প্রথমপাতা  

সাম্প্রতিক সংবাদ 

 স্বদেশ

আন্তর্জাতিক

বাংলাদেশ কমিউনিটি

লাইফ স্টাইল

এক্সক্লুসিভ

বিনোদন

স্বাস্থ্য

বর্তমানের কথামালা

 শিল্প-সাহিত্য

 প্রবাসপঞ্জী 

আর্কাইভ

যোগাযোগ

 

 

 

 

 

 

মহানায়কের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন
 


প্রফেসর আবদুল মান্নান

সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ, সকলের ফয়েজ ভাই ১৯৬৮-৬৯ সালে ঢাকা সেনানিবাসে অনুষ্ঠিত ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য’ মামলাটি অধুনালুপ্ত দৈনিক আজাদ পত্রিকার জন্য কভার করতেন । ফয়েজ ভাই সেই মামলা কভার করার দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখিত গ্রন্থ ‘আগরতলা মামলা, শেখ মুজিব ও বাংলার বিদ্রোহ’ হতে মামলার প্রথম দিনের শুরুর পর্বের খানিক বর্ণনা দিয়ে মহানায়কের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিয়ে লিখিত প্রবন্ধটি শুরু করতে চাই । ‘ন’টা প্রায় বাজে বাজে ।...প্রথম যিনি পাশের দরজা দিয়ে ট্রাইবুনাল কক্ষে প্রবেশ করেন-রাষ্ট্রদ্রোহিতায় অভিযুক্ত এক নম্বর ব্যক্তি, দেশের সর্র্র্ববৃহৎ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান । ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি ও পায়জামা পরিহিত দীর্ঘকায় শঙ্কাহীন মানুষটি দৃঢ় পদক্ষেপে নির্দিষ্ট আসনের দিকে এগিয়ে এলেন । প্রবেশের পরেই তিনি সমগ্র কক্ষটির ওপর চোখ বুলিয়ে গেলেন । খালি উঁচু এজলাসের দিকে তাকালেন । মৃদু হাসি, বলিষ্ঠ মনোভাব ও অকুতোভয় মানুষটিকে দেখার সাথে সাথে দর্শক ও আইনজীবীদের মধ্যে একটি গুঞ্জন শোনা গেল । তিনি যেন ভুলেই গেছেন যে ফাঁসি দেয়ার জন্য ষড়যন্ত্রের কোন মামলায় তাঁকে আনা হয়েছে ।...আমি এবং অন্য সমস্ত রিপোর্টারই ফাঁসির আসামী এক নম্বর অভিযুক্ত ব্যক্তিকে সারাজীবন মুজিব ভাই বলতাম । ...আমি রিপোর্টারদের সারিতে প্রথম ব্যক্তি হিসেবে বসা ছিলাম বলে আমার ও তাঁর (শেখ মুজিব) মধ্যে মাত্র হাত দুয়েক ব্যবধান ।... এতো সতর্কতার মধ্যেও কথা বলা যায় কি না সেই ফাঁকে আমরা স্ব-স্ব পদ্ধতিতে ভাবছিলাম । ...এমন সময় আকস্মিক ডাক, ‘ফয়েজ, ফয়েজ, এই ফয়েজ ।’ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পাথরের মূর্তির মতো বিচারকদের দিকে চেয়ে রইলাম । একটু পরেই আমার ডান উরুতে শেখ সাহেব হাত বাড়িয়ে কিছু একটা দিয়ে খুঁচিয়ে দিলেন । দেখলাম তাঁর সেই বিখ্যাত পাইপের আঘাত । নিশ্চয় তিনি অভ্যাসের দাবিতে (তামাকহীন) পাইপ আনতে অনুমতি পেয়েছিলেন । ...অন্যদিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বললাম, মুজিব ভাই, কথা বলা মানা । মাথ ঘোরাতে পারছি না । বের করে দেবে’ । তক্ষুনি উত্তর আসলো যথেষ্ট উচ্চকণ্ঠে, ‘ফয়েজ, বাংলাদেশে থাকতে হলে শেখ মুজিবের সাথে কথা বলতে হবে’ । স্থম্ভিত কোর্ট, সমস্ত আইনজীবী ও দর্শকগণসহ সরকারি অফিসাররা তাঁর এই সুস্পষ্ট উচ্চারিত কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন । ...তখন তিনি (মুজিব) জানতেন না যে, শেখ মুজিবের এই প্রতীকী উচ্চারণ একজনের জন্য নয় সমগ্র দেশের জনগণের মধ্যে অগ্নি প্রজ্জ্বলনের বাণীস্বরূপ ।’
সেই শেখ মুজিব আগরতলা মামলা হতে এক গণঅভ্যুত্থানের মাধমে ১৯৬৯ সালে ছাড়া পেয়ে বঙ্গবন্ধু । মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরে গ্রেফতার হয়েছিলেন পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর হাতে । তাঁকে গ্রেফতারের প্রধান দায়িত্বে ছিলেন পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার জহিরুল আলম খান । তাকে সহায়তা করেছিলেন একজন বাঙালি অফিসার । পওে সেই অফিসার মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমনে আহত হয়ে ফিরে গিয়েছিলেন পাকিস্তানে । দেশ স্বাধীন হলে বঙ্গবন্ধু অন্যান্যদের সাথে তাকেও ফিরিয়ে এনেছিলেন । এই ব্যক্তি পরবর্তিকালে বেগম জিয়ার মন্ত্রী হয়েছেন । গত ৪ তারিখ বেগম জিয়ার সাথে তাঁর গুলশান কার্যালয়ে দেখা করতে গিয়েছিলেন । ১৬ই ডিসেম্বর দেশতো হানাদার মুক্ত হলো । কিন্তু তখনো জাতির জনক বঙ্গবন্ধুতো