@
@
@
@
@ |
@
রোহিঙ্গা সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান প্রয়োজন
@
প্রফেসর আবদুল মান্নান
সোমবার দেশের সকল গণমাধ্যমে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ শিরোনাম ছিল মায়ানমার
সরকার দুই হাজার ৪১৫ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে বাংলাদেশ হতে মায়ানমারে ফেরত
নিতে রাজি হয়েছে । সিদ্ধান্তটি এসেছে দুই দেশের মধ্যে ঢাকায় পররাষ্ট্র
মন্ত্রণালয় পর্যায়ের বৈঠকে । আপাতঃ দৃষ্টিতে সিদ্ধান্তটি ভাল মনে হবে ।
বাংলাদেশে কক্সবাজার জেলার উখিয়ার কুতুপালং আর টেকনাফের নয়াবাজার শরণার্থী
শিবিরে বত্রিশ হাজার রোহিঙ্গা মানবেতর জীবন যাপন করছে প্রায় তিন দশকেরও বেশী
সময় ধরে কিন্তু এর বাইরে কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গা চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে
অবৈধভাবে বসবাস করে । এদের মধ্যে অনেকেই এক শ্রেণীর দূর্নীতিপরায়ণ সরকারি
কমকর্তা ও দালালের সহায়তায় বাংলাদেশী পাসপোর্ট নিয়ে সৌদি আরব সহ
মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশে চলে যায় । এরা সেসব দেশে গিয়ে নানা ধরণের
বেআইনি কার্যকলাপ আর অপকর্মে জড়িয়ে পরে এবং তাতে আসল বাংলাদেশীরা প্রায়
বিপদে পরে । বাংলাদেশে যে সব রোহিঙ্গা বসবাস করে তাদেরও একটি বিরাট অংশ
মাদক চোরাচালান, ডাকাতি, মানব পাচার জঙ্গিবাদ প্রভৃতি অসামাজিক কার্যকলাপে
সম্পৃক্ত হয়ে পরেছে । গত মার্চ মাসে আমার সুযোগ হয়েছিল মায়ানমারের পুরানো
রাজধানী ইংয়াঙ্গুনে eস্বাধীন গণমাধ্যমf বিষয়ক একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে
অংশগ্রহণ করার । সেখানে কথা হয়েছে প্রখ্যাত সুইডিশ সাংবাদিক বারটিল
লিন্টনারের সাথে । লিন্টনার দীর্ঘদিন বিখ্যাত সাপ্তাহিক ফার ইষ্টার্ন
ইকোনমিক রিভিয়্যূর দক্ষিণ পূর্ব এশীয় সংবাদদাতা ছিলেন এবং এই অঞ্চলে
জঙ্গিবাদের উত্থান ও বিস্তার সম্পর্কে তিনি প্রচুর রিপোর্ট করেছেন । ২০০২
সালে তিনি বাংলাদেশের উপর এক প্রচ্ছদ প্রতিবেদন করেছিলেন যার শিরোনাম ছিল
Bangladesh-a cocoon of terror । কিছুদিন আগে তার একটি নতুন বই Great Game
East প্রকাশিত হয়েছে । বইটি দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার জঙ্গিবাদের উত্থানের একটি
গবেষণা মূলক বড় মাপের কাজ । এই বইতে চট্টগ্রামে দশট্রাক অস্ত্র খালাসের
বিষয়টিও উল্লেখিত হয়েছে । আলাপচারিতায় লিন্টনার আমাকে জানান এই বই এর জন্য
তথ্য সংগ্রহ করা কালে তিনি বাংলাদেশ সফর করেন । এটি ছিল চারদলীয় জোট
সরকারের সময়কালের কথা । তিনি টেকনাফের এক রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে গিয়ে
দেখতে পান সেখানে রোহিঙ্গারা জামায়াত-শিবিরের সশস্ত্র ক্যাডারদের প্রশিক্ষণ
দিচ্ছে । লিন্টনারের তোলা প্রশিক্ষণের এমন একটি ছবি তার বইতেও ছাপা হয়েছে ।
এই রোহিঙ্গারা সেই সত্তরের দশক হতে বাংলদেশে মায়ানমারের সামরিক জান্তার
অত্যাচার সইতে না পেরে নাফ নদী পার হয়ে বাংলাদেশে অবৈধ ভাবে প্রবেশ করছিল ।
কিছু থাইল্যান্ড ও মালেয়শিয়াও গিয়েছে এবং সেখানেও তারা সামাজিক সমস্যা
সৃষ্টি করেছে । বাংলাদেশ হতে দুই হাজার বা কুড়ি হাজার বা এক লক্ষ রোহিঙ্গা
শরণার্থী ফেরত নিলেও এই সমস্যার সমাধান হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত সমস্যার কারণ
দূরীভূত হচ্ছে ।
ধর্মীয় বিশ্বাসে রোহিঙ্গারা মুসলমান । তার প্রধানতঃ বাংলাদেশে লাগোয়া নাফ
