[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

গার্মেন্টস শিল্প: সোনার ডিম পাড়া হাঁসটাকে কেন হত্যা করবেন?

 

 

প্রফেসর আবদুল মান্নান

ঢাকার বিভিন্ন পোষাক শিল্প এলাকায় পোষাক শ্রমিকরা বাড়তি মজুরির দাবিতে আবার বিক্ষোভ, ভাঙচুর, সড়ক অবরোধ, গুদামে অগ্নিসংযোগ করেছে এবং এই প্রথম বারের মতো তারা আনসারদের ফাঁড়ি আক্রমন আর অস্ত্র লুঠের মতো ঘটনা ঘটিয়েছে এবং নিজেদের একজন সহকর্মিকে খুন করেছে । বাংলাদেশ সহ অন্যান্য দেশে শ্রমঘন শিল্পে শ্রমিক অসন্তোষ কোন নতুন ঘটনা নয় । চীনের তৈরী পোষাক শিল্পে শ্রমিক অসন্তোষের কারণে সেই দেশে মালিক পক্ষ কয়েকশত কারখানা গত কয়েক বছরে বন্ধ করে দিয়েছে । এই কারখানা গুলিতে স্বল্প মূল্যের পোষাক তৈরী হতো । চীন এখন উচ্চ মূল্যের ডিজাইনার ব্র্যান্ড কাপড় তৈরী করে আর তার নিজের দেশের এক শত কোটির বেশী জনগণের ব্যবহৃত কাপড় অন্য দেশ হতে আমদানী করে যার মধ্যে বাংলাদেশও অন্তভূর্ক্ত। চীনের উদ্যোক্তাদের এই পদক্ষেপে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে সে দেশের শ্রমিক শ্রেণী আর কিছুটা হলেও দেশের অর্থনীতি । একটি মাঝারি আকারের পোষাক প্রস্তুতকারি কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে মালিকের তেমন কোন ক্ষতি নেই কারণ এই ধরণের শিল্পকে বলা হয় ‘ফুট লুজ’ শিল্প । রাস্তায় চলতে গিয়ে সেন্ডেল ছিড়ে গেলে তা আমরা সাধারণত বগল দাবা করে বাড়ী ফিরি না, রাস্তায় ফেলে দিয়ে আসি । তৈরী পোষাক শিল্পও অনেকটা ঐরকম । মালিক এই শিল্পে যে পুঁজি লগ্নি করেন তা তার উঠিয়ে আনতে পাঁচ থেকে সাত বছর লাগে । অন্যদিকে তার প্রতিষ্ঠান বীমা করা থাকে । আগুন লেগে বা অন্য কোন কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হলে মালিক বীমা কোম্পানি হতে সাধারনতঃ ক্ষতিপূরণ পায় । এই কথা আমি এর আগেও বলেছি । মালিক যদি ইচ্ছা করেন তিনি বাংলাদেশে পুঁজি লগ্নি করে আর কারখানা প্রতিষ্ঠা করবেন না তার সামনে অনেকগুলি বিকল্প আছে । বাংলাদেশে বিশ্বের সব চেয়ে কম মজুরীতে শ্রমিক পাওয়া যায় সত্য কিন্তু তিনি যদি কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, শ্রীলংকা অথবা মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়ায় তার শিল্প কারখানা স্থাপন করবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন তিনি তা সহজেই করতে পারবেন । আর কিছুদিনের মধ্যে আমাদের পাশের দেশ মায়ানমারও বিদেশী পুঁজিকে দুবাহু মেলে আলিঙ্গন করার জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকবে । তখন আমি নিশ্চিত বাংলাদেশের অনেক উদ্যোক্তা তাদের কারখানা সে দেশে সরিয়ে নেবেন, এবং কোন অবস্থাতেই তাদেও দোষ দেয়া যাবে না । । এই সব দেশে বাংলাদেশের মতো সস্তায় হয়তো শ্রমিক পাওয়া যাবে না সত্য কিন্তু অন্যান্য অবকাঠামোগত যে সুবিধা সেখানে তাদের মিলবে তা কিছুটা হলেও সস্তা শ্রমিকের বিষয়টা পুষিয়ে যাবে । হয়তো তারা এখনকার মতো আর সস্তা পোষাক তৈরী না করে বাজারের উঁচু স্তরের দামী কাপড় তৈরী করবেন । এমন যদি অবস্থা হয় তাহলে আমাদের এই যে প্রায় চল্লিশ লক্ষ নারী শ্রমিক এই শিল্পে কর্মরত আছেন তারা কর্মচ্যুত হবেন এবং তারা আবার বাড়ী ফিরে যেতে বাধ্য হবেন এবং সেখানে গিয়ে তেতুল হুজুরের প্রত্যাশা অনুযায়ী স্বামীর আসবাবপত্রের হিসাব রাখবেন ।