পাকিস্তান কারাগারে বন্দী । তিনি দ্বিতীয়বারের মতো ফাঁসির মুখোমুখি। যে মহানায়ক স্বাধীনতার অগ্নি প্রজ্জ্বলন করেছিলেন তাঁকে ছাড়াতো স্বাধীনতাটা পূর্ণ হয় না । অনেক মুক্তিযোদ্ধা ঘোষণা করলেন জাতির জনককে মুক্তি না দিলে প্রয়োজনে তারা পাকিস্তান আক্রমন করবেন । এটি বাঙালির সহজাত আবেগের বহিঃপ্রকাশ । পাকিস্তানের উপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়তে লাগলো । এগিয়ে এল সোভিয়েত ইউনিয়ন, বৃটেন ও ভারত । মুজিবকে মুক্তি দিয়ে ফিরতে দিন তাঁর স্বদেশে । ৬ই জানুয়ারী ১৯৭২ সালে ভূট্টো বঙ্গবন্ধুকে কারাগার হতে মুক্তি দিতে বাধ্য হলেন । লন্ডন হয়ে ১০ জানুয়ারীর এক পড়ন্ত বিকেলে ঢাকা ফিরলেন মহানায়ক ।
লন্ডন হতে ফেরার পথে প্রচন্ড শীতের সকালে দিল্লিতে স্বল্পকালিন যাত্রা বিরতি । তখনো তিনি আনুষ্ঠানিক ভাবে কোন রাষ্ট্রীয় পদে অধিষ্ঠিত নন । সেই শীতের সকালে দিল্লির আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে বঙ্গবন্ধুকে রিসিভ করার জন্য সকল প্রটোকল ভেঙ্গে ছুটে এসেছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরী আর প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী । মনে হলো মহানায়কের পদস্পর্শে ধন্য হলো ঐতিহাসিক দিল্লি নগরীর মাটি । লন্ডনে অবস্থান আর দিল্লি পর্যন্ত যাত্রাপথে ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু জেনে ফেলেছেন মুক্তিযুদ্ধ সময়কার তাঁর অনেক অজানা কাহিনী । দিল্লিতে সংক্ষিপ্ত এক ভাষণে ভারতবর্ষের জনগণ ও রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদানের জন্য কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুললেন না স্বাধীন বাংলাদেশের এই স্বপ্নদ্রষ্টা । ব্যক্তিগত আলাপ চারিতায় শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধির কাছে বঙ্গবন্ধু জানতে চাইলেন কখন বাংলাদেশ হতে ভারতীয় বাহিনী ফেরত আসছে ? জবাবে ভারত নেত্রী বললেন যখন আপনি চাইবেন । তাহলে আগামী স্বাধীনতা দিবসের আগেই হোক । তাই হবে । দু’জনই শুধু রাজনীতিবিদ ছিলেন না, ছিলেন দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক, ষ্টেটসম্যান ।
১০ জানুয়ারী বঙ্গবন্ধু একটি সম্পূর্ণ যুদ্ধ বিধ্বস্থ বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলেন । দিল্লি হতে বঙ্গবন্ধুর সহযাত্রী হয়েছিলেন পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগকারি আমলা ফারুক চৌধুরী । পরবর্তীকালে তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব হয়েছিলেন । তিনি লিখেছেন বৃটিশ রাজকীয় বিমানটি যখন ঢাকার তেজগাঁও বিমান বন্দরের উপর চক্কর দিয়ে অবতরণের সুযোগ খুঁজছে তখন নিচে মহানায়ককে বরণ করার জন্য হাজার হাজার জনতা । বঙ্গবন্ধু মাথায় হাত দিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন । ফারুক চৌধুরী তাঁর কাছে গিয়ে বললেন নীচে তাকিয়ে দেখুন । বঙ্গবন্ধু বিমানের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে শুধু একটা কথাই বললেন ‘এত মানুষকে খাওয়াবো কী’? বাংলাদেশ বর্তমানে শুধু এত মানুষকেই খাওয়াই না, দ্বিগুণ মানুষকে খাদ্য যোগান দিয়ে তার খানিক উদ্বৃত্ত রফতানিও করে ।
দেশে ফিরে একদিন পর বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়ে মন্ত্রী সভা পূনর্গঠন করে দেশকে একটি ধ্বংস স্তুপের ভিতর হতে টেনে তোলার দায়িত্বটা হাতে তুলে নিয়েছিলেন । প্রায় এক কোটি ছিন্নমূল শরণার্থী ভারত হতে দেশে ফিরছে । চারিদিকে লাখ লাখ স্বজন হারানো মানুষের আহাজারি । বাতাসে বারুদের গন্ধ । দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা পলায়নরত পাকিস্তানি সেনা বাহিনী সম্পূর্ণ ধ্বংস করে রেখে গেছে । তাদের পোতা মাইনে দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রাম সম্পূর্ণ অচল । ব্যাংকগুলোর ভল্ট শূন্য । খাদ্য গুদামগুলোতে নেই এক ছটাক চাল । বেসামরিক প্রশাসন সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত । আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চীন-মার্কিন-সৌদি বলয় বাংলাদেশের জন্য একটি প্রচন্ড বৈরী পরিবেশ সৃষ্টি করে রাখার জন্য সদা তৎপর । দেশের অভ্যন্তরে এ দেশীয় পাকিস্তানি দালাল ঘাতক রাজাকার-আলবদর, জামায়াত আর চীনপন্থী অতিবামরা একাট্টা হয়ে চালাতে লাগলো একের পর এক অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা । আজ এই পাটের গুদামে আগুন দেয়তো কাল ওই সার কারখানায় বিস্ফোরণ ।
