ সালের ৪ জুলাই । ১৯৭১ সালে তার বয়স মাত্র বার বছর । সে
সময় অনেকের সাথে ঢাকার একটি ইংরেজি দৈনিকে শর্মিলার গ্রন্থের সমালোচনা করে
আমারও একটি লেখা ছাপা হয় । এই সময় তারই এক সহকর্মী পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত
গবেষক আয়েশা সিদ্দিকা এক মন্তব্যে লেখেন ‘শর্মিলার গ্রন্থটি আমার সামনেই
লেখা হচ্ছিল । এই সময় তার সাথে একাধিক পাকিস্তানি জেনারেলদের যোগাযোগ ছিল
এবং তিনি তাদের সাথে নিয়মিত পানাহার করতেন । আমি বুঝতে পারিনা শর্মিলা কেন
এমন একটি বিতর্কিত কাজ করেছেন তবে এটি নিশ্চিত পাকিস্তানে বইটি বেস্ট সেলার
হবে ।’
শুরুতে উপরের কথাগুলি লিখলাম কারণ গত কয়েকদিনে আমার অনেক শুভানুধ্যায়ী
অনুরোধ করেছেন যেন আমি এ কে খন্দকারের সদ্য প্রকাশিত ও তুমুল সমালোচিত
গ্রন্থ ‘ভেতরে বাইরে’ নিয়ে কিছু লিখি । তাদের বলেছি না পড়ে কিছু লেখা ঠিক
নয় । প্রথম দিকে ঢাকা ও চট্টগ্রামে বইটি যোগাড় করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি
। একজন বিক্রেতা আমাকে জানালেন তার কাছে দশ কপি ছিল তার সব কটিই স্থানীয়
একজন জামায়াত কর্মী কিনে নিয়ে গেছেন দলের কর্মীদের মধ্যে বিতরণ করবেন বলে ।
কয়েক দিন আগে বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ সংগ্রহ করি । বইটি পড়ার পর আমার মনে
হয়েছে যারা এই বই নিয়ে শুরু হতে হৈ চৈ করছেন তাদের অনেকেই হয়তো বইটি পড়েন
নি । এই কথাটি বিশেষ করে বিএনপি’র নেতা নেত্রীদের বেলায় বেশী প্রযোজ্য । এম
কে আনোয়ার হতে শুরু করে মির্জা ফখরুল সকলে মিলে চিৎকার শুরু করে দিলেন
এতদিনে আওয়ামী লীগের থলের বিড়াল বের হয়ে পরলো সে জন্যে তাদের গায়ে আগুন
লেগেছে । বিএনপি’র নেতা নেত্রীদের বুদ্ধি বৃত্তিক চর্চা নিয়ে তেমন একটা
উচ্চ ধারণা পোষণ করিনা । দু’একটি ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে । বিএনপি’র যারা এই
গ্রন্থ নিয়ে এতটা উচ্ছ্বাসিত তারা বইটি পড়লে বুঝতেন একে খন্দকার এক ঢিলে
অনেককে পাখি বধ করার চেষ্টা করেছেন যার মধ্যে আছেন তাদের নেতা জিয়াউর
রহমানও । এছাড়াও খন্দকারের বধ করার তালিকায় আছে (১) আওয়ামী লীগ (২) জাতির
জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব (৩) মুজিব নগর সরকার (৪) জেনারেল ওসমানী (৫) মুজিব
বাহিনী (৬) মেজর খালেদ মোর্শারফ ও মেজর সফিউল্লাহ (৭) ভারতীয় মিত্র বাহিনী
(৯) সাধারণ মুক্তি বাহিনী (১০) ভারত সরকার সহ আরো অনেকে । তার গ্রন্থে তিনি
পাকিস্তানি বাহিনীর সক্ষমতা সম্পর্কে বেশ উচ্চ ধারণা পোষণ করেছেন ।
একাধিকবার তিনি তার শ্বশুর গুষ্টি সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন এবং মুক্তিযুদ্ধে
তাদের অবদানের কথা বলতে ভুলেন নি । জানা গেছে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব
মির্জা ফখরুলের পরিবারে এ কে খন্দকার বিয়ে করেছেন (এই তথ্য ভুল হলে ক্ষমা
প্রার্থী)। সব বিষয়ে স্বল্পপরিসরে আলোচনা সম্ভব নয় ।
এ কে খন্দকার পেশায় একজন বিমান সেনা । কুড়ি বছর পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে
নিষ্ঠার সাথে কাজ করেছেন বলে তিনি তার গ্রন্থের ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন ।
বয়স এখন তার চুয়াত্তর । সাধারণত এই বয়সে মানুষ ডেমেনসিয়া (Dementia) নামক
রোগে ভোগেন । এই রোগ হলে মানুষের স্মৃতি দূর্বল হতে শুরু করে । অনেক সময়
ঘরের মানুষকেও চিনতে পারেন না । আমার মা’র বয়স এখন একানব্বই । বছর দুই আগেও
ভাল ছিলেন । ইদানিং তিনি কিছুটা এই রোগে আক্রান্ত । ঘরের মানুষ তাঁর সাথে