গত কয়েক দিনের গাজীপুর বা অন্যান্য এলাকায় গার্মেন্টস্ শ্রমিকদের অসন্তোষের পিছনে কী শুধু বাড়তি মজুরি বিষয়টা কাজ করেছে? বিশ্বাস হয় না । আমার দৃঢ় বিশ্বাস এখানে বাংলাদেশের চলমান অস্থিতিশীল রাজনীতি একটি বড় ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছে এবং আগামী কয়েক মাসে আরো করবে বলে বিশ্বাস । অনেকে হয়তো বলবেন আমি অতি মাত্রায় ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাস করি । হয়তো বা । তারপরও বিষয়টা নিয়ে সরকারের নীতি নির্ধারক আর পাঠকদের চিন্তা করতে অনুরোধ করি ।
মহাজোট সরকারের এই মেয়াদের এখন শেষ সময় । সত্য হোক বা অসত্য, দেশের এক শ্রেণীর মিডিয়া আর সুশীল সমাজ নানা কায়দা কানুনের আশ্রয় নিয়ে বিরোধী দল, শহুরে মানুষ আর এক শ্রেণীর জনগণকে বেশ মুন্সিয়ানার সাথে এই কথা মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে যে সামনের নির্বাচনেতো বটেই আগামী বিয়াল্লিশ বছরেও আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে পারবে না । এর বিকল্প হিসেবে আসবে বিএনপি-জামায়াত জোট, সাথে থাকবে হেফাজত । ইতোমধ্যে তারা দেশের সব বড় বড় সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে জয়ী হওয়াতে সে বিশ্বাস তাদের আরো বদ্ধমূল হয়েছে । গোপালগঞ্জের পর গাজীপুর ছিল আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় দূর্গ । সম্প্রতি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেও সেই দূর্গের পতন হলো শ্রেফ আওয়ামী লীগের দলীয় কোন্দল আর দলীয় ভোটারদের ভোট দিতে যাওয়ায় চরম অনীহার কারণে । গাজীপুরে একটি বিরাট সংখ্যক ভোটার গার্মেন্টস শিল্পের নারী শ্রমিক । এই নারী শ্রমিকদের জন্য বর্তমান সরকার একেবারে তাদের সম্পূর্ণ সন্তুষ্টি মতো না হলেও কমতো করে নি । স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তাদের বেতন ভাতা বৃদ্ধি করার জন্য নিজে চেষ্টা করেছেন । একটি কথা কদাচিৎ বিশ্লেষকরা বলে থাকেন আর তা হচ্ছে দেশের সিংহভাগ তৈরী পোষাক শিল্পের মালিক আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনীতির সাথে জড়িত । সুতরাং তাদেরতো চেষ্টাই থাকবে বর্তমান সরকারকে সুযোগ পেলেই বিপদে ফেলতে । এই সুযোগটা তারা কখনো হাতছাড়া করেন না । গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বাতাসে টাকা উড়েছে এবং সেই টাকায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী কাবু হয়েছেন । একই সাথে চলেছে প্রচ- রকমের অপপ্রচার যেমন হেফাজতের গত ৫ই মে ঢাকা দখল, নজিরবিহীন তা-ব এবং অপারেশন শাপলাকে ঘিরে হুজুর হত্যার আষাঢ়ে গল্প ।
সব ঠিক থাকলে আর মাস তিনেক পর জাতীয় সংসদ নির্বাচন । বিএনপি-জামায়াত জোট আপ্রাণ চেষ্টা করবে সেই নির্বাচনে যে কোন প্রকারে বিজয়ী হতে । অবশ্য দুই দলের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন । বিএনপি’র উদ্দেশ্য ক্ষমতায় যাওয়া কারণ ইতোপূর্বে এই দলটি সতের বছর বাংলাদেশ শাসন করেছে । এই বার ক্ষমতায় যাওয়া তাদের প্রয়োজন কারণ তাদের আগামী দিনের কান্ডারী বলে পরিচিত বেগম জিয়ার জ্যৈষ্ঠ পুত্র তারেক রহমান, যাঁকে দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা পর্যন্ত বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আখ্যায়িত করেন । ফখরুদ্দিন মইনুদ্দিনের শাসনামলে তারেক জিয়াকে দূর্নীতির দায়ে গ্রেফতার করা হয় এবং তার বিরুদ্ধে দেশ থেকে অবৈধ পন্থায় অর্থ পাচারের অভিযোগে বিচারিক আদালতে মামলা করা হয় । সেই মামলায় যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআই’র একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা সাক্ষ্য দিয়ে গেছেন । কিন্তু আদালতে তার আইনজীবীরা নানা অজুহাতে সময় ক্ষেপণের কৌশল গ্রহণ করেছেন । আর কয়েক মাস অপেক্ষা করলে এবং তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসতে পারলে সেই সব মামলার ওখানেই সমাপ্তি হবে বলে ধরে নেয়া যায় । তিনি এখন চিকিৎসার অজুহাতে ল-নে অবস্থান করছেন । যাওয়ার সময় মুচলেকা দিয়ে গেছের তিনি আর রাজনীতি করবেন না । এই সব ছিল কথার কথা । খবরে প্রকাশ তিনি বর্তমানে সে দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন । একই অবস্থা চট্টগ্রামে দশ ট্রাক অস্ত্র আর একুশে আগষ্ট বঙ্গবন্ধু এভেন্যুতে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গ্রেনেড হামলা মামলার । পরের দুটি মামলায় বিএনপি-জামায়াতের অনেকের জড়িত থাকার অভিযোগ আছে । বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা চলছে । সরকার পরিবর্তন হলে এই সব মামলার মৃত্যু হবে তা মোটামুটি নিশ্চিত । অন্যদিকে জামায়াতের লক্ষ্য হচ্ছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে তাদের যে সব শীর্ষস্থানীয় অপরাধীদের বিচার হচ্ছে তাদের বিচার বন্ধ করে ট্রাইবুনাল বাতিল করা এবং ইতোমধ্যে বিচারে যাদের ফাঁসির হুকুম হয়েছে তাদের গলায় ফুলের মালা দিয়ে কারাগার হতে বের করে আনা । সুতরাং ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য পানি যত ঘোলা করা যায় ততই তাদের লাভ । আর এই কাজেই তাদের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে গার্মেন্টস শ্রমিকদের নানা ভাবে উস্কানি দিয়ে কাজে লাগানো এবং এই কাজে তারা সাথে পেয়েছে সরকারের অপরিনামদর্শী শাহজাহান খানের মতো এক শ্রেণীর শ্রমিক নেতা, মালিক পক্ষের কিছু প্রতিনিধি, বিজেএমইএ’র কিছু কর্মকর্তা, এবং না বললেই নয় একশ্রেণীর মিডিয়া । যেমন একটি জাতীয় দৈনিক চার শ্রেণীর শ্রমিকের মজুরির একটি তুলনামূলক চিত্র দিয়ে জানালো পোষাক শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকদের মজুরি সর্বনিম্ন । পোষাক শিল্পের শ্রমিকদের মজুরি যে অত্যন্ত অপ্রতুল তা কেউই অস্বীকার করবে না । কিন্তু যাদের সাথে এই তুলনা তারা সকলে হচ্ছে মৌসুমী শ্রমিক । যখন তাদের মৌসুম আসে তখন তাদের চাহিদা বাড়ে এবং সাথে সাথে মজুরিও । যেমন ধান কাটার মৌসুমে একজন শ্রমিকের দৈনিক মজুরী কোনা অবস্থাতেই তিনশত টাকার নীচে নয় । সাথে থাকে দুবেলা খাবার । সে অন্য কোন সুবিধা ভোগ করে না। এদের অধিকাংশই পুরুষ । ধান কাটা শেষ তার চাহিদাও শেষ । মৌসুম শেষ হলে সে হয়তো অন্য কাজ খুঁজে । তখন সে বেকার, সুযোগ পেলে হয়তো রিক্সা চালায় । সুতরাং সেই রকম একজন শ্রমিকের মজুরির সাথে একজন তৈরী পোষাক শিল্পের শ্রমিকের মজুরির তুলনা নিছক উষ্কানি মূলক ও বদ উদ্দেশ্য ছাড়া আর কী হতে পারে ?
