প্রথমপাতা  

সাম্প্রতিক সংবাদ 

 স্বদেশ

আন্তর্জাতিক

বাংলাদেশ কমিউনিটি

লাইফ স্টাইল

এক্সক্লুসিভ

বিনোদন

স্বাস্থ্য

বর্তমানের কথামালা

 শিল্প-সাহিত্য

 প্রবাসপঞ্জী 

আর্কাইভ

যোগাযোগ

 

 

 

 

 

 

 

একজন ত্রিকাল দর্শীর ক্রিকেটের গল্প
 


প্রফেসর আবদুল মান্নান

 

বেশ ক’দিন দৈনিক পত্রিকা গুলির প্রধান শিরোনাম হতে বেগম জিয়ার নিরর্থক অবরোধ, হরতাল আর পেট্রোল বোমা মেরে মানুষ হত্যার সংবাদের পরিবর্তে জায়গা করে নিয়েছে সাহেবদের খেলা ক্রিকেট । শুধু বাংলাদেশে নয় বহির্বিশ্বেও এখন সাহেবদের এই ক্রিকেট সংবাদ শিরোনাম । তাতে অবশ্য সাহেবদের তেমন কোন অবদান নেই । অবদান বাংলাদেশের, যারা বিশ্ব ক্রিকেট আসরে খেলতে অর্ধ দুনিয়া পাড়ি দিয়ে গিয়েছিল সুদূর অস্ট্রেলিয়ায় । টান টান উত্তেজনার মধ্যে ১৯ মার্চ অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে বাংলাদেশ আর ভারত কোয়ার্টার ফাইনাল খেলল । গ্যালারিতে ভারতীয়দের সংখ্যা বাংলাদেশীদের কয়েকগুণ বেশি কারণ এই শহরে তাদের আগমন অনেক আগে হতে । তারপরও বাংলাদেশ-ভারত বলে কথা । কয়েক হাজার বাঙালি সেই খেলায় উপস্থিত হয়েছিলেন তাদের টিমকে উৎসাহ যোগাতে । শেষতক সেই খেলাকে বরবাদ করে দিল তিন আম্পায়ার, পাকিস্তানের আলীম দার, ইংল্যান্ডের ইয়ান গোল্ড আর থার্ড আম্পায়ার অস্ট্রেলিয়ার ষ্টিভ ডেবিস তাদের মারাত্মক একপেশে ও ভুল সিদ্ধান্তে । এই সব কথা ইতোমধ্যে দেশের মানুষ সবিস্তারে জেনেছেন তার পুনরুল্লেখ করতে চাই না । কোয়ার্টার ফাইনালে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ভারত ৩০৩ রানে ইনিংস শেষ করে । তার জবাবে ভারত আর মাঠের ভিতরে ও বাইরে তিন আম্পায়ারের বিরুদ্ধে খেলে অনেক কষ্টে বাংলাদেশ ১৯৩ রান সংগ্রহ করেছিল । আম্পায়াংি নিয়ে বিশ্বের অনেক বাঘা বাঘা খেলোয়াড় ও গণমাধ্যম, এমনি কী লন্ডনের ইকনমিস্ট পত্রিকা পর্যন্ত সমালোচনা করেছে । ব্যতিক্রম শুধু কোলকাতার আনন্দবাজার । পারলে তারা বাংলাদেশের টিমকে ক্লাব টিমের সাথে তুলনা করে । বাংলাদেশের বাঙালিরা সাহেবদেও খেলা ক্রিকেট খেলছে তা সম্ভবত তাদেও পছন্দ নয় । বাংলাদেশ দল গত রোববার অনেকটা বীরের বেশে দেশে ফিরেছে । কয়েক হাজার ক্রিকেট পাগল মানুষ বিমানবন্দরে সমবেত হয়েছিলেন তাদের নতুন বীরদের সংবর্ধনা জানাতে । কোন টিম খালি হাতে দেশে ফিরলে এমন সংবর্ধনায় সিক্ত হওয়ার দৃষ্টান্ত বিরল । আবেগপ্রবণ বাঙালির পক্ষে এমন ঘটনার জন্ম দেয়া সম্ভব ।