কথা বলে তার স্মৃতিকে যতটুকু সম্ভব তাজা রাখার চেষ্টা করেন । কয়েকদিন আগে
হাসপাতাল হতে বাড়ি ফিরেছেন । ১৯৭১ সালে আমার ছোট বোন বাংলাদেশের একটি পতাকা
বানিয়েছিলো । মা নয় মাস সেটি কোমরে গুঁজে রেখেছিলেন যাতে তিনি যে দিন
বাংলাদেশ স্বাধীন হয় সে দিন তা ছাদে উড়াতে পারেন । ১৭ই ডিসেম্বর ভোরে নামাজ
পড়ে প্রথমে তিনি সেই কাজটিই করেছিলেন । মা কিন্তু এই ঘটনাটি ভুলেন নি ।
‘ভেতরে বাইরে’ পড়ে নিশ্চিত হয়েছি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ডেপুটি চিফ অব স্টাফ
এই রোগ দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারেন । অবশ্য তিনি তার ভূমিকায় স্বীকার
করেছেন ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রায় ৪২ বছর পর আমি বইটি লিখছি। ‘স্বাভাবিক
প্রক্রিয়াতেই আমি অনেক কিছু বিস্মৃত হয়ে যাচ্ছি।’ তার বই লেখার উদ্দেশ্য
হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন ‘মূলত তরুণ প্রজন্মের ইতিহাস জানার আগ্রহ থেকে
।’ খন্দকার যাদের নিয়ে লিখেছেন তাঁদের প্রায় সকলে প্রয়াত । কারো কাছ হতে
তার বক্তব্যের সত্যতা যাঁচাই করার তেমন একটা সম্ভাবনা নেই । তিনি কিছু
মীমাংসিত সত্যকে উড়িয়ে দিয়ে নিজের মতকে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন । তার
মধ্যে দুটি বিষয় উল্লেখযোগ্য । প্রথমটি হচ্ছে একাত্তরের সাতই মার্চ
বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক বক্তৃতা ‘জয় পাকিস্তান’ দিয়ে শেষ করেছেন । এক
সপ্তাহের মাথায় তিনি তা শুধরে লিখেছেন বঙ্গবন্ধু প্রথমে ‘জয় বাংলা’ তারপর
‘জয় পাকিস্তান’ বলেছেন । সে দিনের সেই পড়ন্ত বিকেলের সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তে
তার পক্ষে সেই জনসভায় উপস্থিত থাকা সম্ভব হয় নি । আমাদের পক্ষে সেই
মুহূর্তের সাক্ষী হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল । দুপুর দু’টা হতে মহসিন হল হতে দল
বেঁধে সেই জনসভায় উপস্থিত হয়েছিলাম রাজনীতির কবির সেই হাজার বছরের অন্যতম
শ্রেষ্ট কবিতা শোনার জন্য । খন্দকারের কথা যদি সত্য হয় তা হলে হয় আমরা সেই
জনসভায় উপস্থিত ছিলাম না অথবা রাজনীতির কবি সে দিন অন্য কোন জনসভায় বক্তৃতা
করেছিলেন ।
এ কে খন্দকার একা নন যিনি সে দিন ‘জয় পাকিস্তান’ শুনেছিলেন । প্রয়াত
বিচারপতি হাবিবুর রহমান ২০০৮ সালে তার ‘বাংলাদেশের তারিখ’ নামক গ্রন্থের
নতুন সংষ্করণে লিখেছিলেন ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ শেখ মুজিব ‘জয় বাংলা’ ও ‘জিয়ে
পাকিস্তান’ ধ্বনি দিয়ে ভাষণ শেষ করেন । তথ্যসূত্র হিসেবে তিনি কবি শামসুর
রাহমানের শেষ বয়সে স্মৃতি হাতড়ে লেখা আত্মজীবনী ‘কালের ধুলায়’ এর লেখা
ব্যবহার করেন । শামসুর রাহমানের ভুলটি সাষ্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আলি জাকের ধরিয়ে
দিলে কবি ‘সাপ্তাহিক ২০০০’ এ একটি বিবৃতি দিয়ে বলেন ’আমার এই ভুল ত্রুটির
জন্য সকল বঙ্গবন্ধুপ্রেমীর কাছে আমি লজ্জিত, নিজের কাছে তো বটেই।’ এতে কবি
মহিমান্বিত হয়েছেন । বিচারপতি কবির ভুলের এই স্বীকারোক্তি এড়িয়ে গেছেন ।
অথচ তিনি আগের সকল সংস্করণেই সঠিক ভাবে লিখেছেন বঙ্গবন্ধু সে দিনের বক্তৃতা
‘জয় বাংলা’ দিয়ে শেষ করেন । বিচারপতি ২৬ মার্চ রাত হতে শুরু হওয়া পাকিস্তানি
সেনাবাহিনীর গণহত্যাকে ‘পিটুনি অভিযান’ বলে পত্রিকায় তার এক লেখায় উল্লেখ
করেছেন । বিচারপতি হাবিবুর রহমান সম্পর্কে কোন কিছু বলার যোগ্যতা আমার নেই