নদীর ওপারে আরাকান রাজ্যে বসবাস করেন । একসময় চট্টগ্রাম আরাকান রাজার অধীনে
ছিল । রোহিঙ্গারা কখন আরাকান রাজ্যে বসবাস শুরু করেন বা তাদের আদি বাসস্থান
কোথায় তা সঠিক ভাবে বলা যায় না । তবে ধারণা করা হয় অষ্টাদশ শতকে বর্তমান
রোহিঙ্গাদের পূর্ব পুরুষরা বণিক হিসেবে আরব হতে এসেছিলেন । ভাষা ও সামাজিক
আচার অনুষ্ঠানে তাদের সাথে স্থানীয় চট্টগ্রামবাসীর যথেষ্ট মিল আছে । ১৯৪৭
সনে ভারত বিভাগের সময় বর্তমান মায়ানমার বৃটিশদের অধীনে ছিল । দেশ ভাগের সময়
আরাকান রাজ্যকে চট্টগ্রামের সাথে যুক্ত করে দেয়াটা অনেক বেশী সংগত ছিল ।
কিন্তু রেডক্লিফ সাহেব তা না করে নাফ নদীকে প্রাকৃতিক সীমান্ত গণ্য করে
ভারত পাকিস্তানের সীমানা নির্ধারণ করেন । বাস্তবে আরাকান রাজ্য মায়ানমারের
মূল ভূখন্ড হতে তিন হতে চার দিনের পথ এবং এই রাজ্যের রোহিঙ্গারা ইচ্ছা
করলেই রাজ্যের বাইরে যেতে পারেন না । মায়ানমারও তাদের সে দেশের নাগরিক
হিসেবে স্বীকার করে না । তাদের মতে রোহিঙ্গা হচ্ছে বাঙালি এবং অবৈধভাবে
বাংলাদেশ হতে মায়ানমারে অনুপ্রবেশ করেছে । শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সান
সূচিরও একই মত । নোবেল শান্তি পুরস্কার অপাত্রে দানের তিনি একটি উজ্জ্বল
উদাহরণ । আমার রেঙ্গুন সফরের সময় তিনি আমদের সম্মেলনে অতিথি বক্তা ছিলেন ।
তাঁর বক্তৃতা শুনে মনে হলো তিনি ক্ষমতায় যাওয়া ছাড়া আর কিছুই বুঝেন না যদিও
বর্তমান অবস্থায় তাঁর পক্ষে মায়ানমারের প্রেসিডেন্ট হওয়া সাংবিধানিক ভাবে
সম্ভব নয় । মায়ানমারের সামরিক জান্তা তার এই পথ সাংবিধানিক ভাবেই বন্ধ করে
রেখেছে । অবৈধ পথে প্রায় প্রতিদিন কয়েকশত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং
চট্টগ্রামের অনেক হাসপাতাল ক্লিনিকে তারা চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করে কারণ
আরাকান রাজ্যে রোহিঙ্গারা কোন চিকিৎসা সেবা পায় না । বাচ্চারা পায় ন পড়া
লেখার কোন সুযোগ । আবার অনেক রেহিঙ্গা ট্রলার যোগে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে অন্য
দেশে অবৈধ ভাবে যাওয়ার চেষ্টা কালে হয় পানিতে ডুবে মারা পওে অথবা
কোষ্টগার্ড বা বিজেবিfর হাতে ধরা পরে । বর্তমান বিশ্বে মায়ানমারের মতো এত
ভয়াবহ মানবাধিকার হরণকারি দেশ কমই আছে । তথাপি বিশ্বের কোন মানবাধিকার
সংস্থা এই বিষয়ে কোন তেমন উচ্চবাচ্য করে না যেমনটি তারা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে
পান থেকে চুন খসলে হৈ চৈ ফেলে দেয় ।
এই অঞ্চলে থাইল্যান্ডের পর যুক্তরাষ্ট্রের নতুন বন্ধু মায়ানমার । ২০১২ সালে
মায়ানমারের সামরিক জান্তা সে দেশে যাতায়াতের উপর ও সংবাদ মাধ্যমের উপর
নিয়ন্ত্রণ কিছুটা শিথিল করলে ইয়াঙ্গুনে প্রথম ছুটে যান যুক্তরাষ্ট্রের
তৎকালিন পররাষ্ট্র সচিব হিলারি ক্লিন্টন । তাঁর পিছু পিছু ছুটে আসেন বারাক
ওবামা । তাদের এই ছোটাছুটির অন্যতম কারণ ছিল মায়ানমারের উপর হতে চীনের
প্রভাব শিথিল করা । তেমনটি তারা করতে পেরেছেন তা কিন্তু নয় । কfদিন আগে
মায়ানমারে জাতি সংঘের অর্থায়নে আদমশুমারি শেষ হলো । সেই শুমারি হতে
রোহিঙ্গাদের বাঙালি বলে বাদ দেয়া হয়েছে । এই ব্যাপারে জাতি সংঘও মৌনব্রত
পালন করেছে । এতে আবার প্রমাণ হলো যুক্তরাষ্ট্রের চাপে পরলে জাতি সংঘ কতটুক
অসহায় আর নতজানু হতে পারে ।
শুধু আরাকান রাজ্যেই নয় মায়ানমারের কোথাও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী না হলে