আমার জন্ম যে চট্টগ্রাম শহরে তাকে বাংলাদেশের ক্রিকেটের আঁতুড় ঘর বললে অত্যুক্তি হবে না । তার মধ্যে আমার পাড়াতো আছেই । সে কথায় পরে আসছি । সেই বৃটিশ আমল হতে চট্টগ্রামে ইংরেজদের সংখ্যা অন্য যে কোন জেলার চেয়ে বেশী ছিল কারণ এখানে ছিল আসাম বেঙ্গল রেলের সদর দপ্তর আর ছিল বন্দর । এই সব দেখভাল করার দায়িত্বে ছিল ইংরেজরা । এক সময় বেশ কয়েকটি চা বাগানও গড়ে উঠেছিল । শিপিং কোম্পানি ছিল বেশ কয়েকটা । এক সময় বার্মা অয়েল কোম্পানি ঘাঁটি ঘাড়লো চট্টগ্রামে । সার্সন রোডের পাহাড়ে বানানো হলো আট গর্তের একটি মনোরম গলফ কোর্স । আর ছিল সেনানিবাস, জেলা আদালত । সব জায়গায় ইংরেজদের রমরমা উপস্থিতি । নেটিভদের মাথার উপর ছড়ি ঘুরানোর পর হাতে অজস্র সময় । সময় কাটাতে শুরু হলো রোববারের ক্রিকেট । সাহেব বনাম সাহেব । রেলের পলোগ্রাউন্ড আর দামপাড়ার পুলিশ লাইনে খেলা হতো । পলো গ্রাউন্ডে পোলো খেলাও হতো মাঝে মাঝে । দূর থেকে দেখতো বাঙালিরা । কাছে যাওয়ার হুকুম নেই । দেশ ভাগ হওয়ার পর আমাদের বাড়ির সামনে গড়ে উঠলো দুই গ্যালারির ষ্টেডিয়াম । নাম হলো জেলা প্রশাসক নেয়াজ মোহাম্মদের নামে । পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর উত্তরাধিকার সূত্রে ভারতিয় আর পাকিস্তানিরা ইংরেজদের কাছ হতে ক্রিকেট নামের খেলাটিও পেল । কিন্তু কোন পাকিস্তানি টিমে বাঙালিদের জায়গা হয় না । মাছ ভাত খাওয়া বাঙালি কী আর ক্রিকেট খেলতে পারবে? তারাতো খেলবে ডাংগুলি আর হাডুডু । একবার লতিফ নামের ঢাকার এক খেলোয়াড় দ্বাদশ ব্যক্তি হিসেবে পাকিস্তান দলে অন্তর্ভূক্ত হলো । আমাদের সেই কী উত্তেজনা । দ্বাদশ ব্যক্তি মানে জল বিরতির সময় মাঠে বালতিতে পানি আর তোয়েলা নিয়ে যাওয়া । মাঝে মধ্যে ডাক পরলে ফিল্ডিংও করতে পারে । তাতেই বাঙালি খুশী । লতিফ আসলে ছিল অবাঙালি । শুনেছি বর্তমানে করাচিতে থাকেন । সে’দিন রকিবুল জানালো করাচিতে গেলে তার সাথে কয়েকবার দেখা করার চেষ্টা করেছেন । কোন সাড়া পাওয়া যায় নি । এখনতো আমাদের পদ্মা পাড়ের এগারজন খেলোয়াড় দুনিয়া কাঁপিয়ে দিতে পারে । ছোট বেলায় ভারত-পাকিস্তান খেলা মানেই আলাদা উত্তেজনা । পাকিস্তানের সাথে এই দেশে ভারত প্রথম ম্যাচ খেলেছিল ১৯৫৫ সালে এই ঢাকায় । ১৯৬০ সনে পাকিস্তান ভারতে খেলতে গেলে হৈ চৈ পরে যায় ভাল বা খারাপ খেলার কারণে নয় আম্পায়ার সন্তোষ গাঙ্গুলি মা কালির দিব্যি দিয়ে মাঠ নেমেছিলেন ভারতের বিপক্ষে তিনি কোন এলবিডাব্লিউ দিবেন না সে কারণে । খবর আরো আছে । চারিদিকে কানা ঘুষা লতা মুঙ্গেশকার নাকি পাকিস্তানের সুদর্শন মিডিয়াম ফাষ্ট বোলার ফজল মাহমুদের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেন । সবাই বলাবলি শুরু করলো আমাদের খেলোয়াড়দের চরিত্র নষ্ট করার ভারতীয় ষড়যন্ত্র ।