তবে ইতিহাসের দায়বদ্ধতা হতে অনেক সময় সত্য লিখতে হয় । বিচারপতি বা কবি কেউ
সেদিন সেই ঐতিহাসিক মূহূর্তের সাক্ষী হতে রমনা রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত
ছিলেন না ।
এ কে খন্দকার লিখেছেন বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন এমন কোন
গ্রহণযোগ্য প্রমাণ তার কাছে নেই । যদিও এই বিতর্কটি বর্তমানে একেবারেই
অবান্তর তথাপি খন্দকার সাহেবের উদ্দেশ্যে বলতে চাই ছয়টি মহাদেশের ২৫টি
দেশের অসংখ্য পত্রিকায় ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার
খবরটি প্রচারিত হয় যার অনেক ক্লিপিং আমার কাছে আছে । এই সব দেশের মধ্যে আছে
নেদারল্যান্ডস, আইসল্যান্ড, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, কানাডা, কোষ্টারিকা,
দক্ষিণ আফ্রিকা, পোলান্ড. পর্তুগাল, তুরষ্ক, নরওয়ে, হংকং । দুই একটি নমুনা
। ‘Moedjiboer roept onafhankelijkheit Oost-Pakistan uit’ (Leeuwarder
Courant, March 27, 1971, Netherlands), ‘Mujibur Rahmanlysir yfir
sjalfstaeoi landshlutans’ (Morgunblaoio, March 27, 1971, Iceland),
‘Bengali independence declared by Mujib’ (Buenos Aires Herald, March 27,
1971, Argentina) ‘Declaration unilaterale d’independence La “ligue Awami”
declare hors la loi’ (L’Artisan, Montreal, March 27, 1971, Canada),
`Pakistan Oriental se declare independiente’ (La Nacion, March 27, 1971,
Costa Rica) স্থানাভাবে এখানেই থামতে হলো ।
খন্দকার সাহেব লিখেছেন যুদ্ধের জন্য আওয়ামী লীগের কোন পূর্ব প্রস্তুতি ছিল
না । তাই যদি হবে তা হলে বঙ্গবন্ধু কেন কর্ণেল ওসমানীকে ১০ মার্চ তাঁর
সামরিক উপদেষ্টা নিয়োগ দিয়েছিলেন? এই কথাটি খন্দকার তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন
। খন্দকার আক্ষেপ করে বলেছেন কেন বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ একতরফা ভাবে স্বাধীনতা
ঘোষণা করেন নি । খন্দকারের ইতিহাসের জ্ঞান সম্ভবত খুব দুর্বল কারণ
বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন আর মুক্তি যুদ্ধের মধ্যে তিনি তফাৎ বুঝতে ব্যর্থ
হয়েছেন । খন্দকার মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে লিখেছেন ‘বর্তমানে প্রতি তিন
সপ্তাহে কুড়ি হাজারকে (গেরিলা) প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে । এই বিশাল পরিমাণে
গেরিলা ভর্তির কারণে তাদের আনুগত্য, সাহস এবং আত্মোৎসর্গের মতো ব্যক্তিগত
গুণাবলির প্রতি যথাযথ মনোযোগ দেওয়া হয়নি । ...ফলে রিক্রুটদের অধিকাংশই হয়
প্রণোদিত নয় অথবা গেরিলা হওয়ার যোগ্যতা নেই । এতে ফল দাঁড়িয়েছে: কিছু গেরিলা
ভেতরে গিয়েছে মূলত অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে যেমন লুট, হত্যা, ডাকাতি ইত্যাদি এবং
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রচ- ক্ষতি করেছেন । শতকরা মাত্র ১০ থেকে ১৫ ভাগ ছেলে
সত্যিকার অর্থে যথাযথ অভিযান পরিচালনা করেছে । ...উল্টো ফল হচ্ছে এবং
সাধারণ মানুষ আমাদের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে ’ । জাতির শ্রেষ্ট সন্তানতের কী
অপমান ! ওসমানী সম্পর্কে খন্দকার লিখেছেন ‘সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে থেকে
একটা গুঞ্জন ওঠে যে তাঁরা যেভাবে যুদ্ধ চালাতে চান, কর্ণেল ওসমানীকে প্রধান
সেনাপতি রেখে সেটা সম্ভব হবে না । সর্বসম¥তভাবে কর্ণেল ওসমানীকে প্রধান
সেনাপতির দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়ার দাবি ওঠে, শুধু খালেদ মোর্শারফ এ