প্রত্যেকেই দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক এবং তারা প্রায় সব ধরণের নাগরিক সুযোগ
সুবিধা হতে বঞ্চিত । বাচ্চা ভূমিষ্ট হলে তার নামকরণ করতে হবে বৌদ্ধ ধর্মের
রীতি অনুযায়ী । বৌদ্ধ ভিক্ষুদের নেতৃত্বে আরাকান রাজ্যে গত কয়েক বছরে
একাধিক ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে । এমন কী গত মাসে খোদ ইয়াঙ্গুনের
কাছের শহর মান্দালেয়তে মুসলমানদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাসা বাড়ী আক্রান্ত
হয়েছে । মায়ানমারের এই সব নিয়মিত মানবাধিকার লঙ্গন কখনো বিশ্ব বিবেককে নাড়া
দেয় না । আরাকান রাজ্যের অনেক গ্রাম রাতে পুরুষ শূন্য থাকে ।
১৯৬২ সাল হতে মায়ানমার সামরিক জান্তার শাসনের অধীনে । মায়ানমারের সামরিক
জান্তার মতো বিশ্বের অন্য কোন সামরিক জান্তা এত দূর্নীতিগ্রস্থ ছিল বলে জানা
যায় না । সেই দেশে প্রত্যেকটি বাড়ী, শপিং মল ব্যবসাপাতি সবই এই জান্তার
নিয়ন্ত্রণাধীন । সাধারণ নাগরিকদের জন্য উচ্চ শিক্ষা সোনার হরিণ এবং তা
সহজলভ্য নয় । অথচ সেনা অফিসারদের সন্তানরা দেশের বাইরে উচ্চ শিক্ষা নিচ্ছে
এবং দেশে ফিরে সরকারি চাকুরিতে ঢুকছে । গত দুfদশকে একাধিক বার সে দেশে
সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে তীব্র গণঅসন্তোষ দেখা দিলেও তা জান্তা অস্ত্রের
ভাষায় দমন করেছে । মায়ানমারে সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখল করার আগে এই দেশটি
ছিল এই অঞ্চলের সব চেয়ে সমৃদ্ধিশালী দেশ । বর্তমানে প্রায় সব আর্থ-সামাজিক
সুচকে মায়ানমার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্য সব দেশের চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে ।
সেনা বাহিনী দেশ শাসনের দায়িত্ব নিলে দেশটির কী অবস্থা হতে পারে মায়ানমার
তার একটি বড় উদহারণ ।
বাংলাদেশ হতে মায়ানমার দুfহাজার শরণার্থী ফেরত নেবে বলেছে ভাল কথা । তবে তা
সামগ্রিক পরিস্থিতির তেমন একটা পরিবর্তন ঘটাবে তা মনে হওয়ার কোন কারণ নেই ।
এই পরিবর্তন ঘটানোর দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে মায়ানমার সরকারের । তারা যদি
আরাকান রাজ্যের রোহিঙ্গাদের সে দেশের পূর্ণ নাগরিকের মর্যাদা না দেয় তা হলে
কোন কিছুতেই কাজ হবে না । দুfহাজার যাবে কুড়ি হাজার আসবে । ইতোমধ্যে
রোহিঙ্গাদের একটি বড় অংশ বাস্তব কারণেই নিজ দেশে ফিরে যেতে অসম্মতি জানিয়েছে
। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যে ভাবে সব কিছুতেই
সার্বক্ষণিক হৈ চৈ করে তার ছিঁটে ফোঁটা করলেও মায়ানমারের সামরিক জান্তা
এমন বেপরোয়া ভাবে নিয়মিত মানবাধিকার লঙ্গন করতে পারতো না । মায়ানমার একটি
বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী দেশ । মহামতি গৌতম বুদ্ধের মূল বাণিই হচ্ছে অহিংসা আর
শান্তি । সেই শান্তির দূতকে কী ভাবে পদে পদে অপমান করা হচ্ছে তা মায়ানমার
না গেলে বোঝা যাবে না । বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশ বছরের পর পর বছর
অন্য দেশের নাগরিকদের নিজ দেশে লালন পালন করা সহজ নয় । মায়ানমার যদি তাদের
সকল নাগরিকদের ফেরত নিতে রাজি না হয় তা হলে বাংলাদেশের উচিৎ বিষয়টা জাতি
সংঘে উত্থাপন করা ।
লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় । সেপ্টম্বর ৩, ২০১৪
@
@
WARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
@
[প্রথমপাতা] |
@
@
@
লেখকের আগের লেখাঃ
[......লেখক আর্কাইভ]
|