টিভি নামক বাক্সটি তখনো এদেশে আসেনি । ভরসা রেডিও । তাও সকলের বাসায় নেই । পাড়ায় তামিমের দাদা মানে আকরামের বাবা মোহাম্মদ হোসেনের খাজা হোটেল । তখন ওরা আমাদের ভাড়াটে । খাজা হোটেলের একটি ঢাউস রেডিও ছিল । তাতে ধারা বর্ণনা শোনা যেত । রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা সে সময় ধারা বর্ণনা শুনেছি । তখন যারা ধারা বর্ণনা দিতেন তারা সাধারণত সাবেক খেলোয়াড় হতেন না । পাকিস্তানি ওমর কোরেশি, জামসেদ মার্কার, চিশতি মুজাহিদ, আতিকুজ্জামান খান (বাঙালি) মাঠে বসে অসম্ভব ভাল ধারা বর্ণনা দিতেন । এখনতো ঢাকায় বসেও অস্ট্রেলিয়ার খেলার ধারা বর্ণনা দেয়া যায় টিভিতে খেলা দেখে । কোলকাতা রেডিও হতে বাংলায় ধারা বর্ণনা দিয়ে বাঙালির মনে ঠাঁই করে নিয়েছিলেন অজয় বসু, কমল বসু ও প্রেমাংসু চট্টোপাধ্যায় । এমন কাব্যিক ছন্দে ধারা বর্ণনা এখন আর শোনা যায় না । খেলা নিয়ে লেখা যে একটি অমর সাহিত্য হতে পারে তা প্রমাণ করেছিলেন কোলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার মতি নন্দি আর শঙ্করি প্রসাদ বসু । শঙ্করি প্রসাদের রমনীয় ক্রিকেট বই’এ ১৯৬১ সালে ওয়েষ্ট ইন্ডিজ-অস্ট্রেলিয়ার ‘টাই’ টেস্ট ম্যাচের বর্ণনা পরলে এখনো দম বন্দ হওয়ার উপক্রম হবে ।
বলা হয় ভদ্রলোকের খেলা ক্রিকেট । ছিল এক সময় । পঞ্চাশ ষাটের দশকে । তখন কোন খেলোয়াড় আউট হলে আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা না করে প্যাভিলিয়নের দিকে হাঁটা দিতেন । সব শেষ এই কাজটি করেছিলেন শচীন টেন্ডুলকার । সেই ভদ্রলোক ক্রিকেটারদের মধ্যে ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার বিল লরি, ববি সিম্পসন, নীল হার্ভে, নর্মাল ও’নীল, রীচি বোনো,এডাম গিলক্রিস্ট, ইংল্যাংন্ডের টম গ্রেবনি, টেড ডেকষ্টার, কেন্ ব্যারিংটন, ব্যারি রির্চাডসন, কলিন কাউড্রে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ভীব রিচার্ডস, লেসলি হল, গেরি সোবার্স, রোহান কানহাই, লেন্স গিভস, ফ্রানক্ ওরেল, কনরাড হান্ট । ভারতের বাপু নদিকার্নি, পঙ্কজ রয়, দিলিপ সারদেশাই, মনসুর আলী খান পতৌদি, আবেদ আলি, সেলিম র্দুরানি, গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ, সুনিল গাভাস্কার, শচীন টেন্ডুলকার কম যান কিসে ? পাকিস্তানের আবদুল হাফিজ কারদার, ফজল মাহমুদ, হানিফ মোহাম্মদ, মুস্তাক মোহাম্মদ, জাভেদ বার্কি, নসিমুল গনি, ইন্তেখাব আলম, ইমরান খান, ইমতিয়াজ আহমেদের নামতো করতেই হয় । নিউজিল্যান্ড দীর্ঘ দিন ধরে এবং ক্রিকেট খেললেও ক্রিকেটে তাদের সাফল্য কম হলেও তাদের বেশীর ভাগ খেলোয়াড়ই ভদ্র । দক্ষিণ আফ্রিকা বর্ণবাদের কারণে দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বাইরে ছিল । বাংলাদেশের ওয়ানন্ডে ও টেস্ট ক্রিকেটের যাত্রা যথাক্রমে ১৯৯৭ সালে ও ২০০০ সালে। এ পর্যন্ত বিশ্বের সব দলকে তারা একদিনের ক্রিকেটে হারিয়েছে ও টেস্ট ক্রিকেটেও হারিয়েছে কয়েকটি দলকে।