বিষয়ে আপত্তি তুলেন ।...তিনি ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি রেখে সব সেক্টর
অধিনায়কদের নিয়ে যুদ্ধ পরিষদ বা ওয়ার কাউন্সিল গঠন করে তাঁদের হাতে যুদ্ধ
পরিচালনার দায়িত্ব ন্যস্ত করার পক্ষে মত দেন । যুদ্ধ পরিষদ বা ওয়ার
কাউন্সিলের ধারণাটির সূত্রপাত করেছিলেন মেজর জিয়া । (এই ব্যাপারে) খালেদ
মোর্শারফের অবস্থান ছিল বিপরীতমূখী ’। ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি করার একটি
রাজনৈতিক গুরুত্ব আছে কারণ তিনি ছিলেন একজন অবসর প্রাপ্ত সেনা অফিসার, তখন
সিভিলিয়ন, এবং জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত সংসদ সদস্য । বাংলাদেশের
মুক্তিযুদ্ধটি কোন সামরিক অভিযান ছিলনা, ছিল একটি জনযুদ্ধ যেটি খন্দকার
সাহেব অনুধাবন করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন । তাঁদের এই সব কার্যকলাপ দেখে
ওসমানী পদত্যাগ করার কথা বলেন । এ কে খন্দকার তার ভূমিকায় অনেক গুলি বই
পড়েছেন বলে জানিয়েছেন । তালিকায় নেই মেজর রফিকুল ইসলাম বীর উত্তমের “লক্ষ
প্রাণের বিনিময়ে”। তিনি তা পড়লে উপকৃত হতেন । খন্দকার মেজর জিয়ার
স্বাধীনতার ঘোষণাটি সম্পর্কে একটি সত্য কথা বলেছেন । তিনি লিখেছেন ‘মেজর
জিয়ার ঘোষণাটি কোনোভাবেই স্বাধীনতার ঘোষণা বলা চলে না । মেজর জিয়া রাজনৈতিক
নেতাও ছিলেন না বা স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার মতো উপযুক্ত ব্যক্তিও ছিলেন
না।’ তাইতো বলি খন্দকারের ‘ভেতরে বাইরে’ নিয়ে যে সব বিএনপি নেতা নেত্রী
উল্লাস নৃত্য করেন তারা কেউ এই বই পড়েন নি ।
খন্দকার লিখেছেন ‘প্রথমবার পালানোর চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর আমি ১৮ বা ১৯
এপ্রিল অফিসে যোগদান করি’ । একজন বাঙালি অফিসার পাকিস্তান সেনা বাহিনীর
কতটুকু আস্থাভাজন হলে এই কাজটি করতে পারেন? তিনি ১৫ই মে সীমান্ত অতিক্রম
করেন । অনেক বাঙালি অফিসার পাকিস্তানের হয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে
কেউ যুদ্ধবন্দী হিসেবে পাকিস্তান ফেরত গেছেন অথবা কেউ কেউ যুদ্ধ শেষ হওয়ার
আগেই পোষ্টিং নিয়ে চলে যান । তাদেরকে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান হতে ফিরিয়ে
এনেছিলেন আর বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর যারা পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধ করেছিলেন
তাদের ১৪জনকে পুলিশে আত্মীকরণ করেছিলেন জেনারেল জিয়া যাদের মধ্যে দু’একজন
আইজিপি পর্যন্ত হয়েছেন । আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ডেপুটি চীফ অব ষ্টাফ এয়ার
ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার বীর উত্তম সীমান্ত অতিক্রম করতে না পারলে কী
করতেন তা বলা মুস্কিল তবে তার এই গ্রন্থ আমাদের নতুন প্রজন্মকে চরমভাবে
বিভ্রান্ত করবে । বইটি বাজেয়াপ্ত বা নিষিদ্ধ করার পক্ষে আমি নই তবে সব চেয়ে
ভাল হয় তিনি নিজেই বইটি বাজার হতে প্রত্যাহার করে নিলে ।
আমাদেও মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে খাটো করার চেষ্টা গত চল্লিশ বছর ধরে করা
হচ্ছে । খন্দকারের প্রচেষ্টা শেষ নয় । তবে ইতিহাস তার নিজের গতিতেই চলে কারো
হুকুমে নয় । মনে হয় খন্দকার হিরো হতে জিরো হলেন ।
লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় । সেপ্টম্বও ১৫, ২০১৪
WARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
[প্রথমপাতা] |
লেখকের আগের লেখাঃ
[......লেখক আর্কাইভ]
|