এখন আসি বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি প্রসঙ্গে । এখানে যে নিম্নতম মজুরির কথা বলা হচ্ছে এটি মূলতঃ একজন শিক্ষানবিশ শ্রমিকের প্রাথমিক মজুরি । যেহেতু বাংলাদেশে শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের কোন সুযোগ নেই তাই প্রায় প্রত্যেক শ্রমিকের প্রশিক্ষণই হয় তার প্রথম কর্মক্ষেত্রে । এই কারণে যদিও আমরা বলি বাংলাদেশের শ্রমিকের মজুরি ঘন্টা প্রতি বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় সর্ব নিম্ন কিন্তু আমাদের দেশের শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতাও সর্ব নিম্ন । যেখানে একজন গার্মেন্টস শ্রমিক চীনে ঘন্টায় ১৪টি পোষাক তৈরী করে সেখানে ভিয়েতনামে করে ৮টি আর বাংলাদেশে এই সংখ্যা হচ্ছে ছয় । আসুন এবার ঘন্টা প্রতি নিম্নতম মজুরির হিসাবটা করি । মনে রাখতে হবে বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরী পোষাক রপ্তানিকারক দেশ । ১৯৭৮ সালে প্রথম চালানে চট্টগ্রাম হতে ‘দেশ গার্মেন্টস’ মাত্র বার হাজার ডলারের পোষাক বিদেশে রপ্তানি করে অনেকের ঠাট্টার পাত্র হয়েছিল । এর আগে রিয়াজ গার্মেন্টসও যৎসামান্য পোশাক ফ্রান্সে পাঠিয়েছিল । একশত ভাগ রপ্তানি কারক প্রতিষ্ঠান “দেশ” । প্রতিষ্ঠাতা কোন ব্যবসায়ী নন । একজন ডাকসাইটে সিএসপি আমলা নুরুল কাদের খান। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ফসল । ঠিক করলেন নতুন দেশে আমলার প্রয়োজন আছে ঠিক কিন্তু তার চেয়ে বড় প্রয়োজন উদ্যোক্তা শ্রেণীর । একটি স্বাধীন দেশ তার অর্থনীতিকে চিরদিন কৃষির উপর নির্ভরশীল করে রাখতে পারে না । বন্যা বা খড়া হলে কৃষির আপাত মৃত্যু হয় । বলতে গেলে তিনি ছিলেন নতুন দেশের নতুন প্রজন্মের প্রথম উদ্যোক্তাদের একজন । তার হাত ধরেই বাংলাদেশের তৈরী পোষাক শিল্পের যাত্রা । সেই বার হাজার ডলার বর্তমানে একুশ কোটি (একুশ বিলিয়ন) ডলারে দাঁড়িয়েছে । ‘দেশ’ ছিল কোরিয়ার দাইউ কর্পোরেশনের সাথে একটি যৌথ উদ্যোগ । ‘দেশ’ ১৩০ জন শ্রমিককে পাঠিয়েছিলো কোরিয়ায় ছয় মাসের প্রশিক্ষণের জন্য । সকলে পুরুষ । বর্তমানে এই খাতে বাংলাদেশে প্রায় যে চল্লিশ লক্ষ শ্রমিক কাজ করে যার নব্বই ভাগই মহিলা । রপ্তানি আয়ের আশি ভাগ আসে এই খাত হতে । এটি আমাদের অর্থনৈতিক খাতে এক নীরব যুগান্তকারী বিপ্লব । শুরু যখন হয়েছিল তখন দেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি । এখন তা ষোল কোটিতে দাঁড়িয়েছে । এই যে আমাদের দেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছয় শতাংশের উপর তার জন্যতো গার্মেন্টস শ্রমিক আর বিদেশে কর্মরত আমাদের আশি লক্ষ শ্রমিকদের সিংহভাগ কৃতিত্ব দিতে হবে । আমাদের গাড়ী, বাড়ী, বিদেশে সেকেন্ড হোম, লক্ষ টাকার স্কুলে