বাংলাদেশের ক্রিকেটে চট্টগ্রাম ষ্টার ক্লাবের অবদান অনস্বীকার্য । আমার পাড়ার সামনে ষ্টেডিয়াম ও আউটার ষ্টেডিয়াম । সেই দুটি মাঠকে ঘিরে আশি আর নব্বইএর দশকে গড়ে উঠেছিল সম্পূর্ণ বেসরকারি উদ্যোগে ষ্টার সামার ক্রিকেট । উদ্যোক্তা আসগার ব্রাদার্স, মানে রাশেদ আসগার, সাহেদ আসগার, ওয়াহিদ আসগার আর মোর্শেদ আসগার । রাশেদ ছাড়া বাকি সকলে শখের ক্রিকেটার । তবে এক কথায় বলতে গেলে সকলেই ক্রিকেট পাগল । বাবার মূল ব্যবসা সিনেমা প্রদর্শন হলেও সব ভাইয়ের মন ক্রিকেটে । তাদের চট্টগ্রাম, ঢাকা ও কোলকাতায় গোটা ছয়েক সিনেমা হল ছিল । গাঁটের পয়সা খরচ করে দীর্ঘ দিন ধরে ঘরোয়া ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজন এ’দেশে অভূতপূর্ব । ফলাফল জাতি পেয়েছে নান্নু, নোবেল, আকরাম, আফতাব, ফয়সাল ডিকেন্স, নাজিমুদ্দিন, নাফিস, মমিনুল, তামিমের মতো ক্রিকেটারদের । তামিমের বাবা ইকবাল আমার কয়েক বছরের ছোট । অসম্ভব ভাল ছেলে এবং ভাল খেলোয়াড় । আমাদের সাথে পাড়ার ফুটবল আর ক্রিকেট দু’টাই খেলতো । অকালে মৃত্যু হয়েছিল । নান্নু নোবেলদের বাবা শামসুল আবেদিন পাকিস্তানের হাবিব ব্যাংকে চাকুরি করতেন । ভাল ক্লাব ক্রিকেট খেলতেন । একাত্তরে শহীদ । রাশেদ আসগার কিছুদিন আগে মারা গেছেন । ষ্টার ক্রিকেটই শুধু নয় চট্টগ্রামে এখন আর কোন সিরিয়াস ক্রিকেট বা ফুটবল কোনটাই হয় না । আউটার ষ্টেডিয়াম এখন মেলা ওয়ালাদের দখলে । চট্টগ্রাম হতে বেশ ক’জন খেলোয়াড় জাতীয় পর্যায়ে উঠে এসেছে। সকলে নিজ চেষ্টায় । তবে ষ্টার ক্রিকেটের জন্য তার কর্ণধারদের অবশ্যই রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়া প্রয়োজন ।
ভদ্রলোকের খেলা এখন আর ভদ্রলোকের হাতে নেই । এখন ম্যাচ ফিক্সিং হয় । আম্পায়ারকেও কেনা যায় । গ্রাউন্ডস কিউরেটরও বাদ জান না । খোদ আইসিসিকে বশ করা যায় কারণ এখন এখানে কর্পোরেট পুঁজি ঢুকেছে যার সিংহ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে ভারত । কোন খেলায় ভারত না খেললে আয়োজকদের ক্ষতি কয়েক মিলিয়ন ডলার । সেখানে বাংলাদেশ কী ভাবে জিতবে বলে আশা করি ? অবস্থা এমন চলতে থাকলে মনে হয় অদূর ভবিষ্যতে ভারতকে ভারতের সাথেই খেলতে হবে । পদ্মা পাড়ের মাশরাফিদের প্রাণঢালা অভিনন্দন । তোমাদের অর্জনে বাংলাদেশের ষোলকোটি মানুষ গর্বিত ।

লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় । গবেষক ও বিশ্লেষক । মার্চ ২৪, ২০১৫

 

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ

[......লেখক আর্কাইভ]