এক চরম অস্থিতিশীল পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রপরিচালনা ও দেশ পুনর্গঠনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন তিন বছর তিনি দেশের মানুষকে কিছু দিতে পারবেন না । এই তিন বছর হবে দেশ গড়ার প্রাথমিক পর্যায় । সম্পূর্ণ একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের জন্য তিন বছর এমন কোন সময় নয় । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপ আর জাপানকে সার্বিক সহায়তা দিয়েছিল অর্থনৈতিক পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র । সেই বিচারে বঙ্গবন্ধু দেশ পুনর্গঠন কাজ গুলি করেছিলেন একক প্রচেষ্টায় । সঙ্গে ছিল এক ঝাঁক লোভ লালসা মুক্ত ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ দলীয় নেতা কর্মী ও সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী আর কিছু বন্ধু প্রতীম দেশের সহায়তা ।
এই সাড়ে তিন বছরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের ভূখ- হতে ভারতীয় বাহিনীকে সসম্মানে নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে সক্ষম হয়েছিলেন । ভারত হতে দেশে ফেরা প্রায় এক কোটি ছিন্নমূল শরণার্থীকে পুনর্বাসন করেছিল বঙ্গবন্ধু সরকার । বাংলাদেশকে তিনি জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ, ওআইসি, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনসহ অন্যান্য বিশ্বসংস্থার সদস্য করতে সক্ষম হয়েছিলেন । এই স্বল্প সময়ে তিনি আদায় করেছিলেন প্রায় দুই শতাধিক রাষ্ট্রের স্বীকৃতি । দেশ স্বাধীন হওয়ার এক বছরের মাথায় বিশ্বের অন্যতম আধুনিক একটি সংবিধান রচনা ছিল বঙ্গবন্ধু সরকারের এক অমর কীর্তি । প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড । কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট এই মহান নেতারই অবদান । বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে তিনি প্রথম ব্যক্তি যিনি বাঙালি জাতির জন্য একটি পৃথক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন ।
কারো কারো মনে প্রশ্ন জাগাটা স্বাভাবিক যদি বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানিরা হত্যা করতো তা হলে শুরুটা কেমন হতো স্বাধীন বাংলাদেশের ? এটি সৌভাগ্যের কথা বঙ্গবন্ধু তাঁর কিছু যোগ্য উত্তরসুরী তৈরী করতে পেরেছিলেন । তারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে সফলভাবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন । তবে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে স্বাধীন বাংলাদেশে ঘটতে পারতো দলীয় কোন্দল আর অনৈক্য যার কিছু আলামত মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেও দেখা গিয়েছিল । তেমনটি যদি হতো তা হলে বিপন্ন হতো দেশের সার্বভৌমত্ব । যে বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী দেশে ফিরে এসেছিলেন তিনি ১৯৭৫ সনের ১৫ আগষ্ট নিহত হয়েছিলেন তাঁরই আস্থাভাজনদের হাতে । তাঁর মৃত্যুর পর বাংলাদেশ আবার পিছনের দিকে যাত্রা শুরু করেছিল । দেশটিকে আবারো সামনের দিকে ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছেন তাঁর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা । কিন্তু কাজটি তাঁর জন্য মোটেও সহজ নয় । তবে তিনি যে ভাবে সাহসের সাথে শত প্রতিকূল অবস্থাতেও তা করার চেষ্টা করছেন তাতে মনে হয় তাঁর উপর পিতার আশীর্বাদ আছে । মহানায়কের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে তাঁকে সশ্রদ্ধ অভিবাদন ।

লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় । জানুয়ারি ৭, ২০১৫

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ

[......লেখক আর্কাইভ]