বাচ্চাদের পড়াশোনা, ঈদের ছুটি কাটাতে সিঙ্গাপুর, ব্যাঙ্কক, ল-ন পাড়ি জমানো কাদের শ্রমের ফলে এসব হচ্ছে ? একবারও কী মনে করেছি এই শ্রমিকরা না থাকলে আমাদের বেশীর ভাগই বড়জোর কোন সওদাগরি অফিসের কেরানি হতাম? নিম্নতম যে মজুরি বর্তমান সরকারের আমলে এর আগে ধার্য করা হয়েছিল তা ছিল ঘন্টায় একুশ সেন্ট। আমাদের নিকটবর্তী দেশ কম্বোডিয়া । তারা ২৪ সেন্ট দেয় । আর চীন দেয় তিরানব্বই সেন্ট । যুক্তরাষ্ট্রে যদি এই পোষাক তৈরী করতো তা হলে তাদের দিতে হতো আট ডলার পঁচিশ সেন্ট। কিন্তু তারা যখন আমাদের দেশে আসে এই পোষাক কিনতে তখন রপ্তানিকারকের উপর চাপ দেয় যাতে নুন্যতম দামে সে তার পণ্য ওই ক্রেতার কাছে বিক্রি করে । তার উপর তারা নানা ধরনের শঠতা আর চাতুযের্র আশ্রয় নেয় । প্রস্তুতকারীতো চিন্তা করবে কী ভাবে উৎপাদন ব্যয় কমানো যায় । তা না হলে ওই পোষাক সে কম মূল্যে বিক্রি করতে পারবে না । সে তখন চেষ্টা করে নিজের স্বার্থটা ঠিক রেখে শ্রমিকের মজুরি কমাতে । তবে এই মন্তব্যটা ঢালাও ভাবে করা ঠিক নয় । দেশে তিন শ্রেণীর তৈরী পোষাক কারখানা আছে । প্রথম শ্রেণী যারা শ্রমিকদের ন্যায্য মজুুরি দেয়ার চেষ্টা করে । এই সংখ্যা মোট পাঁচ হাজার কারখানার (বেশ কিছু বন্ধ আছে) প্রায় ত্রিশ শতাংশ । এদের নিয়ে সমস্যা হয় না । কিন্তু পার্শ্বের বাড়িতে আগুন লাগলে আঁচ এদের গায়েও লাগে । দ্বিতীয় শ্রেণীতে আছে প্রায় আরো ত্রিশ শতাংশ । এদের কেউ কেউ ন্যায্য মজুরি দেয়ার চেষ্টা করে আবার সুযোগ পেলে শ্রমিকদের ঠকানোতে বেশ পটু । এরা সরাসরি রপ্তানি করলেও এদের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মালিক তাদের রপ্তানির জন্য দ্বারস্থ হয় বাংলাদেশে অবস্থিত বিভিন্ন বাইং হাউজের । এই বাইং হাউজগুলি মধ্যস্বত্ব ভোগী । যেহেতু এরা রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান আর আমদানি কারক উভয়ের কাছ হতেই কমিশন নেয় তখন প্রস্তুতকারকের মুনাফা সঙ্কুচিত হয় এবং এই দায়টা তারা শ্রমিকদের উপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে । আর সর্বশেষ শ্রেণী হচ্ছে যারা সম্পূর্ণ ভাবে সাব কন্ট্রাক্টের উপর নির্ভর করে । এরা রাণা প্লাজার গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি । ইংরেজিতে বলে সোয়েট সপ (ঝবিধঃ ঝযড়ঢ়) । এই সব কারখানায় কাজ করার জন্য পারলে মালিক পক্ষ মাসে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকায় শ্রমিক নিয়োগ করে । এরা সহজে রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহৃত হয় । বিরোধী দল বলেছে তারা ক্ষমতায় গেলে পোষাক শিল্পের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় করবে । বিগত জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালে পোশাক শিল্পে দেশে সব চেয়ে ভয়াবহ শ্রমিক অসন্তোষ হয়েছিল । তখন কিন্তু সরকারের কোন দায়িত্বশীল মন্ত্রী এই ধরণের কথা বলেন নি । এখন বলছেন শ্রেফ রাজনৈতিক কারণে । মন্ত্রণালয় করলেই এই সেক্টরে বিরাজমান সমস্যা সমাধান হবে না । সমস্যা সমাধান করতে হলে বস্তুত সরকার, উদ্যোক্তা, আমদানীকারক প্রতিষ্ঠান, প্রকৃত শ্রমিক সংগঠন সকলকে যৌথভাবে এই বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে । শ্রমিকদের দাবি কিন্তু আকাশ চুম্বী কিছু নয় । মাসে তারা এক হাজার ডলার নিম্নতম মজুরি দাবি করছে । অনেকেই বর্তমানে এর চেয়েও বেশী দিচ্ছেন । অনেকের দেয়ার সামর্থ আছে কিন্তু অতি মুনাফার লোভে তা দিতে তাদের অনীহা । আর তৃতীয় শ্রেণীর যারা আছে তারা হয়তো অন্য দুই শ্রেণী হতে দুর্বল । তাদের উপরে টেনে তুলতে হলে প্রয়োজন সরকার আর প্রথম শ্রেণীর উদ্যোক্তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা । আবার এর সাথে প্রয়োজন তাদের উপর নজরদারি এবং সঠিক পরামর্শ ।
বিজেএমইএ সব সময় প্রয়োজনীয় কাজগুলি সঠিক ভাবে করে বলে মনে হয় না । তারা তৈরী পোষাক সংশ্লিষ্ট একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনুমোদন পেয়েছেন । এটি নিঃসন্দেহে একটি ভাল উদ্যোগ । কিন্তু আরো ভাল উদ্যোগ হবে আগামী দশ বছরে দেশে অন্তত পাঁচ হাজার শ্রমিক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা । এই কাজটি শ্রীলংকা পারলে বাংলাদেশ কেন পারবে না ? এটি একটি বিনিয়োগ কারণ প্রশিক্ষিত শ্রমিকের অর্থ হচ্ছে উৎপাদনশীলতার বৃদ্ধি । আর উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি মানে উৎপাদন খরচ হ্্রাস । তা হলে মালিকের মুনাফা বাড়বে আর মালিক যদি একটু দূরদৃষ্টি সম্পন্ন হয় তা হলে তার এই মুনাফার অংশ শ্রমিকদের সাথে ভাগ করে নিতে কুণ্ঠিত হবেন না । শ্রমিক খুশিতো মালিক খুশি । তবে এই খুশিতে বাগড়া দিতে পারে নোংরা রাজনীতি আর ধান্ধাবাজ শ্রমিক সংগঠনগুলি । এই ব্যাপারে সামনের কয়েক মাস সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে কারণ অনেকে এখন নিজস্ব এজেন্ডা নিয়ে মাঠে আছে । পানি ঘোলা করার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে । মনে রাখতে হবে একদিন গার্মেন্টস শিল্প এলাকায় অনির্ধারিত বন্ধ থাকলে কমপক্ষে পঞ্চাশ মিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয় । সেই ক্ষতির ভার শুধু মালিক পক্ষকে নয় শ্রমিকদের ভাগেও কোন না কোন ভাবে পরে । গার্মেন্টস শিল্প একটি সোনার ডিম পাড়া হাঁস । এটিকে কেন হত্যা করবেন?

লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় । সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১